বিভাস রায়চৌধুরী
ভাটিয়ালি
বুকের ভেতরে গান... আছে আছে পাখিদের বাড়ি
বুকের ভেতরে ডিঙি... আমি কিন্তু মাঝি হতে পারি
বুকের ভেতরে রাগ... তুলে দিই সব কাঁটাতার!
রক্ত দিয়ে মুছে দিই দেশভাগ, এপার-ওপার
বুকের ভেতরে তির... ভাষাব্যাধ হয়ে পাহারায়
রাত্রিদিন জেগে থাকি, চোখ লিখি রোজ কবিতায়
বুকের ভেতরে চোখ... চোখে চোখে বাংলাভাষা বীর
বর্ণমালা জুড়ে আছে কত কত শহিদশিবির
কত কত ভাঙ্গা পাড়... কত বজ্র... কত ঘুর্ণিঝড়...
মাথাভরতি স্বপ্ন আর কুলুকুলু বাঙ্গালীর স্বর
বুকের ভেতরে আমি আগলে আগলে রাখি ভাঙাবুক
ভাঙা বাংলা জোড়া লাগলে সেরে যাবে আমার অসুখ...
কুঞ্জবন
এক-আধটা চুমু ওড়ে, বেশি বেশি ঝগড়া-ঝাটি হয়
মনে আছে আমি তোর দুষ্টু দুষ্টু লালন ফকির?
মনে আছে আমাদের বাংলাভাষা ঘুঙুর-পায়ে ‘ঝুম্’...
এক-আধটা চাঁদ অড়ে, বেশি বেশি আকাশ কুসুম
সখী, এই কুঞ্জবন দিগন্তের রং মিলেমিশে
যুগে যুগে জাতিস্মর, যুগে যুগে প্রেমের বাগান
সখী, এই কুঞ্জবন পাত্র চাই- পাত্রী চাই মুছে
হয়ে উঠতে পারে আলো, প্রেমানন্দে জাগা বাংলাগান
আলো সূত্রে আমরা পাখি, আলো সূত্রে আমরা রোজ ভোর
দুই পাখি উরে যাচ্ছি শূন্য থেকে পেড়ে আনতে ভাষা
ঝলসে যায় ডানা, তবু মুখ থুবড়ে কখন পড়ব না
গান আনছি ঠোঁটে ঠোঁটে, কুঞ্জবন ফিরছি ভালবাসা
এক-আধটা গান অড়ে, বেশি বেশি গুন-গুন চলে
সখী এই কুঞ্জবন পেয়ে গেছি চাকরির বদলে
কবিতা
নিজেকে ভেতর থেকে প্রথমে কিছুটা উপড়ে নেবে,
নিয়ে নিজেকে প্রতিভা ভাববে, তুমি বিরল প্রতিভা।
টাটকা জখমের দাগ মুছে দেবে গাছেদের গায়ে,
ন্যাংটো গাছেদের গায়ে, ঈশ্বর তখন স্নানরত...
অস্ফুট পিপাসা পাবে, কিন্তু এই খেলা বিনয়ের!
এই খেলা সাধকের বুকের ভেতরে ঘুণপোকা!
দিনকাল গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ে অবিরত...
অতএব, হে শাশ্বত ক্ষত, তুমি একে কবিতাই
ভাববে, না, অন্যকিছু ভাববে, সে তোমার ব্যাপার,
আমি শুধু এই আজ অভিজ্ঞতা থেকে বলে যাই
মাথার ভেতরে গুজবের মতো আসে কবিতারা...
কিছু ঘটে অবশ্যই, বাকিটুকু শুধু রটে যায়!
বাঙালের ছেলে
যেখানে জন্ম হয়েছে আমার সেদেশের বুকে বাংলা নেই
মা বাবার দেশে বাংলা আছেন, একুশে আছেন সগর্বেই
তাড়া খেয়ে বাবা এইদেশে এসে কুঁজো হয়ে গেল... হাপের টান...
ফুটো-সংসার মা-র হাড়েহাড়ে গান বেঁধে দেয়, ভাসান গান...
লখাই ভেসেছে, সঙ্গী বেহুলা... পুর্বদেশের জলের সুর...
মাসিপিসিদের গ্রাম ভেসে যায়, সুর নিয়ে যায় অনেকদূর
অনেকদূরের খুলনা শহর, যশোর জেলার চোখের জল
এপারের বুকে মেঘ হয়ে গেছে- গোবি সাহারার যা সম্বল...
লড়ে গেছি, ভালো খেতেও পাইনি, ভালো জামা নেই... শুকনো মুখ...
স্বপ্নে পেলেই বাহান্নকে- ভিজিয়ে দিয়েছি রক্তে বুক।
দেশভাগে থুঃ... কাঁটাতারে ঘৃণা... দিন কেটে গেছে তবু আশায়
এপারে-ওপারে আত্মীয়তায় জিভে আছে এক বাংলাভাষা
সেটুকুও যদি কেড়ে নিতে চাও, দেশহারাদের ছোবল খাও
সীমান্তদাগ পুড়িয়ে দিলাম, পারলে আমাকে গুলি খাওয়াও
রাষ্ট্র, তোমার অনেক পুলিশ?
আমার শব্দ। শব্দ আনি!
বাঙালের ছেলে কবিতা লিখছি, এটাই আমার চোখরাঙানি
বাতিঘর
অন্ধ, তুমি আলোর পাশে কাঁপতে থাকো প্রেমে...
আমার কত দিনের শুরু এই।
হাত ধরিনি, একা একাই মিহেছি নির্জনে।
বিষাদরঙা নদীটি সঙ্গেই।
ঘন সবুজ স্পষ্ট হয়ে পথের পাশে থাকে।
আলোর মতো আমিও শারীরিক।
পিপাসাময় পালিয়ে যাই দূরের থেকে দূরে...
সর্বনাশ ছোট্ট বাঁক নিক।
অন্ধ, তুমি লাজুক মোমবাতি!
মন্তব্যসমূহ