মুক্তগদ্য-১/সুবীর সরকার



সুবীর সরকার
‘ও মোর হায় হস্তীর কন্যা রে’...

‘কান্দে কানাই

বাজেয়া রে সানাই’


১।

খোকা বর্মন সানাই বাজায়। খোকা বর্মন হাতঘড়ি-প্যান্ট-সার্ট লুঙ্গি এসব কিছুই পড়ে না। পাজামা ও ফতুয়া পরে। খোকা বর্মন নদী ভালোবাসে। আর নদীর পর নদী পেরিয়ে সে নদীপথেই ফিরে আসে। ঘর বানায়। সংসার বানায়। বানায় নাকি নির্মাণ করে। আবার নির্মাণ করে বলেই খোকার একটা বসতবাড়ি হয়। খোকা বর্মন সানাই বাজায় এটা কোনো ঘটনাই নয়। কেননা পৃথিবীতে হাজার হাজার সানাই বাজানেওয়ালা মানুষ আছে। তবু খোকা বর্মন সানাই বাজায়। এটা একটা ঘটনাই। ঘটনার সাথে তুরন্ত জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-দশটি গ্রাম। মানুষজন। খোকা বর্মনের সানাই ছাড়া সেইসব গ্রামে কোনো বিয়ে হবে না, অন্নপ্রাশন হবে না, লোকদেবতার পুজো হবে না। মাটির গভীর থেকে সানাই-এর সুর উঠে আসে। আর উঠে এসেই সেই সুর কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে না। খোকার এমনই যাদু যে সুর প্রথমে স্বল্পগতির দৌড় লাগায়। এরপর ক্রমাগত গতিশীল হয়। গতিশীল দৌড় একটা বহুরৈখিকতা অর্জন করে। অর্থাৎ সানাইয়ের সুর ছড়িয়ে পড়ে মাঠ প্রান্তর নদী বসতবাড়ি বৃক্ষরাজি বালক বালিকা মেঠোপথ যাবতীয় গ্রাম্য অনুষঙ্গের ওপর দিয়ে। ‘ওপর দিয়ে’র মানে বদলে ভিতর দিয়ে বা মধ্য দিয়েও হয়। খোকার সানাই বাদন আবার নাচগান ভুলতে বসা গ্রামের মেয়েবউদের টেনে নিয়ে আসে চিরাচরিত বিবাহনাচের কাছে। অর্থাৎ আনন্দের কাছে। খোকার সানাই টুকরো চাঁদের নিচে ঝুলে থাকে। ঝুলে থাকলেও সানাইকে মোতেও দোলনা অথবা মই মনে হয় না। মনে হয় না কেননা খোকার সানাই অপদেবতার পুজোতে বাজে, বাজতেই থাকে অথচ আমাদের গা ছমছম বা ভয় ভয় কিছুই করে না। খোকা কি জানে বা টের পায় বা বোঝে পৃথিবীতে মেয়েদের জীবন আদতে কষ্ট আর কান্নার জীবন। সেই সানাই শুনে অনেক মেয়েই আবার কান্নাতেই মুখ ঢাকে। কেননা সেই কান্না প্রকৃতই কান্না নয়। তা আসলে বিড়বিড় করে কথা বলে, মেয়েদের নিজস্ব ভাষায়।

২।
আমার খুব ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে। উল্টোপাল্টা করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে বাঁশি বাজিয়ে পুনরায় নদীকে পুরনো খাতে ফিরিয়ে আনতে। মাঠে মাঠে আমি তো শূন্যতাকেই খুঁজি। আর বাজপোড়া গাছ, কালো কয়লার মতো, শূন্যতাকেই রেখে যায়। আগুনে পোড়া লাশ, যুদ্ধ ও দাঙ্গার গল্পে কেঁপে কেঁপে ওঠা রেলব্রিজ; অথবা রেলসেতু ঘামে ভেজা দুপুরের রেলিং ছুঁইয়ে উড়ন্ত পাখির ঠোঁট হয়ে যায়। ঠোঁট নড়ে। আর রামকথার আড়ালে জীবনগাথা গেয়ে চলেন কোনো কোনো লোকশিল্পী। শূন্যতা তুমি তবে পিরামিড হও। ফুলবাগানের কোণে কোণে আমি রেখে আসি ছেঁড়া বোতাম। বোতামের গা জুড়ে রক্তের দাগ। জীবন মানে আপোষ। আত্মহত্যা। অথবা হননদৃশ্যের শুরুতেই অদৃশ্য থেকেই উলুধ্বনি। উলুধ্বনি থেমে গেলে জনপদ জুড়ে আশ্চর্য প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়। গণধোলাইয়ের আগে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ধূপ ও ধুনো। এই জনপদ গূঢ় কোনো বধ্যভূমি। চৌদিকে মাংস পোড়ার গন্ধ। আমি কি যাদু জানি। আমি কি আগের মতন হাতের উপর রাখতে পারবো হাত। বিচ্ছেদপর্বে খুব অন্ধকার। বিষাদের গন্ধ লেবুপাতার মতো। আর শান্ত মেয়েটির মুখের কাছে সামান্য মৃদু মেঘ। জোড়া শিমূলের গাছ। বোবার শত্রূ নেই – এই প্রবাদ ফিকে হয়ে আসছে। তাই পিচকারি থেকে শূন্যতা ছড়াই। আমার স্বপ্নে প্রিয়জন বা অগ্রজ কবিদের কেউ কেউ তো আসতেই পারেন। আসেনও। তাই বলে কি আমি সমস্ত গোপনীয়তা চুরমার করে পুনশ্চ ফিরিয়ে আনবো সান্ধ্যভাষা, শীত ও শিশির। আর আমার দুপুরের ঘুমে বারবার কড়া নাড়ে মহাশূন্যতা। শূন্যতা ধুয়ে দিচ্ছে জলের দাগ। আর তা অনুসরণ করতে থাকুক মেঘের শব্দ। আর আব্বাসের গান।



৩।

কাষ্ঠ নির্মিত ঘরবাড়ির প্রতি আবাল্য আকর্ষণ আমার । আমার বাল্যকালের অনেকটা কেটেছে কাঠের বাড়িতে । কাঠের সব বাড়ি ঘরের মাঝ খানে । এবং আজ কানে বাজে পিতামহর কাঠের খড়মের শব্দ । আবার ঝরনার পাশে ঝোরার কাছে কাঠের বাড়ি । কাঠের বাড়ি মানেই জঙ্গল আর জঙ্গল । জঙ্গল থেকে হাওয়া আসে । হাওয়া এসে ঢোকে কাঠের বাড়ির মধ্যে ।কাঠের বাড়ির সামনে দিয়ে উত্তরের হাতির পালদলবেধে যায় । আবার কাঠের বাড়ির কাঠের বারান্দা থেকে কেউ কেউ হাতিমিছিলের ছবি তোলে । তবে বনবাংলো এবং কাঠের বাড়ি কখনো এক নয় । জদিও উভয়ই কাঠ দিয়ে নির্মিত । বনবংলোতে প্রবেশের জন্য ভ্রমনোপযোগী বিকেল দরকার । আর বর্ষাকালের ভেতরে আকুল হয়ে থাকে আমাদের কাঠের ঘরবারি ।তরাই ডুয়ার্স এ এখনও কতো কাঠের বাড়ি । ছরানো ছিটানো । কাঠের বাড়ী আমাদের


 স্বপ্ন ঝাপি । স্মৃতিকাতর করে । আর স্মৃতিকাতরতা খুলে দেয় দেখা জল চোখ ।আমার কবিতায় খুব চলে আসে কাঠের বাড়ি । বাড়ির সামনে চিলতে মাঠ । নাবাল জমির ঢাল । কাটাগাছে।বনতুলসী । কবিরা আসেন এখানে নদী পেরিয়ে । ছবি আঁকবার লোকজনও । আর সকলে সিঁড়ি ভেঙেই কাঠের বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে । আর তারা তো ঢুকেই আর চুপ চাপ বসে থাকে না । মানে বসে থাকাই যায় না । কাঠের ঘরবাড়ি আবার নিসর্গপ্রীতি জাগায় ।তখন একা একাই গান ধরা । একা একাই হাততালি। কাঠের বাড়ির তৈলচিত্রে পাখিদেরও দেখা যায় । খুব মনখারাপের দিনে আমি কাঠের বাড়ির স্বপ্নে ডুবে থাকি ।স্বপ্নে কাঠের বাড়িকে পাশ কাটিয়ে চলে আসে কাঠের খড়ম , কাঠের আরামচেয়ার , ভ্রমনলাঠি ও কাঠের সিঁড়ি । অথবা সিঁড়িটাকে বাদ দিয়ে বা ঠেলে সরিয়ে দেয়াও যায় কেননা সিঁড়ি তো কাঠের বাড়িরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ।


৪।

দিদির মৃত্যুর দিন বৃষ্টি হচ্ছিল । বৃষ্টি হচ্ছিল এটা সত্যি ।সত্যি দিদির মৃত্যুও। বৃষ্টি হচ্ছিল তবে সেটা জোরালো বা ধারালো বৃষ্টি নয় । বৃষ্টি থামছিল আবার শুরু হচ্ছিল । অথবা বৃষ্টি টেনে নিয়ে যাছিল বৃষ্টিকে । আচ্ছা "টেনে নিয়ে" কাটছাঁট করে লিখি বরং "নিয়ে যাচ্ছিল"। বৃষ্টি তবে কোথায় যায় । যায় বললেই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে ।ফাঁকা ফাঁকা মানে মহাশূন্যতার একতা বোধ ।অনুভূতি । কবিতা লিখবার সময় কালে এমনকি পড়বার সময়ে বা রিক্সায় চেপে একা একা ঘুরে বেড়ানোর মুহূর্তেও ফাঁকা ফাঁকা অবশ্যই ভাবায় ।ভাবায় এবং দীর্ঘ ভাবনার পরেও আমার শূন্যতা সরে না । সরে না তাই পাহাড়ে বেড়াতে গেলে আমি পাথর গড়িয়ে দিই। গড়িয়ে দিই একারণে অনুতাপ হয়ই না কোনো । শহরের শীত সহজেই যুক্ত করে নেয় সার্কাসের তাঁবু ।


 জোকারের হৈ-হল্লা রাজহাঁসের ডাক ঘোড়াদের মৃদু মেদুর সমবেত হাসি -----এইসব স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে সার্কাসের প্রসঙ্গে ।প্রসঙ্গ এমন জিনিস বারবার বদলে যাওয়া যার স্বভাবধর্ম । বদলে যাওয়াটা যথাযথ শোনাবে যদি বলি অবস্থানবিন্দুর ঘোরাফেরা ও চলাচল ।চলাচল ও ঘোরাফেরা চমৎকার ছবি টাঙিয়ে দেয় ।একজন পর্যটক ।একাধিক ধর্মযাজক ও অজস্র হাটফেরত জনতা সমুদয় অনুযঙ্গ এসে বসে পড়ে টাঙিয়ে দেওয়া সেই ছবিতে আর একনদী থেকে বেড়িয়ে আসা আরো এক নদী থাকলে তৎসহ বেড়িয়ে আসা নদীর ঢালু জুড়ে যদি কিছু উড়ন্ত পাখির ঝাঁক টেনে আনা যায় তাহলে সন্দেহাতীতভাবে উপহারযোগ্য ছবি হয়ে উঠবে সেটা আর কথাপ্রসঙ্গে চলাচল ও ঘোরাফেরা মুদ্রাদোষের মত ঘুরে ফিরে আসবে। যেমন কত কত শব্দ রোজদিন ঘুরেফিরে আসে । আর তাদের অধিকাংশই ঘরে ফিরে চলে যায়। চলে যাওয়াটা সামান্য মর্মাহত করে । আবার উৎফুল্লও ।চলে যায় বলেই তো আবার খুঁজতে শুরু করি । জাগরণে থাকি । থাকি তাই বৃষ্টি হচ্ছিল-- এই শব্দটি আমাকে সবসময় দিদির মৃত্যুর কথা ,মৃত মুখের কথা মনে করিয়ে দেয় ।

মন্তব্যসমূহ