মৃত ঘোড়ার পাশে বসে আছি/ সুনীল সোনা

মৃত ঘোড়ার পাশে  বসে আছি/ সুনীল সোনা

            বাংলার আশির দশকের কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে আধুনিকোত্তর চেতনার বাস্তবের সঙ্গে সৃজনশীলতার দার্শনিক ও নান্দনিক সৌন্দর্যকে সত্য উপলব্ধির  মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র করে তুলেছেন কবি বিষ্ণু বিশ্বাস। জীবনানন্দীয় ইমেজ থাকা সত্ত্বেও মৌলিক সৃষ্টির স্বরের পরিচয় দিয়েছিল  । তার কবিতার মধ্যে যুক্তি ও হৃদয়াবেগের সমমিশ্রণ,জীবনবোধ, জীবন যন্ত্রণা , দুর্বিষহ ক্ষয়িষ্ণুতা এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে। যার কারণে কবিতায় বহুমাত্রিকতা এসে যায় । সামগ্রিকতার এই  জাদু স্পর্শে   তাঁর কবিতা আমাদের জীবনের উচ্চারণশৈলীকে পালটে  দেয় , আমরা বলতে থাকি---

বহু জ্যোতিষ্কের দিকে একবার তুমি চেয়ে বলো
আছে স্বপ্ন ধোয়া নদী, তার ম্রিয়মাণ জলাধারে
কদলী - তরুর ছায়া, তাদের ঘাটের জবামালা
নেশা-স্বপ্নের মতন এই অনিবার্য অবিস্থিতি।
বিস্তৃত এ স্বপ্নরেখা অসম্ভব যুদ্ধের কিনারে
হয়ে গেছে কাল কালে, তুমি যে যুদ্ধের যুদ্ধকল।
অপূর্ব খণ্ডিত  খন্ডে তোমাকে নিয়েছ কোনো ভুলে
শ্রাদ্ধের ভোজনে কোনো, যাকে  ভাবো পবিত্র, পাকাল্যা ।
আমাকে হবে যে জানতে , যুদ্ধ হয়েছে কালে কালে
অর্জুন  অথবা ভীম , অথবা কে তুমি কর্ণ ?
আর যোদ্ধার ভিতরে  অহিংস দিগর। পিতামহী ?
তুমি জয়ী হলে জয় , তবে যুদ্ধ হবে পুনর্বার
দূরীকৃত অন্ধকারে  ময়দানের প্রকৃত জ্যোৎস্নায়
যদি হয়, জয়দ্রোহী জয় প্রভৃতি পরাজিতের।
মামাতো ভাই কবি সুনীল সোনা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন কবিকে । 


কবিতার পরাকাষ্ঠা এই কবি পুরাণের  প্রাসঙ্গিকতায়ে জীবনের গভীর থেকে গভীরে নিয়ে গেছেন । তৈরি করেছেন ঐতিহ্য চেতনা । এ কথা  নির্দ্বিধায়  বলা যায় যে, কবি বিষ্ণু বিশ্বাস ঐতিহ্যগতভাবেই একটি স্বপ্নের মধ্যে বহু স্বপ্ন  সৃষ্টি করেছেন।

কালো
ঘন অ্যাম্বুলেন্স নিঃশ্বাস  বিদ্যুৎচমকের মতো
আকাশপথে মরে আছে শত শত  চিল
এখন নক্ষত্রের রাত
মৃত ঘোড়ার পাশে বসে আছি ভীতিস্তম্ভে
দূরবর্তী আগুন  সৎকার করে গেছে তাঁকে
আমি কোথাও যাব না...।অমরাবতী
রক্তে মাংসে একাকার।
পেঁচার সবান্ধব চিৎকার
আয়ুহীন স্তব্ধ ভূমিতে মৃত্যুর ঘোষণা প্রান্তিক অঘ্রাণের শীতে, ধূসর জ্যোৎস্নায়
সবুজ শুয়ে আছে । গ্যাংগ্রিন ।
শাদা ব্যান্ডেজ জুড়ে রক্তাক্ত ফুলের কৃশলাশ
চোখে নীল । নীলাকাশ
কারও পদধ্বনি! হয়তো উজ্জ্বল হয়ে আসে পৃথিবী
কুয়াশার বুকে ভেসে আসে ঝরনার সঙ্গীত
কিন্তু ঘুম কানে বধিরতা বোধের অতীত
ঘোড়ার চোখের মতো সবুজ তারার অট্টহাসি দেখে
নৈঃশব্দ।

            বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা পড়ে এক সময় আমার মনে হয়েছিল প্রেমের মুহূর্তগুলো  যেন অন্তরের দুঃখকে অভিমানে বিছিয়ে দিয়েছে নিঃসঙ্গতায় । সেই আর্ত অভিমান ক্রমশ মুক্তির আকুলতায় নতজানু। তবু অন্তরের সত্যকে কখনও কান্না দিয়ে চেপে রাখা যায়  না। রাঙা বুকের ভিতর লুট হয়ে যাওয়া গোপন সানাই সুরের দৃশ্যমায়ায় ও সঙ্গীত-ধর্মিতায় আমাদের মুগ্ধ করে । তার কবিতায় দুঃখ জল হয়ে আর কষ্ট মাটি হয়ে মিশে আছে কবিতার বেদিতে। জঙ্গলের মাথায় বীজ ফেলে আগুনের জীবন টপকে যাচ্ছে মায়াবী অশ্রু । তবু কবিতার মাঝরাত খুব মধুর । শ্বাস- প্রশ্বাসের মতো আপন। মাটির উৎসবে  ঘাসেদের ঘর চুরি হবার ভয় নেই কিন্তু মাঝে মধ্যে ঘর  ভেঙে যায়। উড়ে যাওয়া খড় অরণ্যময় বিছিয়ে দেয় সমবেত কাব্যরীতি ।

এবং পাহাড় এখানে চূর্ণিত পাথর
হাওয়া
হাওয়া , আত্যন্তি বরফ ।
পাতা ঝরা
পাতা ঝরা বৃক্ষ
কীর্তিস্তম্ভের মত দাঁড়ানো
শীতার্ত আগুন জ্বলে
আগুনের অন্ধকারে পূর্ণ জ্যোতি চাঁদ
(ভীত ও মৃতের পার্থক্য খুঁজো না)
ঢেউ। ঢেউ ভেঙে আসা শাদা ধুলো
বিমরিষ পূর্ণিমা আলো
নিক্ষিপ্ত তারা
রাতের শিশির
এখানে খুলির ভিতর
কেউ মরে না
মৃত্যু মারছে আলো নিবিয়ে
অন্ধকার জ্বলে ।

তার মৃত্যু হল
রৌদ্রের তীক্ষ্ণ নাকে রক্তের স্বাদ।
ঘটনা
এবং  ঘটনার পূর্বাহ্ণ
পল্লবিত বৃক্ষ
বৃক্ষ থেকে বৃক্ষের দূরত্বে চিত্রাভাস ছায়া
পাথর ঝর্নার ঠোকাঠুকি
ধুলো
আকাশ তারাঝরা
আর স্তম্ভিত মেঘ কেটে আলো -পথ-
তার মৃত্যু
ধীরে রক্ত ভেঙে ভেঙে শাদা ফুল
ধীরে অনেক শাদা চোখে
ফোটে লাল করবী
রোদরে মেঘে দেখে বরফ পাহাড়
মুক্তপ্রভা।

         মৃত্যুবোধের  আর এক দৃষ্টান্ত বিষ্ণুর কবিতা । যেখানে মৃত্যুর নগ্নতা প্রচ্ছন্ন রয়েছে সত্যে। জীবনযাপনের শূন্যতাবোধে কবিতাকে অমোঘ করে তুলেছে। মৃত্যুর আঙুল আঁকড়ে হাঁটার থেকে মৃত্যুর  হাতে হাত মিলিয়েই হাঁটতে চেয়েছেন। এই হাঁটার মধ্যে রয়েছে আমাদের সব সমর্পণ । মৃত্যুর আনন্দে হাঁটার জ্বলন্ত শরীরে নদীমন ভেসে যাচ্ছে নৌকা জীবন। ধুলোর নিঃস্ব হবে বলে জগতকে ডেকে মহাকাশ ছুটে যাচ্ছে মৃত্যু পর্যন্ত--

এত সুন্দর অধীর মৃত্যু, বহুদিনের প্রাচীন
তবুও মরবার জয় কুমারীর মাথার ভিতর
কবেকার সমুদ্দুর জানতেই পারোনি তুমি কিছু
ধূলিময় একটি পথে সকালের কন্যা কোনোদিন
সেই হেঁটে গিয়েছিল  কোনো এক মোগল বাগানে
পায়ে বিকেল আলোক। তারও তো বলবার কথা ছিল
দু'একটি , অথবা তিনটি। একদিন বাঁচব না জেনো,এই
ফুলগুলি খুব ভালো , ফের  আসবে আরেকটি খেলা করে,
খেয়ার সাইকেলটার গল্প
শানে ফেস দিয়ে রেখে এম্নিভাবে হেঁটে চলে গেছে
ভাবনা ও স্বপ্নের ধারে বিশ্বাসের সেথা বিবর্তন
মায়া মনে হয় প্রেম , স্বপ্নে-মৃত চমৎকৃত ভোর
সুন্দর অধীর মৃত্যু , বহুদিনের প্রাচীন।

মনে হচ্ছে মৃত্যুর শর্তহীন পাঠ চুকিয়ে কবি চলেছেন বিশ্ববিক্ষণে । বলতে গেলে নিজের করতলে মৃত্যু রেখে মৃত্যুকেই  উন্মোচন করতে  প্রয়াসী । এটা এক দুঃসাহসিক উচ্চারণ সেখানে জীবনের গোপন কণ্ঠস্বর মৃত্যুর মহিমায় সমুজ্জ্বল।

এবার মৃত্যুর পর আমাকে পাহাড়ে যেতে হবে--
রুদ্রকান্তি হাড়ের তরবারি
রাখা বরফের অন্ধকারে
ধীরে আসতে স্তব্ধ ঊষাকালে
বলবার কথাগুলি
কবে মরে জ্বলে আছে কাঁধ
মন্বন্তরের শবে
মৃত্যু, যদি নিশ্চিত নিশ্চিহ্ন কোথাকার হাওয়ায় হাওয়ায়
হাওয়ার আলোককণা ঝরে পড়ে বৃক্ষের নিচে
দাঁড়ানো ওড়ানো চুল , কুমারীর কালো কালো স্তনে--
ধীরে আস্তে স্তব্ধ ঊষাকালে
বলবার কথাগুলি
তুমি বলে গেছ তরবারি
এবার মৃত্যুর পর আমাকে পাহাড়ে যেতে হবে--

 জীবনস্রোতের উত্তাল তরঙ্গ থেকে এই কবি বহুদিন ধরে  নিজেকে গোপন করে রেখেছেন। তাঁর নিভৃতচারী জীবনে সাক্ষীস্বরূপ আমি মাঝে মাঝেই কবির সাথে দেখা করেছি, কবিতা  পাঠ করে শুনিয়েছি। চেষ্টা করেছি একাকীত্বের এই দেয়াল ভেঙে  কবিকে বাইরে আনতে। তাঁর অসহায় ভাবটা দূর করার জন্য আমি কবিতার বই কিনে দিয়েছি, লেখার জন্য খাতা-কলম দিয়েছি। কিছুদিন বাদে গিয়ে দেখেছি তার কিছুই নেই। এই ভাবে কবির  পাশে থাকবার চেষ্টা করেছি। অতি দুঃখের দিনগুলির কথা মনে পড়লে আজও আমার চোখে জল ঝড়ে পড়ে, কারণ আমাদের পারস্পারিক সম্পর্ক আত্মীয়তার ।
 তাঁর এই আত্মগোপনের সাথে মিশে আছে করুন আর্তনাদ। বিষাদজলে পিপাসা মিটানোর মতো জীবনযাপন বৃষ্টিপাতকে গ্রাস করে । তাঁর কাব্য শরীর বর্তমানে পাথর চাপা পড়ে আছে । দিনে দিনে গভীর হচ্ছে ক্ষত, তা থেকে বেরিয়ে আসছে জ্বলন্ত জীবনের রক্ত। এই  রক্তপাতে আমরা আর হাত রাঙাতে চাই না ।  সভ্যতার মহোৎসবে মিশে যাক কবির ভোরের মন্দির । এই মন্দিরেই খুঁজে পাওয়া যাবে এক দগ্ধ পুরোহিতের প্রেমের প্রদীপ। যে প্রদীপ এখনও মিটমিট করে জ্বলছে।
 অসুস্থ, অর্ধাহারই এই কবি আজ কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে চান না ঠিকই , কিন্তু উত্তর রেখে গেছেন কবিতায়।
(পুনর্মুদ্রণ // কবিতা আশ্রম// অক্টোবর ২০১১ )

মন্তব্যসমূহ