সত্তরের সেইসব দিনগুলো... একদিকে সময় তাড়া করে চলেছে আমাদের অস্তিত্ব, আর অন্যদিকে সাহিত্যের সে এক ভাঙচুর... তখন দেবদাস আচার্য, তারপরে নির্মল হালদার... ওদিকে ভাষা নিয়ে নানা কথা... কাব্য করার দিন তুলে রেখে শুধু আন্দোলন... এর মধ্যে এসে গেল এক ফর্মার লিকলিকে, ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে কেটে ছাপানো প্রচ্ছদের একটা বই। 'অন্নপূর্না ও শুভকাল'। ‘এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন...’ আর আমরা পেয়ে গেলাম এক অদ্ভুত কবিতা... আবহমান বাংলা ভাষার সেই হারাতে বসা সুর আর নতুন সময়ের অস্থিরতার এক অসামান্যতার মধ্যে নতুন করে পথ চলা শুরু হল আমাদের বাংলা কবিতার। তারপর প্রায় একদশক পরে আর একটা এইরকম ক্ষিণকায় বই... এভাবেই চলে আসছিল।'অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে', 'রসাতল','নয়নপথগামী' ... তারপরে এই গেলবার একটা বাঁধাই করে বই... 'স্বর্ণগরুড়চূড়া'... কী বলব... এই সময়ের ঝিন্চ্যাক বেংলিশের যুগে তাঁর ওই সুললিত ভাষা আমাদের মুক্তির স্বাদ দেবে... পাঠক, আপনিও পাবেন...
--তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
গৌতম বসু’র কবিতা
(অন্নপূর্ণা ও শুভকাল)
১
জলের পরিবর্তে এই শ্রাবণ
আর সহজ নয়,
ভূমি হয়ে উঠেছে হতশ্রী বাহু
দক্ষিণ, কিন্ন গৃহ শেষের শান্তি।
১৩
কীভাবে ছলনা করবে, আকাশ সর্বদাই আকাশ
নির্মোহ ও চক্ষুকর্ণহীন যে কেবল
থেকেছে আর থেকেছে, তথাপি পথিকের পথিক
শ্রাবণীভূমি, ধনুক-প্রণাম।
১৬
বাদল ফিরে এসে, মাঠ কেটে, নিজের মনের মতো
জলাশয় গড়লো; পঞ্জরময় গাভী, রেলব্রীজের
পিছনে দাগী আকাশ, সবই আছে, কিন্তু এমনভাবে,
ভাতের হাঁড়ির নীচে আগুন নেই, জল
নদীতে জল নেই, আগুন; উদ্বেগ এই জন্য।
(অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে)
শাহী শেরপুর
অনন্তহাট ধুলামোহিত, ধুলায় মুঠি নিয়ে যায়
বারংবার যাচনা করি, ধুলা, পিতা,
ওই রৌদ্রজল যদি সবার, বৃক্ষ ও পক্ষীসমূহ যদি আনন্দময়,
সকলেই যদি চক্ষুমান, তবে পাষাণযোনিসম্ভূত এই জীব
কার কোপতলে চিঁড়ে গুড় মাথায় ফেরে?
জেলাসদর বহরমপুর
খেয়াঘাটে, এ অবহ পদচিহ্ন কার
যেখানে জল জলে ডুবে আছে
স্থলের মহিমায় তিনি জলকণা,
কাদায় শতনাম এখানে বৃষ্টির ও ভাঙ্গনের
সুধীর ভাষায় শতরূপে আবৃত
জন্ম হতে বহে পদরেখার গূঢ় জন্মান্তর।
বারাসাত লোকাল
পাখিরা খুঁটে-খুঁটে জল খায়
জলের রক্তমাংস দেখি,
অন্তরাল তবু বিদ্ধ নয়, দুর্গানগর বিদ্ধ, নতশির
মহারণে ও প্লাবনে মেঘের কল ভেসে যায়।
পাখি, শুনেছি তোমার দেহ অনন্তপথের ধূলোয়
অনন্তবর্ষণে বিভোর, বায়ুগৃহে ফিরে যেতে চায় ব'লে
ওই স্খলিত পালক আপন দুঃখে ভর ক’রে ওড়ে,
তোমার পালকের, তোমার স্পর্শ না পাই, এ—জানালায় হাত রাখি
একটি গহন স্বরের মৃত্যুর ও জন্মের দেখা যেন মেলে, মনে-মনে।
(রসাতল)
মাটি
ফিরে এসে, ধুলো হয়ে ছুঁয়ে, কেন যে তাঁকে মলিন করেছিলাম। নিজহাতে সে তবু খুলে দিয়ে গেছে বৃষ্টির দুয়ার, ঝড়ের তিলক এঁকে দিয়ে গেছে ললাটে।
মীরার মন্দির
একটি পাথরের ঘরে একলা ব’সে, সে ডাকে। যার দেখা পাওয়া যায় না কোনোদিন, পুঁথিগুলি যার কাছে পৌঁছতে পারে না ব’লে মাথা কোটে, তাঁকে, সে ডাকে। নাম যার সহস্রভাবে ঘুমায় অনলে আর অনিলে, নিশাকালের ঘন রুধির যে, তাঁকে, সে ডাকে।
মন্তব্যসমূহ