রম্যরচনা// দীপক মান্না// আটানব্বইয়ে আউট


রম্যরচনা
দীপক মান্না
আটানব্বইয়ে আউট


ঠক্! ঠক্!
- কে?
–আমি, মাস্টারমশাই।
     ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ন'টা, এই সময় মাস্টারমশাই! তবে ঠাকুমার অর্থাৎ মাস্টারমশাইয়ের মায়ের কিছু হল নাতো! এই তো বিকেল বেলায় দেখে এলাম, মোটামুটি ঠিক ছিল। তবে কিছু বলাও যায় না আটানব্বই বছর ধরে ব্যাট করছে, সেঞ্চুরি নাও হতে পারে। সচিন তো কতবার নব্বইয়ের ঘর থেকে ফিরে গেছে। যদিও ডাক্তার বলেছে হুট করে ছক্কা হাঁকাবার চান্স কম, এক রান করেই কয়েকদিন টানবে। তবে যমরাজ বাবাজি কখন যে আউট সুইং দিয়ে দেবে তা কেউ বলতে পারে না। ক্রিকেটের সাথে পটকে যাওয়ার তাই দারুণ মিল। হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে বাইরে আসি, দেখি ধুতি পরে গামছা গায়ে মাস্টারমশাই দাঁড়িয়ে। অবাক হয়ে বলি,
-কি ব্যাপার মাস্টারমশাই, এত রাতে ! ঠাকুমা কেমন আছেন?
গোলগাল চেহারার মাস্টারমশাই মাথা নিচু করে বলেন,
 – না, এমনি ঠিক-ই আছে।
-তবে? ওষুধ-টোসুধ আনতে হবে নাকি?
–না, না, আমি আসলে তোকে একটা কথা বলতে এলাম
–হ্যাঁ, বলুননা। মাস্টারমশাই আমার বাঁ কাঁধে ওনার রোমশ হাতটি রেখে বললেন,
-মাকে দেখে যা বুঝলাম তাতে করে কাল পর্যন্ত লাস্টিং করবে না। আজ রাতেই বোধহয়... তাই তোকে বলতে এলাম যে আগে থেকে কাউকে কিছু বলে-টলে রাখবি কিনা।
আমি অবাক হয়ে ওনার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললাম,
-কি বলছেন আপনি? এখনও তো উনি মারা যাননি ।এসব নিয়ে ভাবছেন কেন? উনি বিচলিত হয়ে বললেন,
 -না, যদি যায়?

- আগে দেখা যাক কবে কী হয় তারপর ভাবা যাবে। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে পাড়ার লোকের অভাব হয়না। আর আমি তো আপনার দুটো বাড়ির পরেই থাকি, ওসব নিয়ে ভাবার কোন দরকার নেই, আমি ওসব ম্যানেজ করে নেব, এখন আপনি বাড়ি যান। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে।
-যাকগে, আমি নিশ্চিন্ত হলাম, তুই তাহলে আজ রাতটা একটু জেগে থাকিস। এই বলে মাস্টারমশাই ধুতি হাঁটুর ওপর তুলে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাল। আমিও আচ্ছা, ঠিক আছে বলে ঘরে ঢুকলাম। মনে মনে ভাবলাম এ কাদের নিয়ে পড়লাম রে বাবা। মা এখনও দিব্বি বেঁচে আছেন আর উনি কিনা আগে থেকে তার চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন! ওদিকে আর এক কুম্ভকর্ণ ভাই নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। মাস্টারমশাই যতটাই হাবাগোবা, সরল, ভাই ততই চটুল। হাতির মতো চেহারা নিয়ে খালি খেতেই ব্যস্ত, কবে বলতে কবে মা পটকে যায় সেদিকে হুঁশ নেই। মান্ধাতার আমলের একটা মিষ্টির দোকান। খদ্দেরের দেখা নেই, তাই খুলতেই সকাল ছটার মধ্যে হাজির হন, ওদিকে রাত এগারোটা, মাঝখানে নাক ডেকে ঘুম। বাড়িতে দু'ঘরে দুই গিন্নি। বিগত পাঁচ বছর বোধ হয় কেউ কারোর মুখের দিকে তাকায়নি। কত্তা-গিন্নি সকলেরই দশাসই চেহারা। বড়ো গিন্নির দুই ছেলে? ছোটো গিন্নির দুই মেয়ে। ছেলেরা সাদামাঠা, মেয়েরা চটপটে এবং চালাক। আমার সাথে বাড়ির সকলেরই ভালো সম্পর্ক। মাস্টারমশাইয়ের ভাইকে ছোটো কাকা আর গিন্নিদের কাকিমা বলে ডাকতাম। বড়ো গিন্নির সাথে কথা বললে ছোটো গিন্নি ডেকে জিজ্ঞেস করে কী বলল, আবার ছোটো গিন্নির সাথে কথা বললে বড়ো গিন্নি ডাকে। মাস্টারমশাইকে কখনো স্যার কখনওবা কাকু বলে ডাকি। স্যারের হাবভাব এবং অতি সরলতা ছাত্র-ছাত্রী, পাড়াপড়শিদের কাছে হাসির উদ্রেক হয়। কিছু বখাটে ছাত্রের জ্বালায় মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন। লোডশেডিং হলে ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিত, দেশলাই লুকিয়ে রেখে সময় নষ্ট করত। একবার মাস্টারমশাই প্রাইভেট টিউশন সেরে ইস্কুলে বের হবে বলে তাড়াহুড়ো করছেন ঠিক সেই সময় একজন ছাত্র মাস্টারমশাইয়ের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলল- স্যার, আমাদের এমাসের সবার মাইনে একসাথে আপনাকে দিলাম। মাস্টারমশাই টাকার গোছা স্ত্রীর হাতে দিয়ে তাড়াতাড়ি স্নানে চলে গেলেন। বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখেন তাতে বেশ কিছু টাকা কম। সে টাকা আর উদ্ধার করা যায়নি। পরে জেনেছিলাম বাকি টাকা দিয়ে ছেলেগুলো ঘোষের দোকান থেকে পেটাই পরটা আর মিষ্টি সাঁটিয়ে ছিল। যাইহোক, মাস্টারমশাই চলে যাবার পর আমি বিছানায় বই নিয়ে বসলাম। সামনেই পরীক্ষা।

              বেশ কদিন গড়িয়ে গেল। ঠাকুমা দিব্বি আছেন। বাড়ির কাজের মাসি দেখাশোনা করে। আমি প্রায় প্রতিদিন একবার করে ও-বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। জামরুল গাছের গোড়ায় আমাদের আড্ডা। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় মাস্টারমশাইকে বললাম – দেখুন তো আপনি কেমন চিন্তা করছিলেন ঠাকুমা দিব্বি আছেন। মাস্টারমশাই বললেন -হ্যাঁ, তাইতো দেখছি। আসলে আগেকার দিনের মানুষ তো। দুধ ঘি খেয়ে বড় হয়েছে। মা তাহলে সেঞ্চুরি করেই ছাড়বে বোধহয়,  কী বলিস? আমি বললাম তাহলে তো ভালোই, আপনাদের বাড়ির নামডাক হবে।




               পরদিন, আমি সকালে প্রাইভেট টিউশন করে সবেই বাড়ি ফিরে এককাপ চা মুখে তুলেছি,ওমনি পিছন থেকে দেখি মাস্টারমশাই আর তার দুই ছেলে আমাদের বাড়ির দিকে ছুটে আসছেন আর তারস্বরে আমার নাম ধরে ডাকছেন।
- বিকাশ, তাড়াতাড়ি আয়, মা আর নেই।
 –সেকি! এই তো কালকে দেখলাম ঠিক আছে, হঠাৎ কি হল?
 – ওসব জানিনা তুই তাড়াতাড়ি চ'।
আমি এক চুমুকে চা টা শেষ করে ছুট লাগালাম। গিয়ে দেখি ডাক্তার বাবু ঘর থেকে বের হচ্ছেন। যাবার সময় বলে গেলেন চার ঘণ্টা পর সার্টিফিকেট নিয়ে আসবেন। দেখলাম, বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। কারোর চোখে একফোঁটা কান্নার লেশমাত্র নেই। কী জন্য ছুটছে কেন ছুটছে বুঝতে পারছি না। আমি বললাম – এত অস্থির না হয়ে ধীরেসুস্থে আত্মীয় স্বজনদের খবর দিন। মাস্টারমশাই বললেন – খাটুলি কোথায় পাওয়া যাবে বিকাশ? ছোটো ভাই বলল- খই নিতে যেন ভুলিস না। আর মালা একটা। সরু হলেই হবে। বেশি মোটা নেওয়ার কি দরকার! ফুলের যা দাম। এমন হাড়কিপটে লোক এর আগে আমি কোথাও দেখিনি। বাজারের প্রত্যেকটা সব্জিওয়ালা ওনাকে দেখলে দোকান ছেড়ে পালায়। দাম যেভাবেই হোক কমাবেই। বেশ মনে পড়ে, সেবার বাড়িতে সরস্বতী পুজো উপলক্ষে খিচুড়ি আর ফুলকপির তরকারি হবে। আমি ছোটো কাকার সাথে বাজারে যাই, সেখানে অনেক দরদাম করার পর সাতটা ফুলকপি নিয়ে আশার সময় পাঁচ টাকা কম দিয়ে দ্রুত হাঁটা লাগাল। পিছন থেকে সব্জিওয়ালা চেঁচাতে লাগল। কিন্তু কে কার কথা শোনে। আমিও কাকার সাথে সাথে তাড়াতাড়ি পা চালালাম। কাকার জন্য আমিও সেদিন বেশ কিছু গালাগাল শুনেছিলাম।

           যাইহোক মায়ের শবযাত্রাকে কেন্দ্র করে দুই ভায়ের কথাবার্তা শুনে আমি ওদের মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। তার থেকেও বেশি অবাক হলাম যখন দূর থেকে দেখলাম মৃত শাশুড়ির কাছে দুই জায়ে একে অপরের সাথে কথা বলছে।মনে মনে ভাবলাম ঠাকুমা চলে যাবার আগে চমৎকার করে গেছেন। সাপে নেউলের মধ্যে নতুন করে সম্পর্ক জুড়ে গেল। কাছে যেতেই কানে এল দু'জনের ফিসফিসানি –হাতের বালাগুলো একদম সরু হয়ে গেছে, নাকের টাও তাই। ছোটো জা বলে-- তবুও তো সোনা দিদি। এক কাজ করো নাকেরটা আর বালাগুলো খুলে নাও। পরে তাড়াহুড়োর মাঝে খেয়াল থাকবে না। আমি দরজার ফাঁক থেকে দেখলাম বড়ো জা বাঁ হাতের আর ছোটো জা ডান হাতের বালা ধরে টানাহ্যাঁচড়া করছে, তারপর একসময় সফল হয়ে বালাগুলো নিজেদের কাছে রেখে দেয়। তারপর ঘেন্না ঘেন্না করে নাকছাবিটাও খুলে নেয়, পারলে এখনি দু-টুকরো করে ভাগাভাগি করে। অবশেষে ছোটো জা নিজের কাছে রেখে দিল। বড়ো জা-কে আদুরে সুরে বলল -দিদি এটা আমার কাছে থাক? বড়ো জা খুব কষ্টে সম্মতি দিল। তাই বলি সাপ আর নেউলের কি দোস্তি হয়। বুঝলাম কেন এই সম্পর্ক জোড়া লাগল।  এও বুঝলাম এসব ক্ষণিকের, পাওনাগণ্ডার হিসাব হয়ে গেলেই আবার যেমন ছিল তেমন। আমি সামনের দিকে পা না বাড়িয়ে পিছন ফিরে মাস্টারমশাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম – এবার কিছু টাকা দিন জিনিসপত্রগুলো তো কিনতে হবে? ততক্ষণে আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। পাড়া পড়শিরাও কোমরে গামছা বেঁধে হাজির। যেন লড়াইয়ে নামবে। পাড়াগাঁয়ের এমনই নিয়ম, কেউ মারা গেলে পিঁপড়ের মতো পিল পিল করে লোক জড়ো হয়ে যায়। আর যদি একশো টপকানো বুড়ো বা বুড়ি হয় তাহলে তো কথাই নেই, মেলার মতো লোক যাতায়াত শুরু করে দেবে। জিলিপি পাঁপড় ভাজার দোকান দিলে কিছু বিক্রি হয়েও যেতে পারে। আমার দিদিমা একশো দশ বছর বয়সে মারা গেছিলেন। যেন উৎসব লেগেছিল সাড়া বাড়ি জুড়ে। শ্মশানে যাবার জন্য লোকের অভাব হয় না। লুচি-তরকারি আর এক পিস রসগোল্লার লোভে অনেকেই হাজির হয়ে যায়। কানা, খোঁড়া ল্যাংড়াও হাজির হয়। শ্মশানে গিয়ে কারোর টিকি খুঁজে পাওয়া যায় না, অথচ খাবার সময় সব হাজির।

              ঠাকুমার ক্ষেত্রেও তাই হল। একশ ছুঁই ছুঁই মৃতদেহ। মাস্টারমশাই আমার হাতে দু-হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বলল – এটা তোর কাছে রাখ। যখন যেমন খরচা হবে করিস এবং হিসাব রাখিস। আমি দুজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে খাটুলি কিনতে চললাম। অবশেষে খাটুলি, মালা, সুগন্ধি, খই সবই কেনা হল। রজনীগন্ধার স্টিক দিয়ে খাটুলি সাজানো হল। এবার বডি তোলা হবে। মাস্টারমশাই এবং তার ভাই কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর দেখলাম মাস্টারমশাই একটা কোঁচকানো পাঞ্জাবি পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। মনে হয় কুঁজোর ভিতর কয়েক বছর ঢুকিয়ে রাখা ছিল। ছোটো ভাইয়ের দেখা নেই। ছোটো কাকা বলে দু'বার হাঁক দিলাম। তারপর ঘরের ভিতর গিয়ে দেখি, কাকা এবং কাকিমা  ট্যাংকের ভিতর কি যেন খুঁজছে। বললাম, --কিছু খুঁজছেন?
– হ্যাঁ, পাঞ্জাবিটা।
-- আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে তাড়াতাড়ি চলুন।
এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি, ছোটোকাকা গতবছর হোলিতে পরা ছেঁড়া একখানা পাঞ্জাবী পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। পাঞ্জাবিতে আবির থেকে বাঁদুরে রঙ সবকিছুরই ছাপ রয়েছে। আমি বললাম – একি পরেছেন। আজকের দিনে এমন জিনিস কেউ পরে? কাকা বলে- ওসব ঠিক আছে, গঙ্গায় গিয়ে তো সব ফেলেই দিতে হবে। মনে মনে তার কৃপণতা আর নিম্ন মানসিকতা দেখে বললাম- তাহলে কিছু না পরে গেলেই তো ভাল। গঙ্গায় কিছুই ফেলতে হবে না। মাস্টারমশাইকে বললাম – কিছু খুচরো পয়সা থাকে দিন, খইয়ের সাথে ছড়াতে হবে। বলা মাত্রই পাশ থেকে বড়ো জা বলে উঠল –এই যে বিকাশ, এই নাও। এই বলে আমার হাতে দশ-বিশটা খুচরো পয়সা দিলেন। তাতে এক পয়সা থেকে কুড়ি পয়সা সব কারেন্সিই আছে। আমি পয়সাগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে বড় জা-র দিকে একবার তাকিয়ে গড় করে খইয়ের সাথে মিশিয়ে দিয়ে শ্মশানের দিকে রহনা দিলাম।

                পথে যেতে যেতে দেখলাম কারোর মধ্যে এতটুকু শোকের ছায়া নেই। ছেলে নাতি নাতনি সবাই যে যার তালে চলেছে। একবার উঁকি মেরে ঠাকুমার মুখের দিকে তাকাই। বাঃ, বেশ হাসছে তো, এতক্ষণ ঘরের মধ্যে ছিল গোমরা মুখ করে। করবেই তো, স্বামীর দেওয়া দু'খানা চুড়ি যেভাবে দুই বউমা টেনে হিঁচড়ে বের করে নিল, প্রাণটা থাকলে কি পারত? এই সংসারে থেকে সেঞ্চুরি করার চেয়ে রান আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যাওয়া অনেক ভাল। হঠাৎ দেখি শবযাত্রার সামনে কে যেন হন্তদন্ত হয়ে খই ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে। ওমা, এ যে দেখি ছোটো কাকা, নিজের মুখেই জোরে জোরে 'বল হরি হরি বল' বলছে আর খই ছড়াচ্ছে। পাশ থেকে এক দোকানদার জিজ্ঞেস করল – দাদা, কাদের বাড়ির? কাকা নিজেদের পদবি ধরে বলে দিল – কর্মকারদের মা। লোকটি ভ্রু কুঁচকে দোকানের ভিতর চলে গেল। হঠাৎ দেখি মাস্টারমশাইয়ের ছোটো ছেলে হাত মুঠো অবস্থায় কাকার দিকে ছুটে যাচ্ছে। আমি তাকে থামিয়ে বলি
 – কোথায় যাচ্ছিস?
– কাকার কাছে।
- তোর হাতের মুঠোয় কি?
-খুচরো পয়সা।
- কোথায় পেলি।
- কাকা যেগুলো ছড়াচ্ছে সেগুলো কুড়িয়ে আনছি।
আমি তাকে ধমক দিয়ে বললাম,
– এগুল কুড়িয়েছিস কেন? এগুলো কুড়োতে নেই তুই জানিস না।
– আমি কি করব? কাকা বলল তাই তো কুড়িয়ে এনেছি। কাকা বলল আমি শব যাত্রার একদম সামনে ছড়াতে ছড়াতে যাব আর তুই একদম পেছনে থেকে পয়সাগুলো কুড়োতে থাকবি তারপর এনে আমার হাতে দিবি। আমি অবাক শবযাত্রার সাথে পা মেলাতে থাকলাম।

       শ্মশানের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছি। আমাদের শ্মশানে যেতে গেলে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পরেশনের সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বিস্তীর্ণ এলাকার মাঝখান দিয়ে রাস্তা। দু'ধারে তেলের বিশাল বিশাল ডিপো। কিছু দূরে জাহাজঘাট। প্রতিদিন জাহাজে করে তেল আসে। সেই তেল ওই বড়ো বড়ো ডিপোতে ভরতি করা হয়। শ্মশানের পাশেই বিরাট কালী মন্দির।

       আমরা সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। চার কাঁধে খাটুলি দুলতে দুলতে চলেছে। সঙ্গে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ নাম সংকীর্তন। সেই সুর যেন ঠাকুমার কানে পৌঁছচ্ছে   আর সে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে উপভোগ করছে। একসময় দেখি সবাই প্রায় এগিয়ে গেছে। কই মাস্টারমশাইকে তো দেখছি না। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম কেউ দেখেছে কিনা। সবাই ‘কই নাতো’ বলে চলে গেল। হঠাৎ পিছন দিকে চোখ চলে যায় দেখি মাস্টারমশাই অনেক পিছনে একা একা হাঁটছেন । অতি ধীরে ধীরে। মাস্টারমশাইকে দেখে আমার মনটা ভারাক্রান্ত হল। ভাবলাম বয়স যতই হোকনা কেন মা তো! মাতৃ বিয়োগে স্যার ভীষণ মুষড়ে পড়েছেন। আমি স্যারের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছে আসতে বললাম- স্যার, মন খারাপ করে কি আর করবেন! যা হবার তা হয়ে গেছে, একটু পা চালিয়ে চলুন, ওরা বোধহয় পৌঁছে গেল। মাস্টারমশাই আমার ভাবনাতে একেবার জল ঢেলে দিয়ে বললেন – নারে বিকাশ, আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলাম।  – কি কথা স্যার?
– এই যে বহু আগে আমি একবার এখানে এসেছিলাম, তখন এই রাস্তার দু'ধারে কোনো পাঁচিল ছিল না, এখন এত উঁচু পাঁচিল দেওয়ার কারণ কী  ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি অবাক হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বললাম – এটা তো সংরক্ষিত জায়গা। চারিদিকে শুধু তেল, কেউ যদি বিড়ি সিগারেট খেয়ে ফেলে তাই এই ব্যাবস্থা। মাতাল শ্মশান যাত্রীদের কি বিশ্বাস আছে!
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস, চ' এবার তাড়াতাড়ি, ওরা বোধহয় পৌঁছে গেল। ভাবনায় ব্যর্থ হয়ে আমি তাড়াতাড়ি পা চালালাম। তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।

               শ্মশানে গিয়ে দেখি স্যারের হোঁৎকা ভাই কাঁধে করে কাঠ নিয়ে চিতা সাজানোর জায়গায় রাখছে। আমি বলালাম – কি করছেন আপনি এসব? আরে, আপনি বসুন, আরও তো লোক আছে নাকি!
– ওদের টিঁকি পাওয়া যাচ্ছে কোথায়, তাড়াতাড়ি করতে না পারলে ওদিকে দেরি হয়ে যাবে, বেশি রাত করলে হবে, কাল আবার দোকান খুলতে হবে না! আমাদের মধ্যে ছিল ঠোঁট কাটা রাজু। সে পাশ থেকে বলে উঠল,
 – ওই তো দোকানের ছিরি, সারাদিনে একটাও খদ্দের আসে না, এক সপ্তা দোকান না খুললে কি এমন লস হবে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন আপনার না, অন্যের মা মারা গেছে। এই বলেই সে গা ঢাকা দিল। ছোটো ভাইকে রাজু একেবারেই দেখতে পারে না। একবার নাকি সে তার মিষ্টির দোকান থেকে শিঙাড়া কিনে খেতে গিয়ে দেখে তার মধ্যে পচা আলু ভরা। অনেক অনুরোধ করেও পালটে দেয়নি। সেই থেকে রাজু তাল পেলেই কথা শুনিয়ে পালায়।

                  অবশেষে, মড়া পোড়ানোর কাজ শেষ হল। গঙ্গায় অস্তি বিসর্জন দিয়ে স্নান করে উঠে এলেন মাস্টারমশাই। ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলেন। কাছা নেওয়ার সামগ্রী রাজুর জিম্মায় রাখা ছিল। মাস্টারমশাই তার থেকে নিজেরটা নিয়ে পরে ফেললেন। ঘাটের ওপরেই দাঁড়িয়ে রইল ছোটোভাই। কিছুতেই জলে নামতে চায় না। এই ঠাণ্ডায় নাকি তার পক্ষে জলে নামা অসম্ভব। বেয়াড়া যুক্তি, জলে না নেমেই কাছা নিতে চায়। শেষমেশ, সবার অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে কোনোমতে কাকস্নান করে উঠে এসে কাছার জন্য চেঁচাতে লাগল। কিন্তু কী বিপদ, রাজু কোথায় গেল, এই তো এখানে ছিল! সবাই রাজু রাজু করে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু তার টিকিরও দেখা পাওয়া গেল না। ওদিকে মাস্টারমশাইয়ের ভাই ঠাণ্ডায় ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে রাজুকে গালাগাল দিতে লাগল। হঠাৎ কী মনে হল, মন্দিরের দিকটায় একবার গেলাম। গিয়ে দেখি রাজু মস্থ এক অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় বসে মনের সুখে বিড়িতে টান দিচ্ছে, আর কাছার ধুতিটা পাঁজাকোলা করে বসে আছে।
– কিরে! তুই এখানে বসে, আর ওদিকে স্যারের ভাই ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে!
 রাজু আমার কথার কোন গুরুত্ত না দিয়ে বিড়ি টানতে টানতে বলল,
- ও শালা কাঁপুক কিছুক্ষণ, আমাকে পচা শিঙাড়া খাইয়েছিল, এখন দেখুক কেমন লাগে। আমি ওর কাছ থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে নতুন জামাকাপড়গুলো ছোটো কাকার হাতে দিলাম। এর মধ্যে হল আর এক বিপত্তি। ছোটো কাকা পুরনো পাজামার দড়িতে গিট ফেলে দিয়েছে। ভিজে দড়ি এদিকওদিক টানাটানি করাতে গিট আরও মজবুত হয়ে গেল। দশাসই চেহারা নিয়েও কিছুতেই তাকে বাগে আনতে পারল না। মুখ দিয়ে দু'চারটে অশ্রাব্য গালাগাল বেড়িয়ে পড়ল গিঁটকে উদ্দেশ্য করে। আমরা মুখে হাত চাপা দিয়ে মুচকি হাসতে লাগলাম। এতক্ষণ রাজু দূর থেকে এসব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল। অবশেষে সাহসের সাথে কাটারি হাতে ছোটো কাকার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর দড়িটাকে টেনে কাটারি দিয়ে দু'বার পোঁচ দিতেই কেটে গেল। কিন্তু এরপর যে ঘটনা ঘটল তাতে সবাইকে চোখে হাত চাপা দিতে হল। ভিজে ভারী হওয়া পাজামা হঠাৎ খুলে নিচে পড়ে গেল। কাকা ভাবল রাজু ইচ্ছে করে এসব করেছে। ঘুরিয়ে এক থাপ্পড় কষাতে গেল। কিন্তু রাজু তা কাটিয়ে এক ছুট লাগাল।

                        পোড়ানোর কাজ শেষ। আমরা শ্মশান থেকে বেরিয়ে হাঁটা লাগালাম। গ্রাম্য রীতি অনুযায়ী মিষ্টির দোকানে আগেই খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। লুচি, ছোলার ডাল  আর দু'পিস রসগোল্লা। দোকানে পৌঁছাতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেল। গিয়ে দেখি দোকানদার টাটে বসে ঝিমচ্ছে। কর্মচারীরাও এদিক ওদিক আড়াল খুঁজে ঢুলছে। হঠাৎ আমাদের দেখে সবাই ধিরপির করে উঠে বসল। নিমেষের মধ্যে সমস্থ টেবিল শ্মশানযাত্রীতে ভরে গেল। চলল খাওয়াদাওয়া। সে কী খাওয়া, যেন বিয়ে বাড়ি! যেহেতু পদের সংখ্যা খুব কম, এক একজন পঁচিশ-তিরিসটা করে লুচি খেল। পরের পয়সায় খেতে পেলে বাঙালির মাথার ঠিক থাকে না। আর পরের পয়সাই বা বলি কি করে। ছোটো কাকা নিজেই বত্রিশটা লুচি আর ছ'টা রসগোল্লা খেল। আমরা দোকানের বিল মিটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

মন্তব্যসমূহ