একটি ভৌতিক গল্পঃ~জোছনার আড়ালে //অমিত কুমার বিশ্বাস

একটি ভৌতিক গল্পঃ~






                                              জোছনার আড়ালে
                                              অমিত কুমার বিশ্বাস

                কে ওখানে? কে? কে? না-তো,কেউ নেই! তাহলে কি মনের ভুল? হতেই পারে। এরকম তো আখছার হয় । এই হদ্য গ্রামের বাঁশবনে এরকম মনে হওয়াটাই স্বাভাভিক । সন্ধ্যার দিকে তো বটেই ।

                 গোপাল পাড়াগাঁয়ের ছেলে । সেই সকাল বেলা বের হয় আর সন্ধ্যারাতে ফেরে। দু-একদিন বেশ রাত হয়ে যায় ।ওঁর মা-বাবা বকাবকি করে,এট্টু আগে ফিরতি পারিস নে?
               গোপাল রাজমিস্ত্রীর জোগালের কাজ করে।মাধবপুর থেকে বনগাঁ যায় । খুব ভোরে। সাইকেল চালিয়ে। পান্তা খেয়ে শান্তা হয়ে গাঁয়ের সুবোধ  ছেলে ছোটে । বয়স আঠারো বা উনিশ । রোজ তাকে  বাঁশবন পার হতেই হয় । দিনের বেলায় গা ছম্ ছম্ করে। আর রাতের বেলা তো কথাই নেই। রাতের বেলা , বিশেষ করে  জোছনা রাতে যেন গা ছম্ ছম্ করাটা বেড়ে যায় । তবে গোপালের ভয়-ডর বলে কিছু নেই। ওঁর বাবার কথায় কেবলই হাসে।
              তবে  লতিফ মারা যাবার পর গোপালের মধ্যে এক  অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। গোপাল আর রাত করেনা। বিকেলের মধ্যেই ঢুকে যায়। লতিফ তাঁর সঙ্গেই কাজ করতো । তিনতলা থেকে পড়ে ছেলেটা মারা যায়। মারা যাবার আগে লতিফ কিছু কথা বলত,যা তাঁর  কাছে কিছুটা রহস্যময় ঠেকেছিল।
--হুনকাবড়া হুনকাবড়া !!
মাঝে মাঝেই এই কথাটা বলত লতিফ। ও নাকি বাঁশবনে হুনকাবড়াকে দেখেছে ।
--সেডা কী?
--প্রেতাত্মা!


             সেদিন গোপালর খুব জ্বর। লতিফ একাই কাজে যায়। ফেরে অনেক রাত করে। মালিকের বাড়ি ঢালাই কাজ ছিল । ঢালাইয়ের পর খুব খাওয়াল । তাই রাত। ফেরার সময় সে নাকি একজনকে ইছামতীর দিকে হেঁটে আসতে দেখেছে। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে গেল জলের মধ্যে ।
--মাছ চোর?
--আরে না,মাছ চোর না! আমি চিনিনা বুঝি। ওডা ছিল হুনকাবড়া । আব্বার মুখি শুনিচি ।
--ধুত্তোর !গাঁজা খেয়ে ছিলি কিনা ক'?
--আরে না না গোপাল! আল্লাহ কসম।
             এর কয়েক দিন পর লতিফের খুব জ্বর হল । জ্বর একটু কমলেই ছুটল কাজে। আর চলার পথে  কথার বিষয় একটাই, হুনকাবড়া । এই অবস্থায় কাজে যেতে বারণ করল গোপাল,কিন্তু গরিবের  ঘরে বসে থাকলে উনুন জ্বলবে কি করে?
              অসুস্থ বলে সেদিন লতিফকে নিচের কাজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুপুরের টিফিন সারার পর হঠাৎ লতিফকে  আর খুঁজে পাওয়া গেল না দেখে সব্বাই এদিক -ওদিক দেখতে লাগল। ঠিক এই মুহূর্তে একটা মানুষ লাফিয়ে পড়ে সটান নিচে । লতিফ ! রক্তাক্ত লতিফ। হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে মারা যায়। মুখে তখন একটাই অস্পস্ট আওয়াজ,হুঙ্ক্যাবড়া !কেউ না বুঝলেও গোপাল বুঝেছিল ওটা হুনকাবড়া! কথাটা আজও তাঁর কানে বাজে । ঘটনাটাকে অনেকেই আত্মহত্যা বলে মেনে নিল,কিন্তু একমাত্র গোপাল জানত এ নিছক আত্মহত্যা নয়। এই ঘটনার পর সে বিকেলের মধ্যেই ফেরে। কিন্তু আজ ব্রিজের মুখে অবনি মাস্টারের সাথে কথা বলতে গিয়েই ঘোর হয়ে এল। আর ফেরার সময় বাঁশবনের আলোআঁধারির মধ্যে  কাকে যেন  নদীর দিকে হাঁটতে দেখে গোপালের বুকটা  ধড়াস করে উঠল ! তবে কি......
                                           
                                                    ২        

           পরদিন খুব সকালে উঠেছিল গোপাল। কাজে বের হবার আগে সে পুবপাড়ায় এক চক্কর দিয়ে এল। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দিনুর, তাঁর পুরোনো বন্ধু,বাবা সেকেলে শিকারী । কথায় কথায় লতিফের প্রসঙ্গ উঠল। উঠল হুনকাবড়ার প্রসঙ্গটাও। হুনকাবড়ার কথাটা শুনতেই চমকে উঠল দিনু ,কারণ সে হুনকাবড়ার কথা শুনেছে তাঁর দাদুদের মুখে ,তবে সে কখনো দেখেনি। এখানেই নাকি ঘুরে বেড়ায় তারা ।একবার কাউকে দেখা দিলেই সে শেষ! তাকে আর ফিরতে হয় না। একথা শুনে আৎকে উঠল গোপাল। আর দাঁড়াল না সে । সোজা বাড়ি ফিরে কাজে বেড়িয়ে গেল ।
             এখন সে বিকেলে বিকেল ফিরে আসে । দু'এক-দিন সন্ধ্যা হয় ঠিকই ,কিন্তু তাঁর চোখে তেমন কিছু পড়ে না। আতঙ্কটা কেটে গেছে বলা চলে।

            এভাবে প্রায় বছর কেটে গেল ।লতিফ বিস্মৃত হয়েছে।মৃতদের আর কে মনে রাখে,মনে রেখেই বা কি হবে ! গোপাল এখন মাঝে মাঝে রাতেও ফেরে ।
            হঠাৎ খবর রটে গেল গ্রামে বাঘ ঢুকেছে। এমনিতে হুনকাবড়ার ভয়ে গ্রামের লোকজনের গা হিম হয়ে থাকে। তাঁরা কেউ নাম নিতে চায় না। নাম নিলেই নাকি সে পিছু ধায়। শেষমেষ পরিনতি হয় ভয়াবহ । যাইহোক বাঘের খবরে রাতের ঘুম চলে গেল লোকজনের । কেউ কেউ নাকি দেখেছে। রশিদ আলি, ডালু মন্ডল নাকি দেখেছে অন্ধকারে হেঁটে যেতে। গর্জনও শুনেছে কেউ কেউ । গ্রামের দু-একটি ছাগল নাকি নিয়ে গেছে । পায়ের ছাপও নাকি দেখা গেছে!গ্রামে একটা থম-থমে পরিবেশ ।বাঘের খুব খোঁজ চলল। গ্রামের লোকজন দলবেঁধে চিরুনী-তল্লাসি চালিয়েও বাঘের টিকি খুঁজে পেল না ।
           সবাই যে-যার কাজে গেল । কিন্তু রয়ে গেল আতঙ্ক । একদিকে হুনকাবড়া আর অন্যদিকে বাঘ । তাই গোপালকে এখন সকাল সকাল খুব সাবধানে ফিরতে হয় । পারলে সঙ্গী নিয়ে ।
          সেদিন রাত হল ।অনেক্ষণ অপেক্ষা করে কাউকে না পেয়ে রাম রাম করতে করতে ফিরছে গোপাল। হঠাৎ বাঁশবনে জোছনার আড়ালে কাউকে দেখতে পেল সে। কে? কে ওখানে? লোকটা পালাচ্ছে । গোপাল পিছু নিল । চোর নাতো? লোকটা নীলকুঠির কাছে এসেই হারিয়ে গেল । গোপাল নীলকুঠির সামনে একা একা দাঁড়িয়ে । হঠাৎ একটা বাঘের গর্জন। সম্বিৎ ফিরল তাঁর। ডাকটা নীল কুঠি থেকে, না তাঁর মনেই বেজে উঠল ? কিছুই বুঝতে পারছে না। গর্জনটা মনে হল পেছনের ঝোঁপ থেকে আসছে ।গোপাল দিকবিদিক শূন্য হয়ে দৌড়ে ঢুকল নীলকুঠিতে । ফাঁকা ঘর । ভাঙ্গা ছাদ থেকে চাঁদের আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে । একটা বিশালাকার সাপ হেঁটে যাচ্ছে মেঝে বরাবর। সেদিকে নজর যেতেই কেঁপে উঠল গোপাল। হঠাৎ দুটো নীল চোখ গোপালের সামনে । হুনকাবড়া? বাঘ? কে? কে? কে ওখানে? কে? কে? কে? পিছন দিকে ছুটল গোপাল। আমবন,বাঁশবন পার হয়ে ছুটছে । সামনে চেনা মতো কাউকে দেখতে পেয়ে ধড়ে প্রাণ এল গোপালের । ডাকল । কে ও ? দিনু? রশিদ? না লতিফ? লোকাটা উত্তর না দিয়ে ইছামতীর দিকে এগোতে লাগল ক্রমশ । সেও পিছন পিছন ছুটল । নিজের অজান্তেই ।নদীর জলে নেমে গেল লোকটা । গোপালও !ঘোরের মধ্যে! লোকটা বুক জলে। গোপালও হাঁটুজল ছাড়িয়েছে । লোকটা আস্তেআস্তে ডুবে গেল ইছামতীর জলে ।গোপাল...
হঠাৎ কে হ্যাঁচকা টান দিল গোপালকে ! মুখ থুবড়ে পাড়ে এসে পড়ল । মাটিতে মুখ গুঁজে গোঙাচ্ছে ।
                                                           ৩                                                                                                                                        
            সকালে পুলিশ আর বনদপ্তরের লোকজন ঘোরাফেরা করছে । অলেম্পিক সার্কাসের একটি বাঘ পালিয়েছে ।গোপালের জ্ঞান ফিরল ।দিনু বন্দুক হাতে পাশে বসে । বাঘের তল্লাশি চলছে। দিনুর বাবার শিকার করার বন্দুক হাতে করে দিনু রাতে বেড়িয়ে ছিল । তাই রক্ষে। রক্ষে বাঘের মুখ থেকেও ।
           নীলকুঠি ঘিরে ফেলা হয়েছ। কিন্তু কোথায় বাঘ? কোত্থাও নেই ।নেই নেই নেই । আছে একরাশ আতঙ্ক ,হুনকাবড়া আর তাঁর সাথে বাঘের ভ্যাবসা গন্ধ ।

    (গল্পটি  'তৃণাঙ্কুর' পত্রিকা থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে।)

মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
খুব সুন্দর। সাধারণত কবিতা না পডলেও এই কবিতাটা আমার আগ্রহ বাডালো।
Unknown বলেছেন…
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।