'নিরঙ্কুশ কাকের আধিপত্যে সৌন্দর্যের মড়ক'// শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

'নিরঙ্কুশ কাকের আধিপত্যে  সৌন্দর্যের মড়ক'// শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

       বাংলা কবিতার মূল্যায়নের মাপকাঠিতে 'মিথ'-কে একটা বড় জায়গা দেওয়া হয়ে থাকে । এই 'মিথ' কোনও রক্ষবৈর্বর্তপুরাণ থেকে উঠে   আসা নয়। এই মিথ কবির জীবনকে নিয়ে । কোনও কবির বিখ্যাত হয়ে ওঠবার পেছনে বাঙালি সমালোচক অনেক সময় সেই মিথ খুঁজতে শুরু করেন। এই মিথ খুঁজতে গিয়ে যে ধুলোর ঝড় ওঠে , তাতে অনেকসময়ই দেখা যায়  কবিমানসটিকে  আর পাওয়াই যাচ্ছে না । ২৫- এ  নভেম্বর ২০০৩ , শক্তিচট্টোপাধ্যায়ের ৭০ বছর জন্মদিনে আনন্দ বাজার পত্রিকা'য় প্রকাশিত 'শব্দের ভিতর দিয়ে দেখা '  গদ্যে জয় গোস্বামী বলেছেন,"লিখিত শব্দই, লেখকের প্রথম ও শেষ পরিচয়। এই প্রথম ও শেষের মাঝখানে যত ঘটনা ঘটে , তারা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে কুৎসা ও  কীর্তিগাথা রূপে । এক সময় কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত হয় , আরও  পুরনো হলে , সেই কিংবদন্তি উড়ে যায় ধুলোয় ; এই রৌদ্র হাওয়া 'এই নিশ্চিন্ত পাগল ধুলোবালি। শুধু এই লেখা বা ধুলোবালি ছড়িয়ে পড়ে আমার বা যে কোনও পাঠকের জীবনের বাহিরে ভিতরে। "  মিথ আক্রান্ত কবিসমাজের জ্বলন্ত শহীদ বিনয় মজুমদার। আর দত্তফুলিয়ার ইছামতী পাড়ে বাংলাদেশের  ঝিনাইদহের থেকে ছুটে চলে আসা আরেক দৃষ্টান্ত, কবি বিষ্ণু বিশ্বাস ।

             বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা মূল্যায়ন করবার স্পর্ধা আমার নেই । কাকতালিয় অনুঘটনের মতো একদিন শুধু হঠাৎ পড়ন্ত বিকেলে বনগাঁর  এক চায়ের দোকানে হাতে এল কবির 'ভোরের মন্দির' । অনুঘটক তরুণ স্পর্ধিত অমিত । ভোরের মন্দিরের প্রাককথনে যে বেদনাঘন আবর্ত দেখতে পাওয়া যায়, তা অবশ্য  বাংলা সাহিত্যে বিরল নয় । 'নিষ্পাপ মুখশ্রী' বিষ্ণু বিশ্বাস মতিহারের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক হবার সাথে সাথে প্রবেশ করছেন কবিতাঘন বেদনায় । কাব্যাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে তার স্বল্পায়ু ছোটোকাগজ 'পেঁচা' । পারিপার্শ্বিক অশান্ত বাবরি মসজিদ উস্কে দিচ্ছে তার আতঙ্কগ্রস্থতাকে। অথচ, স্নিডারিয়ান ফার্স্ট র‍্যাঙ্ক সিস্টেম উপেক্ষা করে বিশ্বচরাচরে বিষ্ণু লিখছেন--  "শহরে পালাবে আদিভূমে/যেখানে সূচনা চেতনার।" নিশাত জাহান রানা ও সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সহায়তায় 'ভোরের মন্দির'-এ জেগে উঠেছে স্বপ্ন।
"...খাড়া পাহাড়ের সারি , অরণ্যের শুরু
সেখানে মানুষ এসেছে বহুবার , বহু স্বপ্নের শেষে
                         এবং প্রারম্ভিক স্বপ্নে।"

             কবিতাবিশ্বে এটাই তবে হান্স জর্গেন আইসনেকের বর্ণিত স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিকত্বের ভিতরের সূক্ষ্ম কাঁটাতার ? যে তার একদিন অছিলায় পার করে গিয়েছিলেন বিনয় মজুমদার ।  কখনো শক্তি চট্টোপাধ্যায় , কখনো বিষ্ণু বিশ্বাস ! 'কা কবিতা' নামক গদ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখছেন,"আমরা শব্দে শব্দে ঘা মেরে বাজিয়ে , বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেই সব আলেখ্যর  কাছে এনে সবাইকে দাঁড় করাতে চাই। সকলে দাঁড়ায় না। সবার দাঁড়ানোর কথাও না। কেউ কেউ দাঁড়ায় । তারা ঠুকরে ঠুকরে কবিতার ছবির রঙ হৃদস্পন্দন খায় । গোগ্রাসে যারা গেলে তারা কবিতার শত্রু । যারা ঠুকরে খায় , তার এদিক ওদিক ঠিকরে পড়ে। তাদের জ্বালার আর অন্ত নেই ।" কবিতা তো আসলে 'জ্বালা'-ই।
               প্রগতি , ও তার মধ্যে নিহিত অস্ত্রচালনা বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতাকে স্পর্শ করেছে বার বার। কখনও কবি হয়ে  উঠছেন শবের অধিপতি । কান পার্শ্বে  ধ্বনিত হ্যালুসিনেশনের মতো ভেসে আসছে ঘোষণা । "এগারোজন মৃত সংঘর্ষে'। 'ওদের কবর দাও "" ধর্ষিতা সাতটি মেয়ে / রক্তাপ্লুত, রক্তনিঃস্ব।" (ভোরের মন্দির)
এক বিরল বিশ্বযুদ্ধোত্তর ছবি গড়ে ওঠে কবির কবিতায় , যা আন্তর্জাতিক স্তরে আমরা খুঁজে পাই রবার্ট ফ্রস্টের কবিতায় । অথচ বিষ্ণু বিশ্বাসের সমকালীন জগৎ তো তার কত পরে! (১৯৬২- ) এই আশ্চর্য মিল সম্ভব হয়েছে কারণ কবি তার কবিতায় ভাঙন  আনতে পেরেছেন। 'নোনা' শব্দ কবির খুব প্রিয়। ইটে নোনা  লেগে গেলে ধীরে ধীরে ভেসে যায় । কিন্তু সেই ভাঙন নাগাসাকি হিরোশিমার মতো আকস্মিক নয়। এই ভাঙন ক্রমায়মান , ধীরে ধীরে। অথচ অবশ্যম্ভাবী । সেই ভাঙনের অন্তর্ভুক্ত হয়ত আমাদের মতো কবি নিজেও । তাই  তিনি নিশ্চুপে বলেন --
"মনে হয় , মাঝে মাঝে
কখনও নিশ্চয় খুন হয়ে যাব আমি " । ( পুষ্পদম্পতি )

অস্তিত্ববাদীরা যাকে এক সময় 'অ্যাবনেডনমেন্ট' বলে ছিলেন , এই পাহাড়খাদে দাঁড়িয়ে নিভৃত কবিসত্ত্বা ডুকরে আবিষ্কার করে উত্তরণের পথ । সৃষ্টি, বিকাশ ও উত্তরণ । অন্তর্লিন থট্ ব্রডকাস্টের মতো কবি আবিষ্কার করেন---
" ঊনষাট মৃত্যু  পেরিয়ে মৃত্যুর শাদা হাত তখন উদ্বেলিত আর জীবিতের মতো
সহস্রের  এক সবুজ হাত মুষ্টিবদ্ধ,
তখনো উঁচিয়ে থাকে
বিরুদ্ধ , হামাগুড়ি দেয়া মাটির বিপরীতে
যেন যে মৃত্তিকার সুগন্ধি উর্ধমুখী
তার ঘ্রাণ পাবে সে।" (ভোরের মন্দির-৬)
নারীত্ব কখনো কবির 'কালো পাথর', কখনো 'সরস্বতী-দর্শন'। ভেসে আসে যুদ্ধোত্তর সৃজনক্ষেত্রে আত্মমগ্ন  ইতিবাচকতা। কখনো কবি কালিদাস , কখনো বা জয়সিংহের অপর্ণার হাত ধরে।
"বার বার যেতে গিয়ে
বার বার ফিরে আসে
অপর্ণা যেভাবে আসে-
এসেছিল
জয়সিংহের রক্তের জোয়ারে- রক্তাক্ত।" (শতাব্দীর গান)

নিরন্তর যুদ্ধক্লান্ত কবি মৃত্যুর পর পাহাড়ে যেতে চান। আলোক কণার মতো জড়িয়ে পড়তে চান 'বৃক্ষের নিচে-দাঁড়ানো ওড়ানো চুল ,কুমারীর, কালো কালো স্তনে/ ধীরে আসতে স্তব্ধ ঊষাকালে..." (তরবারি) । এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে প্রাচীন পারস্য উপকথায় বর্ণিত 'প্রথম মানুষ' গেয়োমার্টের কথা। গেয়োমার্টকে উপকথায় 'আলোক পুরুষ' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মৃত্যুর পর গেয়োমার্টের দেহ থেকে বিচ্ছুরিত ধাতু সৃষ্টি করেছে পৃথিবী। তাঁর আত্মা হয়ে উঠল সোনা , বীর্য থেকে জন্ম নিল পৃথিবীর প্রথম মানব দম্পতি , দুটো চারগাছের মতো। ১৯৯১ সালের 'পৃথিবী' কবিতায় বিষ্ণু বলেছেন--
         "একদিন কিছুখানি মরণের পরে, ভাঙবে।
                                                        অন্যভাবে
                                এগুলোর কথা মনে থাকে ।" (পৃথিবী)

পরক্ষণেই 'নির্বেদ' কবিতায় তার চোখে ভিড় করছে নীল পেঁচার সবান্ধব চিৎকার , প্রান্তিক অঘ্রাণের শীতে 'শাদা'  ব্যান্ডেজে উঁকি  দিচ্ছে  গ্যাংগ্রিন । তার পারস্য মহামানব গেয়োমার্টের মতো কবিও হয়ে উঠছেন 'গল্পের কুমার'।
                     "ধরাতলে একদিন পৃথিবী এনেছে ধারাজল
                      দেবতা - চোখের আলো ক্রমে নিভে হয়েছে সকাল।"
                                                      (গল্পের কুমার)

            রান্নাঘরে দু'রকমের চিনির প্যাকেট থাকে । এক  ধরনের প্যাকেট , যা আসলে ঠোঙা । উপরে চটের সুতো । দানা দানা চিনি ।  মুদির দোকানের । অন্য প্যাকেটটি  মাল্টিপ্লেক্সর । প্যাকেটের উপর স্বল্পবসনা গৃহিণী  দাঁত বের করে আছেন । পেছনে  বার কোডে দাম।  গুণগত মা, আর কপিরাইট লেখা । বৃষ্টির সময়ে প্রথমটিকে নিয়েই যত ভয়। ঠোঙাটিকে কৌটস্থ না করা অবধি জানালার কপাট চুঁইয়ে আসতে থাকা বৃষ্টির জলে তার ধুয়ে যাবার সম্ভাবনা। দ্বিতীয়টি অবশ্য  এয়ারটাইট । শুধু একটাই ফারাক। প্রথম ঠোঙায় মুদি দোকানের দোকানির আন্তরিকতায় চুঁইয়ে জায়গা করে নেওয়া ফাউ চিনি দানাগুলি বড়ো মধুর । প্যাকেটের চিনিতে তার সুযোগ কই? বাংলার  কবিতা সমাজেও এই দুটো প্যাকেট  আছে বৈকি। ভয় একটাই । সময়ের বৃষ্টির ঝাঁটে কখনো ঠোঙাভরা চিনির প্যাকেট লোপাটই না হয়ে  যায়! প্রতিষ্ঠান ও বলশালী যোগাযোগ বাংলা কবিতাকে সত্যিই অমরত্ব দেয় কি না, সে প্রসঙ্গে বরং পরে যাওয়া যাবে। তবে উপেক্ষা অনেক সময় মানবিক স্মৃতিকোষ থেকে ইতিহাসকে মুছে দিতে পারে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটি গদ্যে কবিতা প্রসঙ্গে বলছেন,"প্রতিমা মিথ ঘুরিয়ে চালচিত্র দেখে না এদেশে । এদেশে নতুন কিছু করার সম্ভাবনা যেমন আছে, প্রচুর আছে , তেমনই মৃত্তিকার রক্তের উপর  না দাঁড়িয়ে সচেতনভাবে কিছু করাও প্রচণ্ড কঠিন।" আশার কথা, উচ্ছৃঙ্খল তরুণ মনকে শৃঙ্খল ও গতিময়তা দিতে যে প্রাজ্ঞ কবিসমাজ এতদিন এগিয়ে এসেছে, তার সূর্যালোকে কবি বিষ্ণু বিশ্বাস বেঁচে থাকতে পেরেছেন। কবি বিভাস রায় চৌধুরী , সমরেশ মুখোপাধ্যায়, সুনীল সোনা, মলয় গোস্বামী ও তরুণ প্রজন্ম আজ কবির পাশে দাঁড়িয়ে । বরাবরের মতোই । কৃতজ্ঞতা , বদান্যতা , উদারতা প্রদর্শনের ইঁদুরদৌড়ে এরা কেউ অংশগ্রহণ করেন নি কোনোদিন, এ কথা ভেবে শ্লাঘাই হয়। সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের আধুনুক বাংলা কবিতা  সম্বন্ধীয়    গদ্য 'গমক নয়, গিমিক এখন বাঙ্গালা কবিতার চরিত্র লক্ষণ'  প্রসঙ্গে বলেছেন, " আশে পাশে শুধরে দেওয়ার মতো কেউ নেই, নেই অভিভাবক, কিংবা দায়িত্বশীল তত্ত্বাবধায়ক । "সুব্রতদার কণ্ঠস্বরে  স্বাভাবিকভাবেই  ফুটে উঠেছে হতাশাগ্রস্থ অনিশ্চয়তা । বিষ্ণু বিশ্বাসের  উপর পুনরালোকপাত সেই দায়িত্বশীল কবিতানিষ্ট পথের মাপকাঠি হয়ে উঠুক, এমনটাই আশা করে মন। অন্তত সেই মানুষটা , যার জীবনকে অতিক্রম করে গেছে মিথ । আর মিথকে অতিক্রম করে অনেক অনেক এগিয়ে গিয়েছে তার কবিতাবিস্তৃত ভূবন।

"গাড়িটি সীমাবদ্ধ সীমান্ত পেরিয়ে সীমাহীন দূরত্বের নৈকট্য এনেছে।আর ফুল ও
খাদ্যের প্রয়োজনে কোথাও মরুভূমিতে কৃষি এনেছে জ্ঞানবান সাফল্য।"
( বাতিকগ্রস্ত লোকটির স্বপ্ন কথা )

" দশ লক্ষাধিক জনতা ধীরে ধীরে ফিরে চলল যে যার ঘরে।
তারা নীরব ও আত্মমগ্ন ছিল।"
( সংবাদপত্রে একটি জনসভার রিপোর্ট )

"সমুদ্রে
নিরঙ্কুশ কাকের আধিপত্যে সৌন্দর্যের মড়ক
শহর, পালাবে আদিভূমে
যেখানে সূচনা-চেতনার ।"
(ভোরের মন্দির)

মন্তব্যসমূহ