আইরিন সুলতানা



আইরিন সুলতানা

খাঁজটা একটা ফাঁদ

আজমত একটা সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় হাতপা গুটিয়ে বসে আছেন। এত উঁচুতে পাহাড় জুড়ে বরফ থাকার কথা। এদিকসেদিক নগ্ন কালচে পাথর থাকার কথা।  অথচ চারপাশটা ভেলভেট সবুজ। প্রশ্বাস নিতেও আরাম বোধ  করছেন আজমত।  চূড়ায় উঠতে ভয় হয়নি। পায়ে পায়ে উঠেছেন। এই উঁচু থেকে নিচুতে তাকাতে কেমন লাগবে?  চূড়ার ধারে গিয়ে মাথা গলিয়ে নিচে তাকিয়ে কিছু দেখার সুবিধে করতে পারলেন না আজমত। কিনারে একটা খাঁজ আছে। বুদ্ধি করে ওর মধ্যে দুই পা গলিয়ে, হাঁটু মুড়ে বসে নিচে তাকালেন আজমত। অনেক নিচে। দৃষ্টি আটকাচ্ছে না। দেখা শেষ হচ্ছে না। মাথা চক্কর দিয়ে উঠল আজমতের।  খাঁজের দেয়ালে হাত রেখে পতন সামলালেন। খাঁজটা থেকে পড়ে যাওয়া সোজা নয় অবশ্য। টলে উঠেছিলেন বলে পড়ে যাওয়ার ভ্রম। থাক, উঠে যাওয়া যাক বরং। আজমত ভাবলেন।  দেয়ালে হাত রেখে, হাঁটু সোজা করে যেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা, কাঁপন ধরে গেল বুকে তার। ধপ্ করে বসে পড়লেন আজমত। হাঁপাচ্ছেন। এই খাঁজটা একটা ফাঁদ। এই খাঁজে ঢুকতে ভয় নেই। বসে থাকায় ভয় নেই। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া আত্মহননের সামিল। আজমত ঝটফট করতে থাকেন। কেউ কি নেই পাহাড়ে যে তাকে টেনে বের করে আনে? আজমত শূন্যে দুই হাত বাড়ান।

বাণিজ্যিক সফল লেখক আজমত জামিল দু:স্বপ্ন দেখছেন। কিছুক্ষণ পরেই ঘেমেনেয়ে ঘুম ভাঙবে তার। তারপর খ্যাতির খাঁজে বসে উঁচু দর হাঁকবেন সদ্যলেখা উপন্যাসটির।




গণক জামালের ভাগ্য পাথর

পাগলা বাবা বলেছিল, পাত্থরেই তোর কপাল বান্ধা! জামাল রুটিরুজির ধান্ধা বুঝে নিয়েছিল তখনই। জামাল মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের  ধারে ফুটপাতে ভাগ্যের ঝাঁপি নিয়ে বসে পথচারীদের জন্য। খাবলা খাবলা লোম উঠে যাওয়া টিয়া দিয়ে রঙিন চিরকুট তুলে ভবিষ্যত দেখে। উত্তল লেন্স দিয়ে মক্কেলের হস্তরেখা মাপে। আংটির জন্য রঙিন পাথর বেচে।  এ ফুটপাতের একছত্র গণক জামাল। শুরুতে খবরের কাগজ বিছিয়ে বসত। এখন মোটা পাটি পেতে বসে । জায়গাটা বেহাত না হতে সপ্তাহে একশ টাকা গুঁজে দেয় ট্রাফিক পুলিশের হাতে। এককালে এ পেশায় কামাই ছিল। এখন পুলিশের ঝামেলা আছে। উপরন্তু আলিশান গণকের আবির্ভাব। এরা বিদেশ ফেরৎ, কী সব সার্টিফিকেট দেখায়। বড়লোক পার্টি ওখানেই ভিড় করে। যত কড়ি তত  ভাগ্য।

দু'তিনটা ব্যাগ হাতে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে লোকটা। বারবার মোবাইলে কথা বলছে। ঘড়ি দেখছে। ধারে এসে সিগারেট ফুঁকলো। জামাল শরীর এলিয়ে বসা। লোকটাই এল। পাথর দেখতে লাগল। ব্যাগগুলো রেখে হাত বাড়াল।  লোকটার আঙ্গুল ভর্তি পাথর বসানো আংটি। জামাল অনেকদিন মালদার মক্কেল পায়না। আমতা আমতা করে মুখ খুলছিল তো লোকটার ফোন বাজল। ফোনে ওপাশে কিছু শুনতেই  ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত আরেক কোণায়  মিলিয়ে গেল লোকটা। জামাল  হা করে তাকিয়ে ছিল মিনিট দশেক। আচমকা খেয়াল করল তার পাশে একটা কালো ব্যাগ।

জামাল বেশ অস্থির। পেট মোটা পুলিশটা আশেপাশে কিনা দেখে নেয়। ঢাউস কালো ব্যাগটা শরীর দিয়ে আড়াল করে বসে থাকে। ব্যাগের চেন খুলে  দেখেছে সে। ব্যাগ ভর্তি টাকা। জামালের চোখ ছটফট করে। দ্রুত ভাবতে থাকে। মহাখালী থেকে বাস ধরলে চার ঘণ্টার পথ। নামবে টাউনে। সেখান থেকে ভ্যানগাড়ি। হাঁটাপথ। তারপর হতদরিদ্র একটা ঘর, যেখানে তার পরিবার থাকে। ঢাকায় জামালের  পিছুটান নেই। টিয়াটাকে খাঁচায় ভরে, ব্যাগ কাঁধে উঠে দাঁড়ায় জামাল। কখন কোন বাস ছাড়ে মুখস্ত জামালের। পাগলা বাবা, তুমার কথাই সই, পাত্থরেই ভাগ্য বান্ধিলাম...।

মন্তব্যসমূহ