কুনো অহংকার নাই! ( নতুন বিভাগ) // অমিত কুমার বিশ্বাস


কুনো অহংকার নাই!  
অমিত কুমার বিশ্বাস

কাছাখোলা ভাঁড়  কিংবা ধম্মের ষাঁড়

শালা আমাদের বাওয়ালের নাম খেলো।তবে আমরা খেলো কিনা জানিনা। জানে ফোঁড়েন, যে  সারাদিন 'টিরোম টিরোম' করে স্টেশন চত্বর ফাটাচ্ছে। গলায়  ছাগল বাঁশি সেই যে  সেটে আছে এখনও বের হবার টুফু নেই। প্রথম প্রথম বাঁশি শুনে হোঁচট! কি বলে রে লড়ঝড়ে লোকটা। দেড়ফুটিয়া না হলেও সাড়ে তিন হবে। তিনুদা, মানে আমাদের বস, বুঝিয়ে দিলেন , ওটা  'ঘটি গরম'। যাহ শালা !বেশ কয়েকবার  প্রাকটিস করবার চেষ্টা করেও যখন সুর উঠল না, তখন খেজো বলে  উঠল, রাখতো তোর সাইরেন! কানের পোকাটাকে এবার অকালে  সুইসাইড  করাবি নাকি!

ফোঁড়েনকে ছেড়ে দিলাম। এবার সাক্ষাৎ ঈশ্বর। ঠ্যাং তুলে হ্যাং হয়ে আছে। জং পড়া পা তুলে বসে চোখ কচলাতে কচলাতে ভাবল, না, মালগুলো এখনও আছে, কেউ নেয় নি, এ লাইনে ম্যালা হ্যাপা, কেউ  ঝেড়ে দিলেই কেলো।

 মাল মানে মালা। সোনার। হেব্বি দাম। দশটাকা পার পিস। পরলে গরিবের পিস্ আর পুরুষের কিস্ আলবাৎ।  একটা বিক্রি মারাতে না মারাতেই  পাউচের খোঁজে নেমে পড়ে রেললাইনের পাশে। ঢক্  ঢক্ মেরে  দেয় বাইশদিন পুরনো গরম তেলের ট্যাংকারে চোবানো চপের সঙ্গে। বেশ। এবার জম্পেশ। এবার টেশান। এবার প্লাটফর্মে পা ছড়িয়ে  ঘুম।  চটি ছোটোবেলা হারিয়ে যাবার পর থেকেই  বেজায় রেগে। সো চরণ খালি। আর সেই পা আমাদের মুখের দিকে তুলে আমার গল্পের চরিত্র এখন ঝিমুনি দিচ্ছেন।

 আমরা চলে এলাম। অন্যপাশে। কিছুক্ষণ পরে দেখি আবার সোনার চেন  হাতে আমাদের সামনে, 'নিবেন নাকি ডেডা?' শালা, কে কার চরিত্র। কে  কাকে খুঁজে বেড়ায়! আমিই হয়তো ওর নভলেটের কাছাখোলা ভাঁড়  কিংবা ধম্মের ষাঁড়। যেমন চলছে। চারিদিকে। আমার নিরুত্তর মুখ দেখে  জনান্তে খিস্তি মেরে চরিত্রটি পাশে চলে যেতেই হালুই আঙুল চালিয়ে  দিল  পাঁজরে, বলল, একটা শ্রীলার জন্য নিতে পারতে বস। বললাম, ওই দ্যাখ , শ্রীলার বরের কাছেই গেছে! দেখলাম  ঢ্যামনার মতো দেখতে লোকটা দশটাকা বার করে দাঁত কেলাচ্ছে হদ্দ হারামির মতো, আর  সেটা পকেটে পুরে আমার চরিত্র সটকে পড়ল লাইনের পাশে। তার  আর এক পাউচ মারা এখনও বাকি!



 শ্রীলাকে নিয়ে একটি নির্ভেজাল রিয়েলিস্টিক স্বপ্ন আর সংসারী বাঁশ

আমার চরিত্রটিকে আজ আর খুঁজে পেলাম না। অগত্যা বসে থাকা।   বৃষ্টির জন্য। শ্রীলা আবার বৃষ্টিকে একদমই সহ্য করতে পারে না। গা পিত্তি জ্বলে যায় নাকি । কি উটকো ঝামেলা! আমি যে দুজনকেই চাই।  এক সাথে  থাকবো। শ্রীলা ঘরে আর বৃষ্টি বাইরে। ধুস ! ভাল্লাগেনা। নিজেকে মাঞ্জাহীন  ঘুড়ির মতো মনে হয় । 'আজকাল-আনন্দবাজার'  কেটে সে    এক বিশাল লেজুয়াল ঘুড়ি। রুইদাসের। দেড় পায় দাঁড়িয়ে। থুড়ি বিকলাঙ্গ না বললে খিস্তি খেতে হবে। ক্যালানফ্যালানও খেতে পারি। ভদ্দরলোকের ব্যাপার স্যাপার। তো এই রুই দাস, যে কিনা সারাদিন  একটা ছোট্টও থলে নিয়ে ভিক্ষা করতে বেরিয়ে যায় আর এই ফুরফুরে  হাওয়ায় তার লেজুয়াল ঘুড়ি আকাশে উড়তে থাকে, রিক্রিশান টাইমে,  বিশ হাত ল্যাজ, ভাবতে কষ্ট হলে কষ্ট পান, আমার কিস্যু করার নেই, আর যাকে 'আজকাল-আনন্দবাজার' বললেই  ছুটে আসে  আধলা বা ডেরি নিয়ে, সঙ্গে বাবা-মা-চোদ্দোগুষ্টির ষষ্টি পুজো, সেই কারণে তার     ঘুরিতে কেউ প্যাঁচ লাগানোর সাহস পায় না ।  আজ রুইদাসের  ঘুড়ি  হয়ে  একেবারে হেলের  মতো আকাশে  ভেসে বেড়াচ্ছি আর ভয় পাচ্ছি শ্রীলার চোখ রাঙানিকে। যদিও সিনা চওড়া। বাইসেপস ফুলছে। গ্যাস- অম্বলে নয়। সের্ফ গর্বে।  আকাশে ভাসছি। উড়ছি। আর তাকিয়ে আছি ফ্যাল ফ্যাল করে। গাইছি। 'রোবিন্দ সনগিত' ! এদিকে বৃষ্টি আসবে,    আর ওদিকে গ্যাস ওভেনে ওমলেটটা চড়িয়ে দিয়েই  শ্রীলা সুতোটা টান দিয়ে দেখে নিল ওর লেজুয়াল ঘুড়িটার অবস্থান। এর মধ্যে ঘটে গেল এক বিপত্তি। কোনো এক  গান্ডুমার্কা  কাক-দম্পতি  নিজেদের মধ্যে তুমুল গণ্ডগোল বাধিয়ে আমার ল্যাজাখানা ঠোঁটে বাঁধিয়েই এক হ্যাঁচকা টান দিতেই আজকাল-আনন্দবাজারের   ল্যাজা খোজা হয়ে  গেল। আর আমি ল্যাজবিহীন হয়ে মহাশূন্যে গোত্তা খেতে লাগলাম। এদিকে বৃষ্টি ভেবে পাচ্ছে না, তাঁকে দেখে  ল্যাজে  মাছি বসা  ঘেয়ো রোডেশিয়ান  ঘীয়ে  ভাজা কুত্তার ( সরি কুকুর, সারমেয়) মতো আমি ঘুর পাক খাচ্ছি কেন?  আর ওদিকে শ্রীলা ওমলেটের পর  ওমলেট ভেজে চলেছে, সকালে অনেকে এসেছে, তাদের জলখাবার, খিড়কি দিয়ে দেখার ফুরসত মেলেনি,  কিংবা সুতোয় টান দিয়েও বুঝতে পারছে না আমার অম্লান গোত্তা খাওয়া। মেঘ করল। খুব। গজরালো। কিন্তু যত  গর্জায় তত বর্ষায় না। অভিমানে বৃষ্টি চলে গেল। আর আমি গোত্তা  খেতে খেতে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লাম। ল্যাজা নিয়ে তখনও কাকদ্বয় মহাশূন্যে মহারণে ব্যস্ত । নর্দমার পাশে ভ্যাটের পাশে  এহেন পতন দেখে  পাড়ার ঘেয়ো কুকুরটা চোখ পিটপিট করে হাসল।বলল, দেবো নাকি দাদা হিসি করে! মনে হল হারামির বাচ্চাটাকে  ক্যাঁৎ কর এক লাথি মারি। না। লাভ নেই। চাচা,  পহেলে আপন প্রাণবাঁচা। উঠলাম। ভাবলাম আর একবার উড়ি। বৃষ্টিতো এখনও মেঘের আড়ালে। উড়ে বলি, আমার না আমার না, সব দোষ ওই কেলো কাক দুটোর , ওদের প্রেম-অপ্রেমের সাইড এফেক্টে গোত্তা খেয়েছিলাম মাইরি! সবে  উড়তে শুরু করেছি। ওমনি সুতোয় টান। আমি সটান বাড়ির দরজায়। কলিং বেল বাজাচ্ছি। যেন বলছি, রানি সাহেবা, নোকর হাজির হ্যাঁয়,  হুকুম কিজিয়ে। হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে শ্রীলা বলল, যাও, এবারো  ছোটো। দেখলাম  খেলনায় চাবি দিচ্ছে। আর আমি ছুটছি।  পঁ  অ অ অ অ অ অ অ অ অ অ  কি কি  পঁ  অ অ অ অ অ অ অ অ অ !


শ্রীলা ,অ্যালিস উইন্টারটান এবং...

চায়ের দোকানে  যম্মের গ্যাজান গ্যাজানোর পর  বুঝলাম রাজনীতি-ফাজনীতি আমার কম্ম নয়। এসবে ম্যালা তেল মারা কেস। ঢপ মারাও । তারপর আবার  ঝোপবুঝে কোপ মারো। রঙ পালটাও। ঝান্ডব বনে যাও। বাম হলে সফেদ কেনো। ঝোলা ব্যাগ নিয়ে টো টো কোম্পানি। টোকেন ধরো। চাঁদা তোলো। চাঁদা দাও। স্তালিন স্তালিন বলে দাঁত  ক্যালাও। পাবলিকেও। এখন সব ক্যালানেওয়ালা ব্রাদারেরা ওপারে। তাই গান ধরো,' ওপারে থাকবে তুমি , আর আমি রইবো এপারে'।  এর থেকে ঢের ভালো শ্রীলার ফাইফরমাইশ খাটা ।প্যারেড বাজারে যাও। প্যারেড চাল আনো।  প্যারেড ডগির জন্য মুরগির ঠ্যাং আনো। প্যারেড  শ্যাম্পু, ন্যাপকিন, পারফিউম, মাছ , আলু , পেঁয়াজ , সব্জি ইত্যাদি প্রভৃতি আনো! লেফট্ রাইট্ লেফট্! ডিউটি সেরে এসে পাশাপাশি বসে সিরিয়াল  দেখো। 'শ্বাস ভি কভি বহু  থি'। হ্যাড্ডা ব্যাড্ডা তালের গ্যাড্ডা। নো ক্রিকেট, নো   ফুটবল, নো রাজনৈতিক গ্যাজাগেজি ছেঁড়াছিঁড়ি।  অনলি  সিরিয়াল। লিকার চা  আর ইউরিয়ায় ভাজা  মুড়ি চিবোও, আর চোখ পিটির পিটির করো।  চার্লি   স্টাইলে। সাইলেন্ট মুভি। মনে মনে সাবটাইটেল ভাবো।  'হ্যাঁ ' সে 'হ্যাঁ'  মেলাও,  নেহিতো থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার। সিরিয়াল কিলার সিরিয়াল কিলার! উফ্। আফ্। হে মোদের থার্ড পারসান  সিঙ্গুলার নাম্বার  তাড়াতাড়ি এসো , আর দখল করো এ  মোর রাজ্যপাট। এসো  বদলা নাও  হ্যামলেট, ম্যালকম, আর কে আছো? হিন্দি  ফিল্ম দ্যাখো? শাহেনসা!শাহেনসা! বিগ-বি স্টাইলে। এসেই পা ছড়িয়ে ডোরেমান, অগি, শন দ্য শিপ! আহা আহা আহা ! ইট কা জবাব  পাথ্থার সে !

--ম্যায় কৌন হু? ম্যায় কাহা হু? আরে আমি কি হদ্দ ঘুমোচ্ছিলাম? শ্রীলা?

আমি এখন  ইলিয়া আর ব্রিজেড-এর   পাশে ঘুমোচ্ছি।  শ্রীলা এখন  Alice Winterton-এর সাথে শপিং মলে খোশ গপ্পে ব্যস্ত!  


হরে কৃষ্ণ হরে হরে , ছোলাআছোলা ঘরে ঘরে

প্লাটফর্মে ঢুকতে গিয়ে দেখি এক ঢ্যামনা  রেলিং- এর ভিতর  ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে দিয়েই  কি সব বিড় বিড় করছে। না, এসব  দিকে তাকানো ঠিক না। তবু চোখ যায়। শালা এই নজরকে লাগাম দেওয়া বহুত ঝামেলা। আর এখন যা হয়েছে, গাছপালা  নদীনালা --সব এপাশ ওপাশ খুলে বসে । 'হাওয়া হাওয়া এ হাওয়া খুশবু লুটাদে...' । মানচিত্র। মালভূমি। পার্বত্য ভূমি। তুমি শালা কত সাধু হে ? আমাদের ফোঁড়েনও অটোর মরা আলোর  মতো পিটির পিটির করে চেয়ে থাকে, আর বলে 'টিরম' টিরম'। এতে ফোঁড়েনের কি  দোষ? গাছপালা নদীনালার কি দোষ? সময়ের কি দোষ?   টিভিওয়ালার, নিচেওয়ালার, ওপরওয়ালার কি দোষ? যত দোষ সব ওই শালা নন্দ ঘোষের। ওর বাপখানা কিরকম! ওরকম একটা নাম রাখে কেউ? আর রাখলি বলেই তো কেসটা খেলি। খা। যম্মের খাওয়া খা। আর এর ওর বাড়ি যা পারিস ঢুকিয়ে দে! কারো কিছু বলার নেই। সব কুলুপ। শুধু আমাদের এই সব বাওয়ালকোম্পানি ছাড়া। নেলি বলল, ঐ ব্যাটা নন্দকে দেখলেই মনে হয়  গায়ে চ্যার চ্যার  মুতে দি। রোপোই সাথে সাথে  প্রটেস্ট করে উঠল, "কেন রে, আয়ানই তো  এই ঝক্কাটার গুরু। মালটা নপুংসক ছিল বলেই তো  যত ফষ্টিনষ্টি ! আর  কেষ্টা পার পাবে কেন?"
"পাবে পাবে, কারণ ওর ইন্টারন্যাশনাল হাসি আর বাঁশি আছে। বাঁশ  দিতেও সিদ্ধহস্ত। দেখলেনা একশো ভাই কেমন খেয়ে গেল। ফাটাবাঁশে পড়ে দেবব্রতরও  দুরবস্থা! আর এই কথাটা মনে রাখবে, বাঁশ খানেওয়ালাদেরই  সে কিন্তু বাঁশ দিয়েছিল। মামুলি আদমি দের নয়। এর  সাইড এফেক্ট  তো একটু আধটু হবেই ।"  বসের কথা  কেউ  আর ক্রস করার  উপায় পায় না। হঠাৎ সামনে দিয়ে একটা কমলালেবু গাছ চলে গেল। কি আশ্চর্য, আমরা সেদিকেই চেয়ে  রইলাম। আমাদের বসও ! এবার সবাই সমস্বরে বললাম, "হরে কৃষ্ণ হরে হরে , ছোলাআছোলা ঘরে ঘরে।"
এসব ভাবি। আড্ডা দি। কিন্তু আমাদের কুনো  অহংকার  নাই!  

  

মন্তব্যসমূহ