এক বৃদ্ধের গল্প এবং একজন কবি--বিষ্ণু বিশ্বাস //নাজনীন খলিল

এক বৃদ্ধের গল্প এবং একজন কবি--বিষ্ণু বিশ্বাস //নাজনীন খলিল



"আমি নেই, হয়ত ছিলাম---"
এমন দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণে কে বলতে পারে এই কথা?একজন কবি ছাড়া আর কেউনা।যেখানে প্রতিদিন মানুষ সাড়ম্বরে জানান দিচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব ----আমি আছি ,আমি ছিলাম , আমি থাকবো।এমন নিঃশর্তে নিজের অস্তিত্বের প্রতি সন্দিহান হতে পারেন শুধুমাত্র একজন কবিই।কিন্তু এই মৃদু উচ্চারণই প্রবলভাবে জানিয়ে দেয় ---কবি আছেন , কবি ছিলেন।এই উচ্চারণ একজন কবির অহংকারের উচ্চারণ।শুধুমাত্র একজন কবিকেই মানায়।


" ‘আমি নেই, হয়ত ছিলাম’, শুরু হল এইভাবে তার কথা।
সে মরে গেছে কি বেঁচে আছে, তা নিয়ে আমরা ভাবছি না তখন।
কে জানে, সে হয়ত শেষ থেকে শুরু করেছিল। তবে তার গল্প শুরু হলো সে সময়
যে সময়টিতে কেউ আমরা আর তৈরি নই এই গল্পটি শোনবার জন্য।"
( এক বৃদ্ধের গল্প/বিষ্ণু বিশ্বাস// ২১/২২.১১.৯২ )

             কী বিস্ময়কর! কী অদ্ভুত মিল নিজের জীবনের সাথে !
 হ্যাঁ কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের কথা বলছি। আশির দশকের কবি।
জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঝিনাইদহের বিষয়খালিতে (১৯৬২/২৯ মে)।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। '৮৫ সালে অনার্স শেষ করে চলে আসেন ঢাকায় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ।নতুন জগৎ ।জীবনযাপন এবং কাব্যচর্চার নতুন পরিমন্ডল।শুরু হয় কিছুটা যেন এলোমেলো, এক বোহেমিয়ান জীবনযাপন। ।তবুও সময়ের সাথে মানিয়ে যায় সবকিছুই।লেখালেখি, আড্ডা, বন্ধুবান্ধব সবই চলছিল স্বাভাবিক।


           ছন্দপতন ঘটলো ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার রাজনৈতিক ডামাডোলে।যার প্রভাবমুক্ত ছিলনা বাংলাদেশও।সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা উদ্ভুত এই হিংস্র পরিস্থিতি কবিকে বিপর্যস্ত করেছিল মারাত্মকভাবে।করেছিল আতংকগ্রস্থ।আজব আজব হ্যালুসিনেশনে ভোগতে থাকেন।ভীতচকিত হয়ে দেখতেন একটা সাদা গাড়ী  অথবা ছুরি হাতে কেউ একজন তাকে তাড়া করে ফিরছে।এইরকম ভীতিবিহবলতার মাঝে প্রায়ই উধাও হয়ে যেতে শুরু করেন মাঝে মাঝেই । আবার ফিরেও আসেন। এরকম স্কিৎজোফ্রেনিক অবস্থায় শুরু হয় মনোচিকিৎসা। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যান একেবারেই ।চলে যান পশিমবঙ্গে।১৯৯৩ সালে। এরপর বহু বছর আর তেমন কোন খোঁজ পাওয়া যায়না তাঁর।খোঁজ মিলল সুদীর্ঘ আঠারো বৎসর পরে ।পশিমবঙ্গের বনগাঁয়ের আশেপাশে কোথাও আছেন তিনি এটুকু জানা গেল। যেখানেই হোক, আছেন যে এটাই আনন্দের এবং স্বস্তির।


            তাঁর বন্ধুবান্ধবের কথা থেকে জানা যায় বিষ্ণূ ছিলেন খুব ফ্যাশন্যাবল ছেলে। জিনস্‌ছিল তাঁর প্রিয়, শার্ট পরতেন ইন করে।আশ্চর্য ব্যাপার  হলো সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েও তিনি ভুলে যাননি নিজেকে গুছিয়ে রাখার অভ্যাস, ভুলে যাননি তাঁর একদাঘনিষ্ট বন্ধুদের নাম।এক প্রত্যক্ষদর্শী সুহৃদের কাছে জানা যায় আজো তিনি আগের মতই থাকেন সুসজ্জিত আর কেউ বন্ধুদের কথা জিজ্ঞেস করে গড়গড় করে বলে যান বন্ধুদের প্রিয় নামগুলো।অর্থাৎ  তিনি আছেন স্মৃতি ও বিস্মৃতির এক নতুন জগতে। যা ফেলে এসেছেন পিছনে তা সম্পূর্ণ ধরে রাখতে না পারলেও পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেননি ,অতীতের কিছু অংশ আঁকড়ে ধরে আছেন গভীর মমতায় ।

" থেমে থাক, লাল লাল বোতলে সৌগন্ধ স্থির
জলভারে
অপূর্ব অন্তর উৎসারিত শান্ত কান্ত জল
তোমাদের
আর নোনা হাড়ের আঘাতে ঝরুক আদর?
নোনা দাঁতে নোনা হাড়ে।
তারপরে
সাগরের অজানা গুহায় মানব আমি দাঁড়াব এসে
সম্মুখে তোমার তোমাদের
ঝর্ণাধারা
শাদা শাদা পতাকার মতো হলদে সঙ্গীত হবে
যখন ভোর হবে ভোরের আকাশের নীল চোখে।"
(রাতের সঙ্গীত/বিষ্ণূ বিশ্বাস)


              জীবন থেমে যায়নি ঠিক ।তবে থমকে আছে। প্রায় চলৎশক্তিহীন। এই থমকে যাওয় জীবন আবার চলতে শুরু করবেতো?"ঝর্ণাধারা /শাদা শাদা পতাকার মতো হলদে সঙ্গীত হবে /যখন ভোর হবে ভোরের আকাশের নীল চোখে" । আকাশের নীলচোখে ভোর হোক।কবির জীবন বয়ে যাক ঝর্ণাধারা হয়ে ,শাদা পতাকার মতো হলদে সঙ্গীতে।


                কবি কি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ? '৯২ সালে লেখা  এক কবিতায় লিখছেন, ' আমি নেই ,হয়ত ছিলাম', আর ঠিক এক বৎসরের মাথায়ই হারিয়ে গেলেন, নেই হয়ে গেলেন। ' আমি নেই ,হয়ত ছিলাম'  বাক্যটা আর 'এক বৃদ্ধের গল্প' হয়ে রইলনা।হয়ে গেল কবির নিজস্ব উচ্চারণ।

                এই কবিতা যখনকার কবি তখন হয়ত ভোগছিলেন অস্তিত্বহীনতার সংকটে।এই থাকা অথবা না থাকা ধরে নিতে পারি নিজেকে নিয়ে একধরণের দ্বিধাগ্রস্থতা--নিজের গুরুত্ব-অগুরুত্ব নিয়ে।এই দ্বিধাদ্বন্দ নিয়তই আলোড়িত করে মননশীল মানুষকে।কী আমার অবস্থান অথবা আমি কতটুকু প্রয়োজনীয় অন্যদের কাছে--এই কৌতুহল মানুষের মাঝে খুবই প্রবল।বিশেষ করে একজন কবির কাছে।কবি থাকেনইতো নিজস্ব অস্তিত্বভাবনার জগতে ।নিজের এবং  চারপাশের  বাস্তবতা থেকে দূরে এক কল্পরাজ্যের সন্ধানে। এই পলায়নি মনোভাব থেকেইতো কবিতার জন্ম।কবি বাস্তবের হয়েও সম্পূর্ণ  বাস্তবের নন।

                কে যেন বলে গেছেন --একজন কবির ভাবনা সমাজের সাধারণ মানুষের ভাবনার থেকে পঞ্চাশ বৎসর এগিয়ে থাকে। কাজেই এই প্রগতিশীল ভাবনার মাণদন্ডে প্রচলিত সমাজকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে গিয়েই কবি বারবার হোঁচট খান।সমঝোতা করাটা কখনোবা দূরুহতম হয়ে ঊঠে তার জন্য।আর তখনই ঘটে যায় বিপত্তি।সমাজ এবং কবিমানসের মধ্যে শুরু হয় এক অনিবার্য সংঘর্ষ--যাকে কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্থ হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।ভেঙ্গে যায় মানসিকস্থিতির বাঁধ।নিজের সাথেই তখন নিরন্তর  যুদ্ধে যুদ্ধে ক্লান্ত কবি কখনওবা পারেন স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরে আসতে,  আবার কখনও ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দেন ;খেই হারিয়ে ফেলেন ।বিষ্ণু এই যুদ্ধে হেরে গেলেন ।স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফেরা হলোনা তাঁর।

"তারপর দ্রুত ভিড়ের ভেতর কোথায় সে ডুব দিল
 কোনদিন, তারপরে, তাকে আমরা আর দেখি নি।"
 ( এক বৃদ্ধের গল্প/বিষ্ণু বিশ্বাস)

  এতো নেহায়েতই 'এক বৃদ্ধের গল্প' নয়।এ যে কবির নিজেরই গল্প।অজানা অচেনা এক ভিড়ের ভিতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলার গল্প।যাকে আর কেউ খুঁজে পাবেনা সুদীর্ঘ আঠারো বৎসর পর্যন্ত ; এমন সফল এক আত্মগোপন।এই আত্মগোপনে আর কার কি আসলো গেল জানিনা ,বড় হয়ে রইল একজন অমিত সম্ভাবনাময় কবির আত্মবিনাশের ইতিহাস।বাংলাসাহিত্য বঞ্চিত হয়ে গেল কিছু আসাধারণ পংক্তিমালা থেকে।

             আশার কথা কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের খোঁজ পাওয়া গেছে। কিছু অসাধারণ মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন যাতে কবিকে আবার সুস্থ করে তোলা যায়। ফিরিয়ে আনা যায় তাঁর পরিচিত সাহিত্যের ভূবনে।
আশাকরি বিষ্ণু আবার ফিরবেন আমাদের মাঝে সুস্থ-স্বাভাবিক। বাংলা সাহিত্যভান্ডারে যোগ করবেন আরো নতুন কিছু অসাধারণ কাব্যশৈলি।


"এমন গল্পের কবি অন্ধ হলে সৃষ্টি স্থিতি লয়
নিশ্চিহ্ন আলোর সখা, তোমাদের শোনা কোন গান
পাথরে স্থির হয়েছে।"
( গল্পের কুমার / বিষ্ণু বিশ্বাস)


এমন কবিতা গল্পের কবির অন্ধত্ব মেনে নেওয়া যায়না। " এমন গল্পের কবি " আবার চক্ষুষ্মান হও।ফিরে এসো আলোকের ঝার্ণাধারায়------'যখন ভোর হবে ভোরের আকাশের নীল চোখে '।

"শুধু মৃতদের গল্প কত আর কাঁধে ঝুলে যাবে
এবার নিষ্কৃতি পেলে, শান্তি অন্বেষণে মহাকাশে
গিয়ে, দু’টুকরো লোহা ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দেব
অসহ অসীম শব পুড়ে হোক ছাই পুড়ে ছাই।"
( কালো মেয়ে / বিষ্ণু বিশ্বাস)


হ্যাঁ কবি --মৃতদের গল্পগুলো কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে , শবগুলো পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে শুরু হোক নবজীবনের গান। জীবন আবার ফিরুক জীবনের মতো।


এক বৃদ্ধের গল্প/ বিষ্ণু বিশ্বাস


সূর্য ধীরে নিভে গেল। আকাশে গোলাপি একটা রঙ আস্তে অন্ধকারে হারাল। এক
বৃদ্ধকে ঘিরে আমরা বসে আছি কিছু তরুণ তরুণী। বহুকালের প্রাচীন। ও আমাদের
কিছু বলবে ভেবেছে, অথবা,
আমরা কিছু শুনব অপেক্ষায় রয়েছি। আমরা কোনো কথাই বলছি না।
তারপর একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ- বৃদ্ধটির। নাভীপদ্মে সঞ্চিত যেন বহুকালের
গাঁজাময় গেজানো ধোঁয়া সে অসীমে ফুঁকে দিল।
‘আমি নেই, হয়ত ছিলাম’, শুরু হল এইভাবে তার কথা।
সে মরে গেছে কি বেঁচে আছে, তা নিয়ে আমরা ভাবছি না তখন।
কে জানে, সে হয়ত শেষ থেকে শুরু করেছিল। তবে তার গল্প শুরু হলো সে সময়
যে সময়টিতে কেউ আমরা আর তৈরি নই এই গল্পটি শোনবার জন্য।
কিন্তু শুরুতেই একটি প্রাচীন তরবারির কর্মসিদ্ধির কথা বলে, সে আমাদের থমকে
দিয়েছে। তারপর কবেকার ওর জীর্ণ ব্যাগ থেকে রাশি রাশি ঝরা পাতার মতো টাকা
-টাকা, একে একে, মুঠো মুঠো বের করল, আর তাতে আগুন জ্বালাল।
পৃথিবীর যতসব সুগন্ধি বৃক্ষের পত্র, পোড়া মাংস আর ধূপগন্ধের মতো,
চন্দন বনের হাওয়ায় কোথায় যেন হারিয়ে গেল সেইসব।
আমরা আবার ব্যাকুল হলাম- কী বলে, শুনবো ভেবে ঠিক তখুনি
সে তার পলকা দাড়িতে কিছুক্ষণ হাত বুলালো, মাথা থেকে টুপিটি পকেটে নিল এবং
হাসল, তীব্র মৃদুস্বরে বলল, ‘এবার তোমরা’।
তারপর দ্রুত ভিড়ের ভেতর কোথায় সে ডুব দিল
 কোনদিন, তারপরে, তাকে আমরা আর দেখি নি।

২১/২২.১১.৯২

মন্তব্যসমূহ

আইরিন সুলতানা বলেছেন…
চমৎকার করে কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতার ভাঁজ খুলে খুলে দেখেছেন আপা। এভাবে বিষ্ণু বিশ্বাসকে পাঠকের সাথে পরিচিত করানোর জন্য ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা।