কবির নিয়তিঃ একটি সাধারণ অভিমান / বিভাস রায়চৌধুরী


কবির নিয়তিঃ একটি সাধারণ অভিমান / বিভাস রায়চৌধুরী

           
কবি বিভাস রায়চৌধুরী 
 ঢাকায় গিয়ে কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের কথা জানতে পারি। এই নতুন শতাব্দীর একদম গোড়ায়। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে সেই প্রথম ঢাকায় যাই। অমর একুশে। আমাদের এপারের মতো শৌখিন নয়, জীবন্ত আবেগ। আমি পাগলের মতো হয়ে  গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল কবি সুনীল সোনা। আমাকে ওখানে বিশেষ কেউ চেনে না তখনও। সুনীলের বেশ পরিচিতি। সুনীলই আমাকে অনেকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। তখনই বিষ্ণু বিশ্বাসের কথা ওঠে। তিনি অসুস্থ অবস্থায় কোথাও চলে  গেছেন কয়েক বছর। বিষ্ণুর আত্মীয় হিসেবে সুনীল কিছু জানে কি না – এইসব প্রশ্ন উঠল। বিষ্ণু বিশ্বাসের কথা সেবার আমার মনে  থাকেনি বেশিক্ষণ। কারণ ঢাকায় আমি আবেগে ভাসছিলাম, আর ফিরে আসার পর চালচুলোহীন বাস্তব জীবনে কবিজন্মকে বাঁচানোর লড়াইয়ে লুঠ হয়ে যাচ্ছিলাম প্রতিনিয়ত। সুনীল কম কথা বলা মানুষ। সেও আমাকে বিষ্ণুদার কথা ততটা বলেনি তখন। কয়েক বছর পর ঢাকায় ফের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে কবিবন্ধুদের কাছে বিশদে জানলাম বিষ্ণু বিশ্বাসের কথা। তিনি বাংলাদেশের ( হ্যাঁ, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের কবিজগৎ বিষ্ণু সম্পর্কে কিছুই জানে না, দু-একজন ছাড়া )  আটের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি। মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে উধাও। বন্ধুরা তাঁর জন্য অনেক করেছে, কিন্তু সবাইকে ফাঁকি  দিয়ে কবি নিরুদ্দিষ্ট। ঢাকায় তরুণ কবিসমাজের মধ্যে বিষ্ণু বিশ্বাস নিয়ে অনেক গল্প-গাথা প্রচলিত। সবাই আমাকে বলল বিষ্ণুর মা এপারে চলে এসেছেন, বনগাঁ সীমান্তের কাছাকাছি কোথাও, আমি যেন একবার খোঁজ করি।  ঢাকা থেকে ফিরে  এসে সুনীলকে বললাম সব। সুনীল কিছুদিন পর বলল, সে ঘুরে এসেছে বিষ্ণুর মা’র কাছ থেকে এবং সেখানেই আছেন অসুস্থ বিষ্ণু বিশ্বাস। যাব-যাব করে আমার যাওয়া হল না। আমার জীবনেও তখন বিশ্রী ঝড় চলছে। কিছুতেই থিতু হতে  পারছি না। সুনীল ছ’সাতমাস পর-পর ঘুরে এসে খবর দিত নানারকম।

                 আরও দু-তিন বছর পর অবশেষে গেলাম বিষ্ণু বিশ্বাসের মায়ের বাড়ি। সঙ্গী সুনীল। দত্তফুলিয়া- রানাঘাট পথের মাঝামাঝি  জায়গায় সেই বাসা। মাটির বারান্দা, বেড়া-টিনের ছোট্ট বাড়ি। অন্ধকার ঘরে ছন্নছাড়ার মতো শুয়ে আছে জীর্ণ, দীর্ঘদেহী কবি এবং কিছু বিড়াল। পাশেই তাঁর আত্মীয় নিত্যবাবুর বাড়ি। সম্পন্ন কৃষক। আমরা এসেছি খবর পেয়ে  তাঁরা ছুটে এলেন, বিষ্ণুদার মাও। তাদের মুখে শুনলাম বিষ্ণুদা ঝিনাইদহ-র সন্তান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পরে ঢাকায় থাকতেন।   অল্প বয়েসে পিতৃবিয়োগ হয় তাঁর। বিষ্ণুদার মা নিজ পিতৃগৃহে ফিরে আসেন তখন ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে। বড় হয়ে ছেলে  ঢাকায়  থাকতে শুরু করলে তিনি একাই বাপের বাড়ির কৃষক পরিবারে থেকে যান। নিত্যবাবু সেই পরিবারেরই সদস্য।   নিত্যবাবুর কাছে আমরা জানলাম, বিষ্ণু বিশ্বাসের উজ্জ্বল যৌবনের দিনগুলির নানা কথা। কবি কেন আত্মবিষে নীল হয়ে যান, তা তাদের বোঝার কথা নয়। কবিতায় সাক্ষ্য থেকে যাবে শুধু... অক্ষর ভিজে যাবে উন্মাদের লালায়।
যাই হোক, বিষ্ণুদাকে ঘরের বাইরে জোর করে এনে বসালেন নিত্যবাবুরা। তাঁরা ‘ নিজের দোষেই আজ এইরকম অবস্থা’- জাতীয় গালমন্দ করতে থাকলেন। একমাথা চুল- দাড়ির  বিষ্ণুদা কিছুটা নীরব, প্রতিক্রিয়াহীন। আমি গোপন কান্না লুকিয়ে ( আমার খুব আটের দশকের শেষ দিকের বিনয় মজুমদারের কথা মনে পড়ছিল ) হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাঁকে বললাম, “ ঢাকায় আপনার বন্ধুরা সব খুঁজছে আপনাকে। তাঁরা আপনার কবিতাসংগ্রহ প্রকাশ করছে। নিশাত জাহান রানা... চেনেন? সুব্রত   অগাস্টিন গোমেজ... মনে পড়ছে?” কবি চুপচাপ। চা-টা খেয়ে বিষণ্ণ মনে ফিরে এলাম সেদিন। সন্ধ্যায় একটি আবেগী- দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম অজান্তে। আমাদের নাটকের ঘরে উত্তেজিত ভাবে আমি বলে ফেললাম আমাদের ‘কবিতা আশ্রম’ পত্রিকায় বিষ্ণু বিশ্বাস  নিয়ে এই অভিজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে। ফেসবুকেও সেদিন তোলা বিষ্ণুদা ও তাঁর মায়ের ফোটো পোস্ট করলাম। আর এসবই আমি যখন করলাম, একটি বাচ্চা মেয়ে তখন আমার সামনে উপস্থিত। আমি জানতাম না সে ফেসবুক-খ্যাত, দুই বাংলায় ফেসবুক-সদস্যরা তাঁকে চেনে ও অতি-গুরুত্ব দেয়। সে ভালো মুখে উঠে গিয়ে বিষ্ণুদাকে নিয়ে আমার সংখ্যা বের করার বাসনাকে বিদ্রুপ করল ফেসবুকে। আগুন জ্বলে উঠল মুহূর্তে। বাংলাদেশের অনেকেই ‘ বিষ্ণু বিশ্বাস বেঁচে আছেন’ এই আনন্দে আমাকে অভিনন্দন জানাতে লাগল ফোনে, ফেসবুকে। সবাইকেই আমি বললাম, “এটা তো কোনও কৃতিত্ব না... সুনীল আমাকে নিয়ে গিয়েছিল... আমি সবাইকে জানালাম... এখন এই কবিকে সুস্থ জীবন উপহার দিতে হবে আমাদের...সেটা নিয়েই ভাবুন।”
এই হচ্ছে একদিকে। অন্যদিকে চলছে নোংরামি। পশ্চিমবঙ্গের মিতুল দত্ত যেই ‘বিষ্ণু বিশ্বাসকে রক্ষা করতে হবে’, এরকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে লাগল ফেসবুকে, স্বঘোষিত মানবতাবাদী চক্রটি তখন আমার সঙ্গে মিতুলকেও জড়িয়ে দিতে লাগল হদ্দ গালাগাল। বনগাঁর বাচ্চা মেয়েটির তখনকার ঘনিষ্ঠ এক শূন্য দশকের কবি ব্যক্তিগত রাগ মেটাতে এক মানবাধিকার সংস্থার   নাম ভাঙিয়ে আসরে নেমে পড়ল। ঢাকা থেকে ফোন এল এক বন্ধুর, “দোস্ত, বিষ্ণু বিশ্বাস নিয়ে কী ঝামেলা পাকাইছ?”
প্রকৃতপক্ষে, বাচ্চা মেয়েটির ভুলে এবং উপর্যুপরি কার্যক্রমে খুব গণ্ডগোল শুরু হয়েছিল ঢাকায়। বিশদ বলা যাবে না। ইশারায় বলছি, সাম্প্রদায়িক সমস্যা তৈরি হচ্ছিল... বিষ্ণু বিশ্বাসকে আমি নাকি পুশব্যাক করার চক্রান্তে মেতেছি, যিনি কিনা খারাপ  মানুশদের হাতে খুনের ভয়ে পালিয়ে ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। ( বিষ্ণুদা ঢাকায় অসুস্থ হন বাবরি মসজিদ কাণ্ডের ঠিক পরে।)
আমি ঝামেলার ভয়ে গুটিয়ে গেলাম। ফেসবুক বন্ধ। মিতুল একা ঝগড়া চালিয়ে সব আরও জটিল করে তুলল। আসলে মিতুল খুব আবেগী। এই চুপ করে যাওয়ার পরেও আমাকে কি রেহাই দিল ওরা? কেউ দিল না।
১) বনগাঁর বাচ্চা মেয়েটিও না। (সে তখন কলকাতার এক কাপুরুষ দ্বারা চালিত)
২) বিষ্ণুদাও না। আমি ঘোলাটে, জীর্ণ, নিষ্পাপ ওই মানুষটিকে ভুলতে পারছিলাম না।

শান্ত মাথায় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ঝগড়ায় যাব না। বিষ্ণু বিশ্বাসের চিকিৎসা প্রয়োজন আগে। যোগাযোগ হল তটিনী দত্ত-র সঙ্গে। ঘটনাটা জানাতে তিনি বললেন, “অবশ্যই যাব কবিকে দেখতে। তাঁর চিকিৎসার ভার আমাদের।” তটিনী নিজে মনোবিদ। তাঁর স্বামী তো বিখ্যাত মনোচিকিৎসক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ডাক্তার দম্পতি সাহিত্য ভালবাসেন। ‘নিরন্তর’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা প্রকাশ করেন নিয়মত। এই দুজন রাজি হতেই আমি সমস্ত অবান্তর গালাগাল তুচ্ছ করার শক্তি পেয়ে গেলাম নিমেষে। নাটকের দলের বন্ধুরা, সুনীল সোনা, চঞ্চল পাল, আরও কয়েকজন বনগাঁর বাসিন্দা কবি আমার যন্ত্রণার সাক্ষী ছিলেন। লেখার জগতে নানারকম বদমাইশি আছে, সেসব অভিজ্ঞতা সামলাতে সামলাতে যৌবন পেরিয়ে এলাম, তাতে আজ আর কিছু মনে হয় না। কিন্তু বিষ্ণু বিশ্বাসের ঘটনায় আমার জীবনে নতুন বাঁক এসেছে। আমি বুঝে গেছি, বেশিরভাগই কবি-শিল্পী সেজে কাটায়, তাঁরা মানুষই না।
              বনগাঁর বাচ্চা মেয়েটি কলকাতার শয়তানটার বুদ্ধিতে আরও কিছুদিন নোংরামি করেছে। চর হিসেবে বিষ্ণুদার বাড়ি গিয়েছে। বিষ্ণুদার বাড়ির ঠিকানা সে ফোনে আমার কাছে চেয়েছে, আমি দিইনি। সেকথাও সে ফেসবুকে লিখেছে- “কী সেই রহস্য? কেন বিভাস বিষ্ণু বিশ্বাসের ঠিকানা গোপন করছে?” তাঁকে আমি দেখা করতে বলেছিলাম। সে করেনি। দেখা করলেই সে  জেনে যেত, যেহেতু বিষ্ণুদার ভারতীয় নাগরিকত্ব নেই, তাই আইনত তিনি অনুপ্রবেশকারী, ব্যাপারটা নিয়ে মিডিয়া হইচই করলে যদি তাঁকে ধরা হয়, পুশব্যাক করা হয়, তাহলে সর্বনাশ! কী ঠাণ্ডা মাথায় পুলিশ-মিডিয়া-রাজকবি সামলেছি তখন!  আমার মাথা এত ঠাণ্ডা আমিই জানতাম না।
মামাতো ভাই কবি সুনীল সোনার সঙ্গে কবি 

              এই সময় এক রবিবার, মেয়েকে নিয়ে নতুনগ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছি, স্বপ্নের মতো ফোন এল কবি মৃদুল দাশগুপ্তের। মৃদুলদা আমাকে জানালেন, মানবাধিকার সংস্থার নাম ভাঙানো শয়তানটির বিরুদ্ধে তিনি নালিশ করেছেন সেই সংগঠনের প্রধানের  কাছে। বিষ্ণু বিশ্বাস মৃদুলদার প্রিয় অনুজ কবিবন্ধু। তাঁর চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়ায় তিনি আমাদের পাশে থাকবেন সবসময়। এমনিতেই বিরোধিতার মুখে পড়লে মানুষের তীক্ষ্ণতা বেড়ে যায়। তাঁর ওপর মৃদুলদার সমর্থন! আর দেরী নয়।
                  দ্রুত তটিনী, গৌতমদাকে নিয়ে যাওয়া হল বিষ্ণুদার বাড়ি। তাঁরা  আমাদের সকলকে সরিয়ে দিয়ে বিষ্ণুদা’র সঙ্গে গল্পে   মাতলেন।  বিষ্ণুদা’র দিক থেকে সামান্য মাথা নাড়া শুধু। প্রথম ছ’মাস আমি বিষ্ণুদাকে কোনও কথা বলতে শুনিনি। চুল- দাড়ি কেটে অবশ্য তাঁকে রুগ্ন রাজপুত্রের মতো লাগছিল। শুরু হয়ে গেল চিকিৎসা-পর্ব। বিষ্ণুদার মা ও নিত্যবাবুর ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু সদাহাস্যময়, প্রচারবিমুখ ডাক্তার-দম্পতির কোনও তুলনা হয় না। কবিকে ভালবেসে তাঁরা এক আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি করে ফেললেন ওই পরিবারের সঙ্গে। শুধু ওষুধ নয়, অনেক প্রয়োজনীয় উপহার তাঁরা সঙ্গে নিয়ে যেতেন। দীর্ঘ  চিকিৎসায় প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন আজ কবি বিষ্ণু বিশ্বাস। একদিন তটিনী-গৌতমদার সঙ্গে আমাদের বাসায় এসে ঘুরেও  গিয়েছেন। গমগমে, সুরেলা গলায় আমাকে যখন জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কেমন আছেন?” – এমন এক কান্না এল মনে, মুছে গেল অকারণে পাওয়া সব অপমান। গৌতমদারা কবিকে তাঁদের কল্যানীর বাড়িতে নিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কবি  তা পছন্দ করলেন না। মায়ের ওই সামান্য ঘরই তাঁর প্রিয় জগৎ।

                ২

             পেছন দিকে ফিরে একটা  আশ্চর্য দিনের কথা মনে পরে। সেদিন ঢাকা থেকে এসেছিলেন বিষ্ণুদার একমাত্র গ্রন্থ ‘ভোরের মন্দির’ প্রকাশ করেছিলেন যিনি, সেই বিষ্ণুপ্রেমী নিশাত জাহান রানা। উল্লেখ্য , বিষ্ণুদাকে যখন নিরুদ্দিষ্ট বা মৃত ধরে নেওয়া  হয়েছিল, তখন ২০০১ ফেব্রুয়ারিতে নানা সূত্রে সংগৃহীত বিষ্ণু বিশ্বাসের প্রকাশিত- অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে রানাদি ‘ভোরের  মন্দির’ প্রকাশ করেন। ভালোবাসার জন্য এ এক দায়পালন। সেই ভালোবাসার দায় থেকেই ছুটে এসেছিলেন বিষ্ণুকে দেখতে রানাদি ও নাহার মওলা। আমরা আমন্ত্রণ জানিয়ে সেদিন হাজির করেছিলাম পশ্চিমবঙ্গে বিষ্ণুর ঘনিষ্ঠ দুই কবি মৃদুল দাশগুপ্ত  ও গৌতম চৌধুরীকে। মিতুল, সুনীল, আমি, চঞ্চল, তটিনী, গৌতমদা, সুশীল সাহা – আরও কয়েকজন ছিলাম। রচিত হল  অপূর্ব এক মিলনদৃশ্য। এরকম দৃশ্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য অনেক দিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। বিষ্ণু বিশ্বাসের মুখোমুখি রানাদি, নাহার। নাহার গাইছে গান। মধুর কন্ঠের সেই গানে খেলা করছে যেন অলৌকিক বিষাদ। আর সেই বিষাদ, যাতে জেগে আছে পুনর্জন্মের পুলকটিও। বিষ্ণুদা শূন্যে তাকিয়ে। সর্বার্থেই শূন্যে। শূন্যে মিশে যাচ্ছে তাঁর অদৃশ্য অশ্রু।  কিংবা কী ছিল সেই দৃশ্যে, আমার আজও জানা হয়নি। কবিতা যেমন বারবার পাঠ করতে হয়, এই দৃশ্যও তেমন বারংবার পাঠযোগ্য সম্ভবত। মৃদুলদা- গৌতম চৌধুরীও বিষ্ণু বিশ্বাসকে উষ্ণ আলিঙ্গন করলেন। মৃদুলদার সেই অমোঘ ধ্বনি- “ফিরে এসো, বিষ্ণু... ফিরে এসো...”

              ৩

           কবি ফিরে এসেছেন জীবনে। আমারও কাজ ফুরিয়েছে। একটু কি কৃতিত্ব নেওয়া গেল আগের বাক্যটিতে? তা নয়। আসলে আমি এখন পালিয়ে বেড়াই। বিষ্ণুদা একদিন ফোন করেছিলেন।একটাই কথা- “আসেন না কেন?” বিষ্ণুদার মা ফোন করেন প্রায়ই। যেতে বলেন। জিজ্ঞেস করেন, “বিভাস, তুমি কি রাগ করেছ?” অত্যন্ত সংকোচে বলি, “যাব... যাব... একটু ব্যস্ত...”। কেন আমি এভাবে পালিয়ে বেড়াই? তাঁর কারণ, এক অপরাধবোধ। এতদিন অসুস্থ কবিকে ভুলতে না পেরে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। আমি তো মহামানব নই। সাধারণ মানুষ। অনিশ্চিন্ত এক জীবনে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে কোনওক্রমে বেঁচে আছি। বিষ্ণুদার এত সব গুণমুগ্ধ, কাউকে একদিনের বেশি পাইনি আমরা। সুস্থ হওয়ার পর কবি কী করবেন এখন? তাঁর বাড়িটা কি একটু পাকা করে দেওয়া যায়? জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় অর্থ কোথা থেকে আসবে? এইসব সাংসারিক প্রশ্নের উত্তর কোনও গুণমুগ্ধই দিলেন না। সকলের সঙ্গে আজও কথা হয়। রানাদি মনে করেন, কবিকে বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে  পারলে ওঁরা সব দায়িত্ব নিয়ে নেবেন। দুই দাক্তারের বক্তব্য, বাংলাদেশে গেলে উনি আবার মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যাবেন... যেটুকু উন্নতি হয়েছে, সব জলে যাবে। মৃদুলদা-গৌতম চৌধুরীরা বলেন, ‘আবার একদিন ঘুরে আসব।’ আমি একই কী করব? তাই পালিয়ে বেড়াই। ডাক এলেও যাই না। চঞ্চল পাল, আমার অনুজ বন্ধু, সে-ই প্রতিমাসে বেশি যেত- আসত আমাদের হয়ে। সে-ও এখন নিজ পেশায় ব্যস্ত। একমাত্র তটিনী ও গৌতমদা নিঃশব্দে তাদের কোথা রেখে চলেছেন।  বিষ্ণু বিশ্বাসকে জীবনে ফিরিয়ে আনার সমস্ত কৃতিত্ব এই দুজনের। আমরা বাকিরা, মহত্ত্ব দেখানোর আনন্দ চেটে পুটে খেতে চেয়েছি শুধু। মহৎ সাজা কী যে এক নেশা!

               

             সুনীলের সঙ্গে এবার অমিত গিয়েছিল। অতি সম্প্রতি। অমিত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘বিষ্ণু বিশ্বাস’ সংখ্যা প্রকাশ করবে। খুব আনন্দ পেয়েছি। অমিতের কর্মকাণ্ডের পেছনে যে সব মেধাবী মানুষেরা আছেন, সবাই এবার জড়িয়ে পড়ুক দায়বদ্ধতায়।   বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা নিয়ে এই সংখ্যায় বিশিষ্ট কবি-আলোচকেরা নিশ্চয়ই লিখবেন। তাঁরা যোগ্যজন নিঃসন্দেহে। আমি চাই,  তাঁরাও জড়িয়ে পড়ুক দায়বন্ধনে। আমি তো মানুষটাকে পেরিয়ে কবিটির কাছে পৌঁছাতেই পারলাম না  আজও। একদিন নিশ্চয় পৌঁছে তাঁর কাছে শুনতে পাব কবিতা- “আমাকে পেরিয়ে গেলে তুমি পাবে এক ধূলিপথ/ ডানে বাঁয়ে সবখানে শিলীভূত পাখিদের শব/ যেখানে অমর মৃত্যু...” আমিও কবির কবিতা উচ্চারণ করেই কবিকে উত্তর দেব সেদিন- 
“... সূর্যাস্তের মতো সূর্যোদয়ে/ তুমি কত স্বাভাবিক ও উদ্বিগ্নচিত্ত। অন্ধকারে/ সর্বত্র দেখেছ তুমি জটিল ও স্বাভাবিক উড়ন্ত শালিক/ কারণ বুঝেছ কিছু, কী বুঝেছে, কেন,/ না জেনে নদীর জল দীর্ঘ স্রোতাকাঙ্খী/ কবি হওয়া তাই যেন তোমার নির্দিষ্টি...” ।                          

মন্তব্যসমূহ