তপন বাগচী ও তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়



তপন বাগচী 
সময়ের স্রোত শুধু

অনেক দূরের থেকে খেটে এসে দূরে চলে যায়
তার পায়ে মেখে নিতে পারি নাই সযতন বেড়ি
কেবল আহ্লাদ আর কিছু অভিমান জমে অবজ্ঞায়
ভারী পায়ে একা একা ফিরে যেতে পথে হয় দেরি।

জানি যে আসবে ফিরে, নিরাপদ বুকের ভূগোলে
হয়তো পথের ক্লান্তি মুছে পাবে পথের হদিশ
কী জানি পথের বাঁকে কোন ফুল অপ্রত্যক্ষ দোলে
কার সাথে গাঁটছড়া, কোন দিকে দোয়েলের শিস!

সকলেই চলে যায়, সকলেই ফেরে অবশেষে
সময়ের স্রোত শুধু মাঝখানে যায় ভেসে ভেসে।


জল চাই প্রান্তরের কাছে

যে যার নিজের দেশে থাকি -আমি শুধু জল চাই -জল

চারিদিকে ছোট গ্রাম খেলা করে এখানে -ওখানে
ঘরের চৌকাঠ একা মাড়িয়ে গেলেই দেখি বিদেশের ছবি
ঘরে বসে দেখা যায় ওপারের আদিগন্ত ভূমি
তবু আজ জল পেতে কেন এত বিষাদের সুর।

কাঁটাতার সরে গেলে ঝুলে থাকে জলের ফোয়ারা
তার গায়ে লেগে থাকে তিলকের মাটি
মুছে যায় ঝুলকালি বিভাজন রেখা।

পাহাড়ের অনাপত্তি জানা আছে আজ,
নদীর আপত্তি নেই জল ঢেলে দিতে
সেই কথা মজলিশে বলছে আকাশ ।

বিভাজনরেখা থাক ইতিহাসে অথবা ভূগোলে
তাতে কোন ক্ষতি নেই জেনো
মননে যদিবা ধরে এতটুকু চিড়
সব নেয়া সব দেয়া নিষ্ফলে গড়ায় !

যে যার নিজের দেশে যার যার মতো বেঁচে থাকি
প্রান্তরের কাছে শুধু জল চাই জল।








তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
মিলন

পালক ঝরবে কি না, সম্ভবত তার ‘পর আমাদের মিলন নির্ভর।
নতুবা এমন দেহ, যাকে পুড়িয়ে দিয়েছে আগামী সভ্যতা,
যার নিঃশেষিত পিণ্ড আঘাতে আঘাতে ক্রমে আরও নিম্নগামী
আর দূরে দৃশ্য দেখে মৃত্যু-বেদনা ভুলে উল্লসিত মিলন-সিদ্ধান্ত
মৃদুস্বরে প্রশ্ন তোলে – তোমার শরীরময় কেন ক্ষতচিহ্ন, বলো,
তাহলে মানুষ তুমি, পোশাকের নিচে ছিল তোমার পতন-
যতদূর সম্ভাবনা, এ মিলনে নির্দেশিকা প্রাপ্য ততধিক।
পালক সামলে রাখি, এসো, ওরা এ বিরহ ভাগ করে নিক।

তেমন আমি নই আবাসিক

বাড়িটা নীরব থাকে, দুপুর-গলির মতো, একা।
অন্ধকার ঘরে ঘরে। অভাবের আমিই সীমানা।
তাড়িয়ে বেড়াই রোদ, শালিখের হইচই, আলো –
পাহারা সজাগ থাকে, জেগে থাকে বাড়িটির ডানা

কেবল মন্ত্রের মতো ঘুম এলে, কাঁদি সারারাত।
সময় কমেছে দেখি, জেগে জেগে কাটানো উচিৎ
কখন যে ডেকে ওঠে শ্মশানের ‘হরিবোল’। দূরে...
আমার স্নায়ুর ডাকে, আবার মৃত্যুর ডাকে উঠি।

বলি, প্রভু, ক্ষমা করো, একে আমি বাঁচাতে পারিনি।
বলি, কেন প্রতিরাতে আলোহীন নিভে যেতে রাজি।
অন্ধকার বড় প্রিয়, পাহারায় প্রতি ঘরে ঘরে...
বাড়ির কুকুর আমি, এ বাড়ি ঘুমোলে একা জাগি।

অসুখের বারান্দা

অন্ধকার তাড়া করছে জঙ্গলের প্রতিটি পাখিকে।
পাখিরা ফিরেছে দ্রুত, কাঁটাঝোপ, আগুন ও পাতা
যা কিছু পেয়েছে দূর, ছড়িয়েছে মায়াবী বিকেল,
পরিচিত গাছে গাছে তাই আজ মৃদু নীরবতা

অন্ধকার ফিরে আসছে তোমার মুখের সীমানায়
অসুখের পাতা জুড়ে, অসুখের পাতায়, বাহারে
দুটি তিল ঠোঁট থেকে ঝাঁপ দিলে আমি নিরুপায়
পাখি হব! হতে চাই। রাজি নয় পাখিরা? আহারে!

রাজি হতে দিয়েছ কি? হলে এই অন্ধকার থেকে
পাখিরা উন্মুখ হবে। ওদের ডানায় কিছু শ্রাম।
ছড়ানো বিকেল জুড়ে অনেক সুগন্ধে জেগে উঠে
দিয়েছি তোমার হাতে পরিচিত, প্রিয় এক নাম।

সে নাম অজানা থাক। পাখিদের তাড়া করা ঠোঁটে
অসুখের অন্ধকার জঙ্গলের ডানা হয়ে ফোটে।

ট্রয় ধ্বংসের পর

অবশেষে বলো সেই অগোচর শিকারির কথা
দূর থেকে যার তির বিষ মেখে ছুটে ছুটে
তোমার নরম পায়ে এঁকে দিল সহজ প্রণাম।
অবিশ্রাম সাবধানে একবার ছুঁতে চাই তাকে,
যেন সে আমার পায়ে আঘাতের স্পর্ধা না করে,
মৃত্যুবৎ গোপনীয় দেহরহস্যের কাছাকাছি
শরীর সাজিয়ে বসে ধরা না পড়তে হয় আর...
এমন নিষ্কাম দেহে অবিরাম রতিচিহ্ন মুছে
খুলে রাখা স্তনভার কেমন রঞ্জিত করে রাখো !
দাও, সেই শহরের পাদদেশ জুড়ে, পরিখায়
কিছু চিহ্ন রেখে দাও। যেন শেষ আঘাতের পর
ছলোছলো সীমানায় আগুন দেওয়ার অবকাশে
ক্লান্ত চোখ বুজে আসে, আর শিকারির তিরগুলি
অবনত পতঙ্গের চিহ্নময় ভেসে-ভেসে দূর...

বলো, সেই প্রণামের বিশ্বাসঘাতক যত চোখ
আজও কি সে অমলিন? তোমাকেই করেছে পরখ?


শাসন

তবুও ছবির কাছে দাঁড়িয়ে পড়েছ একবার,
দেখেছ গোপন কোণে তুলে রাখা যত নাশকতা,
নুয়ে পড়া বয়সের রঙমোচনের কথা ভেবে
সমস্ত প্রকাশ জুড়ে তোমার শাসন হেসে উঠে
ভেঙে দিল শ্মশানের অপরূপ বোধি-সম্ভাবনা...
আর যে নিথর দেহ কাঁধে করে হেঁটে চলা
অনর্থক মনে করে স্রোতের ওপার থেকে
সাড়া দিল এপারের ছায়াহীন, সীমাহীন স্বর,
বাতাস ছুঁয়েছে তাকে; আমি সেই স্পর্শটির দেহে
প্রাণ ফেরানোর কথা ভেবেছি তোমার অগোচরে;
ভেবেছি নদীর স্রোত এভাবেই ভেসে যেতে পারে,
তোমার চোখের ঢেউ বাড়িয়ে দিয়েছে তার গতি।
অবলোকিতের সাথে পাথরপ্রতিমা সেজে
যত সাধনার কাছে সাজিয়ে রেখেছ শবদেহ,
সেখানেই ছুটে ছুটে, দেখি, এক উন্মোচন ছুঁয়ে
ওই তো সিন্ধুর পথ খুলে গেল গোপন দুয়ারে !

মন্তব্যসমূহ