প্রবন্ধঃ১ // অণুগল্প, ব্যস্ত সময়ের ফসল//রূপাই পান্তি



প্রবন্ধঃ১ 
অণুগল্প, ব্যস্ত সময়ের ফসল

রূপাই পান্তি

গল্প শোনার অভ্যেস মানুষের চিরকালের এক চাহিদা। সেই কবে থেকে মুখে মুখে কাহিনি রচনার শুরু থেকে লিপি আবিষ্কারের হাত ধরে চলেছে সেই গল্প লেখার কারসাজি। পদ্য আর গদ্যের স্পষ্ট বিভাজন এড়িয়ে অবশেষে ‘রবিনসন ক্রুসো’র হাত ধরে যখন উপন্যাস এল, তখনও গল্প বা ছোটোগল্প আসেনি। তারপর সময়ের চাহিদা, আর চার্লস ল্যাম্ব-এর আত্মকথার ছোটো ছোটো লেখাগুলোর হাত ধরে, সেকভ, মঁপাসাঁ, রবি ঠাকুরের হাত ধরে ছোটোগল্প এল, দেখল এবং জয় করল। ব্যস্‌।




গল্পটা এরকম হলে তো হয়েই যেত। তারপর লেখা থাকত, ‘...তারপর ছোটগল্প এক অনন্ত সুখের রাজ্যে বিচরণ করিতে থাকিল...’। কিন্তু তা তো হয়নি। ফাস্ট ফুডের মতো ফাস্টলিটারেচারও মানুষের বড়ো প্রিয়। তাই পদ্য সাহিত্যের গাঁথা কাহিনি ছাড়িয়ে কবিতা, দীর্ঘ কবিতা ছাড়িয়ে সনেট, লিরিকের  ছোটো অবয়ব এসেছে। অবশ্য জাপানি হাইকু বা তামিল কুড়ালের কথা অন্য, তারা প্রথম থেকেই ছোটো। যাই হোক, গল্প পড়তে পড়তেও সময়ের দিকে চোখ পড়ল। সময়টা সম্ভবত ১৭১১ বা ১৭১২। জোসেফ অ্যাডিসন ও রিচার্ড স্টিল প্রকাশ করলেন ‘দ্য স্পেক্টেটর’। যেখানে মিঃ স্পেক্টেটর, স্যর রজার দ্য কভারলে, ক্যাপ্টেন সেন্ট্রি, স্যর অ্যন্ড্রু ফ্রিপোর্ট – এরকম সব মজার চরিত্র রচনা করলেন তাঁরা। ইতিহাস বলে, এখান থেকেই অণুগল্প বা চরিত্রানুগ অণুগল্পের শুরু। ইংরেজিতে বলা যায় ‘Character Sketch’। যদিও অণুগল্পের আসল মজাটা এখানে নেই। যেমন ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’। পুরোপুরি অণুগল্প তো নয়।

১৮১৯-২০ সালে প্রকাশিত হল ওয়াশিংটন আরভিং-এর ‘দ্য স্কেচবুক অব জিওফ্রে ক্রেয়ন’। এটাও সেই নকশা, হুতোমের মতো। আমেরিকানদের হাতে পৌঁছে গেল গ্রেট ব্রিটেনের প্রকৃতি, মানুষ, তাদের আচার, আচরণ, কেচ্ছা, কেলেঙ্কারি, ভালোমন্দ... সব। বেশ মুচমুচে মোড়কে।

তবে যাই হোক, এগুলোর একটাকেও অণুগল্প বলা না গেলেও, পথ যে দেখা গেল, তা স্বীকার করতেই হবে।  আর পথ যদি বলিই, তাহলে জেন গল্পের কথাও বলতে হয়। বলতে হয় বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের প্যারাবেলগুলির কথা, বলতে হয়  বিষ্ণুশর্মার পঞ্চতন্ত্র, ঈশপের ফেবল – সবার কথা। কিন্তু এখানে গল্পের বিশুদ্ধ দেখনদারি বা আনন্দের উপকরণ ছাড়িয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে উপদেশ বা নীতিকথা। যেমন রামকৃষ্ণ কথামৃতে সংকলিত গল্পগুলি।

এবার তাহলে আসি অণুগল্পের কথায়। ডিকশনারি বলছে, ‘A sketch story, or sketch, is a piece of writing that is generally shorter than a short story, and contains very little, if any, plot.’ মূলত বর্ণনামুলক, কোনও স্থান বা মানুষের বা ঘটনার ন্যুনতম বর্ণনা, সেখানে লেখকের কল্পনার,  অনুভূতির বাড়াবাড়ি প্রয়োগ পাঠকের কল্পনাবহকে ব্যাহত করবে না। এ ব্যাপারে Henry Lawson (1867-1922) , বলেছেন, ‘I thought the short story was a lazy man’s game, second to ‘free’ verse, compared with the sketch. The sketch to be really good, must be good in every line. But the sketch story is the best of all.’ কেমন হয়, মানে, অই কল্পনাবিচ্যুত একটা ঘটনার বর্ণনা, তার একটা উদাহরণ দিই। লেখকের নাম Daniel Kharms (1905-42) । মূলত ছোটোদের জন্য অণুগল্প লিখতেন। তাঁরই একটা গল্প-‘An Encounter’.

 সাক্ষাৎ(An Encounter)   
                                                 
কী একটা কাজে যেন একটা লোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দ্বিতীয় একজনের দেখা পেলেন। ঐ দ্বিতীয় লোকটি এক টুকরো পাউরুটি কিনে তখন বাড়ি ফিরছে।
ব্যাস্। ঘটনাটা ,মানে, ওই টুকুই।

এবার পাঠক, আপনি কল্পনা করুন, এই দুই বিপরীতমুখী মানুষের সাক্ষাৎ থেকে আপনি কী আশা করেন।

হ্যাঁ, আপনার সিদ্ধান্তই যে কোনও অণুগল্পের, যাকে বলে ‘essence’। যে দিকে আপনি নিয়ে যাবেন, সেদিকেই যাবে এই গল্পের গরু। গাছে চড়াবেন, না মাঠে, সে সিদ্ধান্ত আপনার।

অবশ্য বিভ্রান্ত হওয়ারও শেষ নেই। যেমন ধরুন কাফকার অণুগল্প। বিষেশত ‘The Next Village’ । অনুবাদটা ততটা আকর্ষক নাও হতে পারে।

পাশের গ্রাম (The Next Village)

আমার ঠাকুরদা বলতেন,'জীবন্টা বড্ড ছোটো। আর আমি  যখন পেছন ফিরি,দেখি জীবনটা আরও ছোটো হয়ে গেছে, আমি বুঝতে পারি না, কেন... যেমন কী করে একজন যুবক ঠিক করল  যে  পাশের গ্রামে যাবে, ঘোড়ায় চড়ে, তার ভয় করল না? দুর্ঘটনার কথা ছেড়েই দিলাম--কখনও কখনও ওই পাশের গ্রামে যতটা সময় লাগে, তারও চেয়ে দ্রুত তো একটা সুখি  স্বাভাবিক  জীবন  শেষ হয়ে যায়, তাই না?'

সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। অবশ্য বলতে পারি, কাফকা এরকমই। আবার এরকমও নন। বহু ছোটোবড়ো গল্পের পাশাপাশি যে সব অনন্য অণুগল্প বা sketch তিনি রেখে গেছেন, তাদের মধ্যে ‘Advocates’, ‘At Night’, ‘A Dream’, ‘The Departure’, ‘The Test’, ‘The Top’, ‘Give It Up’, ‘The Trees’, ইত্যাদি। আসুন কাফকার আরও দু-একটা গল্প পড়ে ফেলি।

গাছ ( The Trees)

কেন যে আমরা এই তুষারপাতের দেশে গাছের গুঁড়ি পছন্দ করি! দেখে মনে হয়, পিচ্ছিল, যেন ঠেলা দিলেই গড়িয়ে যাবে বহুদূর। কিন্তু ,আসলে  তা হয়না, কারণ, মাটির গভীরে গেঁথে থাকা গাছের শিকড়। কিন্তু, ওই-যে ,দেখা চোখে যা দেখা যায়...

                                             
 তাহলেই হয়েছে! ( Give It Up)

ভোর বেলায়, আমি স্টেশন যাচ্ছি। রাস্তা পরিষ্কার , নির্জন। মোড়ের ঘড়ির সাথে নিজের হাতঘড়ি মিলিয়ে দেখলাম, যা ভেবেছি তার চেয়েও বেশ দেরি হয়ে গেছে। পা চালাতে হবে। এই ঘড়ির ভুল আমাকে অনিশ্চিত করে দিল। শহরটা এখনও ভালো চিনি না, তবে কপালজোর, একটা পুলিশের দেখা পেলাম। দৌড়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি,'স্টেশনের রাস্তাটা কোন দিকে?' পুলিশটা শুনে হেসে ফেলল। বলল ,'আপনি আমার কাছে রাস্তা  জিজ্ঞেস করছেন?' আমি বলি,'হ্যাঁ! আমি রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না।' 'তাহলেই হয়েছে!' বলতে বলতে  সে এমন ভাবে ঘুরে দাঁড়াল যেন সে  এবার সে একটু একা একা হাসতে চায়।

জানলার ধারে অলস চাউনি

 এই যে এখন বসন্ত  আসেছে , হুড়মুড় করে, এখন এতে আমাদের কী-বা করার আছে? এইতো  সকালেই আকাশ ঘোলাটে ছিল। কিন্তু জানলার কাছে গেলে যে কেউ অবাক হয়ে যাবে, আর জানলায় মুখ চেপে দেখবে...

 সূর্য এখন অস্ত যাচ্ছে, দূরে ঐ মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে দেখবেন তাঁর মুখ ঝলমল করছে, আর পেছনের লোকটার ছায়া কেমন  গ্রাস করেছে ওকে।

অবশ্য লোকটা সরে গেলে মেয়েটার মুখ আবার খুশিতে ঝলমল করে উঠবে।

সেকভ থেকে সাদাত হাসান মান্টো,  সাকি থেকে পাওলো কোয়েলো অবধি অণুগল্পের চলার পথ খুব বেশিদিনের না হলেও কম বিস্তৃত নয়। এঁদের প্রত্যেকের লেখার বিষয়, ধরণ, স্বভাবতই আলাদা ও অনন্য। সম্প্রতি ২০১৩ সাহিত্যে নোবেল পেলেন অ্যালিস মনরো। ভালো খবর এই কারণে, তিনি গল্পকার। যদিও তার গল্প বা অণুগল্প আমার পড়া হয়নি। জানি, তাঁর অণুগল্পও আমাদের ব্যস্ত সময়ের সামান্য অবসরের মুহূর্তগুলোকে আরও অভিনব করে তুলবে।

( পুনর্মুদ্রণ/ দ্বৈপায়ন/ সম্পাদকঃঅমিতকুমার বিশ্বাস)


                                         
                                                                                                   

মন্তব্যসমূহ