এবং অন্যান্য গদ্য-৩// মৃন্ময় প্রামাণিক

                                                       মৃন্ময় প্রামাণিক
                              এই রেসে আমরাও সামিল

               I have a dream that my eyes could not see/ the color of skin, that your pigment brings/ That I could not feel the lashes of hatred/  ‘cause racism STINGS/ Only the Blind can unconditionally love/ So we must, yes we must/ We must fight now/ We Must Blind Our Eyes/ Listen to the Cries/ Face What’s Inside/Break Shameful Pride/ Changing our Times/ ‘Til Our Fate Satisfied/ Sometimes I wish I was blind, cause only then I could see, I could see…
                                                                                             -   Rockz Solid and Annie Mae 

             উপনিবেশ আর শিল্পবিপ্লব উন্নয়নকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কে হিসেব করতে শিখিয়েছে, সেখান থেকেই আমরা উচ্চ-নীচ, উন্নত-অনুন্নত, সভ্য-অসভ্য ভাগ করতে শিখে গেছি। বিদ্যাসাগর বহু বছর আগে লিখেছিলেন ‘সভ্য- অসভ্য’, আমাদের তথাকথিত সভ্যতার মধ্যে জাতি বিদ্বেষ বা বর্ণ বিদ্বেষ যে কীভাবে সক্রিয় তিনি দেখিয়েছিলেন, সভ্যতার সংজ্ঞা নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সে লেখা পড়েও আমরা কতটুকুই-বা শিখেছি। সভ্য-অসভ্য নিয়ে সংশয় তো সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’-এর দেশ ছাড়ার একটি কারণ। আর দুটি জাতির মধ্যে অপেক্ষাকৃত উন্নত মনে করা জাতি তো অন্য জাতিকে একটু কম সভ্যই মনে করে।সদ্য দিল্লিতে ঘটে যাওয়া অরুণাচল প্রদেশের ছাত্র নিডো তানিয়ামের হত্যাকাণ্ড আমাদের লজ্জাকে, বর্বরতাকে নৃশংসভাবে দেখিয়ে দিল। ভারতবর্ষে এই বর্ণ বিদ্বেষ বা জাতি বিদ্বেষের ঘটনা প্রতি নিয়তই ঘটে চলে। কিছুটা আমরা জানতে পারি, কিছুটা তুচ্ছ বলে অবজ্ঞা করি, কিছুটা ভয়ে ভুলে থাকি, কিছুটা প্রমাণের অভাবে নিশ্চুপ করে আমাদের। বর্ণবিদ্বেষে কখন রাষ্ট্র নিজে অংশ নেয় কখনও বিজ্ঞাপন, মিডিয়া, নানা শিল্প আমাদের বর্ণ বিদ্বেষের শিক্ষা দেয়, কখনও আমাদের জাতিগত অহংকার, কখনও আমাদের নাগরিক মন, কখনও আমাদের সংস্কৃতি, কখনও বিশ্বাস, কখনও নিছক অজ্ঞতা আমাদের জাতি ও বর্ণ বিদ্বেষী করে তোলে।



                     ১৯ শে অক্টোবর ২০০৮ এ মহারাষ্ট্র নভনির্মাণ সেনা ও শিব সেনা আক্রমণ করে উত্তর ভারত থেকে মুম্বাই-এ রেলের পরীক্ষা দিতে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের। ৩রা ফেব্রুয়ারি ২০০৮ থেকে ঐ একই দল সমাজবাদী পার্টির সাথে দ্বন্দ্বের জেরে আক্রমণ শুরু করে মুম্বাই-এ উঠে আসা বিহার উত্তর প্রদেশের মানুষজনদের ওপর। ২০০৭ -এ আলফা ও কে.এল.এন.এল.এফ দ্বারা হিন্দি ভাষাভাষী শ্রমিকরা আক্রান্ত হয় আসামে।গত বছরের অক্টোবর মাসে গোয়ায় নাইজেরিয়ানদের বিরুদ্ধে ড্রাগ ব্যাবসার অভিযোগে নাইজেরিয়ায়ন তাড়াও পোস্টারে ছেয়ে গেছিলো বহু জায়গা। দিল্লি তে ‘আপ’ ক্ষমতায় আসার পর দিল্লিকে পরিচ্ছন্ন করতে দিল্লিতে নাইজেরিয়ান ও উগান্ডার অধিবাসীদের বিরুদ্ধে বেশ্যাবৃত্তি ও ড্রাগ ব্যাবসার অভিযোগ আনা হয়। ‘আপ’ এর আইনমন্ত্রী সোমনাথ ভারতী একজন উগান্ডার মহিলাকে লোকভরতি রাস্তায় মূত্রের স্যাম্পল দিতে বাধ্য করেন। ‘চাঁদের পাহাড়ে’র শঙ্কর আফ্রিকায় গিয়ে চাকরি করতে পারে কিন্তু ভয়ে দিল্লি ছেড়ে পালাতে হয় ঘানা, ক্যামেরুনের মানুষদের। ব্রিটিশের হাত ধরে উপনিবেশের কালে কালো মানুষদের শাসক তো আমরাও ছিলাম, তাই এই ‘প্রভু’ আমরা কালো চামড়া কে দাস হিসেবেই দেখবো, আমাদের শ্রদ্ধা ও লালসা দুই-ই যে সাদা চামড়ার প্রতি। আর সাদা না হলে তো কেউ সুন্দর হয়না, পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে ফর্সা মেয়ে খোঁজার হিড়িক দেখলে আমাদের প্রতিদিনের বর্ণ বিদ্বেষ অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অথবা যখন হিন্দি সিনেমার নায়ককে উত্তর ভারতীয় দেখতে হতেই হয় বা বাজার ছেয়ে যায় ফেয়ার ক্রিমের বিজ্ঞাপনে তখনও বুঝি প্রতিদিন আমরা কীভাবে একটু একটু করে রেসিস্ট হয়ে উঠি। ব্রিটিশের তৈরি আফসপা আইন ভারত সরকার এখনও বলবৎ রেখেছে মণিপুরে। এর বিরুদ্ধে ইরমচানু শর্মিলার ১৪ বছরের অনশনকে এখনও অবজ্ঞা করা হচ্ছে। মনুষ্যত্বের অধিকার কেড়ে নিয়ে ব্রিটিশরা ১৮৭১ সালের ক্রিমিনাল ট্রাইব আক্ট-এ বেশ কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়কে ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ হিসেবে ঘোষণা করে, আজও শবরদের ওপর থেকে সেই সামাজিক  চিহ্ন দূর হয়নি। সর্দারজির জোকস তো মোবাইলে মোবাইলে ছড়াতে থাকে নিয়মিত।ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের মধ্যেও পরস্পর প্রদেশের প্রতি কী  রকম জাতি-বর্ণ বিদ্বেষ আছে তাতো আমরা অনেকেই লক্ষ্য করেছি। এতো সবই সাম্প্রতিক ঘটনা, ক্যালেন্ডার ধরে পিছোতে থাকলে এমন দিন হয়তো কমই আসবে যেদিন বর্ণ বিদ্বেষ বা জাতি বিদ্বেষের ঘটনা ঘটেনি।
ভাষিক বর্ণ বিদ্বেষও জন্ম দেয় নানা সামাজিক সমস্যার। কখনও কখনও তা অন্যান্য অনেক সমস্যার মূলগত কারণ হয়ে যায়। ভারত সরকার যখন ভোটের কথা ভেবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় হিন্দি সংস্থান, রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত সংস্থান ও ঊর্দূ আকাডেমী প্রতিষ্ঠা করে তখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বর্ণ বিদ্বেষ প্রকট হয়ে ওঠে। জয় প্রকাশ নারায়ণের হিন্দির একাধিপত্যের দাবি বা সাম্প্রতিক কালে মুলায়ম সিং যাদবের সংসদে ইংরেজি 'ব্যান' করার দাবি ভাষিক বর্ণ বিদ্বেষের চিহ্ন বহন করে। মাঝে মাঝে উড়ো খবর আসে ফেসবুক বা মোবাইলে, ফরাসীর পরেই নাকি বাংলা পৃথিবীর সব থেকে মিষ্টি ভাষা, এতো বাঙালির জাতীয় দম্ভের প্রকাশ।
                    ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করা বাঙালির তো জাতিগত অহংকার সুতীব্র। আমাদের যত সম্মান সাদা চামড়ার প্রতি, বাকি সব ভারতবাসী আমাদের নীচে। জাতীয় ইতিহাসে আমাদের নাম, বিজ্ঞানে বাঙালি, ইতিহাসে বাঙালি, সাহিত্যে বাঙালি।এই প্রতিনিধিত্বের জোড়ে অন্য জাতির মানুষদের ছোটো করে দেখার অভ্যাস আমাদের আছে। অন্য রাজ্যের প্রতি আমাদের যতটুকু সম্মান তা তথাকথিত উন্নয়নের লালসায়। হায়দ্রাবাদ, বাঙ্গালোর, পুনে, মুম্বাই, দিল্লী আহমেদাবাদ নিয়ে আমাদের উচ্চ ধারণা, কারণ ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট পাশ করা ছেলে-মেয়েরা সেখানে চাকরি পায়, এই যে সম্মান বোধ, এর মধ্যে আছে, বাঙালির কেন এটা নেই, এটা যখন অমুকের আছে, এরকম একটা ঈর্ষাবোধ।
দীর্ঘদিন ধরে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এলিট বাঙালির রুচিবোধ পালিশকরা, তাই ‘আমরা পাঞ্জাবিদের পাঁইয়া বলি, মাড়োয়ারি মাওড়া/ আর নন কমিউনাল দেওয়াল লিখি ক্যালকাটা টু হাওড়া’ (চন্দ্রবিন্দু)। আমরা অত্যন্ত অহংকৃত হই নিজেদের আত্মসমালোচনা করে কারণ তার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে গর্ববোধের চোরাস্রোত, অনেকটা এই রকম, ‘কিচ্ছু হলনা কেন বলুন তো?...আপনি বাঙালি, তাই’ (চলো লেটস গো)। লিখিত বা ভদ্রলোকের সাহিত্য নিয়ে আমাদের অহংকারও শিরোধার্য, অন্য জাতিকে ছোটো করার আগে তো খতিয়ে দেখতে পারতাম নিজেকে প্রকাশ না করতে পারার যন্ত্রণায় কোনো জাতি গুমরে মরছে কিনা, কোনো জাতি তার লোকসংস্কৃতিতে নিজের সব অনুভূতি প্রকাশ করছে কিনা। অজ্ঞানতা অহংকৃত করে তাই সিরিয়াল কিলারের কবিতার নোট দেখতে দেখতে বলে ফেলি, “খুনি যদি পাঞ্জাবি বা মারোয়াড়ী হত খুব ভাল হত/-আপনি কি সাধারণত এরকমই প্রাদেশিক কথাবার্তা বলে থাকেন/-প্রাদেশিক নয়, কথাটা হচ্ছে হক” (বাইশে শ্রাবণ)।

                    ক্লাস থ্রি তে পড়েছিলাম ‘প্রদীপের বন্ধুরা’, ভারতবর্ষের সব প্রান্ত থেকে এসেছিল প্রদীপের বন্ধুরা, ওর জন্মদিনে, উত্তরপূর্ব ভারত থেকে কেউ ছিলনা সেই গদ্যে। জাতীয় সঙ্গীত জাতীয় ইতিহাস কোথাও নেই উত্তরপূর্বভারতের কথা। আজও আমরা কম হেনস্থা করিনা তাদের, ‘চিঙ্কি’ বলে ডাকি, হাজারটা স্টিরিওটাইপ তাদের নিয়ে, বিছানায় সহজেই পাওয়া যায়, সব সময় ড্রাগ নিয়ে থাকে ইত্যাদি নানা কথা তাদের ঘিরে।এছাড়াও বিহারী আমাদের কাছে ‘খোট্টা’, দক্ষিণ ভারতীয়রা যে কেউই আমাদের কাছে মাদ্রাসী, যেকোনো আদিবাসীই আমাদের কাছে সাঁওতাল, গায়ের রঙ কালো হলেই তেলুগু বা 


সাঁওতাল। আমাদের গায়ে একটু ধুলো বালি থাকলে ‘চাষা’, ‘মুচি’, ‘মেথর’, ‘ডোম’তো একএকটা গালি হয়ে যায়। বাঙালি ভদ্রলোকের কাছে ‘চুরি’টা শুধু চুরি নয় ‘চামারিও’ বটে। ভদ্রলোক বাঙালির প্রতিদিনের অভ্যাসের অন্দরে গিজগিজ করছে বর্ণ বিদ্বেষের কীট।
এই ভ্রান্তি ও অন্যায় অভ্যাস থেকে বেড়িয়ে আসতে একটা সংস্কৃতি নির্মাণ প্রয়োজন যে  সংস্কৃতি নির্মাণের একটা উপায় হতে পারে সুশিক্ষার ব্যাবস্থা করা। ইস্কুল পাঠ্যবই-এ বিভিন্ন বিষয়ে উঠে আসুক এই শোষণের কথা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হোক তুলনামূলক সাহিত্য, ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, তাহলে শুধুমাত্র একটা সাহিত্যের অঙ্গনে বন্দি থেকে মানুষ নিজের বিষয় বা ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে গোঁড়া অহংকার লালন করা থেকে একটু দূরে থাকবে। লোক সংস্কৃতি চর্চা বাড়ুক সাহিত্যের বিভাগগুলোতে লিখিত সাহিত্য না থাকলেই যে কেউ অসভ্য হয়না এটা আমরা বুঝতে শিখব তখন। ইস্কুল থেকে ইউনিভার্সিটি এই দীর্ঘদিন ধরে কিছু মানুষ যদি তাদের চেনা জানা পরিসরের বাইরে গিয়ে পড়াশুনো করার সুযোগ পায়, তারাই নিজেদের অজান্তেই অনেককে প্রভাবিত করতে পারবে। অন্যদিকে বাড়ুক আমাদের অনুবাদ প্রবণতা, ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদ, আফ্রিকার সাহিত্যের অনুবাদ, ভারতীয় আদিবাসী সাহিত্যের অনুবাদ ও সে নিয়ে আলোচনা আমরা শুরু করেছি, বিস্তৃত করি সেই অভ্যাসকে। জ্ঞানের অভাবেই দীর্ঘ দিনের অভ্যাস একটি অন্যায় কে অন্যায় হিসেবে বুঝতে দেয়না।ছোটো বেলা থেকে ইতিহাস বই-এর ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’, বৈচিত্র কে দমন করে ঐক্যের কথায় কৃত্রিম বিস্ময়ভরে শুনিয়ে যায়।  অজ্ঞতা থেকে অহংকার আমাদের গ্রাস করে, ভুলটাকে ভুল বলে বুঝতে শিখবো আর কি করে, কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত বলেছিলেন না, ‘দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে’। অন্ধকার কাটানোর চেষ্টা শুরু হোক, ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’ ভেদ বুদ্ধিহীন হওয়ার সংস্কৃতি তৈরি করার প্রয়াস নিই।

(লেখক হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ও অনুবাদ চর্চার গবেষক।)

মন্তব্যসমূহ