বিষ্ণু বিশ্বাস এক কল্পতরুর গাছ// সমরেশ মুখোপাধ্যায়


বিষ্ণু বিশ্বাস এক কল্পতরুর গাছ// সমরেশ মুখোপাধ্যায়

              নিজে কবিতা লেখার চেষ্টা করি বলে জানি, আধুনিক কবিসমাজ কী ভয়ংকরভাবে একাকী ও নিঃসঙ্গ।! এমনটা হলে বোধ হয় চমৎকার হত , যদি না থাকত কোনো ছাপাখানা , কোনো পত্রিকা, প্রতিষ্ঠান বা পুস্তক। শুধু হস্তলিখিত পুঁথি আমরা শোনাতাম একে অপরকে , পরস্পর  আপ্লুত হতাম , আর জড়িয়ে ধরতাম নিজেদের । আমর লেখা বড়ো কাগজে ছাপা হয় তাই আমি বড়ো কবি আর ওর লেখা  তত বড়ো কাগজে ছাপা হল না বলে ও কোনও কবিই না --- এই সরলীকরণের  কোনো কারণ আর তখন থাকত না, যোগাযোগ নষ্ট  হবে বলে নিজের স্বজন বন্ধু সম্পর্কে বিক্ষিপ্ত আর  অসংলগ্ন  মন্তব্য করারও  কোনো প্রয়োজন পড়ত না।
          প্রিয় পাঠক , ভাবছেন নিশ্চয়ই কবি বিষ্ণু বিশ্বাস সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কী-সব অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা করছি। হয়তো করছি।  কিন্তু আমি নিরুপায়। বাংলা কবিতার এই আহত মননকে বুঝতে গেলে , কবিদের নিষ্ঠুরতা এবং স্বার্থপরতাকেও বুঝতে  হবে বৈকি ! গত পঁচিশ  বছরের কবিতা চর্চার প্রাবাহিত স্রোতে ভাসতে ভাসতে বুঝেছি কবিতার জগতে সত্যিকারের বন্ধু পাওয়াটা  দুর্লভ । আপনার ভক্ত শিষ্য হতে পারে, গুণমুগ্ধ পাঠক হতে পারে , আপনি কারও গুরু হতে পারেন , কিন্তু বন্ধু, নৈব নৈব চ ! এবং এর থেকে  মর্মান্তিক  আর কী-বা হতে পারে এক জন সৃষ্টিকর্তার জীবনে! এমনতর এক সমাজে কবি ক্রমশ নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর হতে  থাকেন, যদি  তিনি শক্তিমান হন । আর এই নিঃসঙ্গতার চাপ আরও বেশি হয়ে ওঠে যদি তিনি  তরুণ প্রতিভাবান হন । কারণ নিঃসঙ্গতা মোচনের কোনো পথ বা বলয় তাঁর তখনও তৈরি হয়নি। তাঁর  কোনো নির্দিষ্ট ভক্তমণ্ডলী নেই , গড়ে ওঠেনি কোনো গুণমুগ্ধ পাঠক সমাজ। ফলে  নিদারুণ  প্রত্যাখ্যান, উপেক্ষা আর ষড়যন্ত্রের পর্বত প্রমাণ  চাপ তাঁকে  বহন করতে হয় প্রতিনিয়ত।
   যে মাটি যত নরম, সেখানে আঁচড়ের দাগ ততই স্পষ্ট হয়। রক্তাক্ত সেই ছবি তাঁকে  বিহ্বল করে। অদৃশ্য হত্যাকারীর  ছায়া দেখে সে  ভয় পায়। হয়তো বাস্তবে সে কোনও  কবি বন্ধু নয়, কবির  বন্ধু তো তার সমাজও !

               ২
               আসলে এই সমাজে প্রকৃত গুণীর কদর, তাঁর প্রাণ থাকতে সে উপলব্ধি করতে পারে না। মৃত্যুর পর তার ছবিটায় মাল্যদান এবং স্মরণ  উপলক্ষে উৎসব আমরা বাঙালিরা করি বটে, তবে তা কতটা আন্তরিক আর কতটা নিজেদের প্রমাণ করার তাগিদে সে বিষয়টাও ভাববার আছে !
             তো যে কথা হচ্ছিল, বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে রণজিৎ দাশ ও সাজাদ শরীফ সম্পাদিত 'বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিতা' নামক  সংকলনের মাধ্যমে , সম্ভবত ২০০৯ সালে। এই সংকলনে বাংলাদেশের আরও অনেক খ্যাতিমান ও প্রতিষ্ঠিত কবির কবিতার সঙ্গে  তরুণ কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের কয়েকটি কবিতাও সংকলিত হয়েছে। বলা বাহুল্য , কবিতাগুলি পাঠ করে সেদিন চমকে  উঠেছিলাম, তাঁর কবিতা সম্পর্কে এক ধরণের আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কবি পরিচিতিতে দেখলাম তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ 'ভোরের মন্দির' এবং এই কবি নিরুদ্দিষ্ট । ফলে আমার পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হল না। কিন্তু হঠাৎ জানা গেল তিনি আমাদের এই বনগাঁ থেকে কিছু দূরে একটি গ্রামে অসুস্থ অর্ধোন্মাদ অবস্থায় রয়েছেন । অপ্রকৃতস্থ এই কবির নিয়মিত চিকিৎসা চলছে... এখন আর তিনি ততটা সৃজন ক্ষম নন ! আর ঠিক  তখনই আমার মনে পড়েছিল পূর্বে উল্লিখিত  কথাগুলি , অপ্রকৃতিস্থ   হওয়ার  পর আমারা ঝাঁপাই,  তাঁকে করুণা করে মহান হবার চেষ্টা করি, কিন্তু প্রকৃস্থকেকে আমরা রক্ষা করতে পারি না!
            কেন আমরা ক্রমাগত মানসিক ভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া এক বন্ধুকে দিতে পারি না আমাদের  হৃদয়ের  লাবণ্য! শুধু নিজে সুশোভিত হলেই বুঝি চলে?
           আর তাই আমরা বিনয় মজুমদার বা বিষ্ণু বিশ্বাসের মতো কবিকে আবিষ্কার করে বাহবা নিতে চাই , আর কোনো বিনয় কিংবা  বিষ্ণু যেন না হয়, সে  কথা মোটেও ভাবি না।
 আমি তো  এখনও দেখছি এক কবিকে , যিনি তাঁর অগ্রজ কোনো কবির মৃত্যু কামনা করছেন প্রকাশ্যে। তাই বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতায় যখন পড়ি---
" একা আছি
অনেকদিন অন্ধকারে

আমার আগে অনেকে এসেছে এখানে
আমার পরে অনেকে এসেছে

কেউ কাউকে দেখি না
হাতড়ে হাত খুঁজি

ফাংগাস যন্ত্রণা
সমুদ্রের মতো কাঁপে।"

তখন আমূল শর বিদ্ধ হই । টের পাই নিজেরও ভিতরে ঘটে যাওয়া এক ধ্বংসাবশেষকে। নিজের বিচ্ছিন্নতা , ক্রোধ আর উপেক্ষিত হওয়ার অপমানকে মনে হয় ছোরা হাতে এগিয়ে আসা সেই অদৃশ্য হত্যাকারী , যে যে-কোনো সৃষ্টিশীল মানুষকেই পরিণত করতে পারে  স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রুগীতে!
মায়ের সাথে কবি।  


               
              বাংলা কবিতার আরেক রোগ নিজেকে দুঃখী ভাবা, কেন? সহস্রাধিক বছরেও প্রাচীন  বাংলা কাব্য সংহিতা দুঃখী হবে কেন? কেন  সে হবে না আলোক সন্ধানী? তার চৈতন্য  কেন হবে না আলোময়? যদিও একথাও আমরা জানি যে  সুখ আর দুঃখ আসলে একই, প্রকৃতার্থে  এর কোনো প্রভেদ নেই। যখন আমরা প্রভেদ করি, তখনই শুরু হয় সংঘর্ষ , হিংসা আর দ্বেষ। তুমি  ছোটো, আমি বড়ো, তুমি কিছু জানো না, আমি সব জানি --এই যে  মনোভাবের বাঙালি , অবিনয়ী, দুর্মুখ, বিষধর বাঙালি  কবিসমাজ ক্রমাগত ষড়যন্ত্র আর আত্মসংহারের  বীজ বুনে চলেছি সেই, আমরা বিনয়ের মতো বিষ্ণুকেও পড়তে পারি নিজেদের সংশোধনের জন্য। কারণ এই কবির  কবিতায় পাওয়া যাবে যেসব পৌরাণিক চিত্রময়তা, যেসব প্রাকৃতিক বর্ণনা , যেসব মৃত্যুর বহুস্তরীয় উপলব্ধির বিবরণ , তা মোটেও  বাংলা  কবিতাকে দুঃখী করেনা , বরং আমাদের যুগপৎ  বিস্মিত ও আহ্লাদিত করে।
আসলে দুঃখ বিলাসী আমাদের মন , অন্যের যৌনতাকেও হিংসা করে, এতটাই হিংস্র আমরা মহাকাশ আর মহালোকের ধারণায় বিশ্বাসী হতে পারি না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের দৈন্য অথবা প্রহার , অসহায়তা  অথবা বিপদ্গ্রস্থতাকে উপভোগ করি। তাই অপ্রকৃতিস্থের প্রতি যে করুণা , প্রকৃতিস্থিতের প্রতি এই সমাজের থাকে ঠিক ততটাই  হিংস্রতা। এই দুই অবস্থাকে যদি আমরা দুঃখ এবং সুখ বলে  ভাবি , তাহলেও আমাদের স্বাভাবিক Attitude  এই দুইয়ের প্রতিটি সমান ও স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা আর হয় কৈ ?
আর তাই  বিষ্ণু তার অপূর্ব উপলব্ধিতে দেখতে পান,

".................
প্রেমিক ছিলাম না
সমুদ্রতীরে সমবেত মৎসশিকারী
প্রাক-সভ্য বন্য-মাংসের পশ্চাতে
সংযুক্ত হিংস্রতা
হেঁটে
      হেঁটে
             হেঁটে
                      হেঁটে
আমাদের
         প্রত্যেকের
                   জানলায় গ্রিলে স্থির
মাকড়শার মতো ব'নে যাচ্ছে অস্থির  স্বৈরবৃত্ত
বিদ্যুৎচমকে দেখা গেল
..............................''
( আনন্দধ্বনি জাগাও)

একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে জীবনানন্দীয় চেতনাশ্রয়ী এই কবির উপলব্ধিতে বারবার আঘাত  করেছে হিংস্রতা ।.... প্রাক-সভ্য মানুষ  আর এই অতিসভ্য কবিতার জগৎ তাই হেঁটে হেঁটে হেঁটে তৈরি করেছে এক মাকড়শার জাল... যা এক অস্থির স্বৈরবৃত্তও বটে!


               ৪
            কিন্তু এই চিত্তশালী কবি শুধুমাত্র প্রবহমান হিংস্রতার বর্ণনা দেননি তাঁর কবিতায়, বরং খুব অনায়াসে নিজেকে অতিক্রম করে , বিষময়  উত্তরাধিকারকে ফেলে রেখে তিনি খুঁজে নিতে চেয়েছেন 'কল্পতরুর গাছ'। যেমনটি তিনি লিখেছেন তাঁর 'ঈশ্বরের জন্মজন্মান্তর' নামক কবিতায়--
''আমাকে পেরিয়ে গেলে নিশ্চিত কল্পতরুগাছ।''
 এই কল্পতরুগাছের সন্ধানেই ছিলেন বিষ্ণু । কিন্তু তাঁর অবচেতনে ছিল যে হিংস্রতার আতঙ্ক , তাই যখন সমাজ ও সভ্যতার  বাস্তব পরিচয় হল, তখন এই সত্যদ্রষ্টাও তাঁর নিজস্ব ভারসাম্য হারালেন, আর আমরা হারালাম এক অজেয় প্রতিভাকে.....বিদ্যুৎচ্চমকে যিনি অনেক কিছু দেখতে পেতেন ।
            ছদ্ম আত্মগোপনকারী এই কবি হয়তো জীবনযাপনে হলেন মিথ, আমাদের আলোচ্য, উপজীব্য... কিন্তু আসলে এ-এক ধরণের খুন, এক ধরণের হত্যা... চতুর্দিক আমাদের যত-না অসহায়  করে তোলে  তার চাইতেও অনেক বেশি  অসহায় হয়ে পড়ি আমরা যখন দেখি আমাদের সব সম্পর্কের সত্য গুড়ো গুড়ো হয়ে  যাচ্ছে। মিথ্যে আর চিৎকার মনে হয় তখন এই পৃথিবীকে।
           তবু আমরা বেঁচে থাকি অর্ধোন্মাদ কোনো বিনয় অথবা বিষ্ণু বিশ্বাস হয়ে!
ছবিঃ মেঘ অদিতি 

মন্তব্যসমূহ