![]() |
যৌবনে কবি |
'ভোরের মন্দির' গ্রন্থের প্রাককথন
সে এক সময় ছিল । যখন সমস্ত দেশ সামরিক স্বৈরশাসনের থাবা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রাণপণ ডানা ঝাপটাচ্ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ছিল আন্দোলন মুখর। সবুজ মোতিহারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল উচ্চকিত , প্রতিবাদী । গানে কবিতায় নাটকে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর ঘৃণা উদ্গীর্ণ হত সকাল সন্ধ্যা । আগুনমুখো সেই সময়ে মতিহারে যে কিশোর কবির চোখ ছিল স্বপ্নাচ্ছন্ন আবেগে থরো থরো তার নাম বিষ্ণু বিশ্বাস।
ইতিহাসের ছাত্র বিষ্ণু ছিল আমার অনুজ বন্ধুদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতম । ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখা আমাদের দিনভর সঙ্গীতে - কবিতায় বিষ্ণু ছিল অক্লান্ত প্রাণ । বন্ধু এবং অনুরাগীর কোনো অভাব ছিল না ওর । ছিল আদর কাড়ার প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতা ।
![]() |
২০০১ সালে বইটির প্রচ্ছদ। সম্পাদনায় নিশাত জাহান রানা। ছবিটি কবি শিমুল মাহমুদ-এর সৌজন্যে প্রাপ্ত। |
ঝিনাইদহে বিষ্ণুর জন্ম। এলাকার বৈশিষ্ট্যে সমর্পিত ছিল ওঁর আত্মঘাতী বাবা । কেন তিনি আত্মহনন করেছিলেন তার সঠিক কারণ হয়তো বিষ্ণুও জানত না। ওর স্বপ্নমদির চোখ আর আবেগতাড়িত জীবনযাপন ওকেও একই পথে টেনে নেবে বলে ভয় হত আমাদের কারো কারো।
কিটস সম্পর্কে যেমন বলা যায় , সুদর্শন এই তরুণ যেন প্রকৃতি থেকে বয়ে এনেছিল কবির নিষ্পাপ মুখশ্রী , সম্ভবত বিষ্ণু সম্পর্কে করা যেতে পারে এ রকমই উচ্চারণ । যে বিষণ্ণ আবেগ সারাক্ষণ ছায়া ফেলে রাখত ওর চোখে সেই ছায়া কখনো কখনো হয়তো গ্রাস করে ফেলেছে সম্পূর্ণ অস্তিত্ব । ওঁর ঘোর লাগা চোখ আর মদির উচ্চারণ চারপাশের মানুষদেরও কাব্যাচ্ছন্ন করেছে অনেক দিন।
![]() |
২০১১ সালে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ। এই বইটির সম্পাদক ছিলেন কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। |
অনার্স করেই বিষ্ণু চলে আসে ঢাকায় । ভিড়ে যায় এখানকার সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষ্ণুরা ক'জন মিলে বের করে কবিতা- বিষয়ক ছোটকাগজ 'পেঁচা'।
দীর্ঘ - বিরতির পর আরো ১ টি সংখ্যা বের হয় শামসুল কবি কচির উদ্যোগে। বেশ কিছু ছোট কাগজে মুদ্রিত হয় বিষ্ণুর কবিতা । এর মধ্যে বাবরি মসজিদে হামলা । ভেতরে ভেতরে কত যে হিন্দু নিপীড়ন হল তার খবর কেউ জানে না। বিষ্ণু কীরকম আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে গেল। একটা সাদা গাড়ি অথবা ছুরি হাতে কেউ তাঁকে তাড়া করে ফিরছে --এ রকম ভীতি বিচলিত হয়ে ছুটে আসত মাঝে মাঝে । অসংলগ্নতা বেশ বেড়ে যাওয়ায় ওকে নিয়ে গেলাম মনোচিকিৎসিকের কাছে। স্কিৎসোফ্রেনিয়া আক্রান্ত । একমাস রাখা হল চিকিৎসাধীন । অব্যাহতি দেওয়ার সময় ডাক্তার ওঁর সার্বক্ষণিক দেখাশোনার ওপর জোর দিলেন। কিন্তু বন্ধুদের সব নজরদারই ফাঁকি দিয়ে বিষ্ণু হঠাৎ উধাও হয়ে গেল।
এইভাবে চলল কিছুকাল। মাঝে মাঝে উধাও হওয়া , আবার ফিরে আসা। একদিন শোনা গেল দিনকতকের জন্য রাজশাহী তারপর ঝিনেদা হয়ে সে চলে গেছে কলকাতায় । কিন্তু কলকাতায়ও কেউ তার খবর জানে না । শোনা গেল -- আরো অসংলগ্ন হয়ে পড়েছে বিষ্ণু । আছে কলকাতার কাছাকাছি কোথাও ।
যেখানেই থাকুক না কেন-- মুক্তি পাক সাম্প্রদায়িকতার সকল দুঃস্বপ্ন থেকে --- তরুণ কবির সকল বন্ধুর পক্ষ থেকে এই আমাদের শুভ কামনা।
১৯৯৩- এর বইমেলায় একটি কবিতার বই প্রকাশের পরিকল্পনা বিষ্ণু নিজেই করেছিল। অনেকগুলো কবিতা সে একত্রিত করেছিল এবং বইয়ের নাম পর্যন্ত স্থির করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্থাভাবে তা বাস্তবায়িত হয়নি । সেই নামটিই ব্যবহার করা হল এই বইয়ের নাম হিসাবে । বিষ্ণুকৃত ওর নিজস্ব পাণ্ডুলিপিতে ছিল কয়েকটি কবিতা মাত্র। কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি আমাদের জানামতে প্রকাশিত অপ্রকাশিত সব লেখাই একসঙ্গে গ্রন্থিত করতে । হয়তো বিষ্ণু নিজে প্রকাশনার কাজটি করলে এ বইয়ের অনেক কবিতাই গ্রহণ করত না। কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি ওর সকল লেখা খুঁজে বের করে একত্রিত করতে । মূল পাণ্ডুলিপিটি দেওয়ার জন্য বিষ্ণুর বন্ধু জীবন রায় এবং ফয়জুল ইসলাম সুমনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বিষ্ণুর আরো অনেক বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষীর আগ্রহেই এ বই প্রকাশিত হচ্ছে; বিষ্ণু যেখানেই থাকুক তাদের সবার ভালবাসা নিশ্চয়ই ওর কাছে পৌঁছবে ।
নিশাত জাহান রানা
ফেব্রুয়ারি ২০০১
পুনশ্চঃ অনেকদিন ধরে ভাবছি 'ভোরের মন্দির' পুনর্মুদ্রণ করব । কিন্তু নানাকারণে কেবলই দেরি হয়ে যায়! এর মধ্যে হঠাৎ জানতে পারলাম , বিষ্ণু যখন বই বের করার কথা ভেবেছিল -- তখন ওর বন্ধু বিশিষ্ট কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ছিল সেই ভাবনা ও উদ্যোগের অংশীদার । এরকম নাকি কথা ছিল যে , বইটা সুব্রত সম্পাদনা করবে! অতএব সুব্রতকে অনুরোধ জানালাম বর্তমান সংস্করণটি সম্পাদনা করতে এবং সে ভীষণ আন্তরিকভাবে সেটা করে দিল । বিষ্ণুর জন্য সুব্রত-র কষ্টের অনুভূতি আমারই মতো -- তাই তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আনুষ্ঠানিকতা করতে চাই না। এই সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত হল বিষ্ণুর আরো ৫টি কবিতা। এগুলো পাওয়া গেল কবি মোহাম্মদ কামাল , শামসুল কবির কচি, জুবায়ের এবং সুব্রতর মাধ্যমে।
নিশাত জাহান রানা
ফেব্রুয়ারি ২০১১
টেলিগ্রাফ থামের পাশে প্রজাপতি
আমি, প্রেমে পড়েছিলাম বিষ্ণুর। এ-কথা আশ্চর্য কথা নয়। যারা তাঁকে কখনও জেনেছে, তারা জানবে, অন্যথা হবার কোনো উপায় ছিল না। কত সাধ্যসাধনায় মাঝে-মাঝে মুখ খুলেছে সে, কবিতা বলেছে, গান-গান?-তুমি কিছু দিয়ে যাও। আমি তো দিতাম সবই, নিল কই। তবু দিয়ে গেনু বসন্তের এই গানখানি...
বিদেশে বসন্ত আসে, সাথে আসে রানা-র ইমেল। ওর বই হবে। ‘ভোরের মন্দির’- তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশ। এই বইটা আমি করব, কথা হয়েছিল। বিরানব্বুইয়ের আগে-পরে। আমাদের ‘পেঁচা’ থেকে। আমান ভাইয়ের করা প্রচ্ছদের উল্টোপিঠে-পড়া ছাপ - সেটাই পছন্দ হ’ল আমার, বিষ্ণুরও, কবেকার কোনো এক হোটেল গ্রীনলিফে। আমি কত কাটাকুটি করেছি যে পাণ্ডুলিপিময়। ছন্দ আর বানানের কত সংশোধন। ও বলেনি কিছু। এভাবেই আমার ভালবাসা, অত্যাচার, মেনে নিয়েছিল।
আমাকে উৎসর্গ করা একমাত্র কবিতা ছিল ওর, হারিয়ে ফেলেছি। চিঠিগুলো-রাবীন্দ্রিক হাতের হরফ-সকলই- সকলই ফুরাল স্বপন-প্রায়...
সেই পাণ্ডুলিপি, সেও উধাও হয়েছে। স্মৃতি থেকে কিছু তার উদ্ধার করেছি এই সংস্করণটিতে। বিষ্ণুর মতোই, রানা, নির্বিবাদ মেনে নিল সব। পাঠক, তুমিও, স’য়ে নাও, এই ভালবাসা, আর এই সম্পাদনা-রোগ।
তাঁর সঙ্গে চ’লে যেতে পারিনি, আমাকে ডাকেনি সে। এ তার অক্ষম প্রতিশোধ...
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ
নভেম্বর ২০১০
(বানান অপরিবর্তিত)
মন্তব্যসমূহ