ছোটোগল্প / /আসিত ঘোষ// ভাঙাঘরে একদিন

                                আসিত ঘোষ
                      ভাঙাঘরে একদিন
   
- তুমি নিষিদ্ধ ফল ?
- এ্যাঁ ?
- না , যা করছেন করুন ।
- কি যে কখন বলেন ,মাথাটা গেছে !
- চোখটাও ।
- চোখ কী হল ?
- কি হয়নি বল ! চোখ ধু-ধু,মরা বালি , খালি খালি , খাঁ খাঁ বসন্ত । মৃত্যু অবিরত তোমাকে দেখলেই ।
- আমি এত কুৎসিত !
- খুউব । আমার ঘুম নিয়েছ, নিশ্বাস নিয়েছ, বিশ্বাস নিয়েছ। খুনির মতো হয়ে গেছি । তারপর খুন হতে হতে জ্ঞান হারিয়েছি । জ্ঞান ফিরিয়ে দাও আমার ।
- কীভাবে ?
- জানতে চেয়ো না, কষ্ট পাবে । বাড়ির পলেস্তারা খসে খসে পড়বে ,দেয়াল ভাঙবে । দেয়াল ঘড়িটা চমকে বোবা। ওঠানামার সিঁড়িটা হঠাৎ নেই । শূন্যে ভাসবে সব ।
- তুমি আজগুবি –
- অন্ধ ।
- ওই হল। আপনি তো লেখালেখি করেন জানি । একটা কবিতা শোনান দিকি।
- হাজার এক খুন তোমার ডাগর মেঘ চোখের চকিত চাউনিতে । কাতর হতে হতে ভিজে জবজবে বাতাসের ভণ্ডুল ছাউনিতে ।
- ওগুলো হয়ে গেছে । নতুন কিছু –
- ওহ, আচ্ছা ! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাগল এক আস্ত পাগল, বনের ভিতর ডানা মেলে ওড়ে এক মস্ত ছাগল।
- এটা কবিতা ! এর মানে কী ?
- এর মানে লাগে না। নতুন চাইলে তো...
- থাক । পুরোনই নতুন করে বলুন । আগে যেটা বলছিলেন –
- অন্য ফাল্গুনি হাওয়া দরজায় সোজা এল হেঁটে । পিপাসার নাম করে তোমার ওষ্ঠ  মৃদু গেল চেটে । ওটুকুই চাইলে আমি, মনে মনে  পড়ে নিতে পারো । এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে চায়ের কাপ এনে ধরো । দু'চোখের তারা দুটি তখন টলমল জলে ওঠে ভেসে । কষ্ট দিয়ে ফেলেছি জেনে চাটুকু না খেয়ে উঠে চলে এসে বুঝি , নষ্ট ভ্রষ্ট খুনির মতো এক আমি । তুমি খামচে ধর হাত, বল - খাও  তারপর যা কিছু নষ্টামি । মেরুদণ্ড সোজা করি - ঠোঁটের সরোবরে সাঁতার - চা থাক । উত্তাল দু'তরঙ্গে যেন মৃগশিশু এক বুক চিতিয়ে অবাক ! নাভি কোরকে কত কোটি অণু পরমাণু  সমর সজ্জায় । নিচে নি-চে নামতে নামতে দেখ শয্যা গিয়েছে গোল্লায়!
- আমাকে নিয়ে এত ভাব কেন? পাগলামো । আমি খুব সাধারণ।
- তুমি সাধারণ  বলেই এত অসাধারণ । চাতুরী নেই। সাধারণরা আজকাল কই ! চকচকে মলাটের হৈচৈ। তোমার রাস্তাঘাট বারান্দা সিঁড়িঘর সমুদ্রের মত সাধারণী অসাধারণ । বালিবালি নোনা নোনা বাতাসের একদম অপাতাবাহার ঝাউদের বাঁকা বাঁকা চুলে, পালতোলা সাধারণ ডিঙির মতো কাতর হাতছানি।
ছবিঃ সৌরদীপ্ত চৌধুরী
- আর আমি যে কত অগোছাল ,তার বেলা ?
- টিন এজে দৌড়ের অনেক প্রাইজ আছে জানি । সে জন্যেই এত দুর্দান্ত অগোছাল , চুল এলোমেলো ? পিছন ফিরে না তাকিয়ে সোজা হাঁটো । সময় একা একা ওড়নায় ওড়ে । তোমার লাল চুড়িদারের লাল সুতোটাও ওড়ে একা হাওয়ায় ।
- এত দেখেছ ! এম্মা, এবার সত্যি সত্যি হাঁটতে গিয়ে লজ্জা পেয়ে যাবো !
- পাবে না ।কারণ রাস্তায় তোমার অহং খুব একটা সঙ্গে হাঁটে না। মিছিলের মতো সপাট তুমি।
- চা করে আনি,একটু বসো।
[তুমি চলে গেলে। ছড়ানো বারান্দা ছাড়িয়ে দেখি মিছিল আর মিছিল । ফিরলে হাতে গোলাপ নয়,এক কাপ চা।]
- কি মিছিলের কথা বলছিলেন ?
- বাইরেটা দেখছিলাম। একটা মিছিল গেল । তোমাকে ভাবছিলাম।
- মিছিল ? আমি ? ইমপসিবল ! তবু ভাবনাটা শুনি -
- কটা লাইন এসে গেল
- বলো!
- ওই মিছিলে তুমি নেই জানি। তবু মুখটা খুঁজি । সহজাত ভাবনার খেই টানাটানি । জানলায় তুমি তখন ধরো, এই মন্দ দুপুরে । চেনা অচেনা দেখে... দেখে... কেউ আছে কিনা স্মৃতি খুঁড়ে । আকাশের দক্ষিণে এক তালু মেঘ, জীর্ণ ডিঙিটির মতো । চলে গেল অজান্তে, ঈষৎ আহত । বললাম তাকে, কিছু মনে কর না সুজন । চিনি--বিকেলের প্রাক্কালে সে ঠিক আনমন।
- ঝরনা দেখেছেন?
- হুম, এই শহরেই ।
- শহরে!
- সামনেই।
- আমি! তাই বোধহয় । এক হাতে কান্না । আরেক হাতে হাসি । পাথর জুড়ে পাথর খুঁড়ে বয়ে  চলেছি , ঝরে চলেছি ,রোদ ভেঙে , রাত চীরে । কান্নাকে কিছুই দিতে পারিনি আজও।
- না দেয়াটাই যে কত দেয়া !
- বোঝো ? তাও তো কষ্ট পাও ,কষ্ট দাও !
- আসলে,হৃদয়ের সব স্রোত জমে আছে তোমার কাছে বড়ো । ভাঙো, গুঁড়ো করো , যেমন খুশি গড়ো । অসময়ে তোমার আশে পাশে ধিক ঘোরাফেরা,  কাকের মতো কাল কলুষ আমি, ঢেরা। কষ্ট না থাকলে  জন্ম , জন্মবেদনা থাকত না !
- ও , সেজন্যই কষ্ট দাও ?
- তাই বললুম ! কষ্টরাও রঙ হয় । পিপাসারও রং হয়। পাওয়ারও । কষ্ট-পিপাসা-পাওয়া এগুলো একমুখী হলে,ধরো তোমাকে জড়িয়ে এসব,একটি সনেট হয়।
- আমাকে বাদ দিয়ে কি কিছু হয়না আপনার ?
- ঢেউ ছাড়া সাগর কি সাগর ! স্নান সমুদ্রে হলে বেশ । দেখো, ‘প্রীতি’ শব্দটা চওড়া করে লিখলে ‘পীরিতি’। একই জিনিস,অন্য মানে। সোজা বল না, চলে যাচ্ছি –
- অভিমান হল ? তা নয়,দিনটা শেষ হলেই রাত আসে। সন্ধের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন !
- পাথরের গায়ে খোদাই পাথরকথাগুলি পাথর হয়ে থাকে সারারাত। তুমি চন্দ্রবিভোর আমি নষ্ট গিরিখাত।
[তুমি খোঁপা করা চুল খুলে ফেললে । চুলের কাঁটা ঠোঁটে চেপে চুল ছড়ালে। ওড়নাটা খসে পড়ল ভাগ্যবান মেঝেয় । খর বা তাস তোমার চুলের গন্ধ নিয়ে পুরো একপাতা কবিতা লিখে ফেলল । হাত ওপর তুলেছিলে বলে পায়ের অনেকটা দেখলুম। আর বগলে ভেজার ছাপ নেই বলে, বেশ লাগল। পোশাকের আড়ালের রঙগুলো ভাবছিলাম–-ফরসা, তামাটে, বর্তুল, কমা, কোলন ,কমল,কোমল....। অনেকবার ভেবেছি, গ্লোব থেকে গোল শব্দটি এসেছে কিনা । এবং গোল ও ইংরেজির গোল একই জিনিস কিনা।তুমি এলোচুল আবার বাঁধলে। বসলে। চকচকে হাসলে।]
- অনেক কথা হল। একটা জমাট গল্প বল।
- সত্যি গল্প বলি ! একদিন এক বন্ধুর বাগানবাড়িতে বসে আছি । আদ্যি আমলের বেশ। ভাঙাচোরা পাঁচিলের ইট, যে যখন পারে সরিয়ে নিয়ে যায় । ভেতরের জানলা দরজার পাল্লাগুলিও খোয়া গেছে প্রায় । অসাজানো চত্বরে জমে ওঠা আবর্জনার স্তুপ । কিছু গুরুগম্ভীর ও ডাগর গাছ – দীর্ঘ সেগুন,পাঁচিল ফুঁড়ে আশুত একটি, একটি রাধাচূড়া ,গলাগলি ঘন এক কৃষ্ণচূড়া , দুটি সুউচ্চ সুপুরিগাছ, এককোণে এয়োতির মতো দাঁড়িয়ে কটি কলাগাছ। তালগোল পাকানো  চোরকাঁটা – লজ্জাবতী – আকন্দ – ঘেঁটুফুল ইত্যাদিও । একটি খর্বকায় আমগাছ পুবে । কোথাও লুকিয়ে আছে লেবুগাছ , যার চটকানো টকচালো গন্ধ রোদ ডানায় । সব মিলে সবুজালি তার নিবিড় স্নেহে কোলে করে রেখেছে ভাঙাবাড়িটা।
বাড়িটির তীর ছোঁয়া রাস্তাটায় গোনাগুনতি লোকজনের আসা যাওয়া। ওপ্রান্তে তীব্র সবুজ ঘোমটার ভেতর  খয়াটে রঙ এক বাড়ি। কে থাকে ওখানে কে জানে !
বন্ধুর ভাঙাবাড়ির নৈঃশব্দ্য আমাকে একা পেয়ে কলকল করে কথা বলে চলেছে। হাড়ছেঁচা রোদ না- শোনার ভান করে শব্দ হয়ে ঝরে পড়ছে সবুজালি শরীরে।
বন্ধু তখনও ফেরেনি। হুইস্কি কিনতে গেছে। সারাবেলা দৌড়ের পর শ্রান্ত রোদ আকণ্ঠ সবুজ খেয়ে নেতিয়ে পড়েছে । শালিক, কাক ইত্যাদির বিকেলি চাপানউতর ভাঙাবাড়ির দেয়ালে ঠোক্কর খেয়ে ধ্বনিত হচ্ছে । সম্যক ভ্রান্ত  নারীর মতো যে রাধাচূড়া ঝিরঝিরে হাসছিল কৃষ্ণচূড়ার সাথে ফষ্টিনষ্টির কেস করে,মনখারাপ ঢুকে পড়ল অমনি সন্ধেসন্ধে ছায়ায়। দখিনি বাতাসে এক খরিসের শ্বাস শোনা গেল কোথাও , শিকারটি শেষ গিলে ফেলার আগে ।
খসখস শব্দে ভাঙা গেটের দিকে তাকিয়ে দেখি,বন্ধুটি ঢুকছে । হাতে হুইস্কির ব্যাগ। আমার শরীরের সব ঘাম শুকিয়ে এসেছিল । খোলা পোশাকটা পরে নেবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই চমকে দেখলাম , বাড়ির পিছনদিকে আবছা অন্ধকারে সুড়ৎ করে বেরিয়ে মিলিয়ে গেল দুই আদিম নরনারী!



মন্তব্যসমূহ