ছোটোগল্প // সোম সরকার // ভবিষ্যতের আবির

                                                      সোম সরকার 
                                    ভবিষ্যতের আবির

 আবির কপাল চাপড়ালো । নিজের মনে দুই বালতি ধিক্কার ঢেলে দিয়ে বলল -
"হোলি শিট্ ! দোল খেতে না গেলেই ভালো হত, তাহলে আমার মনের হাত-পা ভাঙতো না । রঙ ডিসিশন্ ।"

              ওদিক থেকে আবিরের কেলো বন্ধুরা সব দল বেঁধে তার কাছে ছুটে আসছে দেখে কাঁদোস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সে -
"না আ আ আ... না প্লিজ , শুধু  আবির প্লিজ ! শুধু  আবির !"
সেই শুনে বন্ধুরা সমস্বরে বলে উঠল -
"এক মাত্তো আবীর তো ও ও ও", সাথে সাথে  আবিরকে অনাবির করে দিল রঙে-বেরঙে । ব্যাস্ । এখন আর চেনার জো নেই । কোনটা আসল  আবির ? রাস্তায় এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পয়সায় কেনা নষ্ট  আবির নাকি রাস্তার উপরে দাঁড়ানো একটু আগেই দোল বোলড্ হয়ে যাওয়া অনাবির  আবির ?

         কেউ তো জানে না  আবির কিনা একটু আগে পাণিপ্রার্থনা করতে গিয়ে কাটা পানিফল হয়ে  গেছিল । কি করে বা জানবে ? কারণ সে নিজের যুদ্ধের ব্যর্থকাহিনী কারুর সাথে শেয়ার করে না । করতেও চায় না সে । যুদ্ধে হেরে গেলে যেমন নিজের ভাঙা মনকে সমস্ত শক্তি নিয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যোদ্ধাবীর, ঠিক তেমনি  আবির । একান্ত আপনে । নিতান্ত গোপনে ।

      সেই দোল খেতে গিয়েই যেমন জিরোচ্যূত হল তেমনি এই দোল খেলতে গিয়েই হল কেলোভূত। কিন্তু পরক্ষণে সে নিজে সামলে নিল । একগাল হেসে সে সরে গেল ওখান থেকে । কমপ্লেক্সের মধ্যে অনেকগুলো গ্রাউন্ডট্যাঙ্ক আছে, তার মধ্যে একটার উপরে উঠে বসল । কেন জানি না তার কোনোকিছুতেই ভালো লাগছে না । অদূরে তার বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে খেলতে ব্যস্ত তখনো । চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যাওয়া সেই দলে রয়েছে পূর্ণিমা । আজকের দোলপূর্ণিমায় দোলের ভোল পাল্টে দেয় সেই পূর্ণিমা ।


         আবির ভাবতেই পারেনি যে পিচকিরির মতো সবকিছুই প্ল্যানছকের বাইরে ছিটকে পড়ে যাবে একটি সামান্য প্রত্যাখানে । পূর্ণিমা সত্যি এরকম করতে পারে তার সাথে ? কি দোষ আবিরের? দেখতে শুনতে সে মন্দ নয় । অঙ্কে পি.এইচ.ডি. স্কলার সে এখন । কমপ্লেক্সে সে খুব জনপ্রিয় । প্রিয়জনদের চোখে হিরো সে । শুধু পূর্ণিমার চোখে হেরো ! হিরো থেকে হেরো ? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে এই হিহিহি-ব্যঞ্জক প্রেম থেকে হঠাৎ অজ্ঞাত হেহেহে-বোধক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পেছনে ? এই সব তার কাছে ঠেকে শব্দছকের মতো এলোমেলো ধাঁধা । অথচ সুডোকু তার কাছে জলভাতের মত সোজাসাপ্টা । সুডোকু খেলার সব প্রতিযোগিতায় ট্রফিকাপ আবিরের জন্যে কুর্ণিশ জানাতে আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকে ।

        যাইহোক, ট্যাঙ্ক থেকে  আবির নামল বাড়ি গিয়ে সব ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবে । নিজের মনে যা রঙ লেগেছে সেটা সবার আগেই ধুয়ে ফেলতে হবে । হঠাৎ সে অনুভব করলো কে একজন হাত রাখলো তার পিঠে । সে ঘুরে দেখল আরেকটা ভূত । তবে ভূতের মুখে হাসি দেখে তার চিনতে কষ্ট হল না । তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই পেত্নী আর পূর্ব-পশ্চিম জুড়ে সেই বিখ্যাত হিহিহি । বিস্মিত আবীর কিছুক্ষণের জন্য হলেও সংযত হয়ে আবার পেছনে ফিরে পা বাড়ায় । অমনি পূর্ণিমার গলা থেকে এক সুরেলা কন্ঠে ভেসে এল -
" আবির !!!"

 আবির থমকে দাঁড়াল । কিন্তু ঘুরে দাঁড়াল না । কেন ঘুরে দাঁড়াবে সে ? এমনকি তার নাম ধরে ডেকেছে কিনা তার মানতে কষ্ট হচ্ছে । হতেই পারে তাকে একটু আবীর দেবে । দোলের শুভেচ্ছায় যা হয় । তবুও সে নট নড়ন চড়ন । পূর্ণিমা যেন তার মাইন্ড রিড করল । আবার সুর করে ডাকল -
" আবির তোকেই ডাকছি !!!"

আবিরের পা দুটি অবশ হতে থাকল মুহূর্তে । এমনিতেই সে পুরো অনাবির । হেরো যোদ্ধাবীর । কেলোভূতের বিচ্ছিরি রঙ ধরে যাওয়া মনে আসে অপ্রত্যাশিত ভিড় । বহুকষ্টে সে ঘুরে এসে দাঁড়ালো পূর্ণিমার সামনে । সে দেখল পূর্ণিমার দু'হাত ভরতি লাল আবীর । সে দেখেও নিশ্চুপ   রইল । মনে মনে ভাবল-
"মাখাক গে । বাড়ি ফিরে স্নান করে সব..."

কিন্তু তাকে ভাবার সুযোগ না দিয়ে পূর্ণিমা দু'হাত ভরে তার সারা মুখে মাখিয়ে দিল আবিরে আবিরে । আবিরের একটু গুঁড়োও মাটিতে পড়তে দিল না পূর্ণিমা । দু'হাতে যেটুকু ছিল সবটুকুই  আবিরের সারামুখ জুড়ে । সাথে সাথে পূর্ণিমা মুখ নামিয়ে নিল । আর তাকে রীতিমত চমকে দিয়ে বলল -
"করলাম তোমায় আমি বরণ,  আবির ! তবে আগে চাকরি পা..."

আবিরের মনে খেলল এক দমকা হাওয়া । সেই হাওয়ার সাথে একসাথে প্রচুর আবির উড়ে গেলো জয়ী যোদ্ধাবীর হয়ে । সে আর অনাবির নয় । এখন সে আসল আবীর যার সারামুখে জ্বলজ্বল করছে ভবিষ্যতের আবির ।


মন্তব্যসমূহ