ছড়িয়ে থাকা রহস্য এবং মেঘগভীর বিস্ময়// শিমুল মাহমুদ

ছড়িয়ে থাকা রহস্য এবং মেঘগভীর বিস্ময়

শিমুল মাহমুদ


এক. ভাববিদ্যার শেষাংশ

             আমার চেয়ে বয়সে বছর পাঁচেক এগিয়ে থাকা বিষ্ণু বিশ্বাস আমাকে খানিকটা পছন্দই করতেন। বিষ্ণু-র চোখে মায়া এবং মেঘগভীর বিস্ময়। উজ্জ্বল শ্যামা রঙের লম্বাটে যুবক কবি বিষ্ণু বিশ্বাস; আত্মগত কণ্ঠ; বসে আছেন পাবলিক লাইব্রেরির অজস্র থাক থাক সিড়ির প্রায় শেষ ধাপে। ঢাকা শহরের সিড়ি; অপরিচিতের ভয় আর রহস্যে মোড়ানো অজস্র সিড়ি। পাবলিক লাইব্রেরিতে প্রবেশ করতে হলে অনেকগুলো সিড়ি ডিঙোতে ডিঙোতে দালানকোঠার প্রায় এক ছাদ অবধি উঠে যেতে হয়। আমরা সিড়ি ডিঙোতে গিয়ে অবশেষে কবিতার হাত ধরে হাটু মুড়ে বসে থাকি দীর্ঘপথ সিড়ির কোনো একটিতে আর তখন বিষ্ণু-র উচ্চারিত কণ্ঠধ্বনি ক্রমশ আভা ছড়িয়ে দেয়। আমাদের চারপাশ শারীরীয় রঙের আভায় বদলে যেতে থাকলে আমাকে ছুঁয়ে দেয় সেই কণ্ঠ-উদগত রঙ; পিছে ফেলা দুপুরের শরীর ছুঁয়ে কবিতার শরীর যখন কেবলি আমাকে জড়িয়ে নিতে থাকে তখন যেন বা জাদুমন্ত্র,

অসংখ্য চলেছে ধূলি পথে
যে পথ গিয়েছে জঙ্গলে আদি পাহাড়ে
মরণের যাবতীয় উপাচার যেখানে, মারণের
আগ্নেয় স্রোতে বিচূর্ণ পাথরের ছাই
তুলে নাও, ছড়াও, সমগ্র ঊষর ভূমিতে,
সময়ের খোলা চোখ, অস্ত্রের সাধনা তোমার
প্রগতি, গতি, পথ এবং পাথেয়-সৌন্দযের
শিল্পের সামগ্রিকে নিমগ্ন শিল্পী হাটু ভাঙা
কাদা খোঁড়া পাখি, সামগ্রী, শব, শব, শব

আমাদের ভরাট চোখে শবদৃশ্য ভেসে উঠতে থাকলে আমরা কিছুক্ষণ থেমে থাকি; তাকিয়ে থাকি পরস্পরের দিকে; যেন বা চোখের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিকে ছুঁয়ে দেবার অমোঘ প্রচেষ্টা। সেই ছুঁয়ে দেবার প্রচেষ্টা আমাদের চোখের পাতায় ভেসে উঠলে, ঘুম ভেঙে অবাক চোখে জেগে ওঠে প্রভাতকাতর গৃহের কোনো এক সদ্য-বাসর-জাগা মেয়ে। সেই মেয়ের চোখে নদীরা সাতভাই ছলাত জলের স্পর্শে শবদেহের যাবতীয় পাপ আর পাপের সরঞ্জাম আগলে রেখে গেয়ে ওঠে,

 আমি শবের অধিপতি

‘এগারো জন মৃত সংঘর্ষে’
‘ওদের কবর দাও’
‘ধর্ষিতা সাতটি মেয়ে
রক্তাপ্লুত, রক্তনিঃস’
‘তারার আঁধারে আপাতত থাকো, রাখো অবগুণ্ঠন
লাল কমল নীল কমল ঝলমল
ধুয়ে দেবে শরীর ও মন
‘তোমার বয়স পনেরোর নিচে, যাও, ঘুমাও
অথবা সাজো ধূলি যুদ্ধের জেনারেল
ওরা আসবেই ডালিম কুমার।


যৌবনে কবি  বিষ্ণু বিশ্বাস //একটি মিডিয়ায় প্রকাশিত ছবি থেকে অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে  'অচেনা যাত্রী'-তে  প্রকাশিত  


                 বিষ্ণুকে কখনো চোখের ওপর কাগজ মেলে ধরে কবিতা বলতে শুনিনি; সব সময় মেমোরি থেকে নিজের কবিতা পাঠ করতেন তিন। আমি সম্মোহিত হতাম তার নিমগ্ন পাঠপ্রবণতার ভরাট উচ্চারণে। ভরাট চোখ আর মায়াকাতর অভিব্যক্তির জাদুস্পর্শে আমি নেশার মতো তার পেছনে লেগে থাকতাম। অথচ শেষাবধি, ঢাকা শহর আর ঢাকা শহরের কবিযশপ্রার্থীগণ কবিকে মায়াপ্রবণ জীবনের মগ্নতায় ডুবে থাকতে দেয়নি। ঈর্ষা থেকে প্রতারণা; প্রতারণা থেকে টিকে থাকার লড়াইয়ে অশুভবান্ধব, সব মিলিয়ে অশুভ প্রেসার; কবি শেষাবধি নেশা-ক্লান্তির নিয়ন্ত্রণসীমা ভুলে যেতে বাধ্য হলে কবির চোখে বিভ্রম। টাকা পয়সার টানাটানি চলছিলো অনেকদিন যাবত। বাড়িতে জায়গা জমি বেঁচতে হয়েছিল, ঢাকাতে টিকে থাকার তাড়নায়; সেইসাথে বন্ধুদের মন ভিজিয়ে রাখতে গিয়ে তাকে খরচ করতে হতো। অথবা প্রশ্ন করা সম্ভব, কবিতার রাজপুত্র হিসেবে এক ধরনের আভিজাত্যবোধ কি সেদিন কবির অবচেতনে জেগে উঠেছিল? তা না হলে খুব অল্প সময়ের ভেতর নিজেকে এভাবে ফু দিয়ে নিঃশেষ করে কেন ফিরে গিয়েছিলেন কবি চিরায়ত জীবনের দিকে; যে জীবনের কোনো উত্তর আমরা আজো খুঁজে পেলাম না। কবি নিখোঁজ হলেন; আমাদের মধ্যে কেউ কেউ জানলাম তিনি আত্মহত্যা করেছেন; অর্থাৎ তিনি মৃতদের সারিতে। সুতারাং আমরা যারা কবিতাপ্রেমিক, বিশেষ করে বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতার জাদুশক্তি এখনো আমাদের তাড়া করে ফিরছে, তাদের কাছে বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতাবলি যেন বা ঐশিপুস্তক; চৌদ্দশ সাতের ফাল্গুনে অথবা ২০০১ এর একুশের মেলায় ‘যুক্ত’ থেকে প্রকাশ পেলো বিষ্ণু বিশ্বাসের ‘ভোরের মন্দির’; প্রচ্ছদ, শফিকুল ইসলাম, গ্রন্থসত্ত্ব, নিশাত জাহান রানা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮৮ এবং কবিতাসংখ্যা ৫৮।
বন্ধু জামালের সাথে বিষ্ণু বিশ্বাস ( বাঁদিকে )/ বিষ্ণু বিশ্বাসের মায়ের কাছ থেকে সংগৃহীত 


                  বিষ্ণু যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জাগিয়ে রেখেছে কবিতা দিয়ে তখন স্বৈরসরকার এরশাদ রাজপথ দখলে রেখেছে, সেনাশক্তিকে জাগিয়ে রেখেছে অস্ত্র আর অর্থ দিয়ে; দুর্দান্ত সেই সময়, বশ মানে না কবিতার। রাজপথের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে গ্রামজনপথে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘৃণা; কোনো এক সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ মতিহারে ঘৃণা উচ্চকিত হলে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো গানে কবিতায় অথবা নাটকে ফুসে উঠতে থাকে; আর তখন কবি বিষ্ণু বিশ্বাস মুখোমুখি হয় ঘৃণা অথবা একটি অশুভ সকালের অথবা এক নগ্ন সন্ধ্যার ওপর দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করে,

আনন্দ নেই
শব যাত্রায়
সমবেত হরিধ্বনিতে জুটেছি
আমরা
মৃত রাত্তির
গলিত অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছি
বিদ্যুচ্চমকে দেখা গেল।

পুরো কবিতাটি ৫৯ লাইনে লেখা; শিরোনাম ‘আনন্দধ্বনি জাগাও’; শিরোনামের নিচে বন্ধনী চিহ্নের ভেতর লেখা আছে, ‘কল্যাণী রমাকে’। কবিতাটি লেখা হয়, ছিয়াশির কোনো এক সময়। প্রথম ছাপা হয় ‘পেঁচা’ পত্রিকার ১ম সংখ্যায় ১৯৮৭ –র জানুয়ারিতে।

              আগুনচোখের সন্ধ্যার ওপর দাঁড়িয়ে মতিহারের ধুলোতে পা ফেলে একলা কিশোর একলা একজন কবি স্বপ্নাচ্ছন্ন অথচ যন্ত্রণাদগ্ধ; সেই যন্ত্রণার নাম বিষ্ণু বিশ্বাস। ক্যাম্পাসে দিনভর সঙ্গীতে অথবা কবিতায় ক্লান্তিহীন; অবশেষে পেয়ে যায় ইংরেজির শিক্ষক কবি অসীম কুমার দাসের কবিতাজীবনের এক লোভনীয় ছায়া। প্রিয়জন অথবা অনুরাগীবেষ্ঠিত কবি; তারপরও একা; যদিও নজর কাড়ার মতো প্রকৃতিপ্রদত্ত সহজাত ক্ষমতায় জড়িয়ে থাকা মায়াপ্রবণ যুবক সহসাই আড্ডাপ্রিয়।

               বিষ্ণু-র জন্ম ঝিনাইদহে। কবি শামীম নওরোজের সাথে, কবি সুনীল সোনার সাথে বিষ্ণুর বাপদাদার ভিটে দেখতে আমি ঝিনেদা গিয়েছি; তখন বিষ্ণু হারিয়ে গিয়েছে। বিষ্ণু-র বাবা আত্মঘাতী। কেন আত্মঘাতী? এই প্রশ্নের উত্তর বিষ্ণু-র জানা ছিল না অথচ আমরা টের পেতাম ওর রক্তেও আত্মহননের বীজ ক্রমশ পুষ্টি পাচ্ছে। সহসা ওর বিষণ্নতা অথবা আত্মগত কবিতার যন্ত্রণা আমাদের যেন বা খানিকটা সতর্ক করে দেয়; আমরা সতর্কচোখে তাকাই বিষ্ণু-র স্বপ্নমদির চোখ অথবা আবেগতাড়িত জীবনের দিকে; যে জীবন আমরা ভালোবাসি ভয়ানক। অথচ এই ভয়ানক ভালোবাসা উপেক্ষা করে বিষ্ণু উচ্চারণ করে, ‘তবে আমি বিচারক নই- আমি, তোমাদেরই মতো যন্ত্রণার শিকার। আমি বলবো, যা ঘটেছে, ঘটতোই এবং আরো ঘটবে যতক্ষণ না রক্তঝর্নার মতো ঘটনাগুলোর মুখরিত উৎসারণ আটকানো যাবে এবং একটি সত্য ধৃত হবে, সূয সত্যির মতো আলোময়। আমি চাই, শান্ত হোক, কুলীন কোলাহল, অনিরীহ নৃত্য। আমি বলছি, আমাদের সমস্ত মূর্খ নারী পুরুষের জন্য শহরময় নাচ গান মজার হুল্লোড়, নিরিবিলি যৌনতার ব্যবস্থা হবে। সাতদিনের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে প্রত্যেকের জন্য বিদ্যাকানন, খেলার মাঠ অরণ্যে যাবার সাইকেল। পাহাড় ফেরত পাবে পাথরের জল এবং তৃষ্ণার নিবৃত্তি শেষে তারা, তখন মধুময় স্বপ্নের মৌমাছি। ব্যস্ত কর্মী। খুব মধুর গুনগুন হবে ওদের চলাফেরা-গনগনে। তার ভাষণ কখন যে শেষ হয়েছে, কেউ টের পেল না। দশ লক্ষাধিক জনতা ধীরে ধীরে ফিরে চলল যে যার ঘরে। তারা নীরব ও আত্মমগ্ন ছিল।’ (সংবাদপত্রে একটি জনসভার রিপোর্ট)

               বিষ্ণু বিশ্বাস নিজেও শেষাবধি নীরব এবং আত্মমগ্ন; সমগ্র জাতি যেন বা নীবর ও আত্মমগ্ন। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের সূত্র ধরে যখন আমরা বিষ্ণু বিশ্বাসকে অনুসন্ধান করি তখন পক্ষান্তরে আবিষ্কার করি জাতিগত অবিশ্বাস আর স্বার্থগত ঘৃণার আগুন। যে আগুন থেকে বিষ্ণু নিয়ত উদ্ধারের পথ অনুসন্ধান করলেও শেষাবধি তাকে ব্যর্থ হতে হয়েছিল। এই ব্যর্থতার বীজ রোপিত হয়ে আছে ধর্ম যখন পরিচয়ের মাপকাঠি হয়ে ওঠে সেই মাপবিন্দুর ভেতর; সেই মাপ-সীমানার ওপর নির্ভর করে ভূগোলের অধিকার, শেকড়ের অধিকার। বিষ্ণু কি শেকড়বিচ্যূত? তা না হলে ‘পুষ্পদম্পতির’ জীবনচক্রে কেনই বা আবিষ্কার করবে আত্মহননের ছায়া?

মাঝে মাঝে মনে হয় কখনো নিশ্চয়
খুন হবো আমি
লাল রক্তধারার বলিষ্ঠ এক স্রোত
আলতার আল্পনায় রাঙাবে একটি পত্র-
যার রঙ মূলত হলুদ,
যে মূলত ঝরা।
এইখানে
একটি গল্পের শুরু এবং সারা হতে পারে-।
কিন্তু চলুক না রক্তস্রোত
ঝরা পাতার থেকে বৃক্ষ অবধি
আর আমি ভাবি-
ফুটপাত থেকে কুড়িয়ে এনেছি
ঝরা, একটি পুষ্প দম্পতি অদ্ভুত।

বিষ্ণু কীভাবে কবিতা উচ্চারণ করে? কীভাবেই বা তার কবিতার জন্ম হয়? এই অনুসন্ধানে জন্ম হয়, ভাষারহস্যের। প্রকৃত প্রস্তাবে এই ভাষারহস্য মূলত জীবননির্ভর এক চিরায়ত রহস্য; ফলে আমরা জীবনের দিকে ফিরতে বাধ্য হই। ফিরে তাকাই বিষ্ণু-র জীবনবিন্যাস অথবা কবিতাবিন্যাসের দিকে; এবং আমরা শুধুমাত্র কবিতার বিন্যাসরীতিতে জাদুগ্রস্ত নই বরং আমরা মোহগ্রস্থ হই বিষ্ণু-র যাপিত জীবন দ্বারা। কবিতার বিষয় কীভাবে যাপিত সময়ের সাথে মহার্ঘ্যতা অর্জন করে? সেই মহার্ঘ্যতার করণকৌশল আবিষ্কার করা হয়তো সম্ভব, যখন আমরা কিছুটা আত্মমগ্ন অথবা কিছুটা সচেষ্ট হই; আর তখন কি আমরা আমাদের প্রজ্ঞাপ্রাপ্তি চোখে দেখে ফেলি বিষ্ণু-র কবিতার ভেতরমহল? অবলীলায় কবিতা উচ্চারণের ধ্বনিমৌনতা আর অর্থ-বিস্ময়স্তরে মনোযোগী হলে বিষ্ণুর কবিতার অন্তর্গত রহস্যের সামান্য হলেও বোধের সাথে মিলিয়ে নেয়া সম্ভব। কবিতা বোধের পাথা দিয়ে ছুঁয়ে দেওয়ার বিষয়; কবিতা দেখা অথবা ব্যাখ্যাযোগ্য শিল্প নয়। বিষ্ণু প্রকৃতই কবিতা লিখেছে; কাজেই তার কবিতার ব্যাখ্যা হয় না; শুধু বোধের পাখা দিয়ে স্পর্শ করা সম্ভব। যার পাখা নেই সে কবিতার স্পর্শ পাবে না; বিষ্ণুকে পাবে না।

বিষ্ণু-র কবিতা বিষ্ণুর মতোই সুদর্শন এবং তরুণ। নিষ্পাপ এবং অকপট সত্যের বিষণ্ন মুখমণ্ডল তার কবিতা। এই যে বিষণ্ন আবেগ যা তার সমগ্র চেতনা, অথবা অস্তিত্বে মিশে গিয়ে অবশেষে কবিকে গিলে খেয়েছে; গিলে খেয়েছে কবির সম্পূর্ণ অস্তিত্ব।

               রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিষ্ণুরা ক’জন মিলে প্রকাশ করে কবিতাকাগজ ‘পেঁচা’। ১৯৮৭-র জানুয়ারিতে পত্রিকাটি প্রকাশ পায়। এরপর ১৯৮৮-র মে মাসে দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশ পায় ঢাকা থেকে। বিশেষ করে শামসুল কবীর কচির উদ্যোগে ‘পেঁচা’কে কেন্দ্র করে বিষ্ণুদের একটা পরিমণ্ডল তৈরি হয়। অসীম কুমার দাস, বিষ্ণু বিশ্বাস, এনায়েত কবীর, শামসুল কবীর, রাশেদ উন নবী, মুশতাক জামাল, সাইদুর রহমান, ফয়জুল ইসলামসহ আরো বেশ কজন মিলে নিজেদের লেখা আর নিজেদের শৃঙ্খলাবিহীন জীবন, সে এক দুর্নিবার বিস্ময়ের জগত। এরপর অনার্স কমপ্লিট করে সোজা ঢাকা; কবিতার তাড়নায় এম.এ. পড়ার দরকার আছে বলে কখনো মনে হয়নি বিষ্ণু-র। কিছুদিন ফকিরাপুলের পানির ট্যাংকের সামনে গ্রিন হোটেল; তারপর বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ভাবে বিভিন্ন জায়গায় রাত্রিযাপন। ঢাকার উত্তেজক লিখিয়েদের সাথে ভিড়ে গিয়ে তৈরি হল জটিলতা; সে এক বিচিত্র জটিলতা; লেখালেখির জগৎ ঈর্ষা আর অহঙ্কারে আতঙ্কগ্রস্থ।

                পেঁচা-র ১ম সংখ্যায় ছাপা হয় বিষ্ণুর ‘আনন্দধ্বনি জাগাও’, ‘টেলিগ্রাম’, ‘প্রত্যালীঢ়’, ‘কাল সমুদ্রে আলোর যাত্রী’, ‘মৃত্যু’, ‘অন্ধকার পাহাড় সমুদ্র’, ‘একা আছি’, ‘সেই অন্ধকার মৃত স্তম্ভ’, ‘কবর কাহিনী’, ‘অ-ভাব মৃত্যুর কবিতা’, ‘সুধীন্দ্রনাথ’, ‘পাথর’, ‘নিরবেদ’, ‘তোমাকে দেখা গেল’, ‘গল্প’, ‘প্রেম’ শিরোনামের মোট ১৬টি কবিতা। ২০০১ সালে নিশাত জাহান রানা এই কবিতাগুলোর ১৫ টি ‘ভোরের মন্দির’ এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বাদ পড়েছে ‘প্রেম’ শিরোনামের কবিতাটি। বাদ পড়ার কারণ হিসেবে বলা সম্ভব, তিনি ১৯৮৮ সালের মে তে পেঁচা-র ২য় সংখ্যায় বিষ্ণু বিশ্বাসের যে ৬টি কবিতা ছাপা হয়েছে সেখানে ‘প্রেম’ শিরোনামে কবিতা পেয়েছেন এবং সেটি গ্রন্থভুক্ত করেছেন। আমার সংগ্রহে পেঁচা পত্রিকার দুটো সংখ্যাই আমি পাঠ করে দেখেছি একই শিরোনাম হলেও কবিতা দুটো পৃথক দুখানা কবিতা। আমি যে কবিতাটি গ্রন্থভুক্ত হয়নি সেটি এখানে উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি। কেননা আমরা বিষ্ণু বিশ্বাসের যতদূর সম্ভব সব লেখাই সংগ্রহে রাখতে ইচ্ছুক।


প্রেম

‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’
-রবীন্দ্রনাথ

তখন চতুর্দিকে বৃষ্টি
বৃক্ষের নীচে পাতা পচা
পায়ের নীচে কাকড়ার খোলস।

আকাশে সূয নেই অনেকদিন
নক্ষত্র পচে গেছে মেঘের নীচে

তার মৃত্যুর সংবাদ
নীরবে নদী বয় নারীর মতন।

তখন, তাঁর বোট বাধা আছে
ঘাটে আর কোনও নৌকা নেই

ছৈয়ের ভিতরে কূপী জ্বলে
জলে আগুনের ছায়া
মাইলের পর মাইল
এবং মাইলের পর মাইল

বিচ্ছেদের ঠিক শেষে
পাল খুলে গেল।

তখন শীত
ছায়া মিশে গেছে শরীরে

বৃক্ষের নীচে ঠাণ্ডা পাতা
প্রেমের উত্তাপে ঘুমিয়ে

সেখানে মৃত্যু নেই
ভাঙা পাঁচিল ঘিরে গাঁদাফুল
শ্মশানে সর্ষের হলুদ শীৎকার।


              পেঁচা-র ২য় সংখ্যা শুরু হয়েছে বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা দিয়ে। প্রথম কবিতা ‘জল’; এরপর ‘শেষকৃত্য’, ‘রাত্রি’, ‘ম্যুজিয়ম’, ‘প্রেম’, ‘আলো ক্রমে নিভিতেছে’ – এই ছটি কবিতা নিশাত জাহান রানা গ্রন্থভুক্ত করেন। ১৯৯১ এর ফেব্রুয়ারিতে কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ও মাসুদ আলী খান সম্পাদিত ২৮০ পাতার ‘প্রসূন’ পত্রিকার শুরু হয়েছে বিষ্ণু বিশ্বাসের ‘ভোরের মন্দির’ কবিতা দিয়ে। অবশ্য প্রসূন পত্রিকা বিষ্ণুর ৮টি কবিতা বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করে উপস্থাপন করেছে। বিষয়টি উল্লেখের প্রয়োজন আছে এজন্য যে ঢাকার সিরিয়াস ধারার ছোটকাগজগুলো ততদিনে বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতার অবস্থান, টেকনিক ও বিষয় নিয়ে ভাবতে শিখেছে; তা যতই কবিতাপাড়ায় দলাদলি থাকুক না কেন। ফলে বিষ্ণু-র নোতুন কবিতা পাওয়া না গেলেও পুনমুদ্রণে কারো আপত্তি নেই; বরং তখন সবার ভেতর বিষ্ণুকে নিয়ে এক ধরনের আগ্রহ দেখা দিয়েছে। ‘প্রসূন’ পত্রিকার প্রসঙ্গ ওঠার আরো একটি কারণ আছে; তা হল এই পত্রিকাতে উপস্থাপিত ৮টি কবিতার একটি অর্থাৎ ‘হাওয়া’ শিরোনামের কবিতাটি গ্রন্থভুক্ত হয়নি। সুতরাং এই কবিতাটিও আমাদের সংগ্রহে থাকা উচিত।


হাওয়া

তুমি চলে যাবার পরে সকালে আমিও গিয়েছি
তোমার চুলের ছায়ায় ফুলের রেখার টান ছিল।
যাওনি অনেক দূরে জানি
আমারও হয়নি যাওয়া বেশি দূর
এক রাস্তার মোড়ের কথা মনে আছে শহরের
যেইখানে
রাস্তাটি নদীর মত বাঁকা
সন্তান ও সন্ততিতে ভাঙা
এবং একা।

পাঞ্চজন্য বৃক্ষের ছায়া পড়েছে ওইখানে
হলদে পাতা মড়া ফুল ও খয়েরি করবী ফল
ঝরে – ঝরেছে মঞ্জরী মুকুলের ডানা সহ
আর ত্রিশূল ধাতুর তারে জড়ানো লতার দুল
অসংখ্য – অসংখ্য।
কোনদিন কাউকে যেন বলেছি
ওই, নগরের একটি মানব পথ
নীল ও সোনালি রঙ আকাশের দিকে
উড়ে যাওয়া চিলের মুখে নিমফল
ব্যথা আর বিশ্বাসের রাঙা মেঘ –
দুইজন তরুণ তরুণী
তখন হয়ত বাস থেকে নামে, থামে কিছুক্ষণ
এবং তখনো নেপথ্যে একটি গান নদীর মত
বাঁকা
সন্তান ও সন্ততিতে ভাঙা
এবং একা।

আমি তোমার সাথে বেরিয়েছি, বেরিয়েছিলাম বাতাসে
আমাদের সামগ্রিক চিত্ত পেয়েছিলো
বৃক্ষার্ঘ্য লতানো দুলের সৌগন্ধ মধু মধু
আর প্রথম চুম্বনের মত হাওয়া, তোমার প্রথম চুমু।
তারপর কান্নার জল তোমার, বনের পাতার মত
অবিরাম ঝর্নাজলে ভেসে ভেসে গেল
আর আমার আনন্দ হলো – আনন্দ আনন্দ
কিন্তু তখনো একই গান নেপথ্যে নদীর মত
বাঁকা
সন্তান ও সন্ততিতে ভাঙা
এবং একা।


               ঢাকার বেশ কিছু ছোটকাগজে মুদ্রিত হয় বিষ্ণুর কবিতা। ইতোমধ্যে বিষ্ণু অনেকটা বোহেমিয়ান হয়ে ওঠে। অনিয়ম, নেশা আর কবিতা; সবকিছু একাকার হয়ে উঠলে কবি যেন বা কিছুটা হোঁচট খান। প্যাপার-ব্যাকে ছাপা ‘ভোরের মন্দির’-এর নিশাত জাহান রানা-র প্রাককথন থেকে বিষ্ণুকে দেখতে পাই, ‘পকেটে টাকা জমিয়ে রাখা ছিল ওর স্বভাববিরুদ্ধ। এমন কি ধার করা টাকাও মুহূর্তে উড়িয়ে দিতে ভালবাসত। অকারণ অন্যের জন্য টাকা ব্যয় করতে ভালবাসত। যখন নিজে প্রচণ্ড আর্থিক সংকটে পড়ল তখনও কিছুমাত্র পাল্টায় নি সে স্বভাব। এই ছন্নছাড়া জীবন যাপন অনেক বন্ধুকে কি একটু দূরেও ঠেলে দিয়েছিল তখন!’

               এই সময় ঢাকার ১১২ মনিপুরী পাড়া থেকে তাজুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশ পেতে থাকে সাম্প্রতিক তরুণদের সাম্প্রতিক কবিতা পত্র ‘নদী’। ‘নদী’র চতুর্থ সংখ্যা প্রকাশ পায় জুন ১৯৯০; এই সংখ্যায় বিষ্ণুর ৭ অংশের একটি দীর্ঘকবিতা ছাপা হয়; শিরোনাম, ‘শতাব্দীর গান’। পত্রিকার শেষে কবি মাসুদ খান, ব্রাত্য রাইসু, বায়েজীদ মাহবুব, আহমেদ নকীব, কফিল আহমেদ, ফরিদ কবির, জুয়েল মাজহার, আদিত্য কবির, সৈয়দ তারিক, শাহেদ শাফায়েত ও শামীম কবীর এর পাশাপাশি কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের পরিচিতিতে লেখা হয়, ‘প্রায় বছর তিনেক আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক হয়ে গতবছর ঢাকায় এসেছেন। রাজশাহীতে ‘পেঁচা’ নামে একটি ছোট পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। বিনয়ী ও বাহির থেকে বেশ সহনশীল। সুন্দর করে কথা বলেন, গলার স্বর চমৎকার। তার ঘরের দেয়ালে গোলাপী রং দেখে তার সম্পর্কে তীব্র রোমান্টিকতার ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ছোট পত্রিকা ভিন্ন অন্যত্র লিখবেন না। মাঝে মাঝে ধোঁয়ায় ঊর্ধ্বলোকে চলে যান।’

              ঢাকার মীরপুর থেকে তপন বড়ুয়া-র সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘গাণ্ডীব’ পত্রিকা বাংলাদেশের আটের দশকের সাহিত্যক্ষেত্র নির্মাণে উল্লেখযোগ্য একটি নাম। তপন বড়ুয়া নিজে লিখতেন না; কিন্তু তার হাতে তৈরি হয়েছে এই সময়ের গুটিকয়েক প্রতিভা। বিষ্ণু বিশ্বাসের জায়গা জুটেছিল ‘গাণ্ডিব’ এর পাতায়। ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল ১৯৯০ এ প্রকাশ পায় গাণ্ডিবের চতুর্থ সংখ্যা। এখানে বিষ্ণু বিশ্বাসের ‘আকাশগঙ্গা’, ‘প্রজন্ম’, ‘প্রেমপত্রের খসড়া’ – এই ৩টি কবিতা এবং ১৯৯১ এর অক্টোবর-ডিসেম্বরে প্রকাশিত ৬ষ্ঠ সংখ্যায় ছাপা হয়, ‘বলবার ছিল’, ‘ঈশ্বরের জন্ম জন্মান্তর’, ‘ভয় শেষে’, ‘অওদিপাউস’, ‘তরুণ কবি’, ‘গল্পের কুমার’, ‘জয়’ – এই ৭টি কবিতা। এ কবিতাগুলোর সবগুলিই গ্রন্থভুক্ত করা হয়েছে।


                 বিষ্ণু বিশ্বাসের সাথে আমার পরিচয় ১৯৮৮ এর শেষ দিকে; তখন শীত ঋতু। বিষ্ণুদার হাতে ‘পেঁচা’। আমার হাতে ‘পেঁচা’-র একটি সংখ্যা ধরিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি সেইদিন। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। ইংরেজি বিভাগে ছিলেন আমার চেয়ে ৩/৪ বছরের সিনিয়র, কফিল ভাই। কবি কফিল আহমেদ; এখন কবিতা লেখেন না, ফোক-ভোকালিস্ট। কফিল ভাইয়ের হাত ধরে সাভার থেকে অর্থাৎ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে ঢাকার শাহবাগের কবিতাপাড়ায়; সেই কবিতাপাড়ায় বিষ্ণু বিশ্বাসের মায়াচোখে আটকে রইলাম পুরো শীতঋতু; কবিতা তখন আমার জন্য উড়ালবিদ্যা। ঠিক করলাম পত্রিকা করবো। কফিল ভাইয়ের হাতে লেখা ‘কারুজ’ শব্দটি কাঠে খোদাই করে কবি আবিদ আজাদের লেটার প্রেসে পত্রিকার প্রচ্ছদ ছাপা হলো। ৫৪ পাতার পত্রিকা প্রকাশ পেলো ১৯৮৯ এর জুলাই-সেপ্টেম্বরে, আমার সম্পাদনায় ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে। এই পত্রিকা প্রকাশের সাথে কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতাবিশ্বাস আর উষ্ণতা জড়িয়ে রয়েছে। বিষ্ণু-র কবিতা ছাড়া পত্রিকা সম্ভব নয়। অথচ বিষ্ণু-র হাতে কোনো অপ্রকাশিত কবিতা নেই। ক্রমশ পত্রিকা প্রকাশ পিছিয়ে যেতে থাকলো। ক্রমশ বিষ্ণু-র আত্মগত কণ্ঠের জাদুশব্দে ডুবে যেতে থাকলাম; তারপর একদিন গ্রীন হোটেলের সরু কক্ষে বসে আমার জন্য লিখলেন ১৬ লাইনের ‘নীল কৈ’ কবিতাটি। আমার হাতে তার হাতে লেখা কাগজটি ধরিয়ে দিলেন। কোন কপি রাখলেন না। অথবা এ বিষয়ে কিছুই বললেন না। এবং আমি পরে বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি এ কবিতাটির কথা ভুলে গিয়েছেন। এক সপ্তাহ পরে আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে তার সাথে পুরো সন্ধ্যা বসে থাকলাম; আমি জানতাম আজ বিষ্ণুদা আমাকে আরো একটি নোতুন কবিতা দেবেন; এবং দেবেন একাধিকবার প্রকাশিত তার সবচেয়ে প্রিয় কবিতা ‘ভোরের মন্দির’; যে কবিতাটির ১৬১টি লাইন বিষ্ণুদা আমাকে বেশ কয়েকবার শুনিয়েছেন স্মৃতি থেকে। এই কবিতার ৩য় এবং ৪র্থ অংশটুকু ‘বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা’ শিরোনামে কোনো অংশ না রেখে টানা ছাপতে বলে দিলেন বিষ্ণুদা; সেইসাথে নোতুন কবিতা ‘পথে পথে পাথর’; এই কবিতাটিরও কোনো কপি তিনি রাখেন নি। উল্লেখ্য ‘নীল কৈ’ এবং ‘পথে পথে পাথর’ কবিতা দুটোর কোনো উল্লেখ বিষ্ণু বিশ্বাসের ‘ভোরের মন্দির’ এ নেই। ‘কারুজ’ এ ছাপা হবার ১৫ বছর পর কবি সুমন সুপান্থ তার ‘স্রোতচিহ্ন’ পত্রিকার ৩য় সংখ্যায় ২০০৫ এর জানুয়ারিতে কবি বিষ্ণু বিশ্বাসকে স্মরণ করেছেন। তিনি তার পত্রিকার জন্য ‘কারুজ’ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন ‘নীল কৈ’ এবং ‘প্রসূন’ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন ‘হাওয়া’ কবিতা। গ্রন্থভুক্ত না হওয়ায়, আজ পঁচিশ বছর পর আমি বিষ্ণু বিশ্বাসের ‘নীল কৈ’ এবং ‘পথে পথে পাথর’ কবিতা দুটো উপস্থাপন করছি।
 বন্ধু জামালের সাথে বিষ্ণু বিশ্বাস ( ডানদিকে )/ বিষ্ণু বিশ্বাসের মায়ের কাছ থেকে সংগৃহীত 



নীল কৈ

গল্পের শেষ ওরকমটি ছিল না মোটেই, তোমার মনে নেই।
সেদিন ছিল রাত্তির জ্যোৎস্নার – শোনো, আবার বলি
সেদিন ছিল রাত্তির জ্যোৎস্নার। জোনাকীরা কেন যে
হঠাৎ আন্দোলনের মত উথাল পাথাল কেঁদেছিল
যদিও আমারও আজ মনে পড়ে না।
চৈত্রের মাঠ গেলো ডুবে তাদের কান্নার জলে
কোথা থেকে ভেসে এলো শত শত নীল কৈ
তাদের নীল ডানা আর নীল দৃষ্টি জ্বলে, জলের ভিতরে
আমি তুমি আর আরো বহু কথা কয়নি কোনো
সেদিন গেয়েছি গান – সমুদ্রের আকাশের আগুনের।
অন্তত তুমি এবং আমি না জেনে –
কী সম্পর্ক সমুদ্রের আর আকাশের এবং আগুনের।
তারপর থেমে গেল জল – কান্নার – জোনাকীর
জেগে উঠল ভূমি।
এরপর বহুদিন, বহুদিন আমরা গান গাইনে কোনো
শুধু গল্প করি – নীল কৈ, নীল কৈয়ের।


পথে পথে পাথর

যখন মরেছি বৃক্ষে দড়ি বেঁধে, আমাকে নামায়
পালকের হাওয়ায় – করে কী আমার সৎকার!
বায়ুজীবী তারা, দেহ রক্তহীন, ঠোঁটে তীক্ষ্ণধার –
যেন ধূলির ঐতিহ্য পুনর্স্থিতি পেয়েছে পাখায়।
শেষকৃত্য যেন তাই পুনরুদ্ভূত ধূলির ভেড়ি
অথবা, কিছুই না; লুপ্তির বিরুদ্ধাভাসে যেইমূর্তি –
বিস্মৃত পথের রেখা। পদ্ম পাতায় জবা সন্ন্যাসী
আনে চন্দনের বনে। আনে যে চন্দন-খড়ি
ভাসায় ডুবায় তারা – ভাসে যেন হলদে জাহাজ
হরিদ্রাভ জলে, নীল পাখি ফেরা কালো চর
পেরিয়ে রক্তের জল পেয়েছে পাথর পোতাশ্রয়
আর পাথরের ঘর – সে আমার নিশ্ছিদ্র আশ্রয়।
তবু ভাবি, পাবে কালো হাড় সে বধির যাদুকর
গ্রামের প্রান্তে যেই না হাট গমগম – পড়ে শত বাজ!


                কবি বিষ্ণু বিশ্বাস কি স্বাধীন ছিলেন? কতটুকু স্বাধীন ছিলেন নিজের কাছে; অথবা পারিপার্শ্বিক সময়ের কাছে? তার কবিতার মনোদৈহিক স্তর বিবেচনা করলে, এখানেও রহস্য; বিস্মৃত পথের রেখা; কবির শেষকৃত্য কবি নিজেই রচনা করেন শেষাবধি আশ্রয় খোঁজেন পাথরের ঘরে; তারপর জাদুকর কালোহাড়ের জাদুতে জনসমাগমকে অস্বীকার করলে শত শত বাজ কবির মস্তিষ্ককোষে আক্রমণ রচনা করে। আর তখন বাবরি মসজিদে হামলা হলে কবি প্রথমত অরক্ষিত হয়ে ওঠেন নিজের কাছে; অতঃপর আতংকগ্রস্ত। শিল্পীর চূড়ান্ত রক্ষক, ‘স্বাধীনতা’। সেই স্বাধীনতা শিল্পীর উপলব্ধির বিবর্তন ঘটায়। আর যদি এই বিবর্তন না ঘটে, তা হলে অযথাই প্রকৃতির অনুকরণ, প্রাচীন শিল্পের অনুকরণ অথবা ব্যক্তিত্ববিকাশে শিল্পী পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য; যা আত্মহত্যাতুল্য। বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা পাঠে অবশ্যই মেনে নিতে হবে তিনি প্রাচীনতাকে অনুকরণ অথবা অযথাই প্রকৃতিকে প্রতিচিত্রায়িত করেননি বরং তার কাব্যের টেকনিকের অন্তরালে রয়েছে কবির ব্যক্তিক-বিকাশ; যা সমাজের অমীমাংসিত রহস্যের সংকটে ক্রমশ যন্ত্রণা-উন্মুখ। সুতরাং আমরা বিশ্বাস করতাম জীবনানন্দ দাশ কর্তৃক তাড়িত হলেও জীবনানন্দের পরবর্তী কবিতা-স্কুলের প্রতিষ্ঠা ঘটতে যাচ্ছে বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা-ব্যক্তিত্বের বাস্তবতায়। অথচ বিষ্ণু ক্রমশ আতংকগ্রস্ত। সে দেখতে শুরু করলো একটা ধবধবে সাদা গাড়ি তার দিকে তেড়ে আসছে; উলঙ্গ চাকু হাতে কেউ একজন ওকে তাড়া করছে। বিষ্ণু-র চোখে আতংক; ভীতিবিচলিত বিষ্ণু আশ্রয়ের জন্য ওর প্রিয়জনের ওপর আস্থা হারাতে শুরু করেছে। বিষ্ণুকে মনোচিকিৎসকের কাছে নেওয়া হলো। আমরা হতবিহ্বল-বিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম, বিষ্ণু সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত। তারপর যখন মাসখানেক পর, ডাক্তারের পরামর্শ মত বিষ্ণুকে বন্ধুবান্ধবদের সারবক্ষণিক নজরদারির সীমানায় আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি করা হল; এবং কবি তখন সূস্থ্য। অথচ, অতঃপর একদিন আমরা আবিষ্কার করলাম বিষ্ণুকে ঢাকা শহরের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেন? বিষ্ণু কি কোনো প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে নিরুদ্দেশ? বিষ্ণু-র কি কোনো প্রিয়জন ছিল? ছিল অবশ্যই। এইভাবে দিন আর রাতের ফাঁকে একদিন শোনা গেলো বিষ্ণুকে ঝিনেদায় দেখা গেছে। অথচ কোথায়?

               তারপর বহু বহু দিন, আমরা সেইসব দিন আর রাত্রির ষড়যন্ত্রের ভেতর আটকে আছি। শিল্পের জগতে তখন এমন এক সময়, যে সময়ে আমরা অবিশ্বাস ঘৃণা আর অনাস্থা নিয়ে নিজেকে টেনে লম্বা করতে ব্যস্ত। আর তখন স্বৈরাচারের পতন যখন নিশ্চিত করা হল তখনও বিষ্ণুকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কবিতাপাড়ায় ততদিনে নয়ের দশকের প্রতাপ ও বিভ্রান্তি; শূন্যের দশক ঘৌড়চিৎকারে দশক অতিক্রমের আগেই দখলদারি নেশায় গোটা অতীতকে যেন বা, হয়তো বা অগ্রজদের পরিচয় বাহুল্য জ্ঞানে আমাদের অনুজগণ বিষ্ণু-র মতো আটের দশকের গুটিকয়েক অসম্ভব মেধাবী যুবাদের ছবি ভুলে গিয়ে কবিতাকে এথলেট শিল্পে, করপোরেট লাইফের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার তাড়নায় মঞ্চকালচারে মেতে উঠলে, আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিতে বাধ্য হলাম, কবিতা কোনো পারফর্ম-যোগ্য শিল্প নয়; কবিতা একান্ত জীবনের আত্মগত পাঠ; যা বোধ ও প্রজ্ঞার মিশ্রণে তৈরি অহমের বিকল্পহীন অনিবারয মানসখাদ্য।

                অতঃপর একদা শূন্য দশকের শুরুতেই শুনতে পেলাম, কবি বিষ্ণু বিশ্বাসকে কলকাতার কাছাকাছি কোথাও দেখা গেছে; পট্টবস্ত্র পরিধানরত অবস্থায়। আত্মমগ্ন ধ্যানী অথবা উম্মাদ; অথবা মেডিক্যাল সাইন্সের পরিভাষায় সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত। অথচ কবিতার প্রজ্ঞায় কবি তখন অনুসন্ধানরত। অসাম্প্রদায়িক জীবনকে বুকে আগলে রাখার প্রাণান্তকর অনুসন্ধান। অনুসন্ধানরত কবি তখন সমস্ত প্রকার সামাজিকতার ঊর্ধ্বে; গোটা সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কবির কবিতা ছাপা অক্ষর ছাপিয়ে উচ্চারণ করছে,

কোথা থেকে যেন শক্তি আসে
জীবিতের মতো শক্তিশালী
অনেক তৃ্ষ্ণা আমার কারণের ও জলের
সরস্বতী –
তোমার জ্যোতিশ্রী রূপে রূপের রহস্য
বীণায় তোমার
গান বাজে তারাদের।
আর আমি
তোমার আলোর দিকে যেতে যেতে
ঊর্ধ্বলোকে
তোমার আগুনে ভস্ম
আর পুনর্জন্মে আমি
যেন সর্ষে ফুলের মতো হলদে।
তোমার জ্যোতির শাদা পোশাকের অন্ধকারে
লক্ষ করি অসম্ভব স্তন তখন – লাবণ্যময়
সমুদ্র-পাথর নির্মিত শরীর
মধুময়।
সরস্বতী
অনেক তৃষ্ণা আমার কারণের ও জলের।
জানি আমি
তোমার বিরহী শরীর সমুদ্রগামী
এসো তবু আপাত অন্ধকারে শয্যায়
মৃদুজল ও কারণ তোমারও দরকার
শীতার্তের মতো চেয়ে থাকো তুমি বসন্তের দিকে –
মর্ত্যলোকে।
পারি আমি
আমিই তোমাকে সমুদ্রে ভাসাতে
তারপরে
যদি সামর্থ্য থাকে আবার এসে উঠে
মণ্ডপে আর শয্যায় –
আমরা জন্ম দেবো ভূমি এবং অতল।
(সরস্বতী/বিষ্ণু বিশ্বাস)


দুই. আলোচনার সূচনা

         ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কবি ওয়ালী কিরণ ‘ক্রম’ পত্রিকার ৪র্থ বর্ষ ১ম সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকার প্রধান আয়োজন ছিল আটের দশকের বাংলা কবিতার গতিবিধির তত্ত্ব-তালাশ করা। মূল প্রবন্ধ লেখার দায়িত্ব নিয়েছিলাম আমি। প্রবন্ধটি কাটছাট করে যখন ছাপা হল তখন তা ৬২ পাতায় আটকে ছিল। সেখানে আমি বিষ্ণু বিশ্বাসকে নিয়ে প্রথম আলোচনা করি। আলোচনার যৌক্তিকতা ছিল, আমরা ইতোমধ্যে বুঝে নিতে বাধ্য হয়েছি, বাংলা কবিতার বাঁক পরিবর্তনে আটের দশক একটি চিহ্নিত ও দৃষ্টিগ্রাহ্য সময়। এই পরিবর্তনশীল সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে যে কজন তরুণ কবির হাতে বাংলা কবিতা মোড় নিতে শুরু করেছিল তার ভেতর বিষ্ণুকে বাদ দিয়ে আলোচনা শুরু করা সম্ভব নয়। ‘ক্রম’ পত্রিকায় বিষ্ণুকে নিয়ে আলোচনার কয়েকটি সূত্র, ‘‘আবুল হাসান যেখানে বললেন, ‘ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তো ফলাও!’ সেখানে পরবর্তী প্রজন্ম আশির দশকে এসে উচ্চারণ করলো:

আর দ্যাখো, অগ্নি
চিতায় পুড়ছে শঙ্খের চাবুক
চিতা পোড়ে দাও দাও।
আর দুগ্ধপোষ্য শিশু বিধবা ঝলসানো পাঁচজন কৃষিকার
চোখের কোটরে আগুন এখনো একটু একটু জ্বলে
গেয়েছিলো ওরা
অগ্নিশুদ্ধির গান সারারাত সারা দুপুরবেলা।
(বিষ্ণু বিশ্বাস এর কবিতা)


ষাট এর কবিদের ধারাবাহিকতায় আবুল হাসান আত্মবিশ্লেষণে সচেতন হলেও তাঁর আত্মদর্শন উপস্থাপনগত কৌশলে ভিন্ন মাত্রা পেয়ে যায়। আর বিষ্ণু বিশ্বাসের আত্মবিশ্লেষণে এসে যোগ হয় সমষ্টিচেতনা, যে চেতনার ভিতর পুড়তে থাকে মানুষের অভিজ্ঞতার দহন। সুতরাং শঙ্খের ধ্বনি নয় বরং শঙ্খের চাবুকে তিনি পোড়াবেন দেহ, সুতরাং চিতা পুড়ছে দাও দাও আর ভিতরে ভিতরে কৃষিজীবীদের সঙ্গীত, আত্মশুদ্ধির সঙ্গীত, যে সঙ্গীত দুগ্ধপোষ্য শিশুদের নিশ্চিত নিরাপত্তাই নিশ্চিত করে; সূচিত করে চিরন্তন সংগ্রাম আর অপ্রাপ্তির রক্তক্ষরণ।’’


বিষ্ণু বিশ্বাসের সময়ে যে কজন তরুণ কবি আমাদের প্রত্যাশা ক্রমাগত জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছিল তাদের মধ্যে বিষ্ণুকে যৌক্তিক কারণেই পৃথক করা সম্ভব:
১.
তার কবিতার টোন এবং মেজাজ তাকে সমকাল থেকে পৃথক করে রেখেছে। তার কবিতা মৃদু অথচ তীব্র; এবং তা এতটাই জীবনঘনিষ্ট যে সেখানে কবিতার কুহক নেই বরং আছে কবিতার মায়া; যে মায়া আমাদের সন্মোহিত করে; ক্রমশ ডুবিয়ে রাখে জীবনের সীমাহীন অমীমাংসিত প্রশ্নে।
২.
তার কবিতার শব্দ মৃদু, সংখ্যায় অল্প অথচ সহসা অব্যবহৃত ও অর্থ-আগ্রাসী; বর্ণনা ধীর ও হ্রস্ব; ফলে লাইন ছোট ও কমপ্যাক্ট। প্রায় বিরামচিহ্নবিহীন প্রবাহমান ছন্দের ধীরস্রোতে স্বচ্ছ অথচ রহস্যমুখর। নির্মাণ নয়, কৃত্রিমতা ও আঁতলামো বর্জিত; শব্দে শব্দে সূদৃঢ় বন্ধন, ধারাবাহিক ও লক্ষ্যাভিমুখি, গন্তব্য বিদ্যমান; ফলে পাঠ-উত্তর পাঠকের প্রাপ্তিযোগ ঘটে।
৩.
ভাষার কাঠামো-নির্ভরতা অপেক্ষা বিষ্ণু অধিক গুরুত্ব রাখেন ভাষার অর্থময়তার প্রতি; ফলে দৈনন্দিন বস্তুজগৎ আশ্রিত ঘটনাবলীর চিত্রায়ন ও জীবন-জগতের সৃষ্টিরহস্য বিষয়ে দার্শনচেতনায় বিবিধ অনুষঙ্গের সূচনা লক্ষ্যযোগ্য; এক্ষেত্রে কবিতার বহু ব্যবহৃত কাঠামো-খোলসকে অস্বীকার করে কবি কবিতার পৃথক পোশাকে উপস্থিত হন; অথচ এই উপস্থিতিতে চটুল কোনো নৃত্য নেই; বরং সেখানে রয়েছে গভীরতার যাত্রাপথ উন্মোচন-প্রক্রিয়া।
৪.
বিষ্ণু বিশ্বাস তার কবিতায় প্রাত্যহিক নন্দনপ্রিয়তাকে খুব সচেতন ভাবেই প্রত্যাখ্যান করেন; ফলে কবিতায় জন্ম নেয় এক ধরনের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া; যেখানে লুকিয়ে থাকে প্রতিবেশের প্রতি অনাস্থা ও ক্ষোভ; সুতরাং প্রচল কবিতারীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দূরূহ; বিপজ্জনক পথে বিষ্ণু কবিতার পদবিন্যাসকে মুক্ত করে দেন এবং ঝুলে থাকেন তীক্ষ্ণ সুতোর ওপর।


তিন. আত্মপক্ষ সমর্থন

          বর্তমান আলোচনায় উপস্থাপিত বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতার উদাহরণসমূহ ‘আলোচনার সূচনা’ অংশে উল্লিখিত সার-মন্তব্যের সমার্থক। বলা বাহুল্য এক্ষেত্রে বিস্তর ব্যাখার অবকাশ রয়েছে; এটি আলোচনার সূচনা মাত্র; যা অন্যত্র পৃথক আলাপচারিতায় সম্পন্ন করার ইচ্ছা রাখি। বর্তমান আলাপচারিতায় অবকাশ নেই বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতার প্রতিটি লাইন ধরে ধরে মন্তব্যের যৌক্তিকতা মিলিয়ে নেওয়া। কেননা আমার আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল এখন থেকে ২৫/৩০ বছরের আগের যে সময়টি বিষ্ণু অতিক্রম করে এসেছেন আমাদের বাংলাদেশে; সেই সময়ে তার যপিত জীবন, কবিতা লেখার দৈনন্দিকতা, পত্রিকা, কবে কোন পত্রিকায় কোন লেখাটি ছাপা হয়েছিল, কোন কবিতাটি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না, সেই কবিতাটি উদ্ধার করে উপস্থাপন করা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আমি এমনতর দৈনন্দিকতার ওপর একটু গুরুত্ব দিচ্ছি এই কারণে যে, আজ এত বছর পর বিষ্ণুকে নিয়ে ‘অচেনা যাত্রি’ যে আয়োজন করেছে সেখানে বিষ্ণু-র প্রতিটি তুচ্ছ বিষয়ও যাতে লিপবদ্ধ করা হয়ে ওঠে, সেদিকে নজর রাখা। বিষ্ণু-র টেক্সট নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তর বয়ান সম্ভব, কিন্তু তার দৈনন্দিকতাকে এখন ধরে না রাখলে তা দ্রুতই হারিয়ে যাবে। আমরা চাই বিষ্ণু বিশ্বাস সময়রেখা থেকে হারিয়ে না যান; অথবা শেষাবধি তিনি দ্রুত অর্থহীন হয়ে ওঠেন এটিও আমাদের প্রার্থিত নয়। পৃথিবীতে এই এতো এতো রহস্যের ভেতর বিষ্ণু-র মতো ওতটা মেঘগভীর বিস্ময় নিয়ে আমরা আমাদের সময়কে দেখতে না পেলেও বিষ্ণু-র কবিতা আমাদের সেই রহস্যে ঘেরা গভীরতার ভেতর ঠেলে দেয়,
‘ধীরে প্রভাত হলো। পাখির মধুর আলাপ আরম্ভ হলো। সূরয উঠল। আমাদের রাতটি সূরযের স্বপ্নের মধ্যে উজ্জ্বল হতে হতে ধীরে নিভে গেল।’ (গীতসুধার তরে/বিষ্ণু বিশ্বাস)

অতঃপর, অপূর্ণাঙ্গ জীবনের যন্ত্রণাকে ভুলে থাকতে, অহম শান্তি…! আর তখন আমাদের প্রতিটি রাত প্রত্যেকটি দিনের উজ্জ্বলতায় ক্রমশ নিভে যেতে থাকলে আমরা আবারও কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের মুখোমুখি হই।






. বানান সংশোধনযোগ্য তবে উদ্ধৃতি সংশোধনযোগ্য নয়
. ফন্ট জটিলতার কারণে যে পদসমূহ সংশোধন করতে হবে তা লাল কালিতে মূল পাঠে চিহ্নিত করা হয়েছে। পদসমূহ এখানে উল্লেখ করা হলো পাশাপাশি ভিন্ন ফন্টে তার সংশোধিত রূপ দেওয়া হলো:

1. সৌন্দযের সৌন্দর্যের
2. সূয সূর্য
3. নিরবেদ         নির্বেদ
4. সূয                  সূর্য
5. সারবক্ষণিক   সার্বক্ষণিক
6. অনিবারয অনিবার্য
7. সূরয                 সূর্য
8. সূরযের             সূর্যের

মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
অসাধারান,আমি মুগ্ধ,হারিয়ে যাওয়া একটা তারার খোঁজ পাওয়া গেলো।আমিত দা এবং সমস্ত লেখক দের কে ধন্যবাদ।
Unknown বলেছেন…
অনেক ভালোবাসা আপনাকে। আমাদের সঙ্গে থাকুন। ভালো থাকুন।
Unknown বলেছেন…
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
Unknown বলেছেন…
ভাই শিমুল মাহমুদ, কবি বিষ্ণু বিশ্বাসকে নিয়ে আপনার লেখাটা যখন পড়ছি তখন 'ভোরের মন্দির' বইটি আমার সামনে। আপনি যেসব কবিতা বইয়ে অর্ন্তভুক্ক হয়নি বলেছেন সবগুলোইতে দেখছি আছে। বুঝতে পারলামনা এরকম ভুল কীভাবে হলো।