ঈশ্বর এক রোমাঞ্চকর বিষাদের নাম/ অমিত কুমার বিশ্বাস

    ঈশ্বর এক রোমাঞ্চকর বিষাদের নাম/ অমিত কুমার বিশ্বাস  

             জীবনে কবিতা অপরিহার্য । জীবনের সাথে কবিতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ও জীবনরসে   জারিত। কবিতার মৃত্যু মানে মানবাত্মার মৃত্যু। মানুষ বেঁচে থাকে কিছু অনুভবকে ভর  করে। আর যদি সেই অনুভব না থাকে, তবে সে জীবন্মৃত হয়ে হেঁটে যাবে বহুদূর আস্ত  এক  শরীর  নিয়ে।  এই বাঁচার মধ্যেও স্বার্থকতা আছে, যেমন আছে  শূকরের ঘোঁতঘোঁতযাপনে । কবিতাকে যে সব থেকে বেশি বোমা ছুঁড়ছে, তার জীবনটাই তো সব  থেকে  কাব্যময় । হয়তো সে বুঝতে পারছে না  কবিতা কীভাবে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজও,  হয়তো বা  সচেতনভাবে কাব্যকে দূরে সরিয়ে রেখেছে সে। একরকম হীনম্মন্যতা কাজ করছে তার মধ্যে  । কন্যার পিতা হবার আনন্দ  উপভোগ করতে পারেন না  অনেকেই। এও এক আত্মঘাতী ভাবনা। এই সব মেঘ করে আসা আত্মহত্যার বারান্দা থেকে আবার বেরিয়ে পড়া ।কবিতার টানে। তাই আবার ছোটা। আবার নেমে পড়া। পথে।  পথের শেষেই  যে  ঈশ্বরের ঘরবাড়ি! 
কবির সাথে আমি। 


                            ২  

               না । কেউ কিছুই বলেনি। দুম্ করে জানিয়ে দিলাম , এবার কবি বিষ্ণু বিশ্বাস সংখ্যা হবে। কেন? গিমিক ? অনেকের মতো ? অথচ তখনও পর্যন্ত 'জল', 'আকাশগঙ্গা ও 'শতাব্দীর গান' ছাড়া আর কোনো লেখাই আমার পড়া হয় নি। কবি সম্পর্কে কিছুটা জেনেছি কবির  একমাত্র কাব্যগ্রন্থ 'ভোরের মন্দির'- এর প্রাককথন' থেকে,  লিখেছেন নিশাত জাহান রানা ও সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ । এ-সবই ২০১১ তে রণবীর দত্ত সম্পাদিত 'কবিতা আশ্রম'-এ  পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল। আর  প্রথম পাঠে এই ক'টা কবিতাই আমাকে চমকে দিলেও কাছ থেকে কবিকে দেখার বাসনা জাগেনি তখনও।  আজ হঠাৎ? পত্রিকার স্বার্থে ? কী স্বার্থপর!  আমি থেকে আমরা। মুখোশের আড়ালে কি বেজে উঠবে শ্যামের বাঁশের বাঁশি ! বলা মুশকিল। কারণ আমি মানুষ । আমরাও। আমরা হাতিদের ডেরায় ট্রেন চালিয়ে হাতিনিধনে মেতে উঠি। বাঘেদেরও । অতএব... 
                     ৩
            যে কাজ করতে ছ'মাস- এক বছর লাগে তা মাত্র ২৫ দিনে? পাগল নাকি ? আমি কি সত্যিই খেপে গেলাম? আগামাথা না ভেবেই ঝাঁপ? আত্মহত্যা ? আসলে এরকম-ই আমি। আজীবন। তাই হোঁচট খাই বারে বারে। প্রেমে- অপ্রেমে। অন্যরা অভিমান করল কি-না  কখনও জানতে চাইনি । খ্যাপামো । চরম হতাশা। কান্নার আগ্নেয়াস্ত্র । এই। এইসবই তো আমার যাপন। তবু মুখে হাসি।  তাই বন্ধুর ভালোবাসা জুটে যায় । এপার- ওপার থেকে। ঘৃণাও । এ-দুইই জীবনে বড়ো বেশি দরকার। কাজ করার জন্য। কাজই  ঈশ্বর। তাই ঈশ্বরের খোঁজে । আর একবার। এবারে সাথি কবি সুনীল সোনা,সম্পর্কে যিনি কবির নিকট আত্মীয় । মনে একটাই শঙ্কা হচ্ছিল , যাচ্ছি, কিন্তু কবির দেখা পাবো  কি?  এরকম নানা শঙ্কা আর দুপুরের চাঁদিফাটা রোদ অবজ্ঞা করে ছুটছে আমাদের গাড়ি। ঘাসবন , কাশবন , বাঁশবন, গাছবন--সব, সব কিছু টপকে ছুটছে আমাদের যান। উঠছে ছবি। চলছে কথা। কিছু কথায় চমকে গেলাম। জামলাম তমালের ( কবিবন্ধু তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় ) এখানে আসার গল্প, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে তার জীবিত থাকার খবর দেবার ঘটনা ইত্যাদি ইত্যাদি।  কিন্তু সব থেকে চমকে উঠলাম  তিনবছর আগে হওয়া এক বিতর্ক নিয়ে। সেখানে বিভাসদার ( কবি বিভাস রায়চৌধুরী) শুভ উদ্যোগকে কীভাবে সন্দেহের চোখে দেখছে কেউ কেউ। আর তার আঁচ ছড়িয়ে পড়ছে ওপারেও।  কিভাবে এক 'মসিহা'  হয়ে ওঠে 'খল'! সামাজিক আন্তর্জালের  'কি অনির্বচনীয় মহিমা' !  দশচক্রে ভগবান ভূত! তবু দমে যাবার পাত্র নন । ভালোবাসার মতো শক্তিশালী শব্দ  পৃথিবীতে দুটো পাওয়া যায় না। আর এই ভালোবাসার জোরেই কীভাবে একটা মানুষ  লড়ে গেছে -- ভাবলে হাজার সেলাম ঠুকি , আবার আৎকে উঠি ! এ-সব  আমি হলে কি পারতাম? আবার নিজেকে  স্বার্থপর মনে হতে লাগল। সত্যি  কথাটা হল, এত কিছু জানা থাকলে আমি হয়তো এগোতাম না। কিন্তু 'মু ফাড়কে' বলে ফেলেছি। অতএব 'নো ওয়ে আউট' ! গালাগাল দেবার জন্য বসে আছে মুখবই এর ঝাঁ চকচকে খিস্তিবিশারদ্গণ ।  থোরা ইধার সে উধার হুঁয়া  তো তু গোলি খা, গালি ভি খা! ঢিঁ-সা সা আ আ আ !!!!   মুখবই জুড়ে কেবল কমেন্টানো ! তবু মনে মনে ভাবলাম , বাধা আসবে না। অনেক  বাধাই তো সামলেছি। কিন্তু লেখা? কে দেবে? ভাবিনি।  বেশ । ওপর আলা কি আমাকে বলে দিয়েছেন , পাগলা, ওসব নিয়ে  ভাবিস না ! হয়ে যাবে হয়ে যাবে! কিন্তু কি করে?
                            ৪
          প্রায় দেড় ঘণ্টার পথে এসে  পড়লাম । কবির বাড়ির কাছেই এক দোকানে দাঁড়ালাম। সিগারেট নিলাম। মুড়ি নকুল দানা সহ সামান্য দেশজ ভোজ চলল। একটা বড়ো পুকুর চোখে পড়ল। এই  পুকুরের মাঝে কি অদ্ভুত এক চর, যা  পুরো পুকুরটাকে বিভাজন করেছে।তার মাঝ খানে দুটো ছাগলছানা দাঁড়িয়ে আছে । কী আশ্চর্য । নামলাম ছবি নেবো বলে । ওরা  ফিরে গেল। হয়তো ওই দূর থেকেই ওদের অভিমান হয়েছে।  আর ছাগলছানারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মহা আনন্দে। পাশে রাজহাঁস ।  অসংখ্য । জলের শীতলতা নিচ্ছে আর ক্রমশ ভেঙিয়ে যাচ্ছে আমাদের ! হায় মানুষ! 
                        ৫ 
'খালবিলনদীনালা  ছেড়ে এবারে আমরা সাগরে' এসে পড়লাম। ঈশ্বরের মন্দির। টিনের খুপরির মধ্যে ঈশ্বরের শুয়ে আছেন ।
-- দাদা, এ অমিত, সম্পাদক!
স্বয়ং ঈশ্বর  স্মিত হাসি নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন , আর বললেন , কেমন আছেন? যেন  শুনলাম 'এতদিন কোথায় ছিলেন?' জীবনানন্দীয় ভাবাবেগে ডুবে থাকা আদ্যপান্ত কবির কণ্ঠেও কি সেই সুর? ঈশ্বরের হাতে এক অদ্ভুত উষ্ণতা । সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। 
-শিমুল দাকে চেনেন দাদা? শিমুল মাহমুদ?
-হু। 
-নিশাত জাহান রানা? 
-হু।
- সুব্রত দা? সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ?
-হু।
--এখন কবিতা লেখেন?
--না।
--কেন?
--সময় পাইনা। 
--বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছে করে?
--হু। বাংলাদেশে যাবো। 
এরকম হাজারটা প্রশ্ন। তাঁর চিকিৎসা নিয়ে। খাওয়া নিয়ে। বই নিয়ে। পোশাক - আশাক নিয়ে। কবির মা এলেন। মাকে চা করতে বললেন। সুনীলদা কবির হাতে তাঁর নতুন কবিতার বই ' প্রতিটি জন্মের ধুলো' তুলে দিলেন। কবি পড়লেন। পাতা উলটে উলটে । এর পর সুনীলদা কিছু নতুন কবিতা পড়ে শোনালেন। টেবিলে তাকালাম। জলের গ্লাস।  বোতল। টেবিল ফ্যান। ওষুধ ছড়িয়ে আছে । কিছু বই। খাতা-পেন। তার বই  লোকে নিয়ে যায়। ফেরত দেয় না। কবির মায়ের আক্ষেপ তার 'ভোরের মন্দির'- এর কপিটি এক তরুণ কবি/ সম্পাদক নিয়ে আর ফেরত দেয় না। যেমন হয় আর কি। পারলে হয়তো কবির মাথাটাও নিয়ে যেত! মানুষ তো। 
চা এল। লিকার। এবার চুমুক দেবার পালা। সাথে বিস্কুট। কবি আমার দিকে বিস্কুট বাড়িয়ে দিলেন। এর পর কবির দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিলাম। কবি ধরালেন ঈশ্বরের মতো। অথবা  ঈশ্বর কবির মতো!  
কবির মা বিড়ি বাঁধেন। এভাবেই চলে দুটো পেট। কিন্তু কতদিন। মা তো আর থাকবে না চিরদিন । তারপর? ইঁদুর খুবলে নেবে ঘুমন্ত কবির হাত! তারপর হাসপাতাল। তারপর বাড়ি। তারপর আবার ইঁদুর ছানা লাফিয়ে উঠবে! আবার ....

কবি তোমার বাড়ি কোথায়?কবি তোমার দেশ কোথায়?কবি তোমার জন্ম?কবি তুমি হিন্দু না মুসলমান?কবি তুমি ব্রাক্ষ্মন না শূদ্র?তোমার ভাষা ,কবি?তোমার ইঁদুর গুলো কি পোষা?আর বেড়ালছানাগুলো ?তোমার দেহ নিয়ে কি আমরা দড়িটানাটানি খেলবো না কবি?তোমার মৃত্যুর পর কত মালা ! কত কত কত উৎযাপন ! কবিতা সভা! কবি তুমি এরকমই থাকো!আমরা না মানুষ!

ঈশ্বরের সিগারেটে ধোঁয়ায় ভরে যায় ঘর।
-আবার আসবেন।
আবার কি আসবো? সত্যিই? এত কবি পাতায় পাতায়, এত ছোটো -বড়ো -মেঝো কাগজ , এত উত্তরীয় উত্তরীয় খেলা, কবিতা পাঠ --- এসব ছেড়ে কি আবার আসা হবে? সূর্য  ঢলে আসে । পুজোর পর ঈশ্বর পড়ে থাকেন গাছতলে। অসহায় ভাবে। রোদবৃষ্টি মেখে। ক্ষয়ে আসে ভগবান। অনাথ ভগবান। একটু একটু করে। পুরোহিত দেখে। কবি দেখে। আমি দেখি। শ্রীলা দেখে। সবাই...
 গাড়িও ধোঁয়া ছাড়ে। পুকুরে তখনও রাজহাঁস । চড়ে দাঁড়িয়ে ছাগল। আমরা ছুটি। ছুটে যাই। আমাদের শহরের দিকে। আমাদের অনেক স্বার্থ আছে। ঘরভর্তি স্বার্থ । 

কবির বাড়ি 
  

মন্তব্যসমূহ