সুবীর সরকার



সুবীর সরকার

বসন্ত মালী
কতবার এইসব রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া। জন্মান্তরের সব ঘাট আঘাটা। যাতায়াতের গতিপ্রকৃতি থেকে তো কিছু একটা আন্দাজ করে নেওয়াই যায়। বেঁচে থাকবার চৌহদ্দি থাকে যার ভিতর আকাশমাটির বাতাসতাতাসের এক জীবন। শীত ঘন হতে থাকে। কাঁপন লাগে হাড়ে হাড়ে। আসারিকান্দীর দিকে পিলখানার দিকে লাউখাওয়ার বিল পেরিয়ে বগরিবাড়ির দিকে হাওয়ার শব্দ ও শীত বিছিয়ে পড়লে বসন্ত মালীর চেতনায় ঘা পড়লে সে স্মৃতিময় হয়ে উঠতে থাকলে গদাধরের ওপর পাখিদের ছায়া। বসন্ত মালী টলমল পায়ে তার জন্মান্তরের ঢোল, ঢোলের কাঠির কাছেই আশ্রয় নেয়। যাপনের টুকরো টাকরা দিয়ে কি আর গোটা এক জীবনযাপনকে স্থিরতর করে দেওয়া যায়! বসন্ত খুঁজতে শুরু করে ব্রহ্মপুত্রের ছোটো ছোটো চর,হ্যাজাকবাতির আলোয় ভরভরন্ত সব গানবাড়ি, নাচুনির দলবল। চরাঞ্চল বনাঞ্চল বাইচের নাও জাফর ব্যাপারির ধনদৌলত পান্তাভাত শুটকি শিদোলের আখ্যানগুলি দিয়ে বসন্ত মালী কেমন দূরাগত হয়ে উঠতে থাকে আর নিজেকে এগিয়ে দেয় মস্ত এক উপাখ্যানের স্মৃতিবিস্মৃতির ভিতর। শীতরাত ভোরের দিকে গড়ায়। পাছা রাত্তিরের মোরগ ডেকে উঠলে বসন্তর তো আর কিছু করার থাকে না। দূরদেশ থেকে যুবতী কইন্যার গান উড়ে আসে-
     ‘গনেশ হাতির মাহুত রে
     মোক নিয়া যান বাপ ভাইয়ের দ্যাশে’।



খুটার বন্দুক


‘খুটার বন্দুক ফোটে না’
১।
সে কি আসলে ভয় দেখাতে চাইছে! আতঙ্কিত হবার সুযোগ সেভাবে না থাকলেও পূর্ববর্তী দিনকালগুলিকে উদাহরণযোগ্য মনে হতেও পারে। হরিচরণ আর বুড়াবাবুর দ্বন্দ্বসংঘাতকে উচ্চমার্গীয় স্তরে নিয়ে গেলেও আসলে কোথাও কোনো গুলির শব্দ নেই। তবে বন্দুক আছে। বন্দুকবন্দনার জন্য ফাঁকা মাঠে জুলুস আছে। বাবুর কেশর ফোলানো ঘোড়া কখন যেন ছুটে  আসে পাটবনের অন্তরাল থেকে। ‘বন্দুক হাতে রায়সাহেব’- মহার্ঘ ছবি হয়ে  ঘুরে বেড়ায় জোতজমির প্রাকৃতিক প্রাত্যহিকতায়।
২।
রহস্যের মায়ামাখা সেই বন্দুক প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠতে উঠতে শীতবর্ষাহেমন্তের দিনগুলিকে আত্মগত করতে থাকলে খাল বিলের মাছেরা পাশ ফেরে নুতন খাতে প্রবাহিত জলধারায় আকুলি বিকুলির দৃশ্যময় বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনবার প্রয়াসটুকুন নিয়ে পুরাকালীন কোনো যুদ্ধক্ষেত্র যেন জীবন্তভাবেই জীবিত হয়ে ওঠে। হরিচরণের হাতে হেন্তালের লাঠি। উলটে যাওয়া কচ্ছপকে সোজা করতে করতেই তার আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে আসে। বুড়াবাবুর টাড়ির দিকে তখন  বিকেলের শেয়ালেরা।
৩।
বন্দুকের জংধরা ট্রিগারে আঙুল রাখলেও হরিচরণকে মোটেও বয়োবৃদ্ধ মনে হয় না। বন্দুকের রহস্য ভেঙে দিতে চাইলেও কোথাও বুঝি কপট এক আড়াল! রক্তপাত হাহাকার পলায়নের তাড়সে কাঁপতে থাকলেও বন্দুক কিন্তু ফোটে না। গুলির শব্দের ধ্বনি প্রতিধ্বনি মিথ্যে মনে হয়। বন্দুকের গল্পটিও হরিচরণ তার উত্তরকালের হাতে বাধ্যতই সপে দেয়, চূড়ান্ত বাধ্যবাধকতায়।

মন্তব্যসমূহ