বিষ্ণুর জন্য সুব্রত’র কয়েক টুকরা

           বিষ্ণুর জন্য সুব্রত’র কয়েক টুকরা

           সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ

           Le Prince Héritier

           My prince cannot stand still. Or, maybe he can. Maybe it is one of those times when he is caught between his feet—which is his stride. O my prince cannot stand still. But, maybe, he can!
          He can fly like a butterfly without having to do that. He can do anything without having to do anything. My prince can fly. Or perhaps he can’t. All this is regulated by some shibboleth or by the absence thereof. He knows.
          My prince cannot fly. But he can.
         He can twinkle! He can chewinkle! What could that be? He knows.
         Come to me ye children of the world, I shall tell you the tale my prince told me, or maybe I told him, about himself, or about anything—which is quite good and is worth listening to.
         Gather! Gather! Hand in hand! Stand! Sit! Lie!
         My prince cannot stand the heat of the sun. But maybe he very well withstands it all. He knows. Brothers and daughters! Fathers and sisters! Come, and swim in this viscous sunshine, this gel of a sunshine, swim!
         He lifts up his hand, my prince, man of man. He lifts up his arm, g‑e‑n‑t‑l‑y…. Son of man, look at him! Look! He is at his best, his very most. He is there, the prince. Lo! How greedily is his coronet glistering like gold! Or is it gold which glisters like his coronet? He knows.
         My prince cannot swim in sunshine. But he can.
         On the shimmering brink of my tale, there lounges a beautiful mirage. Or it could only be a deterring uproar—derived from winter rooftops, chimney’d...
         Maybe a third somebody—but who? Maybe my prince knows it all, maybe he doesn’t. It is yellow, or yellowish; it is yellowesque; it is by all means—golden! That is the hue. Or at least it is the spell that only gold can cast. Perhaps.
        But what has my prince to do with this golden? Where will he breathe?
        And you—you who are stereotyped, who were born in your sister’s womb—you are also welcome! No, do not hide! Don’t! It is all happiness, all the very best.
         My prince is calm now. Or maybe he isn’t. He knows. His teardrops waft down like dewdrops to the marble floor; and his phoenix, untamed, twitters across the parlour—tu whit tu whoo.
         My prince cannot fly. And he can.
         My prince is cold! Dead cold! O heat him up! Come, ye agents of radiances and all. Muster your strictures and all. My prince will go frigid! Alas!
         Come behind the ruddy rock through the deathly crevice. Come, and, lo! There is nothing! Or, maybe, there is. He knows.
         Under these granite shelves, delve deep deep deep into the bottom, and fling yourself up up up—and you are there! In Vaijayantipur! Where my prince is.
           I think.
           My prince is coming from Russia, with pockets full of nectarines, of every shape and hue and taste, of every probable and improbable shape and hue and taste. But nectarine is an un‑Indian fruit. We do not know. He knows.
           He is the blessed. He is the wonder of the world, nowhere to be found again, never again to be heard of.
           This is his arrival, and this his departure. Blaring trumpets and blowing oboes regaling in and out. And the clouds that are neither black nor white gather around the sacrosanct peak of Mount Chimbuk. And there is is. There I can’t listen to nothing. Or maybe I can. He knows.

                                                    Dhaka, December 1997
মায়ের সাথে কবি।জুন ৭,২০১৪



 গান

তুমি আজও
            রক্তে করো গান।
                        কিংবা বুঝি হায়
                                    রক্তই
হ’য়ে গেছে
            কণ্ঠ গো তোমার!
                        অন্ধ অধিরাজ,
                                    চিত্তের,
তোলো তবে
            জোন্‌হা-ভরা পাল
                        মর্ষ-তমসায়
                                    থৈ-থৈ;
করো তুমি
            গেথসিমানি-র এই
                        মজ্জা-গলা রাত
                                    মিথ্যে...

সিডনি, ২০০৩

 বিশল্যকরণী

(বিষ্ণু আর সুব্রতর কথোপকথন তার মৃত্যুর পর। ‘তার’ মানে বিষ্ণুর। কিংবা... সুব্রতর।)

 সুব্রত :

কিন্তু কবে থেকে এই বৃত্তি হ’ল তোর...

 বিষ্ণু :
একদিন ঘুম ভেঙে দেখি ( কিংবা দেখে
ঘুম ভাঙে) একাকার গোধূলি ও ভোর,
আকাশটা আদিগন্ত ভারতীয় ফিকে,
হয়তো ডুবেছে সূর্য, অথবা ওঠে নি—
ঊর্ধ্বমুখী প্রত্যালীঢ় বসি তপস্যায় :
আকাশ বিম্বিত হ’ল অন্তরে। অমনি—
ভ’রে গেল রৌদ্রোজ্জ্বল অমাবস্যায়
আমার হৃদয়;— আর বুলেট তরাসে
কান দিয়ে ঢুকে গেল... স্বয়ং সূর্য যে,
আকাশকে ফাঁকি দিয়ে— আমার আকাশে!
সন্ধিক্ষণ থমকে গেল— শুধু উঠল বেজে
সন্ধিপ্রকাশ, অস্তিত্বের চারপাশে
জলতরঙ্গের মতো।

সুব্রত :
আর তারপর...

বিষ্ণু :
ত্রসরেণু হেন, আহা, গুহ্য মোতি এক
টের পাই অভ্যন্তরে— অহো, কী প্রখর,
কী যে আশ্চর্য সেই ঊহ্য অতিরেক!
কী আশ্চর্য সেই উদ্বোধন, হায়!
ধমনির মুগ্ধ রক্ত দুগ্ধ হ’য়ে ধায়
ঐকান্তিক অভিমুখে! কী দরিদ্র লাগে
নিজেকে! পারি তো, চিপড়ে দিই তার মুখে
আত্মার তলানি তক;— কিন্তু, আরও মাগে!
- কাতরাই অপরুপ সূতিকা অসুখে।

কৃষ্ণ চাঁদে যেরকম কলায় কলায়
শুক্ল চাঁদ বাড়ে, বাড়ে সেও— একই তালে
আমারও ঘটতে থাকে ক্রমশোবিলয়,
শুকনো খোলা হ’য়ে যাই আমি তার, কালে।

সুব্রত :
অতঃপর...

বিষ্ণু :
খোল ভেঙে বেরিয়ে সে আসে,
হিরণ কিরণে গড়া দানব দেবতা—
আজন্ম ক্ষুধায় আর আজন্ম পিয়াসে
খোলটা খেয়ে শুরু করে মানবীয় প্রথা—
আর তৃপ্ত ঘুম যায়; জেগে উঠি আমি...

সুব্রত :
কিন্তু তুই তো খোল, শাঁস তো সে...

বিষ্ণু :
না না,
শাঁস, খোসা, উভয়ই সে, উভয়েই আমি...

সুব্রত :
তোরই মাঝে তুই হলি, তুই হ’য়ে ফানা?

বিষ্ণু :
হ্যাঁ, তাই, কেবলমাত্র কিছু বেশি দামি
হলাম এবার।

সুব্রত :
সে কি আলোকের দাম?
কিন্তু, ওজনের মতো, সে কি দাম হীনও
নয়?

বিষ্ণু :
সত্য, তার নিজের কোনোই দাম
নাই। শুধু যে মাটিতে পড়ে, তার তৃণ
ফলাতে আরম্ভ করে মুক্তার বাদাম—
তেমনই, আমিও হই দামি।

সুব্রত :
তো তখন?

বিষ্ণু :
আস্তে আস্তে দাম ক’মে যেতে শুরু করে,
নানা পথে চ’লে চলে অবমূল্যায়ন,—
তারপর আবার বুক দুরুদুরু করে,
আরবার ফিকে হ’য়ে আসে সন্ধিক্ষণ...

সুব্রত :
আবার...

বিষ্ণু :
সময় হয় তার ফেরবার...

সুব্রত :
কিন্তু এই তপস্যা কি নয় অবান্তর?
যা ছিলি তাই-ই যদি হ’স ফের-বার,
কেন এই মর্মান্তিক জন্মজন্মান্তর?

বিষ্ণু :
কারণ এখন আমি জানি, এ-ই ঘটে,
আমার যেমন, তেমনি তোরও এ-ই হয়—
জানি ব’লে, ডাকি তাকে নিজের নিকটে,
ভয়ের বদলে দিই রক্তের প্রণয়।

পারিস তো, বারেক ডাক্ নিজ মৃত্যুকে,
বুক চিরে, ঢুকে যেতে একবারটি দে,
বিরক্ত না হয় যেন তোর দোর ঠুকে,
মিটিয়ে দে জন্মের মতন তার খিদে।

(জন্মকে আবাহনের কথা ব’লে, শেষে মৃত্যু-আহূতির প্রসঙ্গ বিষ্ণু নিয়ে এলো— কথার মারপ্যাঁচে ঘুলিয়ে দিয়ে আমাকে মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিতে, বা টেনে নিতে, কি সে চায়? নাকি জন্ম আর মৃত্যু, আর পুনর্জন্ম আর পুনর্মৃত্যু তুল্যমূল্য তার কাছে? অথবা প্রকৃতিতে? নাকি এই বিপরীতধর্মী কার্য-দু’টির একই ফল? কিংবা, ফলাভাবে, একই মূল্য? আমি জানি না। পাঠক, তুমি জানো?)

সিডনি, ২০০১



ফিরে এসো

কোথা সেই নর-পিরামিড
যাকে আমি “কুমার” বলতাম?
ছিল না যে কবি বা কোবিদ,
শুধু এক অপূর্ব বাদাম—

এমন কিছুই সে বেচারা
করে নি এ ধরণিতে, যার
উল্লেখে পাড়ার বখাটেরা
ক’রে দিত তার ডেরা বা’র।

আজীবনে তাকে আমি সেই
মায়ার আয়ামে একবার
দেখেছি সবুজ জামাতেই
হেঁটে যেতে হৃদয়ে আমার।

মানুষ কখনও জানে নাই
কে সে হয়, কী সে হয়, তবু
বুঝে যেত গভীর প্রাণেই :
নিকটেই আছে তার প্রভু!

আজ কোটি কল্প পরে ফের
আমি খুঁজি সবুজ জামাটি
আঁতিপাঁতি, মনের মাঠের
পুঙ্খে পুঙ্খে— কিন্তু সব মাটি!

সব মাটি, সব পানি, বায়ু,
সব দ্রোহ, সব অঙ্গীকার,
এই সমস্তরই পরমায়ু
নিয়ে এসো, সূর্যের কুমার!

ফিরে এসো এদেশে আবার
এ আকালে, মাঘে বা নিদাঘে—
ও আমার রাজার কুমার,
কী-তৃষ্ণা ভুবন জুড়ে জাগে!

বিতৃষ্ণা ভুবন জুড়ে জাগে!

সিডনি, ১৯৯৭


পুলিপোলাও (৪৯)

কেনে গো তোমারে খালি ভয় খেতে হবে?
তারচেয়ে বরং এসো, এই বার-এ বসি মুখোমুখি।
স্কুনার-কয়েক হোক স্টাউট বিয়ার,
দু’জনে একত্রে ফিরি সদৃশ শৈশবে।

আমি তো জেনেছি, সাঁই, ভাবে ও ভঙ্গিতে,
তোমারও দরকার শুধু একজন ইয়ার—
তুমিও আমারই মতো পথে ঘাটে ফ্যাঁ-ফ্যাঁ-ঘোরা জনৈক অমুকই,
তুমিও কালের স্রোত পারো না লঙ্ঘিতে।

তোমারও হৃদয় কাঁদে, জেনে গেছি কালকের বৃষ্টিতে,
তোমারও পরান পোড়ে, বুঝে গেছি কালকের হাওয়ায়,
অমনি— এতিমখানা ভরেছে ইষ্টিতে,
নভোময় একখানি করুণ চাওয়ায়...

তবে আর সঙ্কোচ কীসের? এসো, ব’সো গলাগলি,
একটি লহমা শুধু তুমি আমি— আমি তুমি— যেন আমি আর বিষ্ণু— হোক বলাবলি!

সিডনি, ১৯৯৭



 যান

            ‘এ কী! তুমি!’
            বিষ্ণু হাসে; তার সেই নীরব বৈড়াল হাসি।
            ‘তুমি ম’রে যাও নি তাহলে?’
            পুনশ্চ নীরব বৈড়াল হাসি।
            ‘তো এখন কী?’
            আমার ঘরের একমাত্র জানালাটি দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে আমাকে ভেজাচ্ছে ব’লে জানালাটা বন্ধ করতে যাই—
            ‘একটু না-হয় ভিজলেই।’
            আমার রাগ হয়। তাছাড়া বিষ্ণু তো বলবেই, ওর তো আর নতুন ক’রে ভিজবার উপায় নেই; ভিজেই তো সে এসেছে।
            ‘একটু ভিজলে কী হয়?’
            ‘জ্বর হয়, ইনফ্লুয়েন্‌জা, নিউমোনিয়াও হ’তে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা হয়, তা হ’ল, নিজেকে বিশ্রী স্যাঁৎসেঁতে লাগে, সদ্যঃপ্রসূত শিশুর মতো একটা মাখামাখি, লিপ্ততা— আমি নির্লিপ্তিপ্রিয় মানুষ। তাছাড়া এত রাতে এত বৃষ্টিতে এই যে তোমার মাইলপাঁচেক হেঁটে আসা, এ-সবকে আমি বাহুল্যই জ্ঞান করি।’
            নীরব বৈড়াল হাসি, আবার! ইচ্ছা হয়, ওকে ভয়ঙ্কর একটা বাঘ-মুখোশ পরিয়ে দিই— যা কীনা ভয় দেখালেও, বিদ্রূপ করবে না।
            ‘লুঙ্গি প’রে বেরুতে না-চাইলে প্যান্টটা প’রে নাও।’
            ‘পাগল! আমি কোত্থাও যাচ্ছি না। পরন্তু, তুমি, এই মুহূর্তে, আমার স্মৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির কাছে, হয় মৃত, নয়তো উন্মাদ।’
            ‘তাপসদার বৌ মারা গেছেন। অসীমদা রওয়ানা হ’য়ে গিয়েছেন। আমি তোমাকে নিতে এলাম।’
            ‘আমাকে নিতে না-এলে কি চলত না তোমার?’
            নীরব বৈড়াল হাসি।
            ‘দ্যাখো বিষ্ণু, তাপসদার বৌকে আমি কস্মিন্‌কালে দেখি নি। তাঁর অস্তিত্ব বিষয়েও আমার সন্দেহ ছিল বরাবরই। এখনও যে পুরোপুরি নিঃসন্দিগ্ধ হয়েছি এমন বলা যায় না। আর যে-হতচ্ছাড়িনিকে মরিয়া প্রমাণ করিতে হয় সে বাঁচিয়া ছিল, তার বিষয়ে আমার ঔৎসুক্য নাই, আমি রবীন্দ্রনাথ নই। তাছাড়া, আমরা এই ঝড়বাদল সাঁৎরে ওখানে গিয়ে পৌঁছুলেই যে তিনি আবার বেঁচে উঠবেন, তাও তো মনে হয় না। মুমূর্ষু এবং মৃতের মধ্যে একটা পার্থক্য তো আছেই— আমরা কেউ আবার, এমনকি, এক্সরসিস্টও নই।’
            ‘তোমার ছাতা-ফাতা থাকলে নিয়ে নাও সঙ্গে। তোমারই জন্যে বলছি।’
            ‘আমার মনে হয় এ-বিষয়ে আমাদের আগে কথা হওয়া উচিত— মানে, কাজটার ঔচিত্য বিষয়েই।’
            ‘সেটা যেতে যেতে বলা যাবে, মানে, তোমার কথাই বলছি। আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না আজ।’

            অতঃপর ছাতাহীন মাথায় চলতে-চলতে আমার মনে নানা প্রশ্ন তৈরি হ’তে থাকে, এবং আরও আশ্চর্য যে একটা প্রশ্ন আরেকটাকে খারিজ ক’রে দিতে থাকে। আমি আমার যাবতীয় অস্থিরতাকে দমন করতে, নিজের উদ্দেশে সরবেই বলি, ‘মাই ডগ, ডু নট বার্ক্!’
            ‘আই উওন্ট্, মাই লর্ড।’
            ‘আমি তোমাকে বলি নি।’
            ‘নিশ্চয়ই আমাকে বলো নি। বলেছ নিজেকেই। কিন্তু তোমার দুর্বল মনের পক্ষে এ-রকম শক্ত শপথ উচ্চারণ করা সম্ভব হ’ত না।’

এই বিষ্ণু মাত্র সেদিন মারা গেল। বা, নিজেকে ঘিরে একটা রমণীয় মরণীয়তা তৈরি করল। এবং আমি তিন-দিন-তিন-রাত শোক পালন করলাম; তিন-দিন-তিন-রাত অনবরত কবিতা পড়লাম, ওর কবিতা নয়, মাসুদ খানের, সখাতত্ত্ব, সেই  বিষ্ণু যদি আরও একবার সশরীর হয় হাজির, রাত দু’টোর বৃষ্টিতে, কোনো প্রায়-অচেনাজনের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে, আমার আর কোন্ যুক্তি থাকবে তার সঙ্গে বেরিয়ে না-পড়ার? কিন্তু কোন্ যুক্তিই বা আছে বেরুনোরও? অবশ্য, সেটা আমি কীভাবে জানব। আমি নিজে তো নিজের অনিচ্ছাকৃত বেরিয়ে পড়ার পক্ষে কোনো যুক্তি খাড়া করতে পারি না। বিষ্ণু বরং পারে, মানে পারতে পারত, যদি অবশ্য কোনোরকম যুক্তির ধার সে ধারত আদৌ। কোন্ যুক্তিতেই বা সে মরতে গেল, আবার ম’রেও ফিরে এলো? এবার— পাছে প্রশ্নটিকে কেটে দেয় আর কোনো প্রশ্ন— আমি সরবেই নিজেকে শুধাই, ‘হ’তেই পারে, বিষ্ণু পৃথিবীর নিকৃষ্টতম হঠকারী, কিন্তু তার দায় তো আমার নয়। কেন তবে এই দায়ভার আমি বইছি?’
            ‘এ জন্যেই,’ বিষ্ণু বলল।

            বৃষ্টি খানিকটা ধ’রে এলেও, এক নূতনতর উৎপাতের হয় সূচনা; বিষ্ণু তার ঈর্ষণীয় উদাত্ত কণ্ঠে ধরে : ওরে সাবধানী পথিক, বারেক পথ ভোলো পথ ভোলো... এবং যেহেতু এমনকি এ-বাবদেও আমি নিশ্চিত নই যে গানটিকে ছাড়া হয়েছে আমারই উদ্দেশে এই সজল, ঘন বাতাসে— আমি কাজেই অস্বস্তি বোধ করি, অসহায় বোধ করি। কেননা, যদি আমি গানটিকে, আমাকে বিদ্রূপ করবার একটা অস্ত্র বিবেচনা ক’রে, প্রত্যাক্রমণ করবার পরে দেখতে পাই যে, তা নয়, তবে তো বিষ্ণুর দৈবত কণ্ঠের একটা অলোকসামান্য উৎসারের থেকে পৃথিবী তথা মহাবিশ্বের যাবতীয় আলো-অন্ধকার পদার্থ-অপদার্থকে বঞ্চিত করবার মহাপাতক আমাতে অর্সায়; পক্ষান্তরে, ও সত্যই যদি বিদ্রূপ ক’রে থেকে থাকে, অথচ আমি, তা নয়, এই ভেবে গানটাকে উপভোগ করি, তাহলেও না-জেনে বিষ খেলাম; নাটকের প্রট্যাগনিস্ট বিষ্ণু, এবং অডিয়েন্স বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাঝখানে একজন “ফুল” হ’য়ে, একটা মোক্ষম ড্রামাটিক আয়রনির শিকার হ’য়ে গেলাম! অবশ্য, আপাততঃ, দ্বিতীয় ব্যবস্থা, বা অবস্থা, বা অবস্থানটিকেই আমি বেছে নিই, মনের ভিতরে এইরূপ যুক্তি তৈয়ার ক’রে, যে, জেনে বিষ খাবার চেয়ে না-জেনে খাওয়া ভালো। যদিও, আমার যুক্তিবাদী মস্তিষ্কাংশের বাইরে যে অবশিষ্ট আমি, সে কিন্তু ভালোই জানে যে দ্বিতীয় ব্যবস্থাটিকে প্রগ্রহণের একমাত্র কারণ, কর্মবিমুখিতা। এটি বিষ্ণুও অবশ্য জানে, হয়তো তাই, কিংবা এমনিতেই, অর্থাৎ সেসবের তোয়াক্কা না-ক’রেই, এটাই অধিকতর সম্ভাব্য, সে গেয়েই চলে : অনেক দিনের সঞ্চয় তোর আগলি আছিস ব’সে, ঝড়ের রাতের ফুলের মতন ঝরুক, পড়ুক খ’শে...। নাহ্, আর কিস্যু করবার নাই, কারবার ফতে। আমি নিজেই আমার সুবিধাজনক অবস্থানটি ছেড়ে দিয়েছি প্রতিপক্ষকে— এখন মার-খাওয়া-ভিন্ন উপায় নাই। উপায় নাই। এমনকি আদিত্যকে এই পথেই আসতে না-দেখলে, আমি, মেঘের কোনো রন্ধ্রপথে চুইয়ে-আসা এই নীলাভ রুপালি চাঁদের আলো, যা কিনা ভেজা-আয়নার মতো রাস্তাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, এবং খোদ আদিত্যকে একটা হলোগ্রামে বদ্‌লে ফেলেছে, লক্ষ্য করতাম কি? বুঝে দ্যাখো, কী সাঙ্ঘাতিক সর্বনেশে গান বিষ্ণুর!

            ‘তুমি তুমিই তো?’
            ‘হয়তো,’ আদিত্য বলে, বা বিষ্ণু, এবং আদিত্য জুটে যায় আমাদের।
            ‘ঐ কে আসে আবার, ঐ?’
            একটা ছায়ামূর্তি যেন স্কি, যেন স্কিড করতে-করতে এগিয়ে আসে, আমাদের পাশে, এবং কথাটি না-ব’লে, শুধু নিজের মুখানি দেখিয়েই আত্মপরিচয় দেয়।
            ‘তুমি কেন আবার?’
            ‘এ জন্যেই,’ ব্রাত্য হয়তো বলে, বা বিষ্ণুই, ঠিক ঠাহর পাই না। এবং ব্রাত্যও জোটে আমাদের।
            আমাদের আটটি পায়ের চলিষ্ণুতায় একটা সামরিক ভাব এসে যায়। হয়তো, যদি আমি তাকাতাম আমাদের পায়ের দিকে, শনাক্ত কি পারতাম করতে নিজস্ব পা-দু’খানিকে? তাই, কী হবে আর, ভেবে আমি সামনে তাকাই, রাস্তায়, যার শেষে একটা মৃত্যু আমাদের অপেক্ষায়, মৃত-র মতো নিথর শুয়ে আছে— ম’রে আছে? মৃত্যুরও জন্ম হয়, আবার মৃত্যুও হয়। হয় না কি? তাপসদার বৌয়ের কিমবস্থা এখন? তিনি কি মৃত্যুতে বেঁচে আছেন, নাকি সেখানেও মারা গেছেন? আমি জানি না। হয়তো বিষ্ণুই জানে শুধু, কেননা সে-ই তো মৃত্যুর ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু তাতেই কি আমার জাগতিকতা, আমার জীবিতাকে কটাক্ষ করবার অধিকার ওর জন্মগত? মৃত্যুগত? কে দিয়েছে ওকে সেই অধিকার?
            বিষ্ণুর সঙ্গে সম্পর্কটা আমার কী-যে রহস্যে ঘেরা! যে-কেউ ভাববে আমরা প্রেমিক। অথচ আমরা আসলে পরস্পরের কট্টরতম সমালোচক, বা, এমনকি, নিন্দক। তবু আমরাই আবার এ-অন্যের ইচ্ছারও দাস। আজ যেভাবে আমাকে বের ক’রে বিষ্ণু আনল, আমি ততোধিক নির্মমতায় ওকে বের করেছিলাম একদা...। প্রতিবাদ করেছে, অভিযোগ করেছে— কিন্তু বেরিয়ে ও এসেছিল ঠিক। আর, এমনিতেই, বেরিয়ে পড়ার ক্ষমতা ওর, আমার থেকে ঢের ঢের বেশি।
         
            নদীর মতন বহমান এই রাস্তা, পরম ধার্মিকের মতো ঋজু, আমাদের আদিত্যর মতো সরল, ব্রাত্যর মতো স্বাভাবিক— আর, আমাদের স্বপ্নের মতো উড্ডীন, আর বিষ্ণুর চোখের মতো তাৎপর্যময়। আমরা কি আদৌ হাঁটছি এ-রাস্তায়? নাকি রাস্তা নিজে আমাদের ব’য়ে নিয়ে চলেছে? নাকি আমরা পিছ্লে বেরিয়ে যাচ্ছি, এক নবতর জন্মগ্রহণের দিকে, এক অভিনব উদ্বোধনের দিকে? আমরা কি একটিই শিশু শুধু, চারটি ভিন্ন মাত্রায়? বিষ্ণুকে শুধাব? কিন্তু ওর উত্তরটি হবে এত বেশি ব্যঞ্জনাঘন, এমন অতলস্পর্শী, যে আমি মূল প্রসঙ্গ ভুলে গিয়ে ভুল কোনো বিষয়ান্তরে ঘুরপাক খেতে থাকব। তারচেয়ে
            ‘ব্রাত্য, তুমি কি জানো?’
            ‘জানি। তবে বলতে ইচ্ছাচ্ছে না।’
            ‘আদিত্য?’
            ‘সরলতা বক্রতার নির্ভরের দণ্ড।’
            বিষ্ণু হাসে, নীরব, বৈড়াল, বলে, ‘তুমি কেন শুধু প্রশ্ন করো? আর সেই প্রশ্নগুলিই করো যাদের উত্তর মোটামুটি জানা-ই আছে তোমার? কেনই বা এত বলো? তুমি তো আর এখনই মরতে যাচ্ছ না।’
            ‘তাছাড়া,’ ব্রাত্য বলে, ‘এই রাতটির যাবতীয় রহস্যরসিকতাকে বিনাবাক্যে, নিঃশর্তে মেনে নে’য়াটাই উচিত কি নয়?’
            ‘কিন্তু,’ আদিত্য বলে, ‘সুব্রতর প্রশ্নসমূহকেও, এই রাত্রির রহস্যময়তারই একটা বাঙ্ময় মাত্রা ব’লে ধ’রে নে’য়া যায় না কি?’
            তখন সবাই নীরবে মেনে নেয় যে আমার কথা বলাটাও এই রাতেরই অংশ, একটা অবিচ্ছিত্তব্য, পিনদ্ধ অংশ, এবং সেজন্যেই আমার সকল বলা থেমে যায়। অর্থাৎ এই রাত এখন থেকে একজন খেলোয়াড় কম নিয়ে খেলবে। এই রাত কখনও সম্পন্ন হবে না, বিষ্ণুর লেখা অনেক-অনেক কবিতারই মতো, অসমাপ্ত, অনিষ্পন্ন, অনিশ্চিত থেকে যাবে। এই রাত ভোর হবে না আর— সেই ভোলা পথের প্রান্তে রয়েছে হারানো হিয়ার কুঞ্জ...

সিডনি, ১৯৯৭


( বানান অপরিবর্তিত)

যৌবনে কবি। 'ভোরের  মন্দির'  বইটি  থেকে প্রাপ্ত।
 

মন্তব্যসমূহ