চন্দন বনের হাওয়ায় //উৎপল দে

চন্দন বনের হাওয়ায় 
উৎপল দে

          বাংলাকবিতায় যে স্বল্পসংখ্যক কবি ব্যতিক্রম ধর্মী রচনায় নিজেদের চিহ্নিত করেছেন ,তাদের মধ্য নিবিঢ়তম, স্বল্পবাক মানুষটির একমাত্র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ভোরের মন্দির’।নিজের সম্পাদনায় পেঁচায় আত্মপ্রকাশের পরই বিষ্ণু বিশ্বাসের পরিচিতি ঘটে সমসাময়িক কবিমহলে ।একেবারেই প্রথাবিরোধী উচ্চারণ তাঁর নিজস্বঃ অনুধাবন ও প্রতিক্রিয়ার তীব্রতায় ছুঁয়ে থাকা কালো মেয়ে । ‘শুধু মৃতদের গল্প কতো আর কাঁধে ঝুলে যাবে ।এবার নিষ্কৃতি পেলে,শান্তি অন্বেষণে মহাকাশে /গিয়ে দু’টুকরো লোহা ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দেব /অসহ অসীম শব পুড়ে ছাই হোক পুড়ে ছাই’ । বাস্তব আর পরাবাস্তবের অনুপুঙ্খ পাঠকের অনুভবে সঞ্চার করে সামাজিক অবক্ষয়ের এক রূপ ।যা প্রতিবাদ প্রবণতাতেই সূচিত হয় ।‘তুমি আছো কালো মেয়ে সন্ধ্যা স্নানের ঝংকৃত দূরে /আমি ভালোবেসে তোমাকে জ্বালিয়ে দিই নাই’ ।এখানেই আশ্চর্য ভাবে একাত্ব হয়ে যাওয়া ।উত্তরণের সুদূরতা ও ব্যাপ্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা ।তবু ব্যক্তিগত অস্থির জীবনযাপনের মধ্যেও ছুঁয়ে থাকে অন্তমুখী‍ লিরিক ধর্মীতা ।নিজস্ব পরিমণ্ডলের অনুধাবন ও সংগ্রামময় বাস্তবতা ।নিজের প্রতি কটাক্ষে এক স্বতন্ত্র উপলব্ধির সংবেদনশীল উচ্চারণ ; ‘আমি ভুলে গেছি জন্ম আছে /কিছু যন্ত্রণার কথা যে ভাবে বলেছি মনে নেই /একটু আনন্দ কথা গোলাপী স্তম্ভের স্থির রয়েছে /অন্ধ থেকে চোখে জেগে সমুদ্র দেখি বালির স্তূপে’ ।উপলব্ধি ও উচ্চারণ অভিন্ন বিন্দুতে মিলে যায় একসময় ।মরুভূমির রুক্ষতায় স্বপ্নময় তৃষা শুধুই পীড়িত করে ।‘সমু্দ্রের ধারে যেতে পথের বাদামগাছ গুলি/ মিহিকথার কৌতুকে পাথর ফুলের ধাক্কা দিল’ ।এখানেই তিনি ছাড়িয়ে যান সম-সাময়িক সময় কে ।অসীম জ্যোতিষ্ক ,দেবতা ও নিয়তির হাহাকার ছুঁয়ে গড়ে ওঠে তাঁর রূপকথাশ্রয়িতা ।প্রতিকুল জগতের কঠিন বাস্তবতাকে সরাসরি দীর্ণ করে ।অপার বিস্তৃতিতে । ‘জ্যোতিষ্কের পরশপাথর /সীমাহীন ঘটমানে,নিয়তির চুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে /নীল পশমী ছাগল হাটবারে বাঁধা থাকে/পাইকারি কথামালা..’.  


           'ঈশ্বরের জন্ম-জন্মান্তরে’ প্রত্যাশিত ভাবেই আবিস্কৃত হয় তাঁর প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ । রূপকের আবরণ খসে পরিচয় ঘটে তার বর্ণন নৈপুন্য ও আবহ সৃষ্টি, কল্পতরুর মতোই মূর্ত করে তোলেন নিজেকে পারিপাশ্বিক জগতের বাস্তবতায় ।‘মৃত্যু যেখানে অমর অজেয় জলের স্বপ্ন ধোয়া /বাঁশপাতা খড়খড়ির ঊষর দানোর লোহাগড় /হয়ত থামতে হবে বহুবার আত্মীয় শোকে /তোমার সোনালী জামা,হলুদ রঙের শাড়ি খানা /উড়িয়ে নিয়েছে ঝড় ..’ অথবা ‘এই অনুবর্তনের গল্পে যে পথে গিয়েছে ধূলিপথ /ডাইনে বাঁয়ে সবখানে আম জাম সবুজ কত্থক /আমাকে পেরিয়ে নিশ্চিন্ত কল্পতরু গাছ’ শুধু এক মুগ্ধ স্বপ্নময়তায় আবিষ্ট হয়ে থাকা ।এক বৃদ্ধের গল্পে’ নিসর্গ আশ্রয়ী লিরিকের অন্তমুখিতা ফুটে ওঠে জীবনসংগ্রামের তীব্রতাকে উপেক্ষা করে মোহহীন এক উত্তোরণ ।‘সূর্য ধীরে নিভে গেল ।আকাশে গোলাপী একটা রঙ /আস্তে অন্ধকারে হারাল ।এক বৃদ্ধকে ঘিরে আমরা বসে আছি কিছু তরুণ তরুণী /বহুকালের প্রাচীন ... .তারপর কবেকার ওর জীর্ণ ব্যাগ /থেকে রাশিরাশি ঝরাপাতার মতো টাকা/-টাকা ,একে একে মুঠো মুঠো ..বের করল ,আর/তাতে আগুন জ্বালালো ।পৃথিবীর যতসব সুগন্ধি বৃক্ষের পত্র ;পোড়া মাংস /আর ধূপ গন্ধের মতো...’ এই মোহসঞ্চারী নৈসর্গিক চেতনায় ধাক্কা দেয় জাগতিক মোহহীনতার অনুরণন ও অতিপ্রাকৃতের ছোঁয়া এক অন্য মাত্রা যোজন করে নিঃসংশয় ভাবে । তারপর দ্রুত ভিড়ের ভেতর কোথায় ডুব দিল, / কোনোদিন ,তারপরে তাকে আমরা আর দেখিনি..
শুধু চন্দনবনের হাওয়ায় তার অন্বেষণ।

মন্তব্যসমূহ