শূন্য থেকে সৃষ্টি করা সৌন্দর্য ; বিষ্ণুর কবিতা / মলয় গোস্বামী

শূন্য থেকে সৃষ্টি করা সৌন্দর্য ; বিষ্ণুর কবিতা / মলয় গোস্বামী

            কবির সমগ্র যাত্রাই এক সৌন্দর্যের উদ্ভাসনে। কবিতার ভেতরে প্রবেশ করে পাঠকের কোনও রকম আত্মানুভূতি হচ্ছে কি না,  সেটাই পাঠের আয়নায় ফেলে দেখতে হবে। ভালো কোনও কবিতার পাঠ প্রক্রিয়া এমনটাই হওয়া উচিৎ বলে আমার এখন মনে হয়।
ভালো কবিতা পড়ার পর – হতবুদ্ধি, বিমূঢ়, স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকাই এক রকম দস্তুর হয়েছে আমার। বারবার প্রকৃত কবিতার সৌন্দর্যের  মধ্যে প্রবেশ করার পর, এক সুন্দর থেকে আরও এক অন্য সুন্দরের দিকে চলে যেতে হয়। চলে যেতে মনও চায়।
                  আমার এই সুদির্ঘ কবিতা-জীবনে, কবিতার আসল রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে, উন্মোচিত তো কখনই হয়নি; উপরন্তু আরও আরও রহস্য-সৌন্দর্যের বুননে আটকে পড়েছি। কবিতা কী – এই বিষয়ে বারবার সিদ্ধান্তের বদল ঘটেছে আমার। তারপর  ধীরে ধীরে, এখন, এই ২০১৪ সালে এসে মনে হচ্ছে- মহাকবির ভাবনার মতন- অন্যের  মনে সৌন্দর্যের উদ্রেক করা ছাড়া কবিতার আর কোনও কাজ নেই।
                  জানি, আগামী কাল হয়ত এই সিদ্ধান্ত ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই বিশয়টি বুঝতে পারছি যে, কবিতার তেমন কোনও আলোচনা হতে পারে না। যার জন্য একজন পাঠক অপেক্ষা করে, তা হল সৌন্দর্যের ভেতরে ডুবে থেকে এক ধরনের আত্মানুভব।
কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের কাব্যগ্রন্থ ‘ভোরের মন্দির’ - এর অনেক কবিতা আমাকে বাকহীন করে দিয়েছে। নিথর হয়ে এক অতুল অলৌকিক সুন্দরের দেশে আমি বারবার চলে গেছি।
             পড়ছি- “... জীবন জীবন শুধু বাঁচে চারিদিকে/সকল বস্তুতে আহা অন্ধকার জ্বলে।”... কোনো এক হ্যাঁ আর না-এর মাঝখানে জীবনকে দাঁড় করিয়ে দেখছেন কবি! সকল বস্তুতে আলো জ্বলছে; আবার অন্ধকারও জ্বলছে! তার মানে? অন্ধকারের আলো? সেই যে – ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসরিত আলো’! তাহলে কি অন্ধকার আর আলোর উৎস একই? অন্ধকারও তাহলে জ্বলে!
               কবি বিষ্ণু-র অতলান্ত ভাবনার বিষয়টিই এই রকম। অতলান্ত-সৌন্দর্যভাবনা কবিকে আক্রমণ করে করে পরিশেষে সেই পরাবাস্তব সৌন্দর্যের দেশ তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছে।
                জানতে পারছি কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের ছিলেন  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাসে ওথলানো গান ও কবিতার ঘনঘোর। সেই সময়ে বিষ্ণু ছিলেন একেবারেই স্বপ্নমদির পৃথিবীর ভেতর দিয়ে চলা একজন। আবেগমথিত।

                সুন্দরের একটা শূন্যতা থাকে। যেখান থেকে সুন্দর মুখ বের করতে আরম্ভ করে। সেই, একেবারেই শূন্য থেকে সৃষ্টি করা  সৌন্দর্য বারবার বিষ্ণু এনে ফেলেছেন তার কবিতায়। এবং এই সুন্দর একমাত্র কবিতায় জন্ম গ্রহণ করে। বাস্তব ব্যতিরেকে এর উদ্ভাস। এই পরাবাস্তব সৌন্দর্যের যিনি সন্ধান পান, তার হাতেই ধরা পরে শিল্পের এক অন্য পৃথিবী – যা চাঁদের অন্য পিঠে অবস্থিত।
             বিষ্ণুর ‘প্রেমপত্রের খসড়া’ কবিতার প্রথমেই কবির অনুভব অক্ষরধৃত হচ্ছে এইভাবে- ‘ অসম্ভব উর্বর গন্ধের হাওয়ার মতো  কী একটা জিনিস আমার চতুর্দিকে/ ঘিরে থাকে, আমার ভালো লাগে...।’ কবির ভালো লাগছে অসম্ভব উর্বর গন্ধের হাওয়ার মতো কী একটা জিনিস তাজে ঘিরে রাখছে বলে। কিন্তু কী জিনিস ঘিরে থাকছে, তা ঠিক বুঝতে পারছেন না। কিন্তু ভালো লাগছে। ভালোলাগার উৎসভূমির সন্ধান কবির কাছে নেই। না-জানার শূন্য থেকে বেরিয়ে আসছে অসম্ভব উর্বর গন্ধ। যা সু। ... এরপর কবির কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হাঁটা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। একের পর এক তার অনুভূতির জগতে অন্য  পৃথিবী এসে কথা বলে। এই কবিতায়, শেষ দিকে, কবি লিখছেন, ‘তোমার কাছে তবু চায় অনবদ্য আনন্দের একটি চলার পথ – যে পথের/ পাশে অসংখ্য বৃক্ষ অবর্ণনীয় স্বাতন্ত্রে স্থির এবং চলিষ্ণু ও ফুলগুলি/ ওরে, পাতাগুলি ঝরে। আর ফুল ফোটে পাতার জন্মধ্বনি ওঠে – পাতাপত্র।/ তখন স্বয়ম্ভু আমি – ভগবান। তখন আসার সৃষ্টির ভিতরে সৃষ্টি – যা/ আমার নেই।...’ কবির ভেতর- চোখে দেখা পথের পাশে অসংখ্য বৃক্ষ অবর্ণনীয় স্বাতন্ত্রে স্থির। কবি বিষ্ণুর জগতও এরকমই  অবর্ণনীয় স্বাতন্ত্রে গড়ে উঠেছে। তিনি ‘পাতার জলধ্বনি’ শুনতে পাচ্ছেন। অলীক পৃথিবীর সৌন্দর্য-শব্দহীন প্রাচুর্যে এই কবিকে বারবার ধাক্কা মেরে বাকহীন করে রেখেছে নিরন্তর, এবং একসময় স্বাভাবিক পৃথিবীর দৃশ্য থেকে তাকে দূরে নিয়ে ফেলেছে। তিনি শুনতে বাধ্য হচ্ছেন – ‘...পাতার জন্মধ্বনি শঙ্খের ধ্বনির মতো বাজতে/ থাকে অনাদি সত্যের দুপুরে। মানুষ খুঁজেছে  কী খোঁজে নাই পৃথিবী জানে।’
               এই মানুষটিকে কবি নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করতে চাইছেন নিজের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে? বাস্তব পৃথিবী কি সত্যিই জানে  যে, পাতার জন্মধ্বনি সত্যিই কোনও কোনও কবি শুনতে পান! আর সেই কবিও একজন মানুষ!
               এই যে সৃষ্টির শূন্য-ধ্বনি, এই ধ্বনি শুনবার কালে কোনও কোনও মানুষই বাস্তবজড়িত থাকতে পারেন কী না তা নিয়ে  ভাবার অবকাশ আছে। তখন কবি তাই নিজেকে একবার মাত্র   স্বয়ম্ভু  বা ভগবান বলে ভেবে ফেলেন।
                কবিতার পরতে পরতে কবি বিষ্ণু বিশ্বাস এক  অনৈসর্গিক পৃথিবীর উন্মোচন ঘটিয়ে নিজেকেই  এক অনন্য সৃষ্টিকর্তার  আসনে উপবেশন করিয়েছেন। সেখানে বসে তার চোখের সামনে দেখা রহস্যময়- সৌন্দর্যের হীরাকণাগুলি একে একে  গ্রন্থনা  করে চলেছেন।
 বিষ্ণুর কবিতাগুলির সামনে বসে ভাবতে পারছি – সঙ্গীতের ঈশ্বরীয় মুগ্ধতা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল এক অনৈসর্গিক দৃশ্যানুভূতির  দুনিয়ায়। অদ্ভুত আনন্দময় দৃশ্য তাঁকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল তার স্বয়ম্ভু আসনে। আমরা এটা জানতে পেরেছি যে, যে-কোনও গানের সুর-ই শূন্যে মিশে থাকে চিরদিন। তার জন্ম নেই, তার মৃত্যু নেই। সে কারও কাছে  ধরা   দেবার জন্যে দৃশ্যের অপারে ঘুরে ঘুরে  বেড়ায়। বিষ্ণু সেই সুরের সন্ধান করে ফেলেছেন। এবং তা তার কবিতার ভেতরে অনায়াসে প্রবেশ করেছিল। তিনি লিখছেন, - ‘তোমার চুলের ছায়ায় ফুলের রেখার টান ছিল।' এ এক অত্যাশ্চার্য ছবি, যা সুরে বাঁধানো। যা জাগতিক ভাবনার একেবারে  উলটোদিকে বসে তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করতে হয়।
             কবিকে পেরোতে পারলেই আমরা পেয়ে যেতে পারি অনেক কিছু –‘ঈশ্বরের জন্মজন্মান্তর’ কবিতায় বিষ্ণু কিঞ্চিৎ ইশারা দিচ্ছেন এরকম। কিন্তু কবি যে পৃথিবী রচনা করেছেন, সেই রচনার অন্তর্গূঢ় রহস্যছবি পার হতে হবে, না অন্য কিছু বলতে চাইছেন কবি- এ নিয়ে বিশদ বিপদে পড়েছি আমি। এই যে কবিকৃত সৌন্দ্যর্যকেও পার হওয়ার আহ্বান, এ-ও এক  নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছে বিষ্ণুর কবিতা।
কবি বলছেন,'আমাকে পেরিয়ে গেলে তুমি পাবে এক ধূলিপথ/ ডানে বাঁয়ে সবখানে শিলীভূত পাখিদের শব/ যেখানে অমর মৃত্যু, অমর জলের স্বপ্ন-ধোয়া, বাঁশপাতা খড়খড়ি ঊষর দানোর লোহাগড়।...’ পরিশেষে বলছেন, ‘ডানে বাঁয়ে সবখানে জাম   আম সবুজ কথক,/ আমাকে পেরিয়ে গেলে নিশ্চিন্ত কল্পতরুর গাছ।’ এই যে কবি তাকে পেরিয়ে যেতে বলছেন, এ কি পাঠকের  প্রতি কবির সেই চিরকালীন আহ্বান? সেই চির সম্পর্কের দ্যুতিকেও চাইছেন? ‘কল্পতরুর গাছ’ – হতে পারে কল্পনার যাবতিয়, বা হতে পারে সে গাছ যার কাছে যা চাইবে তা-ই পাবে।
               কবি বিষ্ণুর কবিতার কাছে একজন মগ্নপাঠক যা চাইবেন, তা-ই নিশ্চিত পেয়ে যাবেন।

মন্তব্যসমূহ