“জীবন এত ছোট কেনে”
দেবশ্রী ভট্টাচার্য
তারাশঙ্করের ‘কবি’-র মতো এই প্রশ্নের উত্তর আজো কেউ পায়নি। জীবন ছোটো, জীবনে ভালোবাসার আর ভালোলাগার সময় আরো অল্প। রোজকার টানাপড়েনের জীবনে আমরা খাই, ঘুমোই, বেঁচে থাকার জন্য অর্থ উপার্জন করি, সম্ভোগ করি,দরকারে আত্মরক্ষাও করি। কবিগুরুর ভাষায়, "এই সীমাটুকুর মধ্যে জন্তুর সঙ্গে মানুষের প্রভেদ নেই। প্রভেদ হয় তখনই যখন মানুষ লাভ লোকসানের হিসেব ভুলে ‘খুঁজে নিতে চায়, নিজের একান্ত নিজের ‘আকাশমণ্ডল’। কিন্তু আজকের এই দ্রুতগতির সভ্যতায়, মানুষ সত্যিই কি সেই অবকাশ পায়, যে অবকাশে সে তার ‘নিজস্ব আকাশমণ্ডল’ খুঁজতে বসবে?"
হ্যাঁ পায়,পেতে তো তাকে হবেই। জলের ধারা যেমন হাজার হাজার পাথরের বাধাকে অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে নেয়,মানুষের মনের অনুভূতিও তেমনি তার হাজারটা কাজের মধ্যেও খানিক অকাজের (?) জন্যও সময় খুঁজে নেয়। কারণ এই ‘অকাজ’-গুলোই যে তাকে মুক্তির আস্বাদ দেয়।তবু সময় যে বড়ো কম। তাই বিবর্তনের ধারা মেনে মানুষ তার আকাশমণ্ডলকে খানিক ছোটো করে নিয়েছে। সপ্তকাণ্ড রামায়ণ বা বৃহদাকার মহাভারত লেখার সময় আধুনিক কবি-লেখকদের নেই। তার চেয়েও বড়ো কথা, তা পড়ে শেষ করার মতো ধৈর্য এখনকার পাঠকদের হয়তো নেই। তাই মহাকাব্য ছোটো হতে হতে অণুকাব্য হয়ে গেছে। আর উপন্যাস ছোটো হতে হতে অণুগল্প হয়ে গেছে।
অনেককিছুই তো দিন দিন ছোটো হয়ে যাচ্ছে। আগে ধ্রুপদী শিল্পীরা একটি রাগ পরিবেশন করতেন অন্তত ঘণ্টা দুয়েক ধরে। তার চেয়েও বেশি সময় হয়তো হয়ে যেত। গায়ক বা শ্রোতার কারোরই কোন বিরক্তি প্রকাশ পেত না। আর আজ সেইসব রাগ পাঁচ সাত মিনিটের রাগপ্রধান গান হয়ে গেছে। পাঁচদিনের টেস্ট ক্রিকেট এখন চল্লিশ ওভারের বিনোদন হয়ে গেছে। তবে আর গল্পের দোষ কী! যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগের প্রয়োজনে সেও তার আয়তনকে খানিক খর্ব করে নিয়েছে।
সভ্যতার সূচনা থেকেই মানবশিশু গল্প শুনছে। সারা পৃথিবী যখন হিম-শীতল শুভ্রতায় আচ্ছন্ন , মানুষের যখন ভাল করে কথা ফোটেনি, লিপি আবিষ্কৃত হয়নি, তখন থেকেই মানুষ গল্প শুনছে। কাব্য সভ্য মানুষের প্রাচীন সাহিত্যকীর্তি। কিন্তু গল্প তারও আগে থেকে আছে। দু'লক্ষ বছর আগে হাইডেলবার্গের গুহায় বসে মানবশিশু তার দিদিমার কাছে গল্প শুনত-- এমন গুহাচিত্র দেখা যায়। প্যালিওলিথিক যুগের মানুষের মধ্যে প্রচলিত কিছু কিছু গল্পের অস্তিত্ব আজো বেঁচে আছে। এইসব গল্পের অধিকারী ছিলেন দলের নেতৃত্ব স্থানীয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। প্রাকৃতিক বা আধিদৈবিক বিপদ কাটাবার জন্য তারা এইসব গল্পের অবতারণা করত।
তখনকার পৃথিবীতে মানুষ ছিল অসহায় দুর্বল। ডাইনোসরাস, ম্যামথ – প্রভৃতি অতিকায় শক্তিশালী প্রাণীদেরই ছিল আধিপত্য। এদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তখনকার মানুষদের বাঁচতে হত। আদিম মানুষের সম্বল বলতে ছিল তার ক্ষীণ অপরিপক্ক বুদ্ধি। কোনো মানবগোষ্ঠীর ওপর এইসব হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ হলে বা ঝড়, বজ্রপাত, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ প্রভৃতি বিরুদ্ধ প্রাকৃতিক শক্তির আক্রমণ হলে দলের নেতৃত্বস্থানীয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দল পরামর্শ দিত, কী করে বুদ্ধির জোরে এই সকল আক্রমণ প্রতিহত করা যায় । এর থেকেই সূত্রপাত হয়েছে উপকথা বা ‘fables’ –এর। এইসব উপকথায় দেখানো হয়েছে কীভাবে অল্প শক্তিসম্পন্ন অথচ বুদ্ধিসম্পন্ন খরগোশ,শেয়াল শুধুমাত্র বুদ্ধির জোরে হিংস্র বিশালকায় বাঘ, সিংহ, হাতিকে হারিয়ে দিচ্ছে।
এইসমস্ত ‘fables’- কে অণুগল্পের জনক বলা চলে। তবে একটা কথা ঠিক, এই সব লোকায়ত গল্পের ধারা সুদীর্ঘকাল ধরে প্রবাহিত হলেও এরা কখনোই সত্যিকারের সাহিত্যের মর্যাদা পায়নি। ভারতেও জাতক , কথাসরিত, পঞ্চতন্ত্র –প্রভৃতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু দেবভাষা সংস্কৃতে এদের প্রবেশাধিকার ছিল না। জাতক রচিত হয় পালিতে, কথাসরিত পৈশাচী প্রাকৃতে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গবেষক ডঃ শিশির কুমার দাস বলেছেন- “বাংলায় রবীন্দ্রনাথের হাতে ছোট গল্পের সূত্রপাত হবার আগে গল্পের যে তিনটি প্রধান ধারা ছিল তা হল চূর্ণক, আখ্যানক এবং ক্ষুদ্র উপন্যাস।" চূর্ণক বলতে তিনি বুঝিয়েছেন সেইসব হাস্যরসাত্মক ছোটো ছোটো গল্প যাকে সৈয়দ মুজতবা আলী আখ্যা দিয়েছেন ‘চুটকিলা’ হিসাবে। গোপাল ভাঁড়,বীরবল প্রভৃতির নামে যে রসিকতাগুলি আমাদের কাছে ছড়িয়ে আছে, সেগুলোই এই ‘চূর্ণক’ বা চুটকিলা। এইগুলোই এখনকার বাংলা অণুগল্পের আদিরূপ।
তবে চূর্ণক ,চুটকিলা বা fables – এইগুলো থেকে অণুগল্প অনেকটা আলাদা। অণুগল্প কিন্তু শুধুই হাসির খোরাক নয়। অথবা খানিক নীতিকথাও নয়। অণুগল্প হল একটি দুটি টানে আঁকা মানুষের জীবনের ছোট্ট অতি ছোট্ট চিত্র। জীবনের চলার পথে কিছু কিছু ছোট্ট জিনিস আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। উপন্যাসের বিশাল প্রান্তরে তারা হারিয়ে যায়। আর ছোটোগল্পের ছোট্ট পরিসরে তাদের জায়গা হয় না। অণুগল্প সেইসব ঘটনাকে আধুনিক মানুষের দরবারে নিয়ে আসে।
বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে না হলেও উদ্দেশ্যের দিক থেকে অণুগল্প কিন্তু তাঁর পূর্বসূরিদের পথই অনুসরণ করেছে। চূর্ণক, চুটকিলা,fables –এইগুলোর প্রত্যেকটিই একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে রচিত। প্রত্যেকটিই শেষে একটা কিছু বলতে চায়। একটা কিছু বলার উদ্দেশ্যেই তার জন্ম হয়। অণুগল্পও ঠিক তেমনই হয়তো কোনো সামাজিক ক্রুটি কিংবা এক শ্রেণির মানুষের করা কিছু ভুলগুলোকে সবার সামনে আনাই এর উদ্দেশ্য। ‘Art for art’s sake’ – এই নীতিই সাধারণত একটি উচ্চাঙ্গের সাহিত্যের মানদণ্ড হয়ে এসেছে। যখনই শিল্প মানুষের জন্য রচিত হয়েছে, তা কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে। অণুগল্পের ভাগ্যেও তাই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের আসন জোটেনি।
প্রবন্ধের শুরুতে অণুগল্পের সঙ্গে টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের তুলনা করেছিলাম। আরেকবার সেই প্রসঙ্গ টেনে বলছি প্রখ্যাত ক্রিকেটার সচিন তেন্ডুলকর টেস্ট ক্রিকেট এবং টোয়েন্টি-টোয়েন্টি –র পার্থক্য করতে গিয়ে বলেছিলেন,'টি- টোয়েন্টি হল ‘dessert item’ আর টেস্ট ক্রিকেট হল ‘main course’ ।‘Dessert item’ খাবারের শেষে খেতে হয়। শুধুই মুখের স্বাদে খাওয়া, ওতে পেট ভরে না। তার জন্য ‘main course’ দরকার। সত্যিকারের সাহিত্যপ্রেমী মানুষের কাছে আজোও উপন্যাসের বিকল্প নেই। যেখানে একটা জীবনের সমস্তরকম টানাপড়েন, একটা চরিত্রের নানা রঙ ফুটে ওঠে। আর অণুগল্প হল টি-টোয়েন্টি। যেখানে একটা বল টার্গেট ৬! একটা রেখা দিয়ে অনেক কথা বলতে হবে।
তথ্য সংগ্রহঃ
বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস- ডঃ সুকুমার সেন
আধুনিক ভাষাসাহিত্যের ইতিহাস- ডঃ অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়
সাম্প্রতিক কথাসাহিত্য- ডঃ হীরেন চট্টোপাধ্যায়
মন্তব্যসমূহ