বিষ্ণুমানস// শঙ্কর দেবনাথ

বিষ্ণুমানস// শঙ্কর দেবনাথ

     বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতাযাপন আমার দীর্ঘ দিনের নয়। প্রথমে অগ্রজ কবি বন্ধু সুনীল সোনার কাছ থেকে , পরবর্তীতে বনগাঁ থেকে প্রকাশিত রনবীর দত্ত সম্পাদিত 'কবিতা আশ্রম'- এ বিষ্ণু বিশ্বাস সংখ্যা থেকে এবং এই মুহূর্তে অনুজ কবি, গল্পকার বন্ধু 'দ্বৈপায়ন'  (মুদ্রিত ত্রৈমাসিক ) 'অচেনা যাত্রী( জনপ্রিয় অনলাইন মাসিক)-এর সম্পাদক অমিত কুমার বিশ্বাস- এর কাছ থেকে বিষ্ণু বিশ্বাস-এর  একমাত্র কবিতা সংকলন 'ভোরের মন্দির' পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আর অমিতের আগ্রহেই বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা সম্পর্কে ব্যক্তিগত অনুভব লিখতে প্রয়াসী হয়েছি।  বলে নেওয়া ভালো --আমি  কাব্য আলোচক নই। একজন প্রান্তবর্তী কবিতা প্রেমী পাঠক মাত্র । তাই বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা বিষয়ক এই রচনাটি কিন্তু শুধুই আমার নিজস্ব কাব্যবোধের শব্দগুচ্ছ মাত্র।

           
    প্রকৃতি সমস্ত জীবদেহে ও মনে পূর্বগণের উত্তরাধিকার বহন করে। কবিও তাঁর পূর্বের বিশিষ্ট কবিদের দ্বারা প্রাণিত হন-- কখনও জেনে-বুঝে, কখনও অজান্তে। বিদগ্ধ পাঠক সেটা উপলব্ধি করেও আনন্দে মুগ্ধ হন। পরম্পরা ধরে পরমের দিকে এগোনোর পথ পেয়ে যান সহজে। আমার মনে হয় -- জীবনানন্দও তেমনিভাবে প্রথম পর্যায়ে সরাসরি রবীন্দ্রপ্রভাবিত এবং পরবর্তীতে বোধের অন্ধকারে রবিরোদের ছায়ায় নিজস্ব চেতনার রঙ লাগিয়ে সুনিপুণ দক্ষতায় স্বাতন্ত্রতা এঁকেছেন তাঁর কবিতায় । বিনয় মজুমদার প্রথম চারণায়  জীবনানন্দ প্রাণিত প্রত্যক্ষভাবেই -পর্যায়ান্তরে সমকালীনতার উচ্চারণে জীবনের আনন্দ- দুঃখ থেকে ছন্দ নিয়ে মহাছন্দের সাথে মেলাতে চেয়েছেন স্বমেধায়। শূন্যের মধ্যে মহাশূন্যের গাণিতিক হিসাব মেলাতে চেয়েছেন। আর বিষ্ণু বিশ্বাসও সেই জীবনানন্দের জ্বরে পড়েছেন। সময়ের প্রেক্ষিতে সেটা শরীরের মননে  বিবর্তিত স্বাতন্ত্রতা পেয়েছে মাত্র। জীবনানন্দ মধুর ও শান্ত , বিনয় মধুর ও নিপুণ, আর বিষ্ণু মধুর ও তীব্র। সকলেরই কবিতা নারীর শারীরিক বেশভূষায় কালিকতার ছাপ আর মননে একই বোধ আর  দর্শন শুধুমাত্র বিভিন্ন দ্যোতনায় ।  জীবনানন্দীয় দর্শন - মায়াময় মহাভিসারে সংক্রামক , বিনয়ের দর্শন বিনয়ী হিসাবের সূত্র , আর বিষ্ণুর দর্শন - সুদর্শনচক্রে পিষ্ঠ রক্তাক্ততা পেরোনো ম্লান হাসি মাখা।

         
বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতায় অসংখ্য  জীবনানন্দীয় শব্দপ্রয়োগ লক্ষ্য করে বোঝা যায় তিনি কতখানি জীবনানন্দ জ্বরাক্রান্ত । তাঁর কবিতায় কখনও বাক্যবন্ধে , কখনও বিক্ষিপ্ত শব্দে জীবনানন্দের সশব্দ উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। যেমন- 'কুয়াশার বুকে ভেসে আসা ঝর্নার সঙ্গীত" ( নির্বেদ ) । " শটীর বনে হাহাকার " ( ভোরের মন্দির -৩) , " উটের গ্রীবার মত নিস্তরঙ্গতাও" ( ভয় শেষে ) --প্রভৃতি কাব্যছত্রে এবং 'শাদা', 'সোনালী' , 'খয়েরী', 'কবেকার চিলের ডানা'--- এরকম অসংখ্য শব্দে ও উপমার ধরনেও জীবনানন্দের গন্ধ  পাওয়া যায়। যদিও তা কালিক উপস্থাপনায় সযত্ন আড়ালে। বিষ্ণুর কবিতা পড়তে পড়তে তাই বার বার যেন জীবনানন্দের ছায়াময় উপস্থিতি অনুভব করা যায়।

       
জীবন মৃত্যুভীতিময় । তবে মানুষ ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে সেটা তাৎক্ষনিক মাত্র। মানুষের মৃত্যুভীতি সারাজীবনের এবং অনিবার্যতা মেনেই। বিষ্ণুও তাই লেখেন-- "জন্মের আগে মৃত্যু হাত পাতে" অথবা "শৈশব থেকে মৃত্যুর কাছাকাছি" ( কবরকাহিনী ), কিন্তু কবিদের মৃত্যুভীতি  সাধারণী নয় । কখনো তা প্রীতিময় মাধুর্যে ভরা, কখনও আবার  উত্তরণের ছন্দে গাঁথা । রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা মহামিলনের মধুরতায় মুগ্ধ।( 'মরণরে, তুঁহু শ্যাম সমান' ) , জীবনানন্দের মৃত্যুভাবনা অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ অনিবার্যটায় সমর্পিত ( 'আমারে ছিনিয়ে নেবে  মেঠো ইঁদুরের মত মরণের ঘরে' ) , আর বিষ্ণুর বিশ্বাসের মৃত্যুবোধ  যন্ত্রণাময় এবং পরিসমাপ্তিহীন ('উনশত মৃত্যু পেরিয়ে মৃত্যুর   শাদা হাত তখনও উদ্বেলিত') । বিষ্ণুর কবিতায় মৃত্যু বার বার এসে বার বার সশব্দ শব্দে প্রকটিত হয়েছে মুদ্রাদোষের মতো , বাস্তবতায়। তবে তাঁরও মৃত্যুচেতনা জীবনানন্দেরই মতো পুনর্জন্ম প্রত্যাশী । মৃত্যুর পরে তিনি জীবনানন্দের মতো প্রেমের - সৌন্দর্যের টানে ফিরে আসতে চাননি। বরং অনাকাঙ্ক্ষিত অসংখ্য মৃত্যুর মুখোমুখি  রুদ্ররূপে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে আসতে চান। "এবার মৃত্যুর পর আমাকে পাহাড়ে যেতে হবে-/ রুদ্রকান্তি হাড়ের তরবারী / রাখা, বরফের অন্ধকারে " ( তরবারী )
              কবির প্রতিনিয়ত মৃত্যু হয়। পুনর্জন্ম হয় । বোধের । প্রেমের । আর এই জন্ম মৃত্যুর দোলাচলের খেলায় গড়ে ওঠে কবির সংসার , বোধের উত্তরণ। বিষ্ণু অনেক মৃত্যু দেখেছেন-- বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষিত তাকে এই মৃত্যুর উৎসব দেখিয়েছে। "ঘৃতধৌত হেলমেট ঝুলে আছে মস্তকে মৃতের " ( ভোরের মন্দির -৩ ) , " জন্ম উৎসবেও জন্ম ভুলে, মৃত্যু মৃত্যু" ( মৃত্যুগিতি ) , " বুলেট প্রতিটি মৃত্যু... মৃত্যু এখন খড়ের গাদায় আর ভ্যানে নিত্য পা দোলায় " ( কবর কাহিনী ) । তাই গভীর হতাশায় উচ্চারণ করেন --    " শুধু মৃতদের গল্প কত আর কাঁধে ঝুলে যাবে, / এবার নিষ্কৃতি পেলে , শান্তি অন্বেষণে মহাকাশে গিয়ে..." ( কালো মেয়ে )। শেষপর্যন্ত "প্রতিটি ঘরের ভিতরে বাহিরে"-- বিভিন্ন মৃত্যু দেখে কবি বোধিত হন, বিশ্বাসী হতে চান---" মৃত্যুর আকর্ষণ   প্রতীকী ও  বাস্তব। অন্বেষী এবং অনিষ্ট " ( আলো ক্রমে নিভিতেছে) । তবুও কি শেষ রক্ষা হয়েছে ? "মৃত্যুর ভারি ওজন"(শেষ কৃত্য) বয়ে বয়ে কি বিষ্ণু আজ ক্লান্ত?

              ৫
      কবিরা সংবেদী । সমাজচেতনা ও যুগযাপনের  যন্ত্রণা তাকে আলোড়িত করবেই। বিষ্ণুর কবিতার অসংখ্য চরণে চরণে মানব রিরংসা আর প্রবৃত্তির নগ্নচিত্র ফুটে ওঠে স্বভাবতই । "ধর্ষিতা সাতটি মেয়ে , রক্তাপ্লুত, রক্তনিঃস্ব " ( ভোরের মন্দির-৩), "নমগ্ন শিল্পী হাঁটু ভাঙা  কাদাখোঁচা পাখি" ,"মাংসাশী দাঁতের অতি উৎসাহ " ( আকাশগঙ্গা ) , অথবা "এগারো জন মৃত সংঘর্ষে"-র মতো বিপন্নতার ছবি এঁকে  শেষ পর্যন্ত বিষ্ণু বলেন--"আমি শবের অধিপতি।" "অমৃতের অসম বিভাগ" তাকে "স্বৈরবৃত্তের" সমাজ দেখায়। এবং ভবিতব্যে  দেখেন--" সন্তান সন্ততি ভাঙা এবং একা।" তবু তিনি হতাশাবাদী নন বলেই স্বপ্নদেহে খুঁজে পেতে চান --"সবুজ দ্বীপের বার্তাবায়ু"। এবং হয় আস্তিক দর্শন-- '' আমরা ততদিন পায়ে হেঁটে বহুদূর মোগল গোলাপ বনে স্বপ্নময় সৌগন্ধে ঘুমাব।" ( বালক বীরের  বেশে তুমি করলে বিশ্বজয় )।

            ৬
' অপর্ণা যেভাবে আসে" বা "আবার সে ফিরে এল  অপর্ণার মতো" ( শতাব্দীর দান ) অথবা "শূন্যহীন ভালোবাসা --বলা হল। নীলা। আমি জানি। "  (মৃত্যুগিতি )। বিষ্ণু বিশ্বাস অপর্ণা না নীলা-র মুখোমুখি বসে থাকতে চান না জীবনানন্দের বনলতা সেনের মতো। তবে জীবনানন্দের সুরঞ্জনা, সুচেতনা বা বনলতা সেন কি বিষ্ণুকে সময়ের  ব্যবধান তার মননের ভিন্নতায় অপর্ণা বা নীলা সৃষ্টিতে প্রাণীত করেছে? যদিও বিষ্ণুর প্রেম জীবনানন্দের মতো মহাকালিক বা চিরন্তনতার দ্যোতনার দ্যুতিময় নয়। তাঁর ভালোবাসা কখনও "নিরুদ্দেশে ওড়ে" (সময়)  "আবার ফিরে আসে।" কিংবা "মৃত্তিকা রঙের খাটে দুজন পাশাপাশি শুয়ে", শেষে " ব্রক্ষ্মহংসীর মত সরল" অনুষঙ্গে   (কন্যাকুমারী)। জীবনানন্দের "কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশার" অনুষঙ্গে নয়। কারণ বিষ্ণুর কাছে "মায়া মনে হয় প্রেম" (কুমারীর মৃত্যু)। কবি শুধুমাত্র "ওড়না সেরে গেলে  শরীরী উদ্ভাস" দেখে অভিভূতই হতে চান। তাই কামনার বিপ্রতীপে তার স্বীকারোক্তি "কালো মেয়ে , আমি ভালোবেসে ভুলে ,-তোমাকে জ্বালিয়ে দিই নাই।" (কালোমেয়ে) ।
           বিষ্ণুর প্রেমমানসেও কেন জানিনা বারবার জীবনানন্দের প্রেমেরই গন্ধ পেয়েছি । যদিও জীবনানন্দের মতো তিনি প্রেমের মহাপরিক্রমি নন । তার প্রেমের ঘরে "মৃত্যুর শাদা হাত" ওৎ পেতে থাকে। "চিতায় পোড়ে যুবতীর মৃত চোখ"(ম্যুজিয়ম )। তবু অপেক্ষা --"নিরস মৃত্যুর আগে  মৃত্তিকার ঘাস শিস দিয়ে অঠে--তুমি আসবে।' ( তোমাকে দেখা গেল ) ।বিষ্ণুর এই প্রেম, এই অপেক্ষা, সমূহ 'মৃত্যু, মৃত্যু মৃত্যু'র মধ্যেও বেঁচে থাকে 'শূন্যহীন ভালোবাসা'য়।

         ৭
বিজ্ঞানী যেখানে এসে প্তহহীন শূন্যতায় দিশাহারা , দার্শনিক অন্ধকারের মধ্যে দৃষ্টিহীন, সাধক নিজেকে বিলীন করে আত্মসমর্পিত, কবি  সেখানে এসে মুখোমুখি হন বনলতা সেনের। সেই অনন্য অন্ধকার মহামিলনের সুখে কবি ডুবে  যান অরূপের রূপসাগরে। বিষ্ণু স্থল , জড় আর প্রবৃত্তি তাড়নার গল্প বলতে বলতে  চলতে চলতে এক সময় পৌঁছে যান শূন্যতার গভীরতায়-- মহাশূন্যের প্রান্ত সীমায়। আর তাঁর বোধের চোখে জেগে ওঠে --"সকল বস্তুতে আলো সকল বস্তুতে আহা অন্ধকার জ্বলে।" (প্রজন্ম)। আর তার কানে আসে " শঙ্খধ্বনির  মত বাজতে থাকে অনাদি সত্যের দুপুর।" (প্রেমপত্রের খসড়া )  অথবা " কোনও নক্ষত্র সীমায় মানুষের মত কথা বলে, প্রবল মানুষ।" (ম্যুজিয়াম) সেই মহাশূন্যের প্রান্তরেখায়  পৌঁছে আবিষ্কার করে ফেলেন-- মহাসত্যের মহাতত্ব-- "শূন্য এবং শূন্যের সংঘর্ষে আগুন। ঝলসিত সে জ্যোতির্গময়" ( কালসমুদ্রে আলোরযাত্রী) যা সৃষ্টি তত্ত্বের  বৈজ্ঞানিক সত্যও বটে। বিষ্ণুর এই মহাকালিক বিচরণ, মহাজাগতিক সন্তরণ-- তার কবিতাকে পৌঁছে দিয়েছে ভিন্নতর উচ্চতায়।

           
      বস্তুত বিষ্ণুমানস কখনও অসংযমী - আবেগাধীর।  কহনও মিতভাষী- মৌনব্রতী, আবার  কখনও শানিত -সুচতুর। স্বপ্নাতুরের প্রলাপতার মধ্যে হঠাৎ বাস্তবতায় উচ্চকিত। কখনও গদ্যের বন্ধুরতার ভেতর অকস্মাৎ কবিতার পেলবতা এমনি এক আলো-আধাঁরির দোলাচলে দুলতে দুলতে চলে যান মুগ্ধতার মায়াকাননে। আমার মনে হয়--এখানেই বিষ্ণু কবিমানসের স্বতঃস্ফূর্ত  নান্দনিক উত্তরণ ।

       
প্রকৃত কবি জীবন ভারসাম্যহীন। পাগলামিতে ভরা । তবে সেই ভারসাম্যহীনতা স্থূল দৃষ্টির বীক্ষণ মাত্র । কিন্তু বিষ্ণুর ভারসাম্যহীনতা কবিসুলভ নয়। মর্মান্তিক অসুস্থতার অশনি। তাই বিষ্ণুর স্বভাবসিদ্ধ কবিজীবন প্রার্থনা রাখি। বিষ্ণু সুস্থ হয়ে উঠুন-- শরীরে-মননে। ফিরে আসুন কবিতার গহন যাপনে।
-----------------------------------------------------------------


কবি বিষ্ণু বিশ্বাসকে নিবেদিত শব্দগুচ্ছ
শঙ্কর দেবনাথ

          একাল ও'কাল - মাঝাখানে একটি সকাল-- আকালের ঘরে শুয়ে  স্বপ্নে নাকাল হয়। দূরে বসে সুরে সুরে হেসেহেসে দেখে মহাকাল।
       এ- তীর ও- তীর --মধ্যে গতির রথে একজন কর্ণরথীর চাকা, গিলে নিতে চায় ছন্নমতির হা। নতিহীন জ্বরে জুড়ে যতিহীন পথিকের মন তবু জানায় প্রণতি।
        জীবন ও মরণের বিবাহ বাসরে বরণের ডালা সেজে, বিস্মরণ থেকে এঁকে প্রেমের গড়ন -কোনো এক উভলিঙ্গ কবি , গভীর চুম্বনে, স্ব-রমনে গর্ভবতী হয়।
        জীবনে ও মৃত্যু খেলে প্রণয় প্রণয়।


মন্তব্যসমূহ