সম্পাদকীয়ঃ কিছু গোপনের প্রস্তাব...

কবির হাতে বই তুলে দিচ্ছেন কবির মামাতো ভাই কবি সুনীল সোনা। 

     সম্পাদকীয়ঃ   কিছু গোপনের প্রস্তাব... 

 

          ‘কবি হওয়া তাই যেন তোমার নির্দিষ্টি...’ কেন? কবিতা কে লিখবে বা কবিতাটি, বিশেষত, ওই নির্দিষ্ট কবিতাটিই কার দ্বারা লিখিত হবে, তা যদি নির্দিষ্ট থাকে, তাহলে এ অমোঘের কাছে নত হতে বাধা কোথায়? অথচ আশেপাশে এত ভুলে ভরা, ভুল-বোঝানোয় ভরা জীবনের কাছে এসে যা জেনেছি, একদিন, ভাবি, সকালে উঠে কি আমি সে ভুল ভাঙলে খুব অবাক  হব? পারব কবিকে ছাড়িয়ে শুধু ওই কবিতার কাছাকাছি পৌঁছনোর পথ খুঁজে যেতে?
  হয়ত আমার এ বিশ্বাস ততটা দৃঢ় হত না, যদি না ‘ভোরের মন্দির’ আমার সামনে তাঁর অলৌকিক এক জগতের আগল খোলার কামনা নিয়ে এসে দাঁড়াত... যদি না খুঁজে পেতাম ৮০ দশকের ওপার বাংলার এক কবিকে... যদি না তাঁর স্তম্ভিত, কখনও না মুছে যাওয়া অন্ধকারের স্মৃতিতাড়িত পথ চলা দেখতাম...
         শুনেছি, ইতিহাস লেখা হয় অল্প কিছু ক্ষমতাবান মানুষের হাতে, আর কিংবদন্তি তৈরি হতে থাকে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে, তাদের হারানো সমস্ত সঞ্চয়ের হাত ধরে। শুনেছি। সেবার দেখলাম। এতবছর এদেশে মায়ের কাছে সন্ত্রস্ত যে কবিকে লড়তে হচ্ছে তাঁর অন্ধকার ভাঙাচোরা স্মৃতির হাত থেকে সামান্য রেহাই পেতে, সেই বিষ্ণু বিশ্বাসকে নিয়ে ওপার বাংলায় কবিদের মুখে মুখে ফিরছে কত কিংবদন্তি। সেসব তো মানুষের হারানো সঞ্চয় থেকেই গড়া। হারানো তাদের প্রিয় কবিকে, প্রিয় বন্ধুকে, প্রিয় সহযোদ্ধাকে।
আত্মগোপনের কৌশল না যানা মানুষের যেমন বারবার প্রকাশ্যে এসে পড়তে হয়, সে ভাবেই একদিন বিষ্ণু বিশ্বাসের এই স্তম্ভিত আত্মগোপন কেমন, স্বাভাবিক, প্রকাশ পেয়ে গেল! এব্যাপারে নানা খবর, নানা জটিলতার অবকাশে দেখলাম মিতবাক রুগ্ন কবিকে। তাঁর সে ভাঙা ঘর, ক্ষয়ে যাওয়া মায়ের আঁচলের যত দুঃখবিলাসের কথা আমাদের কত মানুষের বানানো, নকল কবিজন্মের ‘আহা-উহু’-র শব্দে আরও ভেঙে পড়ল, তার মধ্যে, সত্যি, আমাদের  আত্মশ্লাঘা অনুভবের জরুরী বহর এতটাই ছিল, এতটাই কাদা ছোঁড়াছুড়ির অবকাশ ছিল, যে কান্নাগোপনের পথ পাওয়া যায়নি তেমন। মুখ দেখানোর, কৃতিত্ব নেওয়ার, আত্মপ্রচারের, ব্যাক্তিগত রেষারেষি শেষ অবধি বহুদূর গড়াল। সে অন্য প্রসঙ্গ।
            ঝড় থেমে যায়। ঝগড়াও। থেমে যায় এইসব আহা-উহুময় বাতাসও... সে ঝড়ের কথা অন্য আর একদিন হবে। আজ সে সন্ধ্যার কথা হক।আজ সেই কিংবদন্তির কোথা হোক। গোপন যে বিষের ভার বহনে অক্ষম কবিতার কাছে মাথা নত রেখে একটা জীবন বয়ে গেছে, সেই অবগাহনের কোথা হোক... ‘আমাকে পেরিয়ে গেলে তুমি পাবে এক ধূলিপথ’-  যে পথের ধারে এক শিমুল গাছের নিচে দেখেছি রুগ্ন কবিকে, যে পথের ধারে যৌবনের এত এত উচ্ছ্বল কবিতা-গানে ভরা ঐশ্বর্যের হাতছানি ভুলে গরিব মায়ের এই ভাঙা ঘরখানি ভালবেসে রয়ে গেছেন অশব্দে, একাকী, নির্জন, তাঁর সব ভুলা যাওয়া কথা-সংলাপে আমাদের ভুল-ভাল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের শুন্যতা ভরে যাক কবিতায়, মুখর...
           কিছু সত্য রয়ে গেল, তাঁর প্রকাশের প্রয়োজন নেই। কিছু মিথ্যে রটে গেল, তাদের সংশোধন সময়ের হাতে তুলে রাখি আজ... পরজন্মে, জন্মান্তরে ঈশ্বরের কৈফিয়ত রয়ে যাবে মানুষের কাছে।
       
                                                                          তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়

                                             এই সংখ্যার সম্পাদক,অচেনা যাত্রী
ভোরের মন্দির- এর পেছনের প্রচ্ছদে কবির ছবি। যৌবনে। 

  

মন্তব্যসমূহ