অচেনা যাত্রী~৯/পৃঃ৫

পুস্তক সমালোচনাঃ

                   "এক বর্ণময় পাঠঅভিজ্ঞতাঃ রাত্রির হৃদয়ে এখন নীল শুঁয়োপোকা"
                                সুবীর সরকার

ম্প্রতি পড়ে ফেললাম হাতে আসা মাত্রই কবি অমিত কুমার বিশ্বাসের  প্রথম গল্পের বই-রাত্রির হৃদয়ে এখন নীল শুঁয়োপোকাধানসিড়িপ্রকাশিত এই বইটি আমাকে চমৎকৃত করেছে । প্রচ্ছদে ইশারা ছড়িয়েছেন পার্থ প্রতীম সেনগুপ্ত । 'বইমেলা ২০১৪' -র এই বই অদ্ভুত এক ভাবনাবিশ্বের গোলকের দিকে আমাকে তুমুল টেনে নিয়ে যেতে থাকে । বইটিতে ১০ টি গল্প সর্বমোট । অমিত কুমার বিশ্বাস থাকেন সীমান্ত মফঃস্বল বনগাঁ শহরে । পেশায় শিক্ষক এই কবি ছোট কাগজ ও একটি অনলাইন ওয়েব ম্যাগ সম্পাদনা করেন । তিনি শব্দের প্রান্তিক চাষা । তুমুল ঘুরে বেড়ান হাটগঞ্জআদাড়বাদাড় । নাটকেও উৎসাহী তিনি । বহুমুখি এই ৩৪ এর তরুণকে ব্যক্তিগতভাবে জানি চিনি বলেই তাঁর বই পড়তে পড়তে আমি তীব্র নিমজ্জিত হতে পেরেছি ।
                  মেঘ ভাঙা বৃষ্টিগল্পটি আমাদের অতীতচারীতা স্মৃতিমগ্নতায় ফিরিয়ে নিয়ে যায় । বিষ্ময়ে দেখি হরু ডোমের ঘরনী, মৌবনী, বনগাঁ লোকালের ছুটে চলা নিয়ে আস্ত এক জীবন যেন ঘিরে থাকছে । আবার দূরন্ত একটি গল্প ফেসবুক ফ্ল্যাশব্যাক আছে ঘরানায় । আমরা নিজেরাই যেন সৃজিত, শীলা বা শিলু হয়ে উঠি,উঠতে থাকি । বিনয় মজুমদারের কবিতার কি অসামান্য প্রয়োগ ঘটিয়েছেন অমিত এখানে,যা বিষ্ময়কর ! আমরা অমিতের মুন্সিয়ানা টের পাই আধপোড়া বসন্তের কাব্য গল্পটি পড়তে গিয়ে । কি গভীর তার দেখা । দেখার সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া আবহমানের দর্শন । পল্টু, সুবোধবাবু,সম্পা-সন্তু আর বাস্তবের মাটিতে নেমে এসে দেখা ভোগবাদ,মানুষের পালটে যাওয়া যাপনবিন্দু ।ঘুমের মধ্যে ঘুম গল্পের দুই সখি দুখি ও কুট্টির সাথে আমরা নিঃসঙ্গতা নিয়ে নিশ্চুপ নিষ্ঠুর দিনদুনিয়ায় ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যাই কেবলই ।টিকটিকি,অমেরুদন্ডী,বেড়াল,সাপ দৃষ্টি গল্পগুলি পাঠ করতে করতে আপ্লুত হই ।মেধামননের ঘরে যেন আমিত চালিয়ে দেন হূণসুমারীর ছুরি ! অসম্ভব স্বাদু ও ঝরঝরে ভাষায় অমিত তাঁর গদ্য লেখেন । কোথাও আটকে যেতে হয় না ।হোচট খেতে হয় না ।তিনি মজা ও ম্যাজিক দিয়ে ভুবনমায়ার জন্মান্তরের আলোর দূরাগতে আমাদের টেনে নেন । আর অপার বিষ্ময়ে আমাদের আমূল বিদ্ধ হতে হয় রবীন্দ্রনাথগল্পটি পড়বার পর । মহার্ঘ প্রতীকের পরতে পরতে সময়সমাজবাস্তবতার বিনির্মাণ করেন তিনি ।
তরুণ এই গল্পকার বাংলা গদ্যের গল্পের চিরকালীনতায় তার জাত চিনিয়ে দেন সহজে ই। দ্বিধাহীন বলি তবে, অমিত থাকতেই এসেছেন । অভিবাদন অমিত কুমার বিশ্বাসকে ।

রাত্রির হৃদয়ে এখন নীল শুঁয়োপোকাঃ অমিত কুমার বিশ্বাস
ধানসিড়ি প্রকাশন, কলকাতা- ৫০
দাম-৮০ টাকা
ISBN 978-81-926422-5-3
(ইতিকথা অনলাইন-এর সম্পাদকের অনুমতিতে পুনর্মুদ্রণ করা হল)



পত্রিকা সমালোচনাঃ
                           "শুধু শিউলি ফোটার আনন্দ...................."
                                 শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী


পাঠ অভিজ্ঞতাঃ"দ্বৈপায়ন~৩" (বইমেলা সংখ্যা)
সম্পাদকঃঅমিত কুমার বিশ্বাস
মূল্যঃ৩০ টাকা


"তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়"যেভাবে  চেয়ে ছিলেন ঈশ্বর তাঁর সদ্য সমাপ্ত বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের দিকে । অথচ এই সৌন্দর্য 'শব্দের কাকাতুয়া'-রই মতো ।অথবা 'সাদা বক'!অনন্তর এই সুন্দরকে দেখতে গিয়েই তো গহ্বরে নিক্ষেপ করলেন নিজেকে প্রাচীন দেবতা নারসিসাস । সুন্দর অসুন্দরের ভেদাধেদ তাই সুপ্রাচীন ।'বাগীশ্বরী  শিল্প প্রবন্ধাবলী'-তে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বললেন,"অসুন্দরের মধ্যে একটা ভান থাকে,সুন্দরের কোনরূপ ভান থাকে না--এটা লক্ষ্য করা গেছে। মিথ্যার আবরণে অসুন্দর নিজেকে আচ্ছাদন করে আসে,সুন্দর আসে অনাবৃত--সত্যের উপর তার প্রতিষ্ঠা ।"
             সুন্দরকে খোঁজবার প্রয়াস এবারের 'দ্বৈপায়ন ~' সংখ্যায় ।সম্পাদকের ভাষায় "গলায় ঝুলছে এলএসডি কিংবা দূরদর্শনের চুম্বকীয় বেল্ট"।যেন "নক্ষত্রের আলোয় কাব্যগ্রন্থে সেই নির্জন পথ,যে নির্জনতা ,নিঃসঙ্গতার মধ্যে লাজুক স্বভাব কবির শালুক প্রেম দূরাগত নক্ষত্রের মৃদু ম্লান আলোয় পাপড়ি মেলেছে"।অনুপ কুমার অমৃতের কবি বিনয় মজুমদারের 'নক্ষত্রের আলোয়'-এর উপর নব্য আলোচনা  নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।প্রসঙ্গে ঘুরে ফিরে আসে  কবির অনাগত আদর্শের স্বপ্ন,ভীরু প্রেম,পদ্মপাতার উপর টলমল জলের দোদুল্যমানতা ।"হৃদয় বিস্মিত এক বিমর্ষ অসুখে ।" লেখকের ভাষায়,চাঁদ নেই,তবু ব্যথা ভরা নীল নক্ষত্ররা জ্বলে দূরে দূরে । যাদের আলো শুধু  এই দুঃশাসনীয় পৃথিবী ও সংকটময় জীবনের অন্ধকারকে কখনই শাসন করতে পারবে না,বিতাড়িত করতে পারবে না । কবিতা ,সময়ের স্বাক্ষরকে বহন  করে ।" যথার্থই ।শিল্প সাহিত্য ও  সমাজ বিষয়ক পত্রিকা 'দ্বৈপায়ন-' -এ এবারের প্রবন্ধ দুটি ।দ্বিতীয়টি 'বিবর্তিত বিনোদন'প্রণেতা সুপ্রসাদ বৈরাগী ।বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ,যদিও  গদ্যের অনুষঙ্গ আরো প্রসার ও গবেষণার দাবি রাখে ।
            কুমারেশ পাত্রের অনুগল্প  'লেফাফার অশ্রুডানা' অভিনব ।প্রসঙ্গত কয়েকটি লাইন রৌদ্রদীপ্ত--"এখনও আছো । আছি আমিও ।তৃতীয় প্রজন্ম নিয়ে ।আহা! চুলে একটু রঙ দিও ।আজও যে চেয়ে থাকি কাঁচামিঠে রোদের দিকে ।"
              সুসংগঠিত কবিতা বিভাগে রয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীসুবীর সরকার,বিভাস রায়চৌধুরী,মলয় গোস্বামীতীর্থঙ্কর মৈত্র, অর্ঘ্য মন্ডলতমাল বন্দ্যোপাধ্যায়,সব্যসাচী মজুমদার, কার্তিক নাথ প্রমুখ বহু  উপস্থিতি ।

"অন্ধকার জ্বলেছে দেখি অন্ধকার পাখিদের  বনে!
মৃত্যুকে খেয়েছে মৃত্যু তবে কোন জন্মের কারণে?"
                                         (বিভাস রায়চৌধুরী)
কবিতার মনে ফুটে ওঠে 'শতবরণের শরীরের মায়া ফেলে'(মলয় গোস্বামী)--

    "বৃষ্টি হয়েছে ।বৃষ্টি তুলনাহীন
আজজেই সেই ,জীবনের ,একদিন
উত্তর থেকে মেঘেরা এসেছে আজ
বুকের মধ্যে তোমার ঠোঁটের বাজ"

সুব্রত মন্ডলের 'মুক্তি' ভালো লাগল ।যখন কবি বলছেন--
  "অন্তত পা দিয়ে মাড়িয়ে বলো
             স্পর্শ করলাম............

আঃ  সমস্ত ব্যথা জুড়িয়ে যায় শেষে !"

ব্যথা জুড়িয়ে যায়  রক্তস্নাত পাঠকেরও ।মৃত্যুভয় হেঁটে হেঁটে বাসা বাঁধে কবি সমরেশ মুখোপাধ্যায়ের 'মৃত্যু' কবিতায়--কবি প্রথম  পঙক্তিতে বলেন --
"কীভাবে বেঁচে থকবো ভাবতে ভাবতে
            একটা সময় মৃত্যুভয় কেটে যায়
মনে হয় মরি মরবো,একবারই তো!"
আর পরক্ষণেই মৃত্যুভয় অতিক্রম করে হেঁটে চলি  'শুধু শিউলি ফোটার' আনন্দে ।কবি অনুপম মুখোপাধ্যায়ের 'এই বিষয়ে বিশেষভাবে বাঙালি পুলিশের উদ্যোগ চাই'  শক্তিমান । চিত্রকল্পে উঁচু বাড়ির সামনে "বালতিতে /একটু হেলে /গাড়ি ধোয়ার জল'' বয়ে আনার দৃশ্যটি নান্দনিক । অথবা যখন শান্তনু চট্টোপাধ্যায় বলে ওঠেন ,"রেনোভেট করে ফেলি মসলিন আলো ও ফিকির/নাৎসি জুলুমগুলো ভেসে আসে অনিকেত দীর্ঘ মন্তাজে । ,প্রহরের শেষ আলো দেখা যায় যেন ।জীবনের  পাপজ  ক্লেদ,শোষণ ,যন্ত্রণা ,আর সর্বোপরি প্রেম ফুটে ওঠে সব্যসাচী মজুমদারের 'লালা' 'স্নায়ু কবিতা দুটিতে। যেমন এই লাইন গুলি--
  "সারাদিন ঘেরা জিভের ওপর পিঁপড়ে
ফসলের মাটি পালটে খাচ্ছে...ইসরে.....
                 ক্ষেতে কেঁপে ওঠে স্বদম্ভ আর শূন্য....
যদি আয়ুটুকু স্মৃতিতেই সম্পূর্ণ"।

'দ্বৈপায়ন-'-এর কবিতাবিভাগ নিঃসন্দেহে শক্তিশালী ।গদ্যবিভাগে শহর কেন্দ্রিক স্বার্থপরতা ও কূপমন্ডুক চিন্তাযাপন ফুটে ওঠে সাত্যকি হালদারের 'মাসিমা' গল্পে।সুদীপ্তর সঙ্গে সঙ্গে পাঠকও হাঁটতে থাকে ।মনে মনে ভাবে ,"তার সময় থেকেও তো পঁচিশ বছর"  আরো দুটি ছোটগল্প রয়েছে এবারের 'দ্বৈপায়নে'। সপ্তর্ষি হোড়ের "ঈশ্বর যা করেন " ও অমিত কুমার বিশ্বাসের 'মেঘ ভাঙা বৃষ্টি'সবশেষে রয়েছে বিশেষ প্রবন্ধ,'পথিকৃৎ আবেদিন;তাঁর কাছে আমাদের যত ঋণ'মতলুব আলির জয়নুল আবেদিনকে নিয়ে লেখা এই গদ্য মূল্যবান সংগ্রহ,এ বিষয়ে সন্দেহ কোথায়
                মাত্র পাঁচ ফর্মার এবারকার 'দ্বৈপায়ন'-এর প্রচেষ্টা অসামান্য।তবু খানিকটা সংকোচ থেকে যায় নামকরণে ! "দ্বৈপায়ন"এর ভারবহন করতে '' সংখ্যার প্রয়োজন কতটা,এ নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে।শিল্পী বাবলু রায়ের প্রচ্ছদে ফুটে উঠেছে প্রাণবন্ত মানব মানবী । অবয়বের চান্দ্রমাসে এই প্রচেষ্টা শ্রীগর্গ - সংহিতায় উক্ত মুক্তা সরোবরে আর একটি মুক্তা ক্ষেপনের মতো ।এই মুক্তা দানের ফল,লক্ষ মুক্তাদানের মতো,সন্দেহ নেই। "একমুক্তাফলস্যাপি দানং তত্র করোতি যঃ ।লক্ষমুক্তাদান ফলং  সমাপ্লোতি ন সংশয়ঃ।।তাই ফিরে আসি অবনীন্দ্রনাথের কথায় আরেকবার--"ফোটা ফুল গন্ধ নিয়ে সুন্দর,না তার পাপড়ি গুলির যথাযথ বিন্যাসটি নিয়ে,না তার ফোটার আদ্যন্ত রহস্য নিয়ে সুন্দর,-এ তর্কের তো শেষ নেই ।যাকে বলতে চাই অসুন্দর তার বেলাতেও এই কথা ওঠে--কেন অসুন্দর?

          (ইতিকথা অনলাইন-এর সম্পাদকের অনুমতিতে পুনর্মুদ্রণ করা হল)

                       (অচেনা যাত্রী~৯ এখানেই  সমাপ্ত হল)

মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
"অবশেষে বারোটা বাজল। কিন্তু কার? না বিশেষ কোনো ব্যক্তির নয়। আবার এক জনের-ও বটে। অনেক গুলতানি হল, এ বার আসল কথায় আসা যাক। প্রতিবারের মত এ বারও প্রকাশিত হল 'আচেনা যাত্রী"। সংখ্যা ~৯।কথা রাখলেন আমিত দা (আমিত কুমার বিশ্বাস) তার তীক্ষ্ণ সম্পাদকীয় মাধ্যমে। ঠিক ১২টায় না হলেও তার কিছুটা পরে । বাংলা সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের কাছে প্রার্থনা যে যদি আপনার মূল্যবান সময় কিছুটা বাঁচাতে পারেন, তাহলে এই ই-ম্যাগাজিন টা পড়েফেলুন, কথা দিলাম মন্দ লাগবে না ।"---ওয়াসিম ফিরোজ, জনৈক পাঠক।
Unknown বলেছেন…
"পড়া চলছে www.achenayatri.blogspot.in ...... এখনো আরও একটু বাকী ... আপাতত বলি প্রিয় পাঠ কোথাও অপ্রিয় বলার সাধ্য নেই সাহসও করিনা ... ধৃষ্টতা হয়ে যাবে একদিকে তীক্ষ্ণ "উত্তরবঙ্গ সিরিজ"-এ মাসুদার রহমান অন্যদিকে "সমস্ত সন্ধ্যার শেষে" কি সাবলীল অথচ আগুন নদীর ফল্গু ধারায় তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় ......" ------অনির্বাণ বটব্যাল
Unknown বলেছেন…
"অমিত কুমার বিশ্বাস সম্পাদিত "অচেনা যাত্রী-9" এপ্রিল-2014 সংখ্যাটি পড়লাম আজ । প্রচুর কবিতা ।ভালো কিছু নয়ন আকর্ষক প্রচ্ছদ ।এই ওয়েব ম্যাগটি খুললেই যেন আমরা স্বপ্ন-বাস্তবের মায়া রাজ্যে পৌঁছে যাবো ।

কবি তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক গুচ্ছ কবিতা পাঠে মুগ্ধ হলাম ।বহুকাল পর ওর কবিতা পড়লাম ।গ্রীক মিথ নিয়ে শূদ্রকের লেখাটি মনন প্রধান ।তথাপি চমত্কার ।উত্পল দে তো চমকে দিলেন ।তর্পন-কবিতায় লিখছেন"তোমার ছবির পাশে/ছবি হয়ে যাবো/পাশাপাশি ,আকন্ঠ তৃষ্ণায় ।"

কানাডা ,আমেরিকা ,আফ্রিকার সাম্প্রতিক কালের কবিতার অনুবাদের পাশে অমিতের "বসন্তের ঘরবাড়ী" র একগুচ্ছ অনুগল্প ।'দ্বৈপায়নে'র সুন্দর আলোচনা ।কবিতাপ্রেমীরা অবশ্য ই পড়বেন ।বিশেষ কথা ,আমার একটি লেখা স্থান পেয়েছে ।তা যথেষ্ট আনন্দের বটে ।"--কবি অমিতাভ দাস।