ধারাবাহিক প্রবন্ধঃ অনুপম সরকার





                                                 অনুপম সরকার 
আমরা মুচকে হেসে,বিনোদ বেশে বাজিয়ে যাব মলঃ পুরুষতন্ত্রের চাহিদা বনাম বঙ্কিম চন্দ্রের   ‘ইন্দিরা’র সামর্থের দ্বৈরথ                                                 

                                                            

          সত্য ঘটনা নিয়ে বিজয় তেন্ডুলকর লিখেছিলেন নাটক ‘কমলা’। আশির দশকের গোড়ায় ‘The Indian Express’ –এর সাংবাদিক অশ্বীন সরিন ক্রিতদাসী কেনা-বেচা সংবাদকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রদেশের এক হাট থেকে কিনে আনেন এক মহিলাকে, তারপর তাকেসুদ্ধ হাজির হন সাংবাদিক সম্মেলনে।চ্যালেঞ্জিং এই ঘটনাটিকে আধার করে রচিত হয় ‘কমলা’। পণ্য হিসাবে লেনদেনের ঘটনাটির মধ্য থেকে নারী জীবনের নিকষ কিছু সত্যমূলক প্রশ্নের উদ্‌ঘাটন ঘটে নাটকটিতে – বিবাহিত জীবনে নারীর ভূমিকা হিসাবে স্ত্রী হিসাবে শর্তনিরপেক্ষ কতখানি, আর কতখানি শোভন লোভন পন্থায় দাসীত্বে পরিবেশনে -–এ জীবনসত্য নাটকটিতে ঘটনাকে ফুঁড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।

        সত্যি কি স্ত্রীর ভূমিকা আসলে গৃহিনী-সচিব-সখা এবং ললিত কলাসঙ্গিনীর অভিধার আড়ালে এক মস্ত দাসীত্বের, যাকে ঢেকে রেখে দেওয়া হয় জীবনসঙ্গিনীর অথবা অর্ধাঙ্গিনীর স্বীকৃতিতে। প্রেম হোক, ভালোবাসা হোক অথবা সামাজিক পন্থাগত নির্বাচনে পাওয়া স্ত্রী নামক বস্তুটি যদি কখনো বা আদরে আহ্লাদে মোড়া সামগ্রী হয়েও ওঠেন তাহলেও একান্ত অনুগতা সেবিকার চেহারাতে তাকে পাওয়া যাবে- এই ইচ্ছে সঙ্গোপনে বাসা বেঁধে থাকে মনের কোণে। আমাদের আজন্মকালের সমাজ যে তাকে এই হিসাবেই দেখিয়ে এসেছে। তাই যদি না হবে তবে অভ্যস্ত ভূমিকা থেকে সরে গিয়ে ভাবতে পারি- তারও কিছু নিজেস্ব ইচ্ছের কথা, আরও চাই ছুটি- অবকাশ বা একান্ত প্রয়োজনীয় কিছু। সত্যিই কি ভাবা যায় তিনি তাঁর স্বামীর কিংবা সংসারের একান্ত অনুগামী হয়ে বাঁচবেন না? বরং তাঁর সংসারের অভিমুখ রচিত হবে তার ইচ্ছেতে, তাঁর স্বাধীন পছন্দে, সেখানে থাকবে তার নিজস্ব রুচির ক্ষেত্রটি। হায়রে! সংসারের পরিপ্রেক্ষিত নারীর অভ্যন্তরস্থ ব্যক্তির মাপে এবং বিকাশে হবে তা যে রীতিমত এক অসম্ভব বিষয়। বরং তার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা যেন এক এক সমাজের কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের দাবী মেনে একটি বিশেষ পরিমাপনের পরিবেশন।

               সংসারের এই গণ্ডিতেই যখন বসবাস করতে হবে তখন এর মধ্যে নিজের অস্তিত্বটুকুকে যথাসাধ্য নিজের মতো টিকিয়ে রাখেন মেয়েরা। যাকে আপাতদৃষ্টিতে বশ্যতা বলে ঠেকলেও তা আসলে জীবনে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার বৃত্তিরই প্রবণতা প্রকাশ। সংসারের মানে একটি মেয়ের আনুগত্য মাত্র নয় বরং তা সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে নিজ ব্যক্তিত্ব গড়তে তুমুল ক্ষমতায়নের বিস্ফোরণ ঘটাতে ব্যয়িত শক্তির সদৃশ কিছু ঘটা, তাতেও তাকে রাখতে নিজ বুদ্ধির ও নিজ সিদ্ধির সুযোগ সন্ধান এবং দখলদারি – সংসারে নিজ প্রতিমা নির্মাণে তার ক্ষমতার প্রকাশ ঘটা।

               নাটকে সাংবাদিক পত্নী সরিতার প্রতি হাট থেকে কিনে আনা কমলার প্রশ্ন ছিল – “How much did he buy you for?” আর সরিতাও বোধ করি কিছুটা  কমলাকে যাচাই করতেই উত্তর দিয়েছিল – সাতাশ। যে স্ত্রী তখনও সাংবাদিক জয় সিংহের কোন সন্তানের মা হয়নি ( সন্তান না হবার কারণ বন্ধ্যাত্ব নয় ,বরঞ্চ পরিকল্পনা ),  তার অত টাকা দাম শুনে কমলার মনে হয়েছিল – এর পুরোটাই অপব্যয়। নিজ অবস্থানের প্রেক্ষিত থেকেই আশ্চার্যন্বিত কমলার গলায় বিস্ময় যেন ধ্বনিত হয়েছিল। “ It was an expensive bargain, memsahib. If you pay seven hundred three are no children…” কমলা তার আজন্ম কালের বুদ্ধি দিয়ে জেনেছে, মেয়েরা গৃহকর্মে দাসী বৈ আর কিছু নয়, তারা সেই দাসী যারা ছেলেপুলে বিয়োবে, ঘর গেরস্থলী সামলাবে, পুরুষের পরিশ্রমের রোজগার হিসেব করে খরচ করবে, এমনকি আত্মীয়স্বজন – বন্ধুবান্ধব – লৌকিকতা কৃত্য ও তার বাধ্যকর দাসীপনার সীমানাতেই অন্তর্ভুক্ত। কেননা হুকুম পুরুষের।

         অতঃপর কমলা জয়সিংহের স্ত্রী সরিতাকে সগোত্র ভেবে দাসীপনার বাটোয়ারা করে ফেলে-
“ Memsahib, if you won’t misunderstand, I’ll tell you. The master bought you; he bought me, too. He spent lot of money on the two of us. Didn’t he? It isn’t easy to earn money. A man has to labour like an ox to do it. So, memsahib, both of us must stay hear together like sisters. We’ll make him prosperous. The master will have children. I’ll do the hard work. I’ll bring forth children. I will bring them up. You are an educated woman. You keep the accounts and run the house. Put on lovely clothes and make marry with the master. Go out with him on holidays and feast-days. Like today. I can’t  manage all that. And we must have land of own. Don’t worry about it, that’s my responsibility. Fifteen days of month, you sleep with the master; the other fifteen, I’ll sleep with him. Agreed? ”

     অতঃপর সরিতার বোধকরি নিজের কাছেই স্তম্ভিত হওয়ার ভিন্ন আর কোন উপায় থাকে না। কারণ নারীর বিবাহবন্ধনের নিকট বশ্যতা যে হিরণ্ময়পাত্র তা দাসীপনা ভিন্ন আর কিছু নয়। আর সে কথা স্পষ্ট হয় সরিতার কাছে। ক’জনের কপালে জোটে রবীন্দ্রনাথের ‘ চিত্রাঙ্গদা’র নিজ বীর্য নির্ভর করে বলে ওঠা।
                                “ রমণীর মন- ভোলাবার ছলাকলা 
                             দূর ক’রে দিয়ে উঠিয়া দাঁড়াক নারী
                             সরল উন্নত বীর্যবন্ত অন্তরের বলে
                             পর্বতের তেজস্বী তরুণ তরুণ সম- 
                             যেন সে সম্মান পায় পুরুষের। ”   


       চিত্রাঙ্গদারও ছিল অর্জুন সান্নিধ্যের পরবর্তী একক জীবন থেকে পুত্রকে সাবালক করে যুদ্ধক্ষেত্রে পিতার প্রয়োজনের মুহূর্তে পাঠিয়ে দেওয়া। তাঁর আগে নয়, তার আগে পুত্র সান্নিধ্যের প্রয়োজন অনুভব করেননি পিতা।

        সকলেই সরিতা নয়, সরিতার শিক্ষিত মনের উপলব্ধি সকল যুগে সকল কালে সকল নারীর হয় না। প্রয়োজনের ( প্রেস কনফারেন্স  সাংবাদিক হিসাবে নিজ কৃতিত্ব প্রদর্শনতো প্রয়োজনের নামান্তরই, তাই না ) ক্রীত সামগ্রী কমলাকে যেতে হয় অনাথালয়ে- যেখানে অবহেলিত প্রবঞ্চিত দুর্গতিপ্রাপ্ত নারীদের জোটে করুণার আশ্রয়। অন্যদিকে নানান মানসিক চড়াই উৎরাই বেয়ে সরিতাদের ঘটে বোধি।

          "… But a day will come, kakasaheb, when I will stop being a slave, I’ll no longer be an object to be used and thrown away. I’ll do what I wish, and no one will run over me. That day has to come. And I’ll pay whatever price I have to pay for it."

        বিজয় তেন্ডুলকরের সরিতা একথা বলতে ও ভাবতে পারে তার কারণ দাসীপনা তার পরিবর্তিত চেহারায় মানুষ হিসাবে ন্যায্য অধিকারের মুখোশের আড়ালে আত্মগোপন করলেও স্বমর্যাদার বিষয়টি তার সমকালে, তার শিক্ষায় অধিষ্ঠিত। অন্তত আইন তার গৃহিনীপনার অধিকার পাবার বিষয়টি মজবুত করেছে। কিন্তু বিষয়টি যদি হয় একশো বছরেরও অধিককাল আগেকার, সেখানে স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়াটাই সৌভাগ্য – সেখানে? কেননা এক চরিত্র নির্মাতা ( অবশ্যই তার সৃষ্টি চরিত্রদের মধ্যে নারী চরিত্রও ছিল ) ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিকের ভূমিকা নিয়ে পাঠকদের শোনান,          “তারপরে মালা – এটি স্ত্রীলোকের বিদ্যা – কখনো আধখানা বৈ পুরা দেখিতে পাইলাম না। নারিকেলের মালা বড় কাজে লাগে না; স্ত্রীলোকের বিদ্যাও বড় নয়। ” অতএব এই ঔপন্যাসিক যখন স্বামীসান্নিধ্য পেতে উৎসুক এক পরিণতযৌবনার কাহিনি রচনা করতে বসে তাকে এক ভয়াবহ ডাকাতির মুখোমুখি করিয়ে দেন এবং তাকে ডাকাতস্পৃষ্টার মিথ্যা কলঙ্কভার বইতে দেন তখন স্বধিকার ফিরে পেতে তাকে জিতে নিতে হয় জীবনের যত দুর্ঘট বিপত্তি। রূপে গুণে এবং সেবাপরায়ণতায় স্ত্রী তো দাসীত্বই করে। কাজে কাজেই দাসীপনার ছলে যদি জীবনে টেঁকা যায় তবে মন্দ কি? কমলা তার আজন্মের ভার বওয়ার অভ্যেস জেনেছিল- দাসীত্বই জীবন। আর ডাকাতের কবলে পড়া প্রাণচঞ্চল মেয়েটি অভিজ্ঞতালব্ধ বুদ্ধিতে জেনেছিল বেঁচে থাকাটাই সব। আর বেঁচে থাকার প্রয়োজনে দাসী হতে হলে হবে। দাসী হয়ে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে দোষ নেই। সাদা চোখে ধরা পড়লেও জীবনটা যে একরকম মস্ত লড়াই – সে লড়াই তাকে জিততেই হবে। তাই দাসীত্বের জীবনে তার ইশারায় সে প্রয়োগ করে শরীরী আবেদনের। সম্ভবত এই ধারণায় যে দাসীর ইতরতার আশ্রয় গ্রহণে দোষ ঘটে না। অথবা সে অনুধাবন করতে পেরেছিল, যখন ‘অপণা মাসে হরিণা বৈরী’ তখন উলটো করে বৈরীকে ঘায়েল করতেই 'অপণা মাসের' পশরা সাজানো যেতেই পারে।

      'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে 'ইন্দিরা' উপন্যাসটি প্রকাশ ঘটে ১৮৭৩ সালে।  'ইন্দিরা' লিখবার আগে ১৮৬৯ সালে ইতিহাসমিশ্রিত জটিল ঘটনাক্রম নিয়ে  বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন তাঁর উপন্যাস 'মৃণালিনী' এবং ১৮৭২ সালে 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বের হয় তাঁর 'কৃষ্ণকান্তের উইল' উপন্যাসটি –-- বাংলা উপন্যাসের ধারায় তাঁর এই প্রথম উপন্যাসটি প্রথম সমকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট নির্ভর উপন্যাস।

       
           মুসলিম আক্রমণের ও শাসনের পটভূমিতে লেখা 'মৃণালিনী' এবং সামাজিক নির্ভরতার 'কৃষ্ণকান্তের উইল'  লিখবার পরিশ্রমের পর তিনি তিনটি হালকা চালের লেখা লেখেন –  'ইন্দিরা', 'যুগলাঙ্গুরীয়'  এবং  'রাধারানী' । তিনটি বইকে একত্রিত করে ১৮৮০ সালে  'উপকথা'  নামে প্রকাশ করেন। 'উপকথা'  এই নামটি কি তবে নিজের রচনাকে উপন্যাস অ্যাখ্যা দেবার পক্ষে বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্টি সাক্ষ্য দেয়? সম্ভবত তাই। পরবর্তি সময়ে অবশ্য ১৮৭৩ খ্রিঃ’র ৪৫ পৃষ্ঠার রচনা পঞ্চম সংস্করণে কলেবর বৃদ্ধি ঘটে ২১ পরিচ্ছেদে বিভক্ত ১৭৭ পৃষ্ঠার যা ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের সযত্ন মনোযোগের সাক্ষ্য বহন করে। অর্থাৎ কেবল শিরোনাম থেকে নয়, কলেবর বৃদ্ধিও ইন্দিরার চরিত্র নামাঙ্কিত নারীর দিকে ঔপন্যাসিকের বিশেষ মনোযোগের অভিমুখকে দেখায়।

            উপন্যাসটিতে বিত্তবানের কন্যা ইন্দ্রিরার দরিদ্র ঘরে বিয়ে হয়। বিত্তবানের ঘরে বিবাহিত কন্যা এবং মেধাবী কিংবা বুদ্ধিমান ঘরজামাই স্বামীর বসবাস কোনো  নতুন কথা নয়। কিন্তু এখানে তার অন্যথা ঘটে। ইন্দিরার শ্বশুরকুল এবং স্বামী স্বভাবে স্বাভিমানী। বিত্তবান শ্বশুরের উপর রুষ্ট হয়ে পদব্রজে পশ্চিমে গিয়ে কমিসেরিয়েটের চাকুরিতে গিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। অতঃপর তাঁর স্বামী উপেন্দ্রবাবু স্ত্রীকে আনতে পাল্কী পাঠালেন এবং সঙ্গে ইন্দিরার বাবাকে রীতিমত ফরমান জারি করা হল ‘পাল্কী বেহারা পাঠাইলাম’ বধূমাতাকে একটিতে পাঠাইয়া দেবেন। নচেৎ পুত্রের বিবাহের সম্বন্ধ করিব।
                                                                                                                              ( চলবে...)

মন্তব্যসমূহ