এবং নজরুল//৩//দেবশ্রী ভাট্টাচার্য

     এবং নজরুল//৩               দেবশ্রী ভাট্টাচার্য  
          
                       বিদ্রোহী কবি নজরুল -এক অন্য বিদ্রোহ   

            নজরুল বিদ্রোহী কবি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে পরাধীন ভারতবর্ষের পরাধীন মানুষের দুর্দশায় আহত হন এবং অসির সাহায্যে নয় মসীর সাহায্যে সক্রিয়ভাবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হন। বিদেশী সরকারের রক্তচক্ষুকে অবহেলা করে তিনি তাঁর কবিতায়,গানে, প্রবন্ধে আগুনের ফুলকি ছড়িয়েছিলেন।এর জন্য তাঁকে কারাবাস পর্যন্ত করতে হয়েছিল । সে যুগে বিপ্লবীদের কাছে নজরুলের গান ও কবিতা ছিল বেদ আর গীতার মত পবিত্র। এ প্রসঙ্গে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মত উল্লেখযোগ্য –“আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তর মরু’-র মত এমন প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না”। নজরুলের এই বিদ্রোহ ছিল স্বজ্ঞানে, নিজের ইচ্ছায়। তবে নিজের অজান্তে আর একটি বিদ্রোহ করেছিলেন তিনি। এই বিদ্রোহ তাঁর রাজনৈতিক বিদ্রোহের চেয়ে কিছু কম ছিল না। বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।


             রবীন্দ্রনাথের পূর্বে বাংলা কাব্য সাহিত্যে- দাশরথির চাতুরি, রামপ্রসাদের আকুল করা ভক্তি , ঈশ্বর গুপ্তের সাংবাদিকতা আর মধুসূদনের বীররসের ভাবধারা ছাড়া আর কিছু ছিল না। এরকম একটা সময় রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব ছিল অনেকটা আকস্মিক। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়-“ যেন এক দৈব আবির্ভাব, অপর্যাপ্ত, চেষ্টাহীন, ভাস্কর। পৃথিবীর মহোত্তম কবিদের অন্যতম। আমার কাছে আমার মতো, আরও অনেকের কাছে তাদের মতো, এই হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার তুল্য ক্ষমতা ও উদ্যম , ভাষার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল। অপরিসর ক্ষীণপ্রাণ বাংলা  সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ যেন সৌরমণ্ডলের অগ্নিবিহঙ্গ, আলোকের ঝর্ণাধারায় অগ্নিস্নানই তাঁর স্বভাবধর্ম”। এর একটা অবশ্যম্ভাবি পরিণতি হল রবীন্দ্র সমসাময়িক কবিকুলের রবিতাপে বিলীন হয়ে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথের মতো হতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথেই হারিয়ে গেলেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের কবিতার আপাত স্বচ্ছতার মোহে ভুলে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের মতো কাব্য রচনা শুরু করলেন। তাঁরা ভুলে গেলেন যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো জিনিস নয়,তাঁর  কবিতা ভেতর থেকে হয়ে ওঠা। চোখে দেখা প্রতক্ষ পৃথিবী কেমন করে তাঁকে নাড়া দিয়েছে, প্রতিদিনের সুখ-দুঃখে তিনি কীভাবে আন্দোলিত হয়েছেন –ইত্যাদি তাঁর গানে কবিতায় রূপায়িত হয়েছে। গদ্য বা উপন্যাসের ক্ষেত্রে যদিও তাঁর কয়েকজন উত্তরসূরি পাওয়া যায়, কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব এমনই সর্বগ্রাসী হয়েছিল যে তা থেকে বেরনোর ইচ্ছেটাকেও অন্যায় বলে মনে  হত।
            এখানেই নজরুলের বিদ্রোহ। রবীন্দ্রনাথের সেই সর্বগ্রাসী প্রভাবের দিনে দাঁড়িয়েও রবীন্দ্রনাথকে সসম্মানে এড়িয়ে চললেন তিনি। রবীন্দ্রপ্রতিভা যখন মধ্যগগনে নজরুল তখন রবীন্দ্র-বন্ধন ছেড়ে বার হলেন, বলা যায় অসাধ্য সাধন করলেন। নজরুলের এই অসাধ্য সাধনের পেছনে সাধনার কোন ইতিহাস নেই। কোনো রকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি না নিয়েই আপন স্বভাবের শক্তিতে রবীন্দ্রপ্রভাবের ছত্রচ্ছায়া থেকে সরে গিয়ে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে নতুন প্রভাব আনয়ন করলেন। রবীন্দ্রানুসারী কবি সমাজের কয়েকটি  সাধারণ বৈশিষ্ট ছিল--
১) এই কবি সমাজ বাংলাদেশের গ্রাম্যসমাজের লোকসমাজের ভক্ত ।
২)নগরজীবনের আশা-আকাঙ্খা, বেদনা, হতাশা, ব্যর্থতা, আশাভঙ্গজনিত ক্ষোভ, বাস্তবের সঙ্গে সংগ্রামে ক্ষত-বিক্ষত মানবতার জীর্ণ ক্রন্দন এখানে অনুপস্থিত।
৩) রবীন্দ্রকাব্যের অক্ষয় শান্তি,সৌন্দর্যের সাধনা এই কবিদের যাত্রা রবীন্দ্রকথিত আস্তিক্যবোধে সৃষ্টিতে কল্যাণে মঙ্গলে শান্তিতে এই কবিকুলের গভীর আস্থা।
৪) গার্হস্থ জীবন চিত্রাঙ্কনে সুখ, বেদনা , আনন্দ, উল্লাস এবং দাম্পত্য, বাৎসল্য,সখ্য ,মধুর রসের প্রকাশেই কবিকুলের অভ্যস্ততা ।
৫)রবীন্দ্রানুসারী কবিকুলের প্রেম-চেতনা রোমান্টিক দৃষ্টিপ্রযুক্ত, আধুনিক প্রেমের বিচিত্র –তির্যক প্রকাশ জটিলতা এখানে অনুপস্থিত।
৬)সে যুগের কবিসমাজের দেশপ্রেম কেবলমাত্র পুরাণকাহিনী ও অতীত ইতিহাসের গৌরব চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
                    নজরুলের কাব্যচর্চার বিশ্লেষণ করলেও এই গুণগুলি চোখে পড়ে তবে তার প্রকাশের স্বরূপ ভিন্ন। রবীন্দ্র সমসাময়িক কবি সত্যেন্দ্রনাথ, কুমুদরঞ্জন প্রভৃতিদের থেকে আলাদা করে চেনা যায় নজরুলকে । এখানেই নজরুলের কৃতিত্ব। বস্তুত নজরুল রবীন্দ্রনাথ ও কল্লোলীয় কবিদের মধ্যে একটি অদৃশ্য সেতুবন্ধন করেছেন।                        
                 ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নজরুলের কবিতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন-“নজরুল ইসলামের কবিতা একযুগে প্রচণ্ড গতিবেগ সৃষ্টি করেছিল, অসাধারণ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিলেন কিন্তু একটু বাজিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে তাঁর কবিতার অন্তর্নিহিত শক্তি বড় অল্প............। তা ক্ষনিকের উত্তেজনা সৃষ্টি করে ক্রমে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়”। নজরুল ইসলাম মননহীন ,অসংযত ভাবাবেগের কবি। তাঁর কবিতার সর্বত্র আবেগেরই প্রাধান্য। এই আবেগ যৌবনের প্রাণ লক্ষণ। কিন্তু আবেগের সঙ্গে মনের প্রগারতা যুক্ত হলে তবেই সেই সৃষ্টি অমরত্ব লাভ করে। নজরুলের কাব্যে আবেগের প্রাচুর্য ছিল, কিন্তু মননের স্থৈর্য ছিল না। একই ভাব ও একই বিষয় তাঁর কাব্যে ফিরে ফিরে এসেছে। অতিকথন ও আতিশয্য এর পদে পদে । তথ্য সংক্রান্ত ক্রুটিও তাঁর কাব্যে নজরে পড়ে। যেমন- ‘আমি ইন্দ্রাণী সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য’ এই পৌরাণিক উদাহরণটির কোন ভিত্তি নেই। ইন্দ্রাণীর পুত্রের নাম জয়ন্ত।তাঁর হাতে চাঁদ ভালে সূর্যের কোন প্রসঙ্গ পুরাণে নেই।ইন্দ্রাণী অর্থে দুর্গাকে ধরলেও তাঁর পুত্র কার্ত্তিক।কিন্তু তাঁরও হাতে চাঁদ ভালে সূর্যের কোন প্রসঙ্গ নেই।  নজরুলের আবির্ভাব হয়েছিল এক অস্থির সময়ে। সেই যুগ সেই সময় তাঁকে ‘art for art’s sake’ নীতিতে বিশ্বাসী হতে দেয়নি। নিজের কাব্যের ক্রুটি সম্পর্কে কবি নিজেও সচেতন ছিলেন। এর জবাবও তিনি দিয়েছেন ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায়-
               “বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ জ্বালা এই বুকে,
                দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে কই মুখে
                  রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা
                   তাই লিখে যাই এই রক্তলেখা
               বড় কথা বড় ভাব আসে নাকো মাথায়, বন্ধু বড় দুখে!
               অমর কাব্য তোমরা লিখিও বন্ধু যাহারা আছ সুখে।
               প্রার্থনা কর যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটির মুখের গ্রাস!
                যেন লেখা থাকে আমার এ রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ”।

                রবিন্দ্রনাথ বলেছিলেন –‘বলেছি যে কথা করেছি যে কাজ / আমার সে নয় সবার সে আজ”। তাঁর কাব্য দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। আজও সব শোকের স্বান্তনা রবীন্দ্রনাথ, সব আনন্দের সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ। নজরুল অস্থির সময়ের অস্থির কবি। তিনি সর্বনাশের কবি। তাঁর লেখা রক্তলেখা। সে যুগে তাঁর কাব্য যতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যুগের প্রয়োজন মিটে গেলে বিশেষজ্ঞদের কাটাছেঁড়ায় ততটাই জর্জরিত হয়। নজরুলের লেখাকে বাংলা কাব্য বিশারদেরা কখনওই ভালো চোখে দেখেননি। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, “অদম্য স্বতঃস্ফূর্ততা  নজরুলের কাব্যের প্রধান গুণ আবার প্রধান দোষ”। এইসঙ্গে তিনি কিন্তু এও স্বীকার করেছিলেন, “নজরুল ইসলামকে  মনে হয় রবীন্দ্রনাথের পর অন্য একজন কবি”। এমনকি রবীন্দ্রনাথও তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় নজরুলকে তাঁর পরবর্তী কবি হিসাবে স্বীকৃতি দেন –
              “আজি হতে শতবর্ষ পরে
        এখন করিছে গান সে কোন নতুন কবি
              তোমাদের ঘরে
       আজিকার বসন্তের আনন্দ অভিবাদন
           পাঠায়ে দিলাম তার করে” ।
এখানেই নজরুলের সার্থকতা, তাঁর অজান্তে করা বিদ্রোহের সার্থকতা।
                                                                               
                 
           তথ্য সংগ্রহঃ-
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যপাধ্যায়
রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক –বুদ্ধদেব বসু
সঞ্চিতা –কাজী নজরুল ইসলাম
সঞ্চয়িতা –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর                        

মন্তব্যসমূহ