অচেনা যাত্রী ১০/ পৃষ্ঠাঃ১৭

    প্রবন্ধঃ২                           সাহিত্যে ভাষার বিবর্তন:  রবীন্দ্রনাথ ও কল্লোল যুগ
                                                        দেবশ্রী ভট্টাচার্য

         রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে এমন একটা সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যখন  মধুসূদন দত্ত ও বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য সবেমাত্র সাবালক হয়েছে। তার গা থেকে তখনো সংস্কৃতের আস্তরণ পুরোপুরি দূর হয়নি। শুধুমাত্র ধর্মের খোলস ছেড়ে, ভগবানের স্তুতিগান ছেড়ে সাহিত্য কিছুটা মানবিক হয়েছে মাত্র। সাহিত্যের ভাষায় সংস্কৃতের প্রভাব তখনো সুস্পষ্ট। সাধু ভাষার আধিক্য, অলঙ্কার আর উপমার বাহুল্যতা সাহিত্যের চরিত্রগুলোকে বাস্তবের চরিত্রর থেকে অনেকখানি আলাদা করে রেখেছিল। সাহিত্যের নায়ক নায়িকারা যে ভাষায় কথা বলে, যে ভাষায় ভাবে,কল্পনা করে সেটা ঠিক আমার আপনার প্রতিদিনকার কথা বলার ভাষা নয়। রবীন্দ্রনাথও বিশ্বাস করতেন,সাহিত্যের মূলগত বিষয়টি হল, সৃষ্টিশীল মানুষের আত্মপ্রকাশের তাগিদ। জীবনান্দ দাশ যেমন তাঁর ‘কবিতার কথা’ গ্রন্থে একটি বিরল অথচ মূল্যবান মন্তব্য করেছিলেন- “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। রবীন্দ্রনাথও ঠিক এই কথাই বিশ্বাস করতেন। পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষই কথা বলতে পারেন। অনেকেই হয়তো সাক্ষর, লিখতেও পারেন। কিন্তু তা কখনোই সাহিত্য পদবাচ্য হতে পারে না। আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তা, সংবাদপত্রে প্রচারিত সংবাদ ও প্রতিবেদন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভূগোল প্রভৃতি জ্ঞানমূলক গ্রন্থে পরিবেশিত তথ্য –তাও সাহিত্য নয়।
           তিনি মনে করতেন সাহিত্য সৃষ্টির তাগিদে মানুষ যখন তার নিত্য ব্যবহার্য আটপৌরে ভাষাকে কিছুটা অন্যরকম করে, অন্যভাবে সাজিয়ে প্রকাশ করে,যখন ভাষার মধ্যে এক ধরণের অপূর্বতা এবং অভাবনিয়তা সঞ্চার হয়, তখনই তা সাহিত্য হিসাবে প্রকাশ পায়। রবীন্দ্রনাথের তাই মন্তব্য-“হৃদয়ের ভাব উদ্রেক করতে সাজ-সরঞ্জাম অনেক লাগে”। ভাষার সাজসরঞ্জাম বলতে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সৃষ্টির উপায় উপকরণকে বোঝাতে চেয়েছেন। ভাষার মধ্যে ভাষাতীতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের মতে, আমরা দুটি জিনিসকে দেখতে পাই,-একটি হল চিত্র, এবং অপরটি হল সঙ্গীত।
        ভাষায় যে ভাব প্রকাশ করা যায় না, তা চিত্রে সহজে করা যায়। সাহিত্যের ভাবকে উপমা-রূপকের সাহায্যে চিত্রিত করা হয়। বৈষ্ণব কবি বলরাম দাশ যেমন লিখেছিলেন, ‘দেখিবারে আঁখি পাখি ধায়’। এর মাধ্যমে রাধার চিত্তের ব্যকুলতা আশ্চর্য রূপ লাভ করেছে। এই রূপক অলঙ্কারের মধ্যে দিয়ে যে ছবি আঁকা হয়েছে, তাতে একটি উড়ন্ত পাখির সাথে রাধার চোখের চঞ্চলতা একাকার হয়ে গেছে। ছবিকে বাদ দিয়ে যা সাধারণ ভাষায় প্রকাশ করাটা ছিল অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরি’ কাব্যের ‘পুরষ্কার’ কবিতায় অনির্বচনীয় ব্যাঞ্জনাকে প্রকাশ করেছেন-
                                  “শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি
                                   বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি,
                                   পুষ্পের মত সঙ্গীতগুলি
                                      ফুটাই আকাশ ভালে।
                                   অন্তর হতে আহরি বচন
                                   আনন্দ-লোক করি বিরচন
                                   গীতরসধারা করি সিঞ্চন
                                      সংসার ধুলিজালে”।

        সাহিত্যকে যে সঙ্গীতের আশ্রয় নিতে হয়, তার জন্য ছন্দ, বাক্যবিন্যাস এবং শব্দগত অবস্থানের শৃঙ্খলার প্রয়োজন হয়। সঙ্গীতের দ্বারা ইপ্সিত বাক্যটিতে একধরণের গতি সঞ্চারিত হয়। যদি বলা যায়,’গগনে মেঘ গরজে ঘন বরষা’ তবে তা আমাদের মনে কোন প্রভাব বিস্তার করে না। অথচ এই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর ‘সোনার তরি’ কাব্যে বলেন ‘গগনে গরজে মেঘ,ঘন বরষা’-তখন এই শৃঙ্খলিত শব্দ বিন্যাস  তার ছন্দিত পদক্ষেপের দ্বারা গতিশীলতা লাভ করে।
          রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন চিত্র কাব্যের দেহ আর সঙ্গীত তার আত্মা। বাইরের প্রকৃতি ও  মানব চরিত্র মানুষের মনে সর্বদা যে রূপ ধারণ করছে, যে সুর সৃষ্টি করছে ভাষায় রচিত সেই চিত্র ও গানই সাহিত্য। সাহিত্যে ভাষার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে পুরুষ মানুষের অফিস যাওয়ার যে সাজপোশাক তা কাজের উপযুক্ত পোশাক বলেই সবরকম বাহুল্য বর্জিত। কিন্তু মেয়েদের যেহেতু লজ্জাশরম, ভাব-ভঙ্গী,ব্যাক্তিগত সৌন্দর্য ইত্যাদি রক্ষা করতে হয় , তাই তাদের সাজপোশাক আলাদা ধরনের। রবীন্দ্রনাথ এখানে আমাদের দৈনন্দিন উচ্চারিত ভাষাকে পুরুষের ভাষা এবং সাহিত্যের ভাষাকে মেয়েদের সাজসজ্জার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
           রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সমসাময়িক কবি ও সাহিত্যিকগণ সকলেই প্রায় মোটামুটি এই ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। এরপর এল তিরিশের দশক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পোড়া জমিতে দাঁড়িয়ে সাহিত্যে এল আরও বাস্তবতার ছোঁয়া। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও তাদের পোশাকের বাহুল্যতা ত্যাগ   করে তাকে করে তুলল কাজের উপযুক্ত। আর ঠিক এই ভাবেই সাহিত্যের ভাষাও তার সব রত্ন অলঙ্কার দূরে সরিয়ে রাখল। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের লালিত্যের বদলে বাংলা সাহিত্যে নেমে এল গদ্য ছন্দের কাঠিন্য। অলঙ্কারের ক্ষেত্রেও এমন সব উপমা দেখা দিল যেগুলি আগে কোনদিন ব্যবহৃত তো হয়ই নি,কাব্যে কোনোদিন ব্যবহৃত হবে বলেও কেউ বোধহয় ভাবেনি। যেমন-
                            ১। উটের  গ্রীবার মত নিস্তব্ধতা
                            ২। মরচে ধরা কালো মাটি মহিষাসুরের মুণ্ড যেন
                            ৩। বহু ছিদ্রওয়ালা ছাতা জরিমানা দেওয়া মাইনের মত।
                            ৪। ঝড়ে ওড়া ভাঙা কুঁড়ের চাল শিকল ছেঁড়া
                               কয়েদি ডাকাতের মত।
সাহিত্যের এই পরিবর্তন, কাব্যের এই পালাবদল প্রাচীনপন্থীরা ভালভাবে নেননি,বিসদৃশ লেগেছিল রবীন্দ্রনাথের চোখেও ।কিন্তু একদিন তিনিও স্বীকার করে নিলেন যে কাব্য এতদিন বাস্তবতা থেকে বহু দূরে ছিল, আজ আর কোন কিছুই সাহিত্য জগতে অস্পৃশ্য নয়–
      “এখন সমস্তকেই সে আপন রসলোকে উত্তীর্ণ করতে চায়।এখন সে স্বর্গারোহন করবার সময় সঙ্গের কুকুরটিকেও ছাড়ে না”।  (আধুনিক সাহিত্য- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
           রবিন্দ্রনাথের এই স্বীকৃতিকে পাথেয় করে কল্লোল যুগের কবিরা পথ চলতে শুরু করলেন ,সেই পথকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁদের পরবর্তী কবিরা এবং এখনো এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। বাংলা সাহিত্য ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠল ভাবে ভাষায় ভঙ্গিমায় আধুনিক থেকে আধুনিকতর।
           বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ হলেন এমন এক মহা সমুদ্রের নাম, যার শুরু আছে শেষ নেই। ‘যে শাখায় ফুল ধরে না, ফল ধরে না,একেবারে’ তার প্রতিও তাঁর লেখনি নীল আকাশের রবি কিরণের মতোই কোন কৃপণতা করেননি। তবে তাঁর এই বিপুল বিশাল সাহিত্য কৃত্তির পাশাপাশি তাঁর যে গুণ তাঁকে সাহিত্যের ইতিহাসে অমর করেছেন , তা হল তাঁর মুক্ত দৃষ্টি আর উদারতা। যার ছোঁয়া ছড়িয়ে আছে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির মধ্যে।সেই মুক্ত দৃষ্টি দিয়েই তিনি যেমন একদিকে তাঁর পূর্ববর্তী কবি সাহিত্যিকদের রচনাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তেমনি স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁর উত্তরসাধকদেরও। তাঁর এই স্বীকৃতি না পেলে পরবর্তী কবিদের পথ চলা কঠিন হত।


তথ্য সংগ্রহ –
সাহিত্য- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আধুনিক সাহিত্য- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক – বুদ্ধদেব বসু
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- ডঃ সরোজ বন্দ্যপাধ্যায়

মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
খুব ভালো লাগলো । তবে আর একটু বিস্তারিত আলোচনা করাই যেত।