শর্ত
হাতগুলো এগিয়ে আসছিল। অসংখ্য হাত। ভিন্ন ভিন্ন রঙের । তার সে-সব হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডগুলো। ভিন্ন ভিন্ন শর্তের বাণীসহ।
পা ডুবল। আস্তে আস্তে কোমর। বুক-পিঠ। নেমে যাচ্ছে সমস্ত শরীর। তলিয়ে যাচ্ছে অথই জলের ঘুর্ণির ভেতরে।শরীরময় জলজ কাঁটালতার খোঁচা। ছিন্নভিন্ন হচ্ছে নগ্ন হাত-পা-বুক। জলের সমতলে ভেসেউঠছে গোলাপি বুদ্বুদ্। রক্তের।কার বাড়ানো হাত ধরবে সে? আপাত সাহায্যের এই শর্তগুলোর মাঝে কোনটা বেছে নেয়া যায়!
আর আশ্চর্য এই জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তার আচমকা মনে পড়ল সেই গল্পটির কথা যা সে বারবার চেষ্টা করেছে কাউকে বলতে । কিন্তু শোনার সময় ছিল না কারো। সবাই এড়িয়ে গেছে ব্যস্ততার অজুহাতে। আসলে তারতো কোন বন্ধুই নেই। ছিল না। আর অনেকেরই এমনি সব গল্পগুলো না বলাই থেকে যায় জীবনভর। বলা হয় না।একদিন চাপা পড়ে মাটির নিচে অথবা আগুনের অবশিষ্টাংশের মাঝে বিলীন হয়ে যায়।
আগ্রহী হাতগুলো তেমনি বাড়ানো আছে একটা লোভ, একটা প্রত্যাশার ব্যাকুলতায়। প্রতিটি হাতেই একটি অথবা একাধিক শর্তের দাবী।
কোনটা? কোনটা?
রক্তের গন্ধে ছুটে আসা জলজদানব কুমীরটা টেনে নিচ্ছিল আরো গভীর জলের ভেতরে। ভয়াল মুখগহ্বরের বাইরে বের হয়ে থাকা তার বাদামী দুইটা হাত তখনও নড়ছিল শর্তের দ্বিধাগ্রস্থতার ভেতরে।
শিকল
অবশেষে তারা থামল।
থামল এসে এক বরফমোড়া প্রান্তরে। আর খুঁজতে লাগল তাদের আপন আপন পথের নিশানা। তাদের চারপাশ ঘিরে বইছে সীমাহীন নিস্তব্দতার এক বাতাবরণ। মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা? আসলে কথাটা ভুল। মৃত্যুকেও ঘিরে থাকে এক ধরণের কোলাহল, হাহাকারের হৈ চৈ ।
এই নীরবতাটা বরফের মতোই। শীতল। জমাট। তারা পাশাপাশি হাঁটছিল। পাশাপাশি। কাছাকাছি নয়। কেউ কাউকে না দিচ্ছিল স্পর্শের আশ্বাস , না জাগাতে পারছিল সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষা। তাদের পায়ের নিচে, মাথায়, সমস্ত শরীরে জড়িয়ে যাচ্ছিল হিমকুয়াশার গুড়ি গুড়ি কণা। ক্রমশ তারা হয়ে যাচ্ছিল আরো বেশি শীতল-ঠান্ডা দুই বরফ খন্ড।
এভাবে কত ঘন্টা...বৎসর...যুগ...শতাব্দী ধরে হেঁটে যাচ্ছে তারা? আর কেনই বা এই সঙ্গহীন সঙ্গ?
এখন তারা ভাবছিল না এসব। দুজনেরই একধরণের তাড়া ভেতরে ভেতরে। একটা শেষ পথের অনুসন্ধানে ব্যস্ত তাদের চোখ।
শেষপর্যন্ত তারা যেখানে এসে থেমেছে, সেখান থেকেই শুরু হবে তাদের ভিন্ন যাত্রার আয়োজন।
এই পর্যন্ত এসে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত নারীটি বসে পড়ল ধুলিমলিন সেই প্রান্তরের একপাশে। বলল, আর পারছিনা আমি। এখানেই থাকি। তুমি এগিয়ে যাও।
পুরুষটি একটু ইতস্তত ফিরে তাকাল, তারপর এগিয়ে যেতে শুরু করল। আর...তারপরে... আবার ফিরে এল বা আসতে হল।
তাকাল তার পায়ের দিকে আর পকেটগুলো হাতড়াতে লাগল একটা চাবির খোঁজে।
মন্তব্যসমূহ