মাসুদার রহমান// একাকিত্বে ও আমার একান্ত স্বজন


মাসুদার রহমান
একাকিত্বে ও আমার একান্ত স্বজন

প্রিয় কবি! এই অভিধাটি নিয়ে এ পর্যন্ত আমার কোন ভাবনা নেই। এই মুহূর্তে লিখতে বসে তা নিয়ে ভাবনা ও ধন্দে পড়া গেল। প্রিয় কবি --এই অভিধাটি মেনে নিয়েই বলি, তা এক বা দু-তিন সংখ্যায় বেঁধে ফেলা আরও সংকটময়। বলা ভালো, অনেক অনেক জনের কবিতা আমার ভালো লাগার। এই ভালো লাগার কিংবা প্রিয় হয়ে ওঠবার পিছনে কিছু বিষয় বা নিয়ামক নিশ্চয় কাজ করে। এক একজন কবি ভালো লাগার বা প্রিয় হয়ে উঠবার পিছনের কারণও এক একরকম।

কবি আবুল হাসান। তাঁর সাথে আমার আলাপ থাকবার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি যখন পিজির গহিনে শেষ নি:শ্বাস ছেড়ে দিচ্ছেন তখন আমার বয়স ৫ । বাংলাদেশের উত্তর জনপদের এক নিভৃত গ্রামে রোগ ও বিষণ্ণতা নিয়ে বেড়ে উঠছি। কবির নামও জানিনি। যখন  জেনেছি কবি এবং তাঁর কবিতাকে, তখন কবির মৃত্যুদিন থেকে একযুগ গত হয়ে গেছে। আমার ১৭ বছর, প্রথম পড়ছি তাঁর কবিতা। এমন একটা অনুভূতি হয়েছিল তখন যে, একটি বিরাট জলপ্রপাত  আমার চোখের সামনে আছড়ে পড়লো। খুব কাছেই ছিল যেন; সামান্য আড়াল। আর তাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে যতোটা  বিস্ময় জাগে!

'তুমি পর্বতের পাশে ব’সে আছো:
তোমাকে পর্বত থেকে আরো যেনো উঁচু মনে হয়,
তুমি মেঘে উড়ে যাও, তোমাকে উড়িয়ে
দ্রুত বাতাস বইতে থাকে লোকালয়ে,
তুমি স্তনের পাশে কোমল হরিণ পোষো,
সে হরিণ একটি হৃদয়।'

কত জীবন্ত আর ঋজু উচ্চারণ। আমার নিজস্ব শ্বাসকষ্টের পাশে শুশ্রূষা উপসম ও সান্ত্বনায় স্বজন হয়ে ওঠেন! যেন কতদিনের চেনাশোনা । নিজস্ব বিষন্নতার পাশে বেশ মানিয়ে যায় তাঁর কবিতা ও পংক্তি।

২.
আবুল হাসানের কবিতায় এক ধরনের  বিষণ্ণতার কষ্টবোধ ক্ষরণ থাকলেও কাঁপতে থাকা আলোক শিখাটিকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা দেখেছি। লড়াই জিইয়ে রাখা জেদি ও প্রচণ্ড দৃঢ়তা। অন্তর্গত রক্তক্ষরণ অমানবিকতা দুর্ভিক্ষ দুঃশাসন। আর মৃত্যুবোধই তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয়  শক্তি। সদ্য যুবক বয়সে তাঁর কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছিলো  বিষাদই কবিতার প্রকৃত স্বভাব এবং দুখি কবিতাই প্রকৃত কবিতা। যা কখনও প্রতারণা করে না। বরং তা ভূতগ্রস্থ করে, নেশা ধরিয়ে দেয়। কবিতা ও কবিতাযাপনে  যে সকল কবি শতভাগ কবিতা আচ্ছন্ন হয়ে জীবন কাটান তাদের কবিতার শরীরে লেগে থাকে এজাতীয় প্রবলতম ঘোর। আবুল হাসানের কবিতায় ডুবে আমি সে ঘোরাক্রান্ত হয়েছিলাম। তিনিই বাংলা কবিতায় তার উত্তর প্রজন্মকে দেখিয়ে গেছেন কবিতার জন্য কিভাবে মুখে রক্ত তুলে শেষ লড়াইটি চালিয়ে যেতে হয়।

কবিতার  পরম্পরা  আবহমানতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন, যেন একটি মশাল খানিকটা পথএগিয়ে দিয়ে উত্তরপ্রজন্মের হাতে ধরে দেওয়া, সেও খানিকটা এগিয়ে তার উত্তরসুরিকে। আবুল হাসান মাত্র ২৭ বছরের জীবনে সে কাজটি মোটাদাগেই করে গেছেন। যে কারণে তাঁর উত্তর প্রজন্মের কবিদের জন্য সে কাজটি আরও কঠিন   হয়ে গেছে। বলা বাহুল্য এ জাতীয় কবির সংখ্যা নিতান্ত কম, প্রচার সর্বস্বতায় সর্বব্যাপি কবিদের প্রাণহীন কঙ্কাল দিকে দিকে।

৩.
 ‘এই তো আমারই মনের কথা’- যে কোন কবিতা পাঠে যতদিন পাঠকের এরকম অনুভূতি মনে হবে সে কবি ততদিন সে পাঠকের মন জুড়ে জায়গা করে নেবে। নিজ  সিদ্ধান্তের বিষয়ে দোদুল্যমানতার প্রশ্নেও আবুল হাসানকে এভাবে অনুভব করি। জানি প্রতিটি মানুষের মধ্যেই দোদুল্যমানতা কাজ করে। হয়তো অনেকের মধ্যে তা মাত্রগত ভাবে সামান্য, আবার কারও কারও ভিতরে তা প্রকট ও প্রচন্ড। এই দ্বিধাগ্রস্থতা জীবনকে কতখানি বিপন্ন করে তুলতে পারে! কোন সুন্দরীকে তাঁর প্রতি মুগ্ধতা জানানোর অপারগতা বাকি জীবন ক্ষতের মতো বয়ে বেড়াতে হয়। নিজের কাছেও যেন নিজের কোনো ব্যাখ্যা নেই তার। তারপরও যে কবি মনোগত  ছাইচাপা আগুনটুকুকেও অনুভবগত উচ্চারণে আনেন তিনি অনেক প্রিয়দের মধ্যে নিশ্চয় আরও একটু বেশি প্রিয় হয়ে উঠবেন।

'তুমি রূপোর টাকা, তুমি ধানক্ষেত,
তুমি কি ধানক্ষেত নও ? তুমি পাখি, তুমি ঠিকই পাখি,
তুমি সোনালী প্যাম্পলেট, তুমি...'

অযোগ্যতা, অপারগতাকে ঢেকে চলি। বুঝি এইমাত্র তা খুলে পড়ে যাবে বেরিয়ে আসবে নগ্নতা। কীট ও ক্রিমিকে লোকদৃষ্টির আড়ালে রাখায় যেন নিজের মহত্বের বিকাশ। ছোট বয়স থেকে দেখে আসা সমাজের এইসব অদম্য সংস্কৃতি মধ্যে বড় হয়ে উঠছি। ধারণ করছি তাকেই। পরে আবুল হাসানের শিক্ষায় শিখেছি নিজের সীমাবদ্ধতার অসংকোচ স্বীকারোক্তি। যা কখনো  নিজেকে হেয় বা নিচু করে না।

'ক্লাসভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেপ সমস্ত কাগজ!
...
আমার হবে না আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ!' 

৪.
কোলাহল থেকে হৈ চৈ থেকে নিজেকে একটু আড়াল রাখতে ভালো লাগছিলো। অনেক জনের মধ্যে একজন হওয়ার চেয়ে নির্জনতা খুঁজেছিলো আমার শৈশবের দিনগুলি। তবে সে নিঃসঙ্গতার পাশেও কিছু না কিছু থাকতে হয়। তখন খুব ঘন ঘন জ্বরে পড়তাম। মজার বিষয় চোখ বন্ধ করলেই কত রঙের আলো ফুটতো মনের চোখে। সেই সাথে খুব নিঃসঙ্গবোধ হতো। বোধের শূন্যতা তৈরি হতো।আর একটা সময়ছিলো খুব মরে যেতে চাইতাম। বলা বাহুল্য তা আর হয়নি। ওই নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে আমি একা একটি বাড়িতে থাকতাম। বাড়িটির টানা বারান্দায় সারাদিনে দু-একটি বিড়াল শুধু নিঃশব্দে হেঁটে যেত। সামনের প্রশস্ত উঠোনে দু-এক ঝাঁক শালিখ বুলবুলি অন্যান্যরা। নিজেকে; নিজের এই যাপনকে আমি কেবলমাত্র আবুল হাসানের কবিতায় আবিষ্কার করি। আবুল হাসানের কবিতা যেন এক সম্পূর্ণ আয়না হয়ে আমাকেই প্রতিবিম্বিত করে বারবার।

'আমি ওই একলা বাড়িতে যাবো, ডাইনে ওর গোধলী সবুজ গাছ
বামে দেখা যায় নীল অপারাজিতার ঝাড়, সামনে শাদা
                                   সম্পৃর্ণ নারীর মৃর্তি।
আমি ওই একলা বাড়িতে যাবো, ডাইনে ওর সুন্দর সাপের ফণা
দরজায় উড়ছে সবুজ শাড়ি সামনে শিশু সপ্রতিভ ফুল!
আমি ওই একলা বাড়িতে যাবো, ডাইনে ওর উড়ছে বেলুন
বামে চলে আসে রোদ,  উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতিদ্বন্দী টাকা ও ধনুক।'


দৈনন্দিকতায়; প্রতিমুহূর্তে আবুল হাসান পাশে পাশে যেভাবে থাকেন তার আরও কিছু ছিটে ফোঁটা নিচে রাখা হলো। নিশ্চয় একটি  বিস্ময়কর রেইনবো ফুটে উঠবে তাতে কিংবা অজস্র রঙিন বুদবুদ।

 'এতো ফর্সা উঠেছে রোদ্দুর
 তোমার দাঁতের মতে এতো ফর্সা দিন আজ
 উঠেছে শহরে...'

'আমারও তো শান্তি আছে, কুকুরের মতো কালো তেষ্টা পায়
আমারও যখন তখন!...'

'দু:খের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখবো না আর আমার ভেতর!...'

'হঠাৎ নিদ্রা ভেঙ্গেযেতে দেখি মধুর চাকের মতো অন্ধকার...'

'ধানের মতো ঝরছে অভাবের যুবতি শরীর...'

এরকম অজস্র কবিতা ও কবিতার পংক্তি ঝরে যেতে থাকে যাপনের ভেতর।

আবুল হাসানের মতো কবিতা লেখা একমাত্র আবুল হাসানের পক্ষেই সম্ভব। তার যে যাপন তার মধ্য দিয়েই বাংলা কবিতাবিশ্ব এমন এক সার্বভৌম পেল। আমার ও অজস্র জনের প্রিয় হয়ে উঠলো যে কবি ও কবিতা। তাই নিরন্তর কবির সঙ্গে আমার আলাপ ও কথোপকথন। শ্রদ্ধা ও স্যালুট!

মন্তব্যসমূহ