এবং নজরুলঃ২ অন্তরা চৌধুরী

 বং নজরুলঃ              অন্তরা চৌধুরী 


                               নজরুলের কবিতায় মিথ চেতনা

                       সভ্যতার সৃষ্টিলগ্ন থেকে অজস্র প্রাকৃতিক ঘটনা এবং বিভিন্ন পার্থিব বিষয়ের ব্যাখ্যা আমাদের আদিম পিতামহদের সংস্কার ও বিশ্বাসে মণ্ডিত হয়ে যে রুপ লাভ করত, সেই ব্যাখ্যাগুলিকেই বলা হয় মিথ বা আদি লোকপুরাণ। ‘মিথ’ ও ‘রিয়্যালিটি’কে পরস্পরের অর্থবাহী বলে গণ্য করা হয়। আপাত দর্শনে ‘মিথ’ যতই অবাস্তব, অলৌকিক, অসম্ভাব্য বলে মনে হোক না কেন, তারই গভীরে লুকিয়ে থাকে বাস্তব তথা রিয়্যালিটির অজস্র উপাদান; যাকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যেতে পারে ‘মজ্জায় মিশে থাকা পিতামহের কাহিনি’। বারবার এই প্রাচীন মিথ নিয়ে লেখক ও শিল্পীরা নবনির্মাণ করেন। আধুনিক সংজ্ঞায় বলা যায় ‘পুরাণের নবজন্ম’। আসলে মিথের সত্তার মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লালন করা বহমান একটা সুদৃঢ় স্রোত রয়েছে। শিল্পে সমকালের প্রতিবিম্বন ঘটলে অনেক ক্ষেত্রে তার আবেদন তাৎক্ষণিক  হয়ে যেতে পারে। কারণ সমকালের স্থায়িত্ব শুধু সেই কালেরই মজ্জায় মিশে যাওয়া ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার –তা নয়। সাহিত্যিক শিল্পীরা বারেবারে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের অবচেতনে সাড়া দেন-তাই পুরাণের নবজন্ম ঘটতে দেখা যায় বারবার।

                      বাংলা সাহিত্যে মিথের প্রথম প্রয়োগ দেখা যায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ এ ব্যাবহৃত রাধাকৃষ্ণ মিথের মাধ্যমে। রামায়ণ ও মহাভারতের পুরো ব্যাপারটাই যেহেতু মিথ সংক্রান্ত তাই কৃত্তিবাস, কাশীরাম ও অন্যান্যদের লেখায় তার প্রয়োগ দেখা যায়। মঙ্গল কাব্যগুলিতেও লোকায়ত জীবনের ক্ষেত্রে ক্লাসিক্যাল মিথ উঠে আসে বারবার।

                     আধুনিক কালে সার্থক ভাবে ‘পুরাণের নবজন্ম’ ঘটেছে মধুসূদনের হাত ধরে। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে রামায়ণ কাহিনিকে তিনি সম্পূর্ণ নতুন ভাবে নতুন দৃষ্টিকোণ  থেকে উপস্থাপিত করেছেন। অবরুদ্ধ লঙ্কার সঙ্গে পরাধীন ভারতকে মিলিয়েছেন বলেই রাবণ তাঁর চোখে ‘grand fellow’ এবং রাম ‘despise’ হয়ে উঠেছে।
                       বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ এর উপসংহারে মিথের ব্যাবহার আছে। এছাড়া স্বল্প পরিমাণে হলেও হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্রের লেখাতেও মিথের উপস্থাপনা ঘটেছে।এই পরিপ্রেক্ষিতে পুরনো মিথের নতুন ভাবে বিশ্লেষন করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’, ‘গান্ধারীর আবেদন’, বিদায় অভিশাপ’, ‘পতিতা’ প্রভৃতিতে।
                    আমাদের আলোচ্য বিষয় নজরুলের কবিতায় মিথচেতনা কিভাবে আধুনিকতায় মিলিত হয়েছে। নজরুলের মিথ ব্যবহারের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এই প্রথম কোনো লেখক নিজেকে মিথের কোন চরিত্রের সঙ্গে সমীকৃত করেছেন। নজরুল ইসলামের অনেক গান ও কবিতায় স্বদেশের বর্ণনা থাকলেও তা কোথাও নিছক আবেগ বা অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর কাছে দেশ প্রেম ছিল মানুষের ব্যথা বেদনাকে অঙ্গীকার করে নেওয়া। তাই তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে-
                   ‘‘স্রষ্টাকে আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষকে দেখেছি। এই ধূলিমাখা পাপলিপ্ত অসহায় দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রন করবে......... এ আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। সকল ব্যথিতের ব্যথায় সকল অসহায়ের অশ্রুজলে আমি আমাকে অনুভব করি......... কিছু করতে নাই পারি, এদের সাথে প্রাণ ভরে যেন কাঁদতে পারি।’’
                   এহেন উপলব্ধি যে সাম্যবাদী কবির তাঁর কবিতায় একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল পুরাণ প্রসঙ্গের ব্যবহার। এত পুরাণ প্রসঙ্গ তাঁর পূর্ববর্তী বা সমযুগের কোনো কবি ব্যবহার করেন নি। বিষ্ণু দে এ বিষয়ে তাঁর উত্তরসূরী। অন্যান্য কবিতার মধ্যে ‘সব্যসাচী’ ও ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় সবথেকে বেশি মিথের উল্লেখ আছে। ‘ফণিমনসা’ কাব্যগ্রন্থের অন্যতম কবিতা ‘সব্যসাচী’। আলোচ্য কবিতায় দেশবাসীকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মহাভারতের অর্জুন চরিত্রকে আধুনিক পটভূমিকায় পুর্ণনির্মাণ করেছেন।

               ‘সব্যসাচী’ রচনাকালে 'বাঙ্গালীর'  প্রাণের বহ্নি প্রবাহিত হচ্ছিল। বিচার হিসেবহীন সে যুগে অসন্তোষ আর বিক্ষোভের ধারা উপধারা 'বাঙ্গালী যুগ' মানুষের হৃদয় তটে আছড়ে পড়ছিল। নারীর অমর্যাদা, ধনতান্ত্রিক অসাম্য, পরজীবি বিদেশীদের শোষণ বঞ্চনা, আর ধর্মগুরুদের ভন্ডামি দূর  করতে হবে-এই ছিল নজরুলের জীবন উপাসনা। নজরুল তাই সমুচ্চ কণ্ঠে ডাক দিলেন ধর্ম সংস্থাপক সব্যসাচীকে। অসংযত, বেহিসেবী ক্ষিপ্ত বিদ্রোহবাদ- যা ছিল সে যুগের মর্মবাণী, তাই যেন রূপ পেল  নজরুলের ‘সব্যসাচী’ কবিতায়।
                   কবি কল্পনায় অত্যাচারিত ভারতবাসীরা পাণ্ডবপক্ষ, এবং অত্যাচারী শাসক শোষক ইংরেজরা দুর্যোধন, দুঃশাসনের দল। ভারতবাসীরা আর অন্যায় সহ্য করবেনা। তাই অবশ্যম্ভাবী সংগ্রামে ভারতীয় পক্ষে সৈনাপত্য করার জন্য ডাক দিলেন মহাবীর পার্থকে-
               ‘‘নবীন মন্ত্রে দানিতে দীক্ষা আসিতেছে ফাল্গুনী,   জাগো রে জোয়ান!ঘুমায়ো না ভুয়ো শান্তির বাণী শুনি!’’
অন্যবীরের যখন এক হাতে অস্ত্র চলে, তখন অর্জুন দুই হস্তেই অস্ত্র চালাতে সক্ষম। দ্বাপর যুগের পার থেকে, তুহিনাবৃত গিরি শিখরে সমুন্নত শৃঙ্গ ভেদ করে হিমালয় প্রাচীকে কম্পিত করে ঐ বুঝি সব্যসাচীর জাগরণ ঘটল।তাই কবি বলেন-
                ‘ওরে ভয় নাই আর, দুলিয়া উঠেছে হিমালয়-চাপা প্রাচী’!
    কবি জানেন কালের গতি বড় কুটিল, এবং সে কখনো থেমে থাকেনা। কাজেই কবির আজকের শাসক ও শোষক একদিন না একদিন পর্যুদস্ত হবেই। তাই সব্যসাচীকে আহ্বান জানিয়ে কবি বলেন-
            ‘‘দক্ষিণ করে ছিঁড়িয়া শিকল, বাম করে বাণ হানি’
              এস নিরস্ত্র বন্দীর দেশে হে যুগ-শস্ত্রপাণি!
                     পুজা করে শুধু পেয়েছি কদলী,
                     এইবার তুমি এস মহাবলী!
             রথের সুমুখে বসায়ো চক্রী চক্রধারীরে টানি’,
             আর সত্য সেবিয়া দেখিতে পারিনা সত্যের প্রাণহানি।’’

কংস কারায় যেমন কংস নিহন্তার জন্ম হয়েছিল, স্ফটিক স্তম্ভ বিদীর্ণ করে যেমন হিরণ্যকশিপুর জন্ম হয়েছিল, নরসিংহ রূপ ধরে শ্রীহরির যেমন আবির্ভাব ঘটেছিল, তেমনি ইংরেজের অত্যাচার ভূমি ভারতেই হবে তাদের শ্মশান শয্যা। পদাঘাত জর্জরিত মানুষ কেই পিতা বলে ডাকতে হয় পদাঘাতকারীকে। বন্দিনী সীতার সম্মুখেই জ্বলেছিল রাবণের চিতা-
         ‘‘লঙ্কা সায়রে কাঁদে বন্দিনী ভারত লক্ষ্মী সীতা
         জ্বলি তাহারি আঁখির সম্মুখে কাল রাবণের চিতা’’

কেননা কবি শুনতে পেয়েছেন জয়ডঙ্কা। তিনি মনে করেন শংকর জেগে উঠেছে। গীতা উদ্‌গাতা শ্রীভগবান ঐ আসছেন নূতন যৌবন মন্ত্রে দীক্ষা দেওয়ার জন্য। জীবনে বসন্ত যৌবনের প্রতিভূ ফাল্গুনীর আগমন ঘটেছে।
   আধুনিকতার পটভূমিকায় মহাভারতের মিথকে অবলম্বন করে রচিত এই কবিতায় কবি সমকালীন ব্যর্থতা নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তাই তিনি লিখেছেন-
        “অনেক দধিচী হাড় দিল ভাই
         দানব দৈত্য তবু মরে নাই
সুতা দিয়ে মোরা স্বাধীনতা চাই, বসে বসে কাল গুনি!

                 ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এতদিন যে পৌরুষহীনতা, ক্লীবতা, অনৈক্যের চোরাবালি, ভ্রাতৃবিচ্ছেদ জনিত লজ্জার আবির্ভাব হয়েছে তার সমাধান এক মাত্র সম্ভব সব্যসাচী অর্জুনের আবির্ভাবে। তাই কবি আদর্শ নায়ক রূপে সব্যসাচীকে পরাধীন ভারতে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আকূল আবেদন জানিয়েছেন।
                অন্যদিকে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবির বিদ্রোহ সমাজের সমস্ত শাসন শোষণ ত্রাসনের বিরুদ্ধে। নজরুল নিজেই জানিয়েছেন –“সুর আমার সুন্দরের জন্য। আর তরবারী? সুন্দরের যে অবমাননা করে সেই অ-সুরের জন্য”।
                  ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি দুরন্ত আবেগ উচ্ছাসে অগ্রসর হতে থাকে, এবং সূচনাতেই মহাবিশ্বের মহাকাশ বিদীর্ণ করে দ্যুলোক ভ্যূলোক গোলোক ভেদ করে, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, খোদার আসন অতিক্রম করে তার আবির্ভাব যেন নাটকীয় ক্রমন্বতির দিকে এগিয়ে চলে। বিধাতার দীপ্ত জয়শ্রীর প্রতীক রাজটীকা ললাটে অঙ্কিত হওয়ার পর দুর্দম দুর্বিনীত এবং নৃশংস রূপে আবির্ভূত। অনিয়ম আর উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতীক বিদ্রোহী, ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণী, মহামারী, শাসন, ত্রাসন, সংহার, রূপে তার ভয়ংকরত্ব প্রকাশ করলেও সৌন্দর্যের মাধুর্যের ধ্যান তার মুক্ত জীবনানন্দে প্রকাশিত।
                পৌরাণিক প্রসঙ্গ ব্যবহারের প্রাসঙ্গিকতা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। এই কবিতায় যেসব পৌরাণিক অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তার রূপরেখা অনেকটা এরকম- ‘আরশ’ অর্থাৎ ঈশ্বরের আসন। ‘টর্পেডো’- ডুবোজাহাজ থেকে যে গোলার মাধ্যমে জাহাজ ধ্বংস করে, ‘ধূর্জটি শিব’-তিনটি রাগের নাম। ‘যমদগ্নি’-পরশুরামের পিতা। ‘ইন্দ্রাণীসুত’-জয়ন্ত। ‘ব্যোমকেশ’- গঙ্গা নামার সময় চুল আকাশে ব্যপ্ত হয়, তাই শিবের আরেক নাম ব্যোমকেশ। ‘ইষাণ বিষাণ’- শিবের শৃঙ্গ। ‘ইস্রাফিল’-ইসলামিয় পৌরাণিক দূত যিনি প্রলয় কালে শিঙা বাজিয়েছিলেন। ‘প্রভঞ্জন’-ঝড়। ‘তাজি বোররাখ’-হজরতের ঘোড়া। ‘হিম্মত হ্রেষা’-অসামান্য গতিবেগ। ‘বাঢ়ব অগ্নি’-জলের বুকে আগ্নেয় গিরি। ‘জেব্রাইল’-স্বর্গীয় দেবদূত। ‘অর্ফিয়াশ’-গ্রীক দেবতা। ‘হাবিয়া দোজখ’-খারাপ নরক। ‘বলরামের হাল’-পরশুরাম আঠার বার ক্ষত্রিয় ধ্বংস করেছিলেন। ‘ভৃগু’-ভগবানের বুকে ভক্তের পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন।
                   ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় ব্যবহৃত পৌরাণিক অনুষঙ্গগুলি হল-
‘ঈষা’-যীশু, মুষা-মোজেশ, ইহুদী ধর্মের প্রবর্তক, ‘বাঁশির’-কৃষ্ণ, ‘নবীরা’- হজরত মহম্মদ। ‘ঘৃতাচী’-দ্রোণের মাতা। ‘কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন’-ব্যসদেব যার জন্ম দ্বীপে; তিনি বেদের বিভাগ করেন তাই তার নাম ব্যসদেব। ব্যস অর্থাৎ বিভাগ। ‘কাণীন পুত্র’- কর্ণ।
                      জীবন সুরায় তার পাত্র পূর্ণ বলেই না বৈপরীত্যের সাধনা তার জীবন সাধনা। তাঁর কবিতায় নানা বৈপরীত্যের সমাবেশ ঘটাতে ঘটাতে অজস্র পুরাণ মিথের বিদ্যুৎ দীপ্তিতে ঝড়ের মাতন, মহাকালের দণ্ড, প্রচণ্ড নাদ ও খ্যাপা দুর্বাশার জীবনের সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে জীবনের মিহিমায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। আর এখানেই নজরুলের শ্রেষ্ঠতা।

তথ্যসূত্রঃ-
সরোজ বন্দ্যোপাধায়ঃ বাংলা কবিতার কালান্তর( দেজ পাব ,কল ৭৩) অক্টোবর ২০০০।
দীপ্তি ত্রিপাঠীঃ আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয় (দে'জ পাব। কলি -৭৩। ১৯৯৭) ।
বাংলা সাহিত্যের সম্পুর্ণ ইতিবৃত্ত- অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

মন্তব্যসমূহ