ছোটোগল্প / পিন্টু রহমান// মানুষ পুলিশ ও পশু

                                             পিন্টু রহমান      
                                             
                                        মানুষ পুলিশ ও পশু 

ছাগলের নিরবিচ্ছিন্ন কান্নার মধ্যে ছেদ না পড়লেও শিশুটির পড়ে। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে সে কৌতুহলী মুখগুলোর পানে নিরস দৃষ্টিতে তাকায়। ভেজা চোখে একটু-বা হাসে। গেদুর মা’র এনে দেওয়া শব্দহীন ঝুঁমঝুমিটা নেড়েচেড়ে দেখে। এই দৃশ্যে ঠেঁকারি বেগম যারপরনায় উল্লাসিত। রাশেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
- মজা দেকিছেন ভাইজান ?
রাশেদ টেবিলের উপর থেকে মুখ তুলে ঠেকারি বেগমের পানে তাকায়। তারপর ধীরস্থির ভাবে জিজ্ঞেস করে,
- কি মজা গেদুর মা ?
- ছেলিডা বোদহয় আর কানবে নানে। দেকেন আমার পানে তাকি কি মানান করি হাসছে!
    মণ্ডলের দূরাগত কণ্ঠস্বর ইতিমধ্যে ক্রমশ নিকটবর্তী। বাতাসের ডানায় ডানায় ভর করে ঐ শব্দ অনেক  দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে।
- ভাইসব, জব্বর একখান খবর! পাইছি, পাইছি, পাইছি- এট্টা ধাড়ি ছাগল আর এট্টা বাইচ্চা ছেলি পড়ি পাইছি। যদি পারেন, কোন হিদয়বান লোক যুত মতো প্রমান দি নি যান। ঝামিলা থিকি আমাগেরে খালাস করেন। উঁরা বড্ডা খিজ্বালত কচ্ছে।
রাশেদ ইচ্ছা করলে অবশ্য এই খিজ্বালত এড়াতে পারতো। সন্ধ্যার ঘোর অন্ধকারে পার্কের কোনায় বাচ্চা ছেলের কান্না শুনে যদি এগিয়ে না যেত, তবে বাড়িসুদ্ধ আর হাঙ্গামা বাঁধতো না। কমবেশি সবাই তার উপর নাঁখোশ। কাজটা নাকি অন্যায় হয়েছে। কার না কার ছেলে, এটা নিয়ে তার মাথা ঘামানোর দরকার কি? যত সব উঠকো ঝামেলা! তাছাড়া ছেলেধরা সন্দেহে পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করতে পারে! বাবা নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে রাশেদের পানে তাকায়।
- বুঝলে খোকা, দিনকাল যা পড়েছে--  নাক বাড়িয়ে সিঁদুর নিতে নেই। ভালোয় ভালোয় এসব ঝাঁমেলা বিদায় করো।
মোর্শেদ আলী আর অপেক্ষা করে না। সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে পা বাড়ায়। রাশেদের খুব অস্বস্থি লাগে। নিজেকে অসহায় মনে হয়। এত কিছুর মধ্যেও ঠেকারি বেগম তাকে আশার বাণী  শোনায়।
- মন খারাপ কোরেন না ভাইজান। আল্লাহ আপনার মজ্ঞল করবে। ম্যালা ছুয়াব পাবেন। তাছাড়া মানষির বিপদে আপদে ইট্টু আধ্টু পাশে না দাঁড়ালি কি হয়! তালি দুনিয়া যে ধবংশ হয়ি যাবে!
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রাশেদ কথোপোকথনে  উদ্যোগী হয়।
- সওয়াবের আবার কি দেখলে, গেদুর মা?
- না দেকলি কি এম্নি এম্নি কচ্ছি! ছেলিডা এতুক্ষন শিয়েল কুকুরির প্যাটে যাতু। আপনির জন্যি রক্ষা!
কিছুক্ষণের বিরতিতে ঠেকারি বেগমের বুকে দীর্ঘশ্বাস প্রতিধ্বনিত হয়।
- আহাঃ! কার মার ছেলি! না জানি কী কাঁন্দা কাঁনছে!
ছেলেটাকে কোলে নিয়ে সে তেল কাজল মাখায়। বুকের মধ্যে জাড়য়ে ধরে আদর করে। গালে মুখে চুমা দেয়। ঘুম পাড়ানি গান গায়।
- ইস লক্কি সুনা আমার! লেলে, লেলে, লেলে। কাঁন্দেনা, কাঁন্দেনা, কাঁন্দেনা। লোকে তালি খারাপ কবেনে।
রাশেদ মনে মনে খুশি হয়। যাক, বাচ্চাটার আপাতত একটা হিল্লে হয়েছে। তবুও অন্য ব্যাপারে সে চিন্তিত। প্রচলিত সমাজ ভাবনা বড় বেশি গোলমেলে। ধনী গরিবের বোধের সুস্পষ্ট বিভাজন। আমরা যারা বলি- মানবতা নেই, মনুষত্ব নেই, কথাটা হয়তো সত্যি নয়। বরং সমাজের চোখে যারা নিচু,  ছোটোলোক, দরিদ্র- তাদের বুকের জমিনে ঐ শব্দগুলো আস্তানা গেড়েছে। এ কথার স্বপক্ষে আজকের ঘটনাটিই বড়ো প্রমাণ বলে মনে হয়। যে দায়িত্ব পালন করার দরকার ছিল রাশেদের বাবা-মা, ভাই-ভাবীর--তারাই পালিয়েছে। উঠকো ঝামেলা বলে কৌশলে এড়িয়ে গেছে। অথচ পালাতে পারেনি মণ্ডল আর ঠেঁকারি বেগম।



দুই
মণ্ডলের চোখেমুখে যেন আলোর ঝিলিক, বিশ্ব জয়ের ইঙ্গিত। রাশেদের পা ছুঁয়ে হঠাৎই ছালাম করে।
- আমাকে দুয়া করবেন ভাইজান।
- কেন?
- আজ আর কুনু দুঃখু নি। আমার জীবনডা ধন্য হলু।
এমনিতেই কাঁধে উঠকো ঝামেলা, তার উপর মণ্ডলের রহস্যময় আচরণ। রাশেদ মনে মনে বিরক্ত হয়। ছালাম করার কারণ জিজ্ঞেস করতেই ছেলেটি একগাল হাসে। খুব মজা করে উত্তর দেয়।
- ছোট বেলায় মায়িকি যকন সিনিমার এ্যাডভ্যাডইজ শুনতাম তকন খুব ভাল লাগতু। শুনতি শুনতি অনেক দূর পর্যন্ত চলি যাতাম। মনে হতু, ইস কুনুদিন যদি মায়িকি ইট্টু কতা বুলতি পাত্তাম!
কথার মাঝখানে মণ্ডল একটু থামে। স্মৃতির ডানায় ভর করে অনেক পিছনে ফিরে যাই। সিনেমার পোস্টার দিয়ে সাজানো রিকশাটি  ঠিক আগের মতোই হেলেদুলে এগুচ্ছে। পিছন পিছন একদল অভূক্ত শিশু। কারো কারো গায়ে জামা নেই। উলঙ্গ পা।
- ঐ দুঃখুডা আজ আর নি ভাইজান, সব ভুলি গিছি। পরাণ খুলি আজ মায়িকি কতা বুলিছি।
- কোথায় কোথায় মাইকিং করলি? সব জায়গায় গিয়েছিস তো?
- হ গিছি। কুনু জাগা বাদ রাকিনি। আতিপাতি করি ঘুরিছি। আর গলা ছাড়ি দি খবর পড়িছি।

বাচ্চাটি ঠেঁকারি বেগমের কোলের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ছাগলটি নির্ঘুম। ভিতর বাড়ি থেকে ভেসে আসে একটানা ভেঁ ভেঁ শব্দ--  যদিও এ বাড়িতে আসার পর থেকে তার কোনো অযত্ন  হয়নি। ঘাস, ঘড় পানির পাশাপাশি মণ্ডল তার গায়ে হাত বুলিয়ে আদরও করেছে। ছাগলটার প্রতি কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে।
- ভাইজান, ছাগলডার কুনু খোঁজ না হলি কিন্তুক আমাক দি দিতি হবেনে।
ছাগল সম্পর্কিত ছোটোখাট একটা চিত্রকল্পও মণ্ডলের মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারে। ঠিকমতো খাওয়াতে পারলে তার শরীরটা আর হাড় জিরজিরে থাকবে না-- ক'দিনেই বেশ মোটাতাজা হয়ে উঠবে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বংশ বৃদ্ধি শুরু করবে। প্রথমে একটা থেকে দুটো, তারপর চারটে-- এভাবে অসংখ্য ছাগল। ভবিষ্যতের অচল চাকা ঠিক তখন সচল হয়ে উঠবে। ভাগ্য ভালো হলে ঘর সংসারও হতে পারে। মণ্ডলের ভাবনাগুলো অবশ্য নেহায়েত মন্দ না। এভাবেই জীবনের চাকা ঘুরাতে হয়। অনুকুল পরিবেশে ঠেঁকারি বেগমের গুপ্ত বাসনা সুপ্ত হয়। মাথাচাড়া দিয়ে শাখা-প্রশাখা গজায়।
- ভাইজান, তালি ঐ ছেলিডা আমাকে দিতি হবে। উক আমি পালি পুষি মানুষ কোরবু।
চৌকির উপর ঘুমন্ত বাচ্চাটার দিকে রাশেদ দরদভরা দৃষ্টিতে তাকায়। ঠিক দিঘির জলের মতো শান্ত একটা শিশু। বাবা-মা হারিয়েও কী আরাম করে শুয়ে আছে! মণ্ডল ছেলেটি ঠেকারি বেগমকে দিতে আপত্তি করে।
- না না ভাইজান, ছেলিডা উক দিয়া যাবে না। ও মাগী ভাত কাপুড় পাবে কনে? গেদুর মতো না খাওয়ি খাওয়ি মারি ফেলবেনে।
গেদুর মৃত্যু শোক হঠাৎই উথলিয়ে ওঠে। ঠেকারি বেগমের চোখে বাঁধভাঙা নোনাজল। চোখের কোন বেয়ে নামতে শুরু করে।
- ভাইজান, ও ভাইজান গো। দুনিয়ায় সাতকুলি আমার কেউ নি। ছেলিডা না দিলি মরণকালে মুখি পানি দেবেনে কিডা? আমি অতশত বুঝিনি, ছেলিডা আমাক দিবা কি না কও?
মণ্ডল মুখ ভেংচি কেটে ঠেঁকারি বেগমের কান্না অনুকরণ করে।
- থাক থাক অনেক হয়িছে। অত আর ঢং কত্তি হবে নানে। দরকার হলি উক এতিমখানায় দেবো তাও তুমাক দেবো নানে। তাইনা ভাইজান?
রাশেদের মুখে হা না কোন ব্যক্তব্য নেই। সে মণ্ডল আর গেদুর মার অম্ল মধুর সম্পর্ক উপভোগ করে।

 তিন
ছাগলটাকে এক নজর দেখার জন্য সবার মধ্যেই আকুলি বিকুলি। কথার ফাঁকে কৃত্রিম হা-হুতাশ। কিন্তু রাশেদের এতে ঘোর আপত্তি। ঠিকঠাক প্রমান দেওয়ার আগ পর্যন্ত কাউকে দেখানো হবে না। মণ্ডলেরও ঐ এক কথা।
- কেউ মিত্যি কতা কবা না গো। আল্লাহ তালি জিব কাটি দেবে নে।
এ কথার পর কেউ কেউ আবার জিহব্বায় কামড় কাটে।
- তউবা তউবা। সামান্য এট্টা ছাগলের জন্যি মিত্যি কতা কবো ক্যা ?
রাশেদের ধারণা, সামান্য বললেও ছাগলটি এখন আর সামান্য নেই, অসামান্য কিছু।  একের পর এক মানুষ এসে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে ফলাফলা শূন্য। ঠিকঠাক মেলে না। যত সব রং মাখানো কথা! তবু সহজে কেউ হাল ছাড়তে চায় না।
- বিশ্বাস করো ভাই, ছাগলডা কিন্তুক আমারি। ছেলির নানি শখ করি পুষতি দিছুলু।
রাশেদ মিট মিট করে হাসে।
- তাহলে বর্ননায় এত ভুল হচ্ছে কেন?
- কেরাম করি কবোরে ভাই! চিন্তায় আমার মাথা খারাপ। চোকে ঘুম আসছে না। বৌডা ফুঁপি ফুঁপি কাঁনছে।
দু'একজন মুখ কাঁচুমাচু করে হতাশা প্রকাশ করে।
- আহারে, বড় আহ্লাদের ছাগল ছিলু!
মণ্ডল নিজেও জিজ্ঞাসাবাদে শামিল হয়।
- কতি পারেন, ছাগলের ক'ডা পা?
ঘাড় বাঁকা লোকটি মণ্ডলের পানে চোখ তুলে তাকায়।
- এডি কুনু কতা হলু নাকি?
- ক্যান গো ভাইজান, খারাপ কলাম কি?
- কেনে মানে, ছাগলের কি তিন পা হয়?
যত সমস্যা সব কিন্তু এখানেই। এই ছাগলটার পিছনের একটা পা কাটা। যে কারনে মিথ্যাচার বা ধোঁকা দেওয়া কঠিন। মানুষ তবু দিচ্ছে। যা বলার না তাই বলছে। ছাগলটা পেতে সবাই মরিয়া হয়ে উঠেছে। অবশেষে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দ'জন কসাই এসে হাজির হয়। উুঁচু গলায় রাশেদের প্রশংসা করে।
- তুমার মতন হিদয়বান লোক না হলি কি ছাগলডা আর পাতাম! অন্য কুনু শালা হলি এতুক্ষণ ঠিক জবোই করি খাতু।
কসাই দু'জনের একজন অন্যজনের পিঠ চাপড়ে বাহবা দেয়।
- এই মিয়া, এরাম করি কী দেকো? দেকতি হবে না কুন বংশের ছেলি!
বিভ্রান্তির নতুন নতুন ফাঁদ। রাশেদ তাতে পা দেয় না। কসাই দুটোর চোখের ম্যারপ্যাঁচ গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করে।

চার
এত কিছুর পরেও কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ছাগলের দাবি নিয়ে শেষ মুহূর্তে পাতিগোছের একজন নেতার আবির্ভাব। সাথে দু'জন পুলিশ কনষ্টেবল। রাশেদ তাদের বসতে বললেও বসে না। আনাড়ির মতো চারদিক নিরীক্ষণ করে। যেন শিকারী কুকুর!  হাতের লাঠি দিয়ে মণ্ডলের পেটে গুতা মারে।
- তয়, ছাগলডা কই? লইয়া আসেন। যার মাল তারে দিয়া দেন।
উদ্বিগ্ন মুখে রাশেদ জিজ্ঞেস করে,
- আপনাদের কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
পুলিশের গলার স্বর এবার সপ্তমীতে।
- হেই মিয়া, বোঝনের দরকার নাই। যা কইতাছি তাই কর। ছাগলডা উঁনার। থানায় জি.ডি. আছে।
পুলিশের আচরণে রাশেদ ক্ষুব্ধ। ভদ্রলোকের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, ব্যাটারা তাও জানে না।
- জি.ডি.’র কাগজ কোথায়? প্লিজ, একবার দেখান।
নেতাসহ পুলিশদ্বয় এবার সত্যি সত্যি অবাক হয়। এক অন্যের চোখ চাওয়া চাওয়ি করে।
- ঐ ব্যাটা, জানে কি ভয়ডর কিচ্ছু নাই? এমুন প্যাদানি দিম--  বাপের নাম ভুইল্যা যাবি। মাডার  কেসে ভি জড়াইয়া দিমু। বেক্কল কোথাকার! জানোস না; এই দ্যাশে পুলিশের চাইতে বড়ো কোনো মাস্তান নাই।
এ কথার স্বপক্ষে নেতা গোছের লোকটিও মাথা নাড়ে।
- হ, মিয়া, উঁনারা ঠিকিই কয়িছে।

কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ছাগলটা ওরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। রাশেদ বাকরুদ্ধ। মুখে কোনো কথা আসছিল না। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলো ব্যাখ্যার অতীত। এদেশে ছাগল হারালে খোঁজ হয়, জি.ডি. হয় কিন্তু মানুষের হয় না! শেষ মুহূর্তে বাচ্চাটাকেও দিতে চেয়েছিল, কিন্তু পুলিশ নেয়নি। মণ্ডলের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।
- ধুর পাগলা, ঐডা দিয়া কি করুম! ছাগলের কাম কি মানুষ দিয়া হয়?
ওরা চলে যাওয়ার পরেও রাশেদের মুখ দিয়ে কথা সরে না। লজ্জার হাত থেকে রক্ষা পেতে এনার্জি সেভিং বাল্বটা অফ করে দেয়। যে যার ঘরে ফিরে গেছে, তার চারপাশে এখন ঘোর অন্ধকার। কোনোদিন ভোর না হলে হয়তো এভাবেই বসে থাকবে।


মন্তব্যসমূহ