ইহা বিষ্ণু বিশ্বাসের একটি সাক্ষাৎকার হওয়ার কথা ছিল

কামরুল হুদা পথিক সম্পাদীত 'দ্রষ্টব্য' ( বর্ষ: ১৭, সংখ্যা: ০৯) -এ বিষ্ণু বিশ্বাসের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় ।  এই স্বাক্ষাৎকারটি কে নিয়েছেন তা জানা যায় নি। সম্ভবত দ্রষ্টব্যের পক্ষ থেকে কেউ নিয়েছেন। দ্রষ্টব্যের এই সংখ্যাটি ২০০৯ এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত। তবে  'দ্রষ্টব্য' ১৯৯৩ সালে বিষ্ণু বিশ্বাসের এই সাক্ষাৎকারটি প্রথম নিয়েছিল। কবি  মাসুদার রহমানের সৌজন্যে  এই বিরল সাক্ষাৎকারটি  'অচেনা যাত্রী' সংগ্রহ করতে পেরেছে। 



          ইহা বিষ্ণু বিশ্বাসের একটি সাক্ষাৎকার হওয়ার কথা ছিল

                      
[ বিষ্ণু বিশ্বাসকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।নাগালের মধ্য থেকে বিষ্ণু বিশ্বাস একবার খসে গেলে আবার কবে নাগাল পাওয়া যাবে তা বলা কঠিন। আমরা একবার তাকে নাগালের মধ্যে পেয়ে সমকালীন কবিতা এবং তার নিজের কাব্যভাবনা, বাংলাদেশে কবিতার  সম্ভাবনা, কবিতার বাঁক এবং তার কিছুটা ব্যক্তিজীবন নিয়ে একটি আলোচনা ক্যাসেটে ধরে রাখি একটি যথাযথ সাক্ষাৎকার তৈরির উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিষ্ণু বিশ্বাসের সাথে আর বসা হলো না কিংবা তাকে যুৎসইভাবে পাওয়া গেল না। প্রাথমিকভাবে ধারণ করা তার কথাগুলো থেকে পাঠকের প্রত্যাশার অসমাপ্তি থেকে যেতে পারে বিধায়ই নামকরণটিকে আমরা এভাবে লিখলাম। ]

উন্নাসিকতা একজন ব্যাক্তির জন্য কতটুকু অপরিহার্য ?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ অপরিহার্যতো নয়ই,আমি বলবো কোনো ব্যাক্তির উন্নাসিকতা না থাকাই ভালো।

তাহলে আপনি কি বলতে চান কবিরা উন্নাসিক নন?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ কবিরা উন্নাসিক কি না তা আমি বলতে পারবো না। তবে যেহেতু অনেকখানি তারা ভেতরে থাকেন, সেহেতু দেখলে মনে হয় উন্নাসিক। আসলে কথা বললে বোঝা যায় এটা মূলত communication gap । তা ছাড়া আর কিছু নয়।

আপনি কি বলতে চাচ্ছেন কবিদের ভেতর ও বাহির দু’রকম?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ হ্যাঁ,দু’রকম হতে পারে। বাইরের দিক বলতে আমি বলতে চাচ্ছি যে তার চেহারায় যে expression সেটাই চূড়ান্ত কথা নয়। আরও কিছু ব্যাপার রয়েছে, যেগুলো ভেতর থেকে দেখতে হয়। ভেতর থেকে দেখতে হলে কথা বলতে হয় তার সাথে। এবং যেহেতু একজন ব্যক্তির বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত কাজ করছে তাই ঐ ব্যক্তিটিকে আমরা বোঝার চেষ্টা করি তার ভিন্ন ভিন্ন বীঢ়ৎবংংরড়হ বা আবেগ অনুভূতিগুলোর মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে যারা কবি তাদেরকে আমার কাছে একটু আলাদা মনে হয়।

কেনো,আলাদা মনে হয় কেনো?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ একজন কবি, অন্যান্যদের থেকে কেনো আলাদা কিংবা তাদের মধ্যে পার্থক্যটা কি? সেটা আসলে অনেক ব্যাখার ব্যাপার। এ মুহূর্তে এতটুকু ব্যাখায় না যাওয়াই ভালো। 

আচ্ছা,বর্তমানে বাংলা কবিতার অবস্থা কি?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ বাংলা কবিতার অবস্থা total দিক থেকে অর্থাৎ বাংলাদেশ,পশ্চিমবঙ্গ,সব মিলিয়ে যে চর্চাটা হচ্ছে তা খারাপ না,ভালো।

আপনি বলছেন--ধরুন বাংলা কবিতার যে একটা ধারা আছে, ধরা যাক এক হাজার বছরের কথা। অথবা চর্যাগীতিকা থেকে আমরা যদি কবিতার চেইনটা ধরতে চাই, মানে contemporary কবিতার যে বেড়ে ওঠা--সে পথ ধরে কবিতা এখন যে অবস্থাটায় এসে দাঁড়িয়েছে এ সম্পর্কে আপনি কি বলবেন? একেবারে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত এসে আপনার কি মনে হচ্ছে, কবিতা যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে,আগাতে পারছে না,অথবা উঠে আসতে।
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ হ্যাঁ, তা মনে হতে পারে, তবে এখন যদি বলতে হয় কবিতার প্রগতি, সামনে এগিয়ে যাওয়া_ এটা কোনোক্রমেই থাকতে পারে না। এটাই চূড়ান্ত কথা। এটা চলে। যেহেতু চলছে চলমানতালে কেউ যদি সারথি হয় তাহলে অনায়াসে সে আরও ভালো চলবে। তো আমরা সেখানে যারা নতুন প্রজন্মের( এ বাংলায় কিংবা ওপার বাংলার সব মিলিয়েই আর কি) যে ধরনের প্রতিশ্রুতি দেখতে পাই সেখান থেকে আমার মনে হয় ভবিষ্যৎ ভালো। বাংলা কবিতায় অর্থাৎ সমসাময়িককালে যে কাজগুলো হবে তা মূলত বাংলা সাহিত্য বা পুরোন অবস্থাটা বাদ দিয়েই।

বাংলা সাহিত্যকে বাদ দিয়ে কথাটা কিন্তু অন্যরকম!
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ না, অন্যরকম ভাবার কোনো কারণ নেই।বাদ দেয়া বলতে আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা হলো এ সময়ের যে লজ্জা এটা ঘোচাবে এ সময়ের লেখকরা।

এসময় বলতে কি একদম সাম্প্রতিক সময়ের কথা বলছেন?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ হ্যা, এবং সাম্প্রতিক এবং আর কিছুটা আগ থেকে বলছি।

আপনি কি ৩০ এর পর থেকে বলছেন? কিংবা ৫০ এর পর থেকে?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ আধুনিক কবিতার অগ্রযাত্রা যেদিন থেকে হলো আমরা সেদিন থেকেই শুরু করবো। পেছনের যে ১০০০ বা ৫০০ বছরের কাজ তো মোটামুটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি কিংবা এ প্রজন্মের কবিরা তা চেষ্টা করছে।

আর একটু বুঝিয়ে বলুন?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ অবশ্যই বলবো। আমি বলতে চাচ্ছি ১০০০ বছরের ইতিহাসতো আমরা জানি। তারপর আমরা বর্তমানকে দেখতে পাচ্ছি এবং একই সাথে আমরা ভবিষ্যতের কথা কথা ভাবছি। যে ভবিষত্যে আমরা দাঁড়িয়ে থাকবো তার জন্য এই সময়ের যে লজ্জা,অসৃজনশীলতা এসব কাটিয়ে উঠতে যে ভূমিকাটা আমরা রাখবো তা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। এজন্য হবে যে, আমরা অতীতকে চিনি, বর্তমানকে দেখছি, অতীত ও বর্তমান সময়ের আমাদের যে চিত্রগুলো,ছবিগুলো এসব থেকে জীবনানন্দ দাস পর্যন্ত যে চিত্রপট, তা থেকে একপ্রকার গতি বা spirit জন্মায়। এবং তা ধরেই আমরা এগিয়ে যেতে পারবো। এ এগিয়ে যাওয়ার মাঝেই নতুন কিছু সৃষ্টির সম্ভাবনা নিহিত থাকবে।

যে কথাগুলো বলছেন_এ চেইনটা ধরে যদি আমরা অর্থাৎ সাম্প্রতিককালের  কবিরা  
আপনার মতে যারা এ সময়ের লজ্জাটাকে ঘুচাবে, যদি ঘুচানোর ব্যাপারই হয়ে থাকে তাহলে এ সময়ে এসে বাংলা কবিতায় এ অবস্থা হলো কেনো? কেনো কবিতাকে মনে হয় যেন সে সথিক পথ খুঁজে পাচ্ছে না?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ এ অবস্থার জন্য ৩০-এর কবিদের কিছুটা দায় রয়েছে। অর্থাৎ তারা রবীন্দ্রনাথের পরে খুব উটকোভাবে ইউরোপের কাছে যাওয়ার ফলে তারা গ্রাম বাংলার সভ্যতা বা বাংলা সংস্কৃতির যে মূল কোষাগার অর্থাৎ গ্রাম, তা এদের লেখায় বঞ্চিত হয়েছে। যেমনি গ্রামকে নিয়ে তারাশংকররা লিখছিলেন তেমনি কবিরা কিন্তু তা ধরতেই পারেন নি। তারা সরাসরি নগরকেন্দ্রিক একটা সাহিত্য তৈরি করলেন। যেহেতু সভ্যতা নগরকে কেন্দ্র করে এগুচ্ছে সেহেতু তাদেরকে এই অর্থে মানাও যায় যে তারা নগর কবি। কিন্তু সমগ্র বাংলার জগতটা অর্থাৎ দুই বাংলারই যে গ্রাম আর কি, সে মহা মহা গ্রাম অর্থাৎ আজ পাড়াগাঁ পর্যন্ত এই নগর চেতনার কিছুই যায়নি, সেখানে তা আদিম এবং সেই আদিম লোকালয় থেকে যারা উঠে আসে এখনকার জেনারেশনে তারা বুঝতে পারবে না যে__তারা কতখানি শক্তিশালী_ কিন্তু ক্ষতিকরও ছিল_ যে আমাদেরকে চিহ্নিত করেননি। ৩০-এর দায়টা এখানে ভয়ংকরভাবে পড়েছে। কিংবা এখনকার ৭০/৮০ দশকের নতুন লেখক।

গ্রামকে নিয়ে লিখলেই কি?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ একটা অংশ বাদ গেলেই যেন সমগ্রটাকে হারানো হয়। একটা অংশের যতই কমবেশি হোক আর কি, তা বুঝতেই পারছেন। communication gap হয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ ওখান থেকে যারা উঠে আসবে যে শিক্ষিত শ্রেণীটা তারা কিন্তু ওদেরকে এক ধরণের এভয়েড করে চলতে থাকে। যার ফলে আর একটা ছন্দ সাহিত্য তৈরী হচ্ছে অর্থাৎ ছন্দ কবিতা। এ ছন্দ কবিতা কিন্তু সবাইকে communicate করতে পারছে না। যেমন নগরের একটা ছেলে এবং গ্রামের একটা ছেলের সাথে gap থেকে যাচ্ছে। এটাই মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।
আচ্ছা কবিতার বাস্তবতা আর জীবনের বাস্তবতা কি এক হতে পারে?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ না পারে না। কবিতার আলাদা একটা ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। এবং সাহিত্যের আলাদা একটা ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। কবিতার ল্যাঙ্গুয়েজ বলতে আমি বোঝাচ্ছি যে, যে ল্যাঙ্গুয়েজটা সে গ্রহণ করবে সমাজ থেকে। তাহলে সে সমসাময়িক কবি হতে পারবে না অর্থাৎ সে কমিউনিকেট করতে পারছে না। অর্থাৎ সমসাময়িক ঘটনার ভেতর দিয়ে যে ভাষাটা তৈরি হচ্ছে _ সে ভাষাতেই তার লিখে যাওয়ার কথা, যদি সে তা না করতে পারে তারতো সমসাময়িক কবি হবার কথা না।
আমাদের এখানকার এ সময়কার যারা তরুন লিখিয়ে তাদের অবস্থাটা কেমন?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ ঐ তো যে কথা বললাম, জানাশোনার ক্ষেত্রে এতো সময় ব্যয় করতে হচ্ছে যে তা নিয়ে তরুন লেখকরা টালমাটাল হয়ে যাচ্ছে। তারপর আছে তাদের জীবনযাপন। তবে নগরে যারা বসবাস করেন তাদের জীবনযাপন অনেকাংশে সহজ। কিন্তু যারা মফস্বল থেকে এসেছে তাদের পক্ষে এটা একটা ভয়ংকর সমস্যা। কারণ এ সমস্ত জানতে বুঝতে হবে এবং তারপর তাকে জীবনযাপন করতে হবে__অতঃপর সাহিত্যচর্চা। আর জীবনযাপনের প্রক্রিয়া এখানে খুবই কঠিন। এবং অনেকের কাছে তা আরও বেশি কঠিন যারা অতি কবি হওয়ার চেষ্টা করছে।

মানে?অতি কবি হওয়ার প্রবণতাগুলি কি রকম?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ আমার ভেতরের যে প্রবণতাটা ভয়ংকর তা হলো আমি কাজ করতে পারছি না। আমি পড়াশোনা করতে পারছি না। তাই লিখতেও পারছি না। জীবন ঠিক না থাকলে লিখবো কি করে?

এটাকে কি আপনার অস্তিত্বের সংকট বলে মনে হয়?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ হ্যা অনেকটা অস্তিত্বের সংকটইতো।

এবার আপনার প্রসঙ্গে আসি।আপনার সাথে কবিতার কবিতার সংশ্লিষ্টতা কতটুকু?

বিষ্ণু বিশ্বাসঃ অনেকখানি। আমার কবিতা আমার মতই। অর্থাৎ আমার বাইরে যেরকম, ভেতরেও সেরকম। অর্থাৎ কখনো ভাঙাচোরা কখনো স্মার্ট,কখনো মহানাগরিক, কখনো আবার মহাগ্রাম।

বর্তমানে আপনার সমসাময়িক লেখক বন্ধুদের সাথে আপনার অবস্থাটা কেমন?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ আমি জানি না। অনেকদিন ধরেই অনেকের সাথে যোগাযোগ নেই। এবং বন্ধুদের সাথে সম্পর্কও সুনির্দিষ্ট নয়। 
আপনার কবিতা নিয়ে কথা বলি। আপনার কবিতায় কতগুলো বিষয় দেখা যায়, যেগুলো জীবনানন্দ দাসকে,তার বোধকে ধরার জন্য কিছু শব্দে আপনি খেলা করেন। যে শব্দগুলি আপনার কবিতায় বারবার ঘুরে ফিরে আসছে অর্থাৎ পাওয়া যায়, যেমন--নক্ষত্র,অন্ধকার,সূর্য,মৃত্যু।

 এগুলো কেনো? যেহেতু আপনার সময় ও জীবনানন্দের সময় এক নয় তাহলে এ বিষয়টা দেখছি কেনো?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ আমি কিন্তু সময়টাকে নিচ্ছি না, তার ডাইরেকশনটাকে মেনে নিচ্ছি। অর্থাৎ একজন কবির একজন উল্লেখযোগ্য লোক থাকে যিনি ঐ কবির দৃষ্টিতে অবশ্যই প্রতিভাবান। যেমন রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে অনেকেই কবি হয়েছিল। যদিও তার উপরই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে ৩০-এর কবিতা সোচ্চার ছিল। তাদের চ্যালেঞ্জ আবার যুক্তিশীলও ছিল। তারা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে অবশ্যই ঋণী।

যেমনি বিষ্ণু দে ফিরে এসেছিলেন প্রথমে ভার্জিলের সমর্থক হয়ে। যখন দেখলেন যে আর মুক্তি নেই আবার রবীন্দ্রনাথে ফিরে এলেন-সেটা আমরা জানি কিন্তু।
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ সেভাবে আমি নিজেকে জীবনানন্দের স্কুলের লোক মনে করি।

কিন্তু এটাকে আপনি প্রেরণা হিসেবে দেখছেন কি?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ হ্যাঁ,এটাকে আমি মূলত প্রেরণা হিসেবেই দেখছি। কিছু কিছু শব্দ এবং তার তৈরি ইমেজ ইত্যাদি চলে আসে। আসলে এটা আমার দায়। কিন্তু এটাকে অতিক্রম করার যে সাধনা সেটা আমাকে আরও তীব্রভাবে করতে হবে। তবে জীবনানন্দ দাশকে কখনও avoid করে নয়। 

না, আমি avoid- এর কথা বলছি না,বলছি আপনি কি স্বীকার করছেন, কবিদের প্রেরণার উৎস থাকা প্রয়োজন?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ অবশ্যই থাকে। মানে-

এটা ছাড়া কি লেখালেখি করা সম্ভব নয়?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ অনেকটা অসম্ভবই। একজন কবি যখন কবিতা লিখতে শুরু করে তখন সে তার সহযাত্রীকে খুঁজবে না এটা কখনই হয় না। এবং যে করেই হোক সে সহযাত্রীকে খুঁজে বের করবে। কারণ একজনের ওপর অনেকেই প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু তার মাঝখান থেকে কেউ কেউ প্রভাব ফেলে তীব্রভাবে এবং এ প্রভাবটা তার জন্য অত্যন্ত জরুরী।

একটা সময় পর্যন্ত মেনে নেয়া যেতে পারে, যখন সময়কে নির্মাণ করার একটা দায় থাকবে একজন কবির তখন তার যে প্রেরণা,পূর্ববর্তী শক্তিশালী কবিদের ভেতর  যার প্রভাব তার ওপর সবচেয়ে বেশি তাকে যদি খেয়ে ফেলে সে প্রভাব, তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াবে।
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ তাতো অবশ্যই। প্রভাবক যদি পুরোপুরি খেয়ে ফেলে তাহলে তো কবিকে আর কবি মনে করা যাবে না। কারণ কবির সবচেয়ে বড় সম্পদ যে নিজস্বতা, বলার ক্ষমতা, তাই যদি না থাকে তাহলে তাকে আর কবি বলবেন কেনো?  তবে প্রভাবিত হয়েও যদি সে ভাষারীতির ভেতর দিয়ে বর্তমানকে উপস্থাপন করতে পারে তাহলে কিন্তু তার গ্রেটনেস থেকেই যায়। দেখা যায় ভার্জিলের অনুপ্রেরণা নিয়ে দান্তে মহাকবিতা লিখেছেন, তারপরে শেকসপীয়রকে অনুসরণ করে অসংখ্য কবি এসেছেন- এরকম প্রভাবতো থেকেই যায়।

জীবনানন্দ দাশের পরবর্তী বুদ্ধদেব বসু কি আপনাকে প্রেরণা দেয়,আপনার কবিতায় কিন্তু বুদ্ধদেব বা সমর সেনের ছায়াও পড়েছে? যেটাকে আমি মিশ্র প্রভাব বলবো।
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ হ্যাঁ, বুদ্ধদেব বসুও আমাকে প্রেরণা দেয়।সমর সেনও। অনেকটা মিশ্র প্রভাবই বলতে পারেন। তবে জীবনানন্দ দাশই প্রধান বলতে পারেন। আসলে আমার ধারণায় রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দের লেখায় ব্যাপক হারে শহর ও গ্রামের প্রভাব যুগপৎভাবে পড়েছিল। এই যে শহর ও গ্রামের মধ্যে কমিউনিকেট করার ব্যাপারটা সেটাই আমাকে বেশি করে দোলা দেয়। আমার ক্ষেত্রে গ্রাম বলতে ব্যাপারটা থেকেই যাচ্ছে।

গ্রামটা কি? আপনার স্বপ্নের গ্রাম নাকি অন্য কিছু?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ  আমার স্বপ্নের গ্রাম। সে গ্রামটা আমি আজকে চাই যে গ্রামটা আসলে স্বপ্নের এবং যে গ্রামটার আমি দুর্দশা বর্ণনা করছি সে গ্রামটা এখনকার। একটা স্বপ্নের জায়গায় জীবনানন্দ আমার সাথে মিলে যাচ্ছে। যখন বর্তমান গ্রামকে বর্ণনা করি তখন অন্যের মত বা অন্যের প্রভাব পড়ছে। এই প্রভাবটা যে সবসময় থাকছে বা থাকবে তাও নয়। এটা দূরও হয়ে যেতে পারে। এই যে great মানুষকে ধরে কারও এগোনো তাকে আমি খারাপ মনে করি না।

যদি সে ঐ পথ ধরে নিজস্ব একটা পথ নির্মাণ করতে পারে?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ গানের ক্ষেত্রে যেমন একজন গুরু থাকা দরকার তেমনি কবিতায়ও থাকতে পারে।

সন্তরণের যে ব্যাপারটা, যেমন আমাদের এখানে পুরাণের যে ব্যাপারটা আমি আমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে আমাকে পাড়ি দিতে হবে এবং এ পাড়ি দেবার যে প্রক্রিয়া, আমরা যাবো, কোথায় যাবো এটার ওপর নির্ভর করে আমরা পথ হাঁটি। যে পথে আমরা হাঁটি সে পথটা কিন্তু আমাদের কাছে black?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ এখন যেভাবে যাবো সেভাবে পরিকল্পনা করে আমি এগুতে পারবো এটা ঠিক বলা যায়  না। মাঝপথে নানাপ্রকার লক্ষ্যচ্ছেদ, বিঘ্নতা রয়েছে –যা আমাকে পার হতে হবে।

পরিকল্পনাটাও কিন্তু সেই স্বপ্নের।সেটিও কিন্তু আমাদের অজানা। আমরা ধরে নিচ্ছি যে এভাবে এটা করা যায়। আমরা আমাদের পূর্ববর্তীদের ধারণা অনুযায়ীই প্রথমটায় আগাই। কিন্তু আমরা যখন পথ হাঁটতে থাকি তখন আর পুরোপুরি সে পথটা থাকে না। কারণ আমাদের অবস্থায় এসে তাতে চরিত্র বদল হয়ে যায়।
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ হ্যাঁ, এটা হয় বলেইতো কোনো প্রভাবই আর গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না।

তাহলেতো আমরা শূন্যতার দিকেই এগুচ্ছি বা শূন্যতাকে চাচ্ছি বলেই যাচ্ছি বা আমরা যে ভাবনার কথা ভাবছি সে ভাবনাটা আদতেই কোথাও নেই বা ছিল না বা থাকবে না?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ আলটিমেটলি তাই মনে হয় । অর্থাৎ যখন আমি হাঁটছি তখন স্বপ্ন ধরেই হাঁটছি এবং স্বপ্ন ধরেই যাচ্ছি বলেই শূন্যের দিকে যাচ্ছি। কিন্তু ঐ আপাত শূন্যর ভেতর থেকেই বারবার নতুন এক পথ বেরিয়ে এসেছে। তাই আমাদের স্বপ্নের ভেতর দিয়েই যেতে হয়। অর্থাৎ আমি যখন স্বপ্নের ভেতর দিয়েই ভ্রাম্যমাণ তখন বর্তমানের এই জটিলতা থেকে পরিত্রাণ পেতে চেষ্টা করি। আমার স্বপ্নগুলো রচিত হবে সুন্দর সুন্দরভাবে। যেখানে কোনো নৈরাজ্য থাকবে না, কোনো দুঃখ থাকবে না,অপরাধ থাকবে না ইত্যাদি। বলা যায় পুরোনো ধর্মীয় ritual-এর মতো।

আপনিতো সাম্প্রতিক সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য কবি?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ এটা মনে করলে আপনি করতে পারেন,আমার ব্যাপার নয়।

তাহলে আপনার কাছে কবিতা কি রকম? অর্থাৎ কবিতা কি হওয়া উচিত অথবা কি হলে একটি লেখা কবিতা হয়ে ওঠে?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ আমি যেভাবে ভাবি আর কি, কবিতা বিষয়ে আমার জীবন ও জটিলতা একাকার হয়ে আছে। অর্থাৎ আমার জীবন যখন সুন্দর আমি যখন ভবিষ্যতের স্বপ্নটা দেখি এবং বর্তমানে একটা চমৎকার অবস্থানে আছি তখন আমি ভবিষ্যতকে নির্মাণ করছি একটা স্বপ্নের ভেতর দিয়ে। নির্মাণ করছি আমার পরিকল্পনা মতো আমি নগর বানাচ্ছি, নগরের অন্যান্য সুস্থ চিত্র আঁকছি। যার ফলে আমার ভবিষ্যৎ চেতনাটা অনেক ক্ষেত্রে স্বর্গের যে চেতনা তার মত মনে হচ্ছে। আর যখন আমি আমার জীবনে নৈরাজ্য দেখতে পাচ্ছি আমার জীবন ধ্বংশ ও মৃত্যুমুখী মনে হচ্ছে তখন আমার মৃত্যু চেতনা এবং আনুষ্টানিক অনেক দুশ্চিন্তা, আশংকা এগুলো আমার ভেতর তীব্র হয়ে উঠছে। এজন্য আমার কবিতা কয়েকটি ধারায় বিভক্ত। কখনও নৈরাজ্যিক কেওয়াসের ভিতর দিয়ে তৈরি হচ্ছে আর একটা বেশ শান্ত ও সমাহিত ভঙ্গিতে তৈরি হচ্ছে।

মৃত্যু বিষয়ে আপনার ভাবনাটা কি রকম?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ আসলে মৃত্যু চিন্তাটা আমার পারিবারীক জীবনে অত্যন্ত ভীতিকর একটি ব্যাপার। এটা আমার রক্তের ভেতরও প্রবহমান। যার জন্য আমার মৃত্যুভীতিটা একটু তীব্র। আর পারিবারিক ভীতি কি রকম সেটা আমি বলি, আমার বাবারা চার ভাই ছিলেন। তাদের মধ্যে তিন ভাই অবিবাহিত অবস্থায়ই মারা গেছেন। তাদের এক ভাই-ই বিয়ে করেছিলেন-তার সন্তানই আমি। যে আমার এক বছর হতেই আমার বাবা আত্মহত্যা করেছিল। আমার দুই পিসিমাও আত্মহত্যা করেছিল। যার ফলে মৃত্যুভীতিটা আমার ভেতর চূড়ান্ত আকার ধারণ করে আছে। আমি এগুলো চ্যালেঞ্জ করে করেই মৃত্যুকে এড়াতে চাই। কিন্তু মৃত্যু এড়াতে চাই বলেই মৃত্যু আমার প্রতি অনেক বেশী আকৃষ্ট হয়ে চলে আসে। যাকে চ্যালেঞ্জ করা হয় সে তো আসবেই। যেমন আমার মৃত্যুকে নিয়ে একধরণের চ্যালেঞ্জ আছে বলেই আমার কবিতায় ও জীবনে মৃত্যু চেতনা খুব তীব্র।

বন্ধুদের থেকে আপনার এ চিন্তা আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখে-এমন কি মনে হয়?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ হ্যাঁ, দূরে সরিয়ে রাখে বৈকি? অনেকখানি যন্ত্রণাকাতর করে, অপরাধবোধেও ভুগি-সব মিলিয়ে জীবনটা হয়ে পড়ে দুর্বিসহ। বন্ধুদের সাথে ফাঁক সৃষ্টি হয়, ব্যক্তিবাদী হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা দেয়। এটা আবার শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।

ধরুন আপনার প্রিয় বন্ধুকে বললেন-আপনি আত্মহত্যা 
করবেন,আপনার  বন্ধু কি ব্যাপারটা অন্যভাবে নিতে পারে না?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ আত্মহত্যার কথা আমি বলিনি। আমি বলছি মৃত্যু আমাকে তারা করে। তাড়া খুব আবেগপ্রবণতার ফল। আমার ওপরেও এ আবেগপ্রবণতা খুবই কার্যকরী। আমি যখন শুভবাদী হবো তখন শুভ হবো। কিন্তু আমি পুরোপুরি শুভবাদী হতে পারি না। আমার এ না পারার প্রধান কারণ হচ্ছে বর্তমানে আমার আর্থিক দুরবস্থা।
এটা কি ঘুচতে পারে না?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ পারে, তবে তার আগেই অনেকগুলো ঘটনা কাকতালীয়ভাবে ঘটে যাচ্ছে। যেগুলো আমার ঘুচিয়ে ফেলার চেষ্টাটা প্রতিহত করে ফেলেছে। অর্থাৎ আমাকে সাবলম্বী হতে দিচ্ছে না। এসব অতি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো না হয় আলোচনা না-ই করলেন।

চলুন আমরা আর একদিন বসি।
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ বেশতো,কোথায় বসবেন?

এখানেই,কুন্দনে। ঠিক আছে?
বিষ্ণু বিশ্বাসঃ ঠিক আছে।

( এরপর বিষ্ণু বিশ্বাসকে আমরা খুঁজে বের করতে পারিনি। একদিন হঠাৎ করেই নির্বাহী সম্পাদক পিজির বটতলায় বিষ্ণু বিশ্বাসকে পেয়ে গেলে ক্রোড়পত্রের স্কেচের জন্য স্টুডিওতে ঢুকিয়ে একটি ছবি তুলে নেয় এবং বিষ্ণু বিশ্বাস জানান তিনি খুব শীঘ্র কোলকাতা চলে যাচ্ছেন )

মন্তব্যসমূহ