মুক্তগদ্য-৩// অমিত কুমার বিশ্বাস//হৃদয় ডানা মেলে //ফেসবুকের পাতা থেকে


হৃদয় ডানা মেলে  
অমিত কুমার বিশ্বাস


তিলক্ষেতের ভেতর ভোটের পতাকা ! কাকতাড়ুয়া? বেশ। মেনে নিলাম মাঠও আজকাল রঙিন হয়ে থাকবে আর মানুষগুলো থাকবে সাদাকালো। তবু আমাদের অটো থেমে থাকে না। ভাঙাচোরা রাস্তার পাঁজরের উপর দিয়ে নিজেকে ঠেলে ঠেলে এগিয়ে চলে ক্রমশ । অটোচালকের পাঁজরের মতো প্রাচীন হতাশা আমাকে আড়াল করতে পারিনি। কারণ চারিদিকে তখন পাটশাকের গ্রামীণ মেজাজ আর পায়ে পায়ে ধুলোর সংবাদ।  তবে মন ভেঙে গেছে যখন দেখেছি গ্রামের পর গ্রাম বন্ধ্যা জলাশয় বুকে নিয়ে হাহাকার করছে নিমঠাকুরুণ! আসলে এইতো তো আমাদের অদূর সকাল !শূন্য কলসির বিষণ্ণ গান নিয়ে ছুটে যাবো মাইলের পর মাইল আর নিজেদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে টাঙিয়ে রাখবো পত্রহীন গাছে।


অবশেষে আমাদের ফিরতে হয় সেই সব তালখেজুরের দেশ থেকে। জানি  নক্সিকাঁথার    শেষ অধ্যায় গুনে চলেছি  নীরবে। ভাটার আগুন ডাকছে আয় আয় । এভাবে বাঙালি ভুলে যাবে  অনেক কিছুই, আর আঁটিসার খেজুরের মতো জীবন নিয়ে কেবল ছুটোছুটি হেথাহোথা।  আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই । শুধু কেন্নোর মতো  সম্ভোগানন্দে এগিয়ে যাওয়া । চারিদিকে  কাতারে কাতারে ক্ষুধামুখ।  আমাদের ফানুস ফুলতে ফুলতে ফেটেযাবার  উপক্রম। মন খারাপ হয় । আমাদের ভারের কাঁচা রস খেয়ে যায় অন্ধ  শকুনি। কী রেখে যাবে শেষমেশ?  কেবলই আঁটিসার খেজুরের  গড়াগড়ি দেখতে দেখতে  কেটে যাওয়া । এই সব ফোঁকলা জীবন নিয়ে বাঙালি এগোবে আরো কিছুটা। যেমনটা  এগিয়েছি একলা  কাঁটাতারের  'পর হেঁটে হেঁটে । রক্ত আর বেদনার ছায়াছবি মেখে। আজো হুঁকোজোড়া বিষণ্ণ প্রশ্বাস নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে পুকুর পাড়ে। আমাদের জন্য এইসব ভাঙাচোরা আদর্শলিপি দেখে মুখ লোকায়  ইছামতী। সেও  পক্ষাঘাতগ্রস্থ গোধূলির ছায়ার মতো শুয়ে থাকে একা একা। আর আমি কান্নার আয়োজনে ব্যর্থ  হয়ে  নির্বোধের মতো কাঠকলের নিচে শুয়ে পড়ি সুদীর্ঘ গুঁড়ির বেদনা মেখে।  


লোকগুলো কলাগাছের মতো ভালোবাসা নিয়ে   এল সেদিন। আমাদের ভাবনাকে বোকা বানিয়ে দুই ভাই  সমস্বরে গেয়ে উঠল গান। আর আমরাও দোতারা হাতে অ-আ-ক-খ শেখা ছাত্রের আত্মবিশ্বাস নিয়ে নেমে পড়লাম মাঝপথে । আমাদের মাঠে কোনো রক্ত নেই। কোনো এগজিমার জীবাণু ছড়িয়ে পড়িনি এখনও । আমাদের ঘাটে ঘাটে কেবল লালন লালন খেলা। এসপার- ওসপারের  শিশুদের  হাসি মেখে আমাদের মা ঠাকুমার ঘরে ভাসে   আবহমান ঝুলন্তসেতু । তবু কারা মাঝরাতে  শঙ্খচূড় লেলিয়ে দেয় পুকুরে ? বাতাসে মিশিয়ে দেয় ফলিডল?  স্তন কামড়ে উপভোগ করতে চায় সম্ভোগ? আমরা এমন দেশ চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম পালকিতে  রহিম- লতিফমিয়াঁদের সাথে  মদন বিশ্বাস- বুদ্ধু মন্ডল   থাকবে । আর হাঁকবে হেঁইয়া হো। ছুটে যাবে অনন্ত পথ। আর পান্তাভাতের মধ্যে কাঁচা লঙ্কা মিশিয়ে আলের উপর সেরে ফেলবে  আহারপর্ব।  তারপর আবার বেড়িয়ে পড়া। আবার কাঁচাআমের মতো ভালোবাসায় নুইয়ে পড়বে এইসব মুখগুলো । আর আমি চেয়ে থাকবো আমার শিশিরভেজা চোখ নিয়ে যেন হৃদয় ডানা মেলে  প্রথমবার দেখছি এই পরম  জগৎ কে ...


লালজামায় দেখে আবার খুলে গেল  অরণ্যের সিংহদুয়ার। যদিও সে  অরণ্যে ছিল বাঘেদের দাপট । খুব। যদিও সেইসব বাঘেরা আজ দাঁত খুঁইয়ে  বুনো শুয়োরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করে ঘুরে বেড়ায় সারাটা দুপুর আর পাঁচিলে গুঁতো খেয়ে আবার ফিয়ে যায় গভীর অরণ্যে। তবে সময় কি একটুও হাঁটেনি ? নিটোল ভালোবাসার মতোই আজও তোমার  অমায়িক  সন্তরণ! বুনো মেঘেদের সাথে ছুটে যাও  সব থেকে উঁচু টাওয়ারে লেগে থাকা নিষিদ্ধ চুম্বনের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে কিছুক্ষণ । আবার ...আবার ছুটে চলা...আবার আমার বোহেমিয়ান চাউনিতে ধরা পড়ে গেলে হাতেনাতে ...আর একসাথে কেঁদে ফেললাম কিছুক্ষণ... যেন  উদ্বাস্তু স্বপ্নের শিবিরে ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছে  নিরুদ্দেশ  সকাল ।
অবশেষে আমাদের ফিরতে হয় সেইসব তালখেজুরের দেশ থেকে। জানি  নক্সিকাঁথার    শেষ অধ্যায় গুনে চলেছি  নীরবে।



সেইসব অন্ধকার সেইসব অবহেলা এখনও  রোমকূপ ছুঁয়ে আছে... তবু অম্লান আকাশে উড়ে যাই  আজও... কারণ  একদিন গাছেদের কাছেই শিখেছিলাম পাখিদের আদর্শলিপি... একদিন রাতের কাছে শিখেছিলাম আঁধারের নিচে কীভাবে লুকিয়ে রাখতে হয় নিজ মুখ... গুহামুখে তবু তুমি আজও দাঁড়িয়ে... অন্ধকারের সাথে খেলতে খেলতে তুমিও বড়ো বেশি গম্ভীর হয়ে গেছো... যেন এ দেশে বাতাস বইতো না কখনও ... যেন  বন্ধ্যা মেঘের  হতাশা নিয়ে তোমার আজন্ম সন্তরণ ...জানি  একদিন শিমুল-পলাশের  তুমুল ভালোবাসায় তুমিও ছুটে আসবে কুয়াশার দরজা খুলে  ...  তখন যদিও আমাদের  ঘাসবন সটান ঢুকে যাবে পাতালরেলের উদরে!


মেঘলা আকাশের নিচে ছুটে চলেছে আমাদের রয়াল এনফিল্ড । রাস্তার দু'ধারে  ঈশ্বরের  সাজানো বাগান। বাঁওড় । ইছামতী । নদীর ওধারে  বাংলাদেশের   বাড়িঘর। রাস্তার বাঁদিকে বিস্তীর্ণ তাঁরকাটা। তার মধ্যে চলছে চাষাবাদ। ফাঁকে পান্তা ভোজন। আলে বসে। যুবক ও তাঁর বৃদ্ধা মা। কাজের ফাঁকে এ এক সুখের আহার। মুখে লেগে আছে প্রশান্তি । অর্থের হাহাকার লুকিয়ে রেখেছে সযত্নে। রাখবেও । এভাবেই। এমনই যাপন।  তাঁরকাটার পাশে সশস্ত্র প্রহরী  আমার ক্ষতচিহ্নের  মতোই আমার দিকে চেয়ে । মাঝে মাঝেই কৃষ্ণচূড়ার শোভা। আর সে আচমকা কিছুটা ক্ষত মুছে দিয়ে  পিছনে চলে যায়। অবশেষে কালীতলা আংরাইল বণ্যেবেড়িয়া ঝাউডাঙা পাঁচপোতা  ছাড়িয়ে এসে পৌঁছালাম  গোপালপুর ঘাটে।  ইছামতী বাঁদিক থেকে ঘুরে ডান দিকে 'ইউ টার্ন' নিয়েছে। বাংলাদেশের মাটিতে চুম্বন করে  আবার এদিকে! বৃদ্ধার অদ্ভুত চলন আজও। সম্মুখে কাঠের  সেতু। আমারও  এগোলাম। হেঁটে হেঁটে।  সেতুর উপর  দাঁড়িয়ে আমাদের সুপরিচিত ইছামতীকে একবার দেখে নিলাম দু'চোখ  মেলে। তারপর আরো পথ। আরো কিছুটা চলা।



হনুমানের মতো মুখ বাড়িয়ে  গলির গাড়িটা !  তাকে ডিঙিয়ে আমাদের  কবিতাগ্রাম। মেঘের অভিমানও ভেঙেছে অবশেষে ; আর সে জড়িয়ে ধরছে পেছন থেকে, যেন ঝোড়ো হাওয়ায় মাটিতে  চুমু দিয়ে যায় বাঁশবন। আমাদের সেই চলা চিরপরিচিত পথ নতুন লাগে ।পাতায় পাতায় আজ গান লেখা । পথে পথে কাঁচা মাটির মতো আলপনা। তার উপর আমাদের ছুটে যাওয়া। এইসব বৃষ্টিদিনে মহাদেব পাগলকেও বড়ো বেশি রোমান্টিক লাগে। তার চোখের নিচে ভাঙা ভাঙা হৃদয়ের  সুদীর্ঘ প্রচ্ছায়া। বিড়ির ধোঁয়ার মতোই তার হতাশা। আবার নেমে পড়ে । হাত ছুঁড়ে দেয় । জুটে যায় । কিংবা জোটে না।  রাত কেটে যায়। তবু বেঁচে থাকে। তার প্রেমিকারা ইংলিশ মিডিয়াম  ইস্কুলের  পাশে বসে আজও চুটিয়ে প্রেম করে যায়। আচমকা বৃষ্টি থামল। ইছামতীর বুক ছুঁয়ে এগিয়ে যায় সুবোল হালদার। ছেলে পুলিশে  গেছে। শহরে উঠছে বাড়ি। টালি মানে আজকাল দেওয়াল- মেঝেতে  থাকে । আর ভগবান পাঁচিলে! তবু সুবোল ঠাকুরের কাছে  জোড় হাত করে বলে , "ওদের ভালো রেখো পভু!"

হঠাৎ চলে যাবে! কেন? এত তাড়া কীসের? এত ঘেন্নাই-বা কেন! না । তার চেয়ে বরং ফিরে এসো আর চলো  মৃত্যুর সাথে একদান লুডো খেলে নেমে পড়ি ভাঙাঘর মেরামতের  খেলায়। দেখো তোমার মতো আজ  বৃষ্টিও কেঁদে ফেলল! দেখো এই  আলোআঁধারির  ফাঁকে ফাঁকে যে সব ঝুলন্ত সেতু আছে তার প্রতিটা  পাঁজরে তুমি পেয়ে যাবে সব ক্ষতের ইতিহাস । দেখো তোমার জন্য এখনো ঘাসবনে উবু হয়ে  বসে আছে  নীল সকাল ! আর তুমি ...
              না। এভাবে কি নিভে যায় জোনাকির ভালোবাসা কিংবা  সবুজ  মেঘের আশ্চর্য প্রদীপ! চলো , আমাদের নৌকো করে নেমে পড়ি আবার । আবার চলো  মেঘলা দিনে  জলের  আলপনা আঁকতে আঁকতে হারিয়ে যাই কোনো এক নির্জন কুটিরের জলধারায় ।

বৃষ্টিবিন্দু মেখেই বেড়িয়ে পড়া। সেই  আদারেবাদাড়ে ।  বহুযুগ পর ভেজামাটির গন্ধে গুমরে উঠল মন। মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন আমি মাটির ভালোবাসায় বিরক্ত! এমনইতো হয়। যশোদাকে ছেড়ে যায় কানাই। রাধাকেও।তবু এগোনো। চটি জোড়া হাতে । সম্মুখে মাঠপাড়া । পাঁচ-ছ'টা ঘর নিয়ে নতুন পাড়া বাঁওড়ের পাশে। নতুন গ্রাম গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। প্রথম দেখি এই গড়ে ওঠা। নির্জন ভূমিতে। আহা , এরকমই যদি থাকতো ! তা থাকবে না জানি। ক'দিন পর শুরু হবে কোলাহল। ঝগড়াঝাঁটি ঢুকে যাবে আততায়ীর মতো। আর গ্রাম আর গ্রাম থাকবে না, বাঁওড় আর বাঁওড় থাকবে না, সবুজ আর সবুজ থাকবে না! আরামডাঙায় তখন  গাড়ির ধোঁয়া। চোখ পুড়ে যাবে আমাদের কাক আর কাকতাড়ুয়ার শহরের মতো ! তখন আরো দূরে ছুটে যাবো ।আরো দূরে মুখ লুকাবো। যশোদার স্নেহ আর রাধার প্রেম খুঁজে বেড়াবো অন্ধ ফকিরের মতো। হয়তো কংক্রিটের  থামে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাবো খালের জলে, হয়তো সেখানেই পড়ে থাকবো মহাদেব পাগলের সাথে , হয়তো এই পথেই চলছি আমি এবং আমরা । গ্রাম পোড়ানো চুল্লির নিচে তখন একে ওকে জড়িয়েই আমাদের  রাত্রিযাপন!

১০
তরুণী মা  সন্তানকে নিয়ে ধেবড়ে বসে পড়ল প্লাটফর্মে ।আরো এল। পরিবারের । আরো মা। আরো কাচ্চা- বাচ্চা। ন্যাংটো -একপায়ে মোজা- ঝুলন্ত সেতুর মতো হাফ প্যান্ট ইত্যাদি। সারাটা প্লাটফর্ম জুরে তাদের খেলার মাঠ। কোমরবিছে আর খালিপায় ছুটে বেড়ানো মায়ের কোলের পুঁচকেটা কেমন তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। মশারি মেলে এখানেই নেমে পড়ল একে একে। পথিক-যাত্রীরা সারারাত চেয়ে থাকবে তাদের আঁচলের নিচে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির দিকে। এরা সব ডুবুরি। সোনাদানা খোয়া গেলে ডাক পড়ে। সাপ ধরে। এভাবেই এক আস্ত জীবন। এভাবেই পথে পথে সঙ্গম। প্রসব বেদনা । তবু  দলপতির মুখে চওড়া হাসি। ঘর থেকে  ভোট মেখে ফিরে এসেছে । আঙুলে কালির  অহংকার স্পষ্ট।

১১
চাঁদ আমাদের দেখে লুকিয়েছিল মুখ। পাতার পিছনে। তারপর ওড়না মুখে মুচকি হেসে বলল,কেন আসেন এই অবেলায়?
-কেন আসি? সেতো জানি না। ভাবিনি কখনও ! শুধু জানি আসি আর আসবো। এভাবেই । আর তাকিয়ে থাকবো তোমর নীল চোখ দুটির দিকে ।অনন্ত কাল।অনন্ত তারার আলো মেখে।






মন্তব্যসমূহ