এবং অন্যান্য গদ্য -১ // বিভাস রায়চৌধুরী

                                                         
                   
               
                                                                                                          
                                                                                 

                         প্রকৃত   //    বিভাস রায়চৌধুরী  

   
                                                     
             বাংলা কবিতার দিব্যোন্মাদ চরিত্র বিনয় মজুমদার পূর্বাপরহীন । তা যতই তাঁকে জীবনানন্দ - অনুসারী বলে  দেগে দেওয়া হোক না কেন! এই দেগে দেওয়ার কাজটি যাঁরা করেন তাঁরা গভীরতাহীন পেশাদার এবং একইসঙ্গে  আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। পয়ার -মহাপয়ারে দখল থাকলেই , আর কবিতার শরীরে নিসর্গ-প্রকৃতির  উপস্থিতি দেখা গেলেই একজন জীবনানন্দের অনুগামী হয়ে যান না  কখনোই। ভাষাভঙ্গি তো সময়ের দান। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, জীবনানন্দের 'দ্বিধা' ' হতাশা' বিনয়ে নেই , বরং তাঁর আছে 'বেদনা'র পথে হেঁটে অনন্তের দিকে যেতে চাওয়া এবং পর্যবেক্ষণকে 'সিদ্ধান্ত'-এর স্তরে উন্নীত করার সাবলীল প্রয়াস। বারবার বিনয় যে  একাজে সফল হয়েছেন , তার কারণ তিনি ছিলেন একজন গণিতবিদ। গণিতই তাঁকে 'প্রকৃত' শব্দটির বিশুদ্ধ অবস্থান চিনিয়েছে । সেই শক্তিতেই রচিত হয়েছে শতাব্দী-জয়ী এই কবিতা পঙক্তি- "মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়"। এ তো দ্বিধাতুর রহস্য নয়, এ হল স্বচ্ছ অভিজ্ঞান। গ্রামবাংলার খালবিলের অতিচেনা ছবিটি যে 'জ্ঞান' হয়ে উঠল , তা ভাষার জোরে নয়, ছন্দের দক্ষতায় নয়, তা সম্ভব হল একটি নতুন অর্থ বাক্যের শরীর বইয়ে দেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতায় । আশ্চর্য বললেও অবশ্য একটি হাততালি দেওয়া হয়ে যায় । এই জাতীয় কবিতা রচনা তখনই সম্ভব , যখন কবিতা আলাদা করে আর কোনও 'লিখবার বিষয়' নয় , কবিতা কবির জীবনযাপনেই লীন হয়ে থাকে। চর্যাপদের সাধক কবিরা  বা সেদিনের  রামপ্রসাদ সেন প্রমুখরা এই ধারাটিকেই বহন করে এনেছেন , যেখানে কবিতা বা গান এক সাধনপ্রক্রিয়া, যেখানে দৃশ্যই ধারণ করে অদৃশ্যকে, বাস্তব বয়ে নিয়ে যায় বাস্তব-অতিরিক্তকে। এক্ষেত্রে কবি হন ধর্মনিষ্ঠ ও একাগ্র । সামান্য ভানও ভেঙে দিতে পারে তপস্যা । বিনয়ের ক্ষেত্রে ধর্মটি ছিল বেদনা ।  বেদনাধর্মে  দীক্ষিত এই কবি সমস্ত ছেড়ে কবিতাকে বেছে নিয়েছিলেন অচিরেই। তারপরের ঘটনা অনেকেই জানে । কেউ ব্যথিত হয় , কেউ মেতে ওঠে নানান গালগল্পে।
বিনয় মজুমদারের সমাধি। এখানেই কবিকে দাহ করা হয়।

                                                    ২

                            ১৯৬০ সালে যখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন, কেবল কবিতাই লিখবেন , তখন কী অবস্থায় ছিল তাঁর জীবন? ১৯৫৩-তে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই এস সি উত্তীর্ণ , ১৯৫৭-তে শিবপুর বি ই কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং- এ প্রথম শ্রেণি পাওয়া বিনয় তখন উজ্জ্বল মেধাবী যুবক। কবিতা লিখে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অনেকের। পঞ্চাশের সমসাময়িক কবিদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ঘোরাফেরা করেন। কফি হাউসের আড্ডায় নিয়মিত। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'নক্ষত্রের আলোয়'। চাকরি করেছেন অল ইন্ডিয়া ইস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট , ত্রিপুরা গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ , হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড , যুগান্তর পত্রিকা, দুর্গাপুর আয়রন অ্যান্ড স্টিল প্লান্ট প্রভৃতি সংস্থায়। পরবর্তীতে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় , বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় , জাপানের ইঞ্জিয়ারিং ফার্ম থেকেও ডাক পেয়েছিলেন। যাননি। তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন শুধুমাত্র কবিতা লিখবেন। প্রসঙ্গটি এই জন্যই বিস্তারিত লিখলাম , আমাদেরকে অনুভব করতে হবে কবিতাসাধনার জন্য কতটা আত্মত্যাগ করেছিলেন তিনি সেই সময়ে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে রোগজীর্ণ , দারিদ্রক্লিষ্ট যে- বিনয়কে দেখে মধ্যবিত্তসুলভ 'আহা-উহুঁ ' করেছি আমরা , সেই বিনয় কিন্তু ইচ্ছে করলেই গণিত- অধ্যাপনা বা ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে বড় চাকরি  করে স্বচ্ছল থাকতে পারতেন কবিতা রচনার পাশাপাশি। বাংলার কৃতবিদ্য কবিরা তো সেভাবেই লিখে চলেছেন একজীবন । আমাদের সমাজে প্রধানত কবিতা রচনাকেই জীবিকা  হিসাবে গ্রহণ করলে যে ঘোর বিপদ , তা কি সেদিনের বিনয় জানতেন না? তিনি সেই বিরল মানুষ , যিনি স্বেচ্ছায়  কবিতাসর্বস্ব  হতে চেয়েছেন । কবিতা লিখে বেদনাকে ভুলে থাকতে চেয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিজীবন যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল , সেজন্য বিনয়কে কোনও দিন অনুতাপ করতে দেখিনি। যাই হোক , ১৯৬০-এ কেবল কবিতা রচনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কী হল? কলকাতায় এক বন্ধুর বাড়িতে এসে প্রবল ঘোরের ভেতর তিনি  রচনা করতে থাকলেন অমর কাব্যগ্রন্থ 'ফিরে এসো, চাকা'র প্রবহমান কবিতাগুচ্ছ। এই সময়েই তাঁর মধ্যে  মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দেয়। ১৯৬১ সালে তাঁকে ভরতি করা হয় মানসিক হাসপাতালে । ছ'মাস  পরে তিনি হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে 'ফিরে এসো, চাকা'র বাকি কবিতাগুলি লেখেন।  এই সময়কালে বিনয়  তাঁর শেষ চাকরিটি করেছিলেন দুর্গাপুরে। ১৯৬২ সালে 'গ্রন্থজগৎ' থেকে 'গায়ত্রীকে' কবিতাপুস্তিকার   পূর্ণাঙ্গ  সংস্করণ 'ফিরে এসো, চাকা'  প্রকাশিত হয়  এবং চতুর্দিকে আলোড়ন সৃষ্টি করে। শেষ চাকরির শেষ বেতনের টাকা ব্যবহৃত হয় গ্রন্থপ্রকাশে --এই তথ্য কবির কাছ থেকেই জানা গিয়েছে। দু'বছর পরেই গ্রন্থটি কবির ভূমিকাসহ 'আমার ঈশ্বরীকে' নামে প্রকাশিত হয়। যেন একটি সাধনার অধ্যায় সমাপ্ত করেছেন, তার প্রকাশ নিয়ে কবি অস্থির নানাভাবে। এই সময়ে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছন কবি। স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা হয় ,  বিনয়  কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। বাংলা কবিতায় তাঁর এক-একটা পঙতি যেন ঋষিবাক্য হয়ে আছে। দশকে দশকে কত না বিচিত্র শক্তির কবি আবির্ভূত হয়েছেন , নতুন শক্তির কবিতা রচনা করেছেন , কিন্তু আজও অসীম হয়ে আছে বিনয়ের সাধনসত্য ।লিখেছেন--"তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে / চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা" কিংবা "সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও / মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে" বা "সকল সমুদ্র আর উদ্ভিদজগৎ আর মরুভূমি দিয়ে/ প্রবাহিত  হওয়া ভিন্ন বাতাসের অন্য কোনো গতিবিধি নেই"। ভালবাসার ক্ষত দিয়ে লেখা তীব্র ভালোবাসারই  কবিতা এইসব। ব্যর্থ সম্পর্ক থেকে পলায়ন নয় , বরং সহ্য করা হচ্ছে  ব্যর্থতাকে । সমগ্র  অস্তিত্বে মিশিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিচ্ছেদের সত্য। বেদনাও যে এক মায়া , বেদনাও যে এক দান , বেদনাও যে এক বেঁচে-থাকা , তার আশ্চর্য দার্শনিক ফসল এইসব কবিতা।"নিষ্পেষণে ক্রমে ক্রমে অঙ্গারের মতোন সংযমে / হীরকের জন্ম হয় , দ্যুতিময় , আত্মসমাহতি"--এই উচ্চারণ যার , তাঁর ব্যক্তিজীবনে উত্তম-সুচিত্রা মার্কা গপ্পো খুঁজতে যাওয়া নিরর্থক। কোন মানবী কবিকে কষ্ট দিয়েছিল, তা আলোচনার চেয়েও জরুরি বিনয়ের এই গাজনের সন্ন্যাসীর মতো 'আত্মনিষ্পেষণ'- সাধনাকে লক্ষ্য করা। সমস্থ মানুষ যখন সাফল্যের জন্য  মরিয়া, খুন- জখম -রাহাজানি-ঘুষ-প্রতারণা- টাকাচুরি যে-কোনও উপায়ে সফল হওয়ার জন্য প্রাণপাত করছে , তখন বিনয় নিজের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখছেন কাঁদতে-কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়া সরল এক শিশুকে। অপূর্ব তাঁর জীবন ভঙ্গিমা--" মাঝে -মাঝে অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে / প্রস্রাব করার মতো অস্থানে বেদনা ঝ'রে যাবে।"

            
বিনয় মজুমদারের বাড়ি
                                                 
                     বিনয়ের পরবর্তী জীবনে বিপন্নতার মাত্রা দুঃসহ হয়ে ওঠে। মানসিকভাবে অসুস্থ , দারিদ্রপীড়িত বিনয় ১৯৭০ -এ চলে আসেন ঠাকুর নগরের শিমুলপুর গ্রামে মা-বাবার কাছে । ১৯৮৪ সালে পরপর মা-বাবা প্রয়াত হলে তিনি একদম একা হয়ে যান এবং একই সঙ্গে অধিক বিপন্ন । তবে কোনও কোনও শুভানুধ্যায়ী তাঁকে ভোলেননি। লিটল ম্যাগাজিনের কবিরা , স্থানীয় কিছু মানুষও তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন । আমি তাঁকে দেখেছি ভাঙাচোরা এক মানুষ হিসাবে। অল্প বয়সে মনে অনেক প্রশ্ন  জেগেছে। তাঁর বিখ্যাত বন্ধুরা কেন এই অবিস্মরণীয় , অসুস্থ কবির পাশে আরও যত্ন নিয়ে দাঁড়ালেন না ? একলা এক প্রতিভাকে তিলে তিলে মরতে না দিয়ে তাঁকে ভালোভাবে বেঁচে-থাকার ব্যবস্থা করা যেত না? এত কষ্টের ভেতরেও বিনয় নিয়মিত লিখে গিয়েছেন, বাংলার অজস্র ছোটো পত্র-পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছে। নগর থেকে দূরে কবিতার জগতে বিপুল প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন উত্তরোত্তর। মৃত্যুর আগে-আগে বিনয়কে রবীন্দ্র পুরস্কারসাহিত্য একাডেমী পুরস্কার  দেওয়া হয় । ততদিনে রামা-শ্যামা সবাই পেয়ে গিয়েছেন। কেন এই বিলম্ব? প্রশ্নটা তো সহজ এবং উত্তরও তো জানা। নয়বার পাগলাগারদে যাওয়া , কুড়িটির বেশি কাব্যগ্রন্থের, একাধিক গদ্যগ্রন্থের জনক এই কবি ২০০৬ সালের ১১ ডিসেম্বর সকালে নিঃস্ব ফকিরের মতো মারা গেলে গোপনে একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি । অপরাধবোধের দিন শেষ হল আমাদের। কবির তো মৃত্যু হয় না। কবির মৃত্যুদিন 'প্রকৃত' অর্থে জন্মদিন। বাড়ির উঠোনেই আগুনে পুড়ে গেল বিনয়ের নশ্বর দেহ। জেগে থাকল অবিনশ্বর কবিতা--" পৃথিবীর ঘাস মাটি , মানুষ , পশু ও পাখি -- সবার জীবনী লেখা হলে/ আমরা একার আর আলাদা জীবনী লেখা না-হলেও চ'লে যেতো বেশ।"


                                                  

মন্তব্যসমূহ