নিয়মিত বিভাগঃ২ তবু লালনমনঃ দেবশ্রী ভট্টাচার্য// “তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল ?



 তবু লালনমনঃ   
            
 দেবশ্রী ভট্টাচার্য
“তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল ?”

         
আজ থেকে কয়েক লক্ষ বছর আগে এই ভারত বর্ষের এক প্রান্তে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়েছিল। ইতিহাসে তার সাক্ষ্য-প্রমান না থাকলেও পুরাণে তার সাক্ষ্য আছে। ভারতবর্ষের প্রাচীন যুগের যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে গেলে হয়তো এই যুদ্ধের কথা সবার প্রথমে আসে। আজও শিশু থেকে বৃদ্ধ আপামর ভারতবাসী এই যুদ্ধের কথা শুনলে রোমাঞ্চিত হয়, আর শোনা শেষ হলে দুঃখিত হয়, তাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়। এই যুদ্ধ হল মহাভারতের সেই কুরু- পাণ্ডবের যুদ্ধ। মাত্র ১৮ দিনের স্থায়িত্ব ছিল এই যুদ্ধের, কিন্তু তার ভয়াবহতা ছিল মারাত্মক। যুদ্ধের শেষে বিজিত রাজা যুধিষ্ঠির ভাগীরথীর তীরে দাঁড়িয়ে মহর্ষি ব্যাসদেবকে বলেছিলেন – “ভগবন্‌! আমি মহাত্মা বাসুদেব, ভীম ও অর্জুনের বাহুবলে এবং ব্রাহ্মণগনের প্রসাদে এই পৃথিবী পরাজয় করিয়াছি, কিন্তু আমার রাজ্যলোভে নিবন্ধন জ্ঞাতিকুলক্ষয় এবং দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রের ও অভিমন্যুর বিনাশ হওয়াতে এক্ষণে এই জয়লাভ পরাজয়ের ন্যায় বোধ হইতেছে”।
          অনেকটা এইরকমই কথা শোনা গেল আর এক যোদ্ধার মুখ থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্কর পটভূমিতে দাঁড়িয়ে অনেকটা একই সুরে চার্চিল বললেন –“This is not the end. It is not even the beginning of the end, But it is, perhaps the end of the beginning”.দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে ঘটে যাওয়া দুটি যুদ্ধের শেষে দুজন বিজিত সেনানায়কের মুখে এ কেমন বিষাদের সুর শোনা যাচ্ছে! হয়তো এটাই বাস্তব।যুদ্ধ শেষে বিজিত নায়ক যখন একবার পিছনে ফিরে তাকান, একবার রক্তাক্ত মৃত মানুষগুলোর দিকে দৃষ্টি দেন , তখন মানুষের বিবেক তাকে দিয়ে বোধহয় এরকম এক সুরেই কথা বলায়।যুধিষ্ঠির রাজত্ব করেননি, করতে পারেননি। মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেছিলেন। রাজত্ব করতে পারেননি মহামতি অশোকও। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত করেছিল। তবে চার্চিলের ক্ষেত্রে এমন কোন পরিবর্তন হয়নি। হয়নি জর্জ বুশের ক্ষেত্রে, ওবামার ক্ষেত্রেও। আর হবে না গাজা যুদ্ধের সেনানায়কদের ক্ষেত্রেও। হয়তো তাঁরা পরবর্তীকালে আবার কোন যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবেন।  
          আদিম যুগে মানুষ ছিল পশুরই সমগোত্রীয়। একজন মানুষ আর একটি পশুতে সেরকম কিছু পার্থক্য ছিল না। কালে কালে মানুষ সভ্য হয়েছে। সে তার সেই পাশবিক জীবনকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছে।তবু যখন আজও যুদ্ধ হয়, তখন মনে হয় মানুষের সেই আদিম পাশবিক রূপটা ফুটে ওঠে।হয়তো তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এক পশু অন্যকে আক্রমণ করে আত্মরক্ষার জন্য কিংবা খাদ্যের জন্য। কিন্তু মানুষ যুদ্ধ করে তার লোভ লালসা চরিতার্থ করার জন্য। শুধু নিজে যুদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়না। সে ডেকে নিয়ে আসে আরো অগণিত মানুষকে! যারা কেন যুদ্ধ করছে, কী তাদের লাভ কিছুই জানেনা।
         মনে পড়ে সেই হাল্লা রাজার সেনাদের কথা। যাদের উদ্দ্যেশ্যে গুপির প্রশ্ন ছিল ‘তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল’? হাড় বের হয়ে যাওয়া কঙ্কালসার এক একটি চেহারা, যারা শধুমাত্র এক অসাধু বিজ্ঞানীর ওষুধের প্রভাবে শুণ্ডির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল! কী জানে তারা! কী বোঝে তারা! তারা ধর্ম বোঝে না, দেশ বোঝে না, কোন আদর্শও বোঝে না। তাদের কোন জাতও নেই। তাদের একমাত্র পরিচয় তারা না খেতে পাওয়া অসহায় গরিব সাধারণ মানুষ! আর লোভ ...! লোভ তাদের একটাই, দুবেলা পেট ভরে খাবার লোভ। তাদের এই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ তাদের ব্যবহার করছে। তাদের দিয়ে হত্যা করাচ্ছে তাদের চেয়েও নিরীহ অসহায় মানুষদের! তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো নিতান্তই খেটে খাওয়া মানুষ।মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগেও হয়তো তারা জানতে পারে না কতটা নির্দয় মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো শিশু, যারা এখনো পৃথিবীটাকে ভালো করে দেখেইনি। অনেকেই হয়তো সবে যৌবনের চৌকাঠে পা রেখেছে! চোখে আছে তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন! কয়েক মুহূর্ত আগেও যারা জানতে পারে না সেই ভবিষ্যৎ  তাদের কাছে আর কোনদিন আসবে না!
            প্রত্যেকটা যুদ্ধের পর বিবেকবান মানুষ হাতে হাত রেখে শপথ নিয়েছে – আর যুদ্ধ নয়! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউনাইটেড নেশন গঠিত হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীকে এক সুত্রে বাঁধবার জন্য। কিন্তু তাতে কী লাভ ! যুদ্ধ তো শেষ হয়নি ! তার ভয়াবহতা আরো বেড়েছে ! আজ আর শপথ নিতেও ভয় হয় ! হয়তো যে মুহূর্তে শপথ নেব সেই মুহূর্তে পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে আর একটা নতুন যুদ্ধের সুচনা হবে! তাই আজ আর শপথ নয়, শুধু একটা প্রশ্ন রাখলাম সব দেশের, গোষ্ঠীর দেশনায়ক সেনানায়কদের কাছে- যদিও জানি তারা কেউ এটা পড়বেন না, তবুও লালন মন একটা প্রশ্ন রাখলো - ‘তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল’?


মন্তব্যসমূহ