অচেনা যাত্রী~৯/দ্বিতীয় বর্ষ /চৈত্র পবনে/১৪২০/১ এপ্রিল,২০১৪



সম্পাদকীয়
নয় নয় করে নয়।তবে ‘আর নয়’ যেন কভু নয়।'অচেনা যাত্রী' আমাদের স্বপ্ন।পাগলামি।উচ্ছ্বাস।এ পাগলামি দীর্ঘজীবী হোক। বিপ্লবের থেকেও। বিপ্লব তো মরে ভূত। এখন ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ চলছে। সারাদিন। এদিকে নিজের বাপের শ্রাদ্ধ করতে নিমরাজি বড়ছেলে।তবু জিন্দাবাদ।আমরা খাবো তোমরা বাদ।খাও খাও খাও।কে খাবে? আম-আদমিকে আম দেখিয়ে আমের আঁটি ছুঁড়ে মেরে বলছে, আমের কুশি মাসি কে? অভিনেতা ঝান্ডব। শিল্পী ঝান্ডব।কবি ঝান্ডব।আম আদমি আরো বিচলিত।এ দিকে অকাল বৃষ্টিতে আমের বোল ঝরেছে। তাই আম আদমির গোঁফে চিন্তার ভাঁজ( মহিলা হলে মনে মনে গোঁফের কল্পনা করে নিন)। এবারে আম জুটবে তো? আম জুটুক বা না জুটুক আমের ফ্লেভার নিয়েই কাঁপাবে বহুজাতিক কম্পানি থেকে ট্রেনের আম হকার।'নিন বৌদি,আম পোড়া,এখন পলিথিন প্যাকে।' বাঃ ! কিয়া বাত। ম্যাঙ্গো-পিপলের জন্য ম্যাঙ্গো ফ্লেভার । এর পর কবিতা ফ্লেভার। নিন বৌদি। নিন সম্পাদক মশাই। না নিলে বয়ে গেল।আছে আমার আপনার মুখবই।যখন তখন রাতদিন সাতদিন নিন। নিন আর লাইকান। দিন রাত লাইকান। না না এ রাশিয়ান কুকুর নয়। এ হল নতুন এক ব্যামো। তাও ম্যাঙ্গো পিপলের। ট্যাগানো আর লাইকানো। হুলানো। ব্লকানো। পোকানো। পোস্টানো। সবই মুখবই এর ক্যারিশ্মা।অতএব ম্যাঙ্গো পিপলকে অসহায় ভাবলে হবেনা। তারা সারারাত জেগে থাকতে পারে। বিপ্লব আসুক বা না আসুক, অন্তত বিপ্লবের মা-মাসি আসলেই হবে, রান্নাটা করে রাখলেই হবে।রান্না। কবিতার রান্না। দিবারাত্র। এহেন দিবারাত্রের কাব্যে আম আদমি আবার গভীর সঙ্কটে। কোনটা কাব্য আর কোনটা নয়।নয় নয় নয়।উহু। অচেনা নয়।মানে অচেনা যাত্রী নয়।দেখুন পড়ুন। লাইকান বা না লাইকান ,পোস্টান বা না পোস্টান,আমের বোল ফুটুক বা নাই ফুটুক ,আজ বসন্ত   আবার কালও বসন্ত।
(অনুগ্রহ করে লেখাগুলো কেউ কোনো সোসাল সাইটে পোস্ট করবেন না। তবে লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন। এই সাংখ্যায় ‘উড়োচিঠি’,’তবু লালনমন’ ‘ও ‘ঠোঁটকাটা’ বিশেষ কারণে প্রকাশ করা সম্ভব হল না,আগামী সংখ্যা থেকে এই বিভাগগুলি যথারীতি প্রকাশ পাবে। আলোচনার জন্য  আমাদের দপ্তরে বই পাঠাতে পারেন । আলোচনা  ‘অচেনা যাত্রী’, ‘দ্বৈপায়ন’ ও ‘ফসিল’- এ প্রকাশিত হবে।)


সূচি
প্রিয় পাঠ~১ ‘উত্তরবঙ্গ সিরিজ’ ~মাসুদার রহমান
প্রিয় পাঠ~২ ‘সমস্ত সন্ধ্যার শেষে’~ তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
কবিতাঃউৎপল দে, মামুন মুস্তাফা, মাইতি,শবরী রায়,অমিতাভ দাস,শূদ্রক উপাধ্যায়,
সৈকত ঘোষ, অর্ঘ্য রায়, সৌম্যজিৎ আচার্য, সুকুমার চৌধুরী,মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়,সুমন মল্লিক,শঙ্করনাথ প্রামাণিক, বাবলু রায়, অরুপম মাইতি
অনুবাদ কবিতাঃ১-৭ মৈনাক আদক ও রূপাই পান্তি(স্প্যানিশ,কানাডিয়ান,আমেরিকান ও আফ্রিকান কবিতা)
এক গুচ্ছ অনুগল্পঃ ‘বসন্তের ঘরবাড়ী’ থেকে~অমিত কুমার বিশ্বাস
ব্যাক্তিগত গদ্যঃভালোবাসা মন্দবাসা~ নিষাদ নয়ন
পুস্তক সমালোচনাঃ রাত্রির হৃদয়ে এখন নীল শুঁয়োপোকাঃ সুবীর সরকার
পত্রিকা সমালোচনাঃদ্বৈপায়নঃশুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী


প্রিয় পাঠঃ১
‘উত্তরবঙ্গ সিরিজ’/ কবি মাসুদার রহমানের কাব্যগ্রন্থ থেকে কয়েকটি কবিতা

কবি মাসুদার রহমান বাংলা ভাষার অসম্ভব শক্তিশালী ও অর্ন্তমুখি এক কবি ব্যাক্তিত্ব।বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবির কবিতাগ্রাম সোনাপাড়ায় মাসুদারের বসবাস।কবিতাযাপন।হালকা একটা মেঘের ভিতর তুমুল ডুবে থাকেন কবি।মাসুদার একজন খাঁটি কবি।মাসুদারের উত্তরবঙ্গ সিরিজবইটি থেকে তুলে দেয়া হল এখানে ৫ টি কবিতা।

রাজশাহী
নদী মৃত্যুর পাশে লোকালয় জীবনকে দেখে
একটি পাখির গলা ছুড়ি দিয়ে কেটে দিলে
          রক্তশূণ্য তার নিথর শরীর

রাক্ষসির লেখা এই রূপকথা

ধু-ধু বালুচর জুড়ে পড়ে থাকে
কোন এক রাজার কাহিনী

কুড়িগ্রাম
ডাক বাক্সের ভেতর কুয়াশা
অল্প একটু জ্বর
            তার লেখা উত্তর!

শীত বিকেলের আহ!শিহরণ
কে জানে কি এর নাম?
           কুড়িগ্রাম!কুড়িগ্রাম!

ঈশ্বরদী
ব্রিফকেস ভর্তি জোনাকি,তেমন সন্ধ্যে নেই
            মুক্ত করে দেব

লোহার ওভারব্রিজ কেঁপে ওঠে
ধাতব চিৎকার ভরা গানে
বৈদ্যুতিন আলো ফুল ফুটে আছে রেলের বাগানে

গোবিন্দগঞ্জ
যমজ বোনের মতো দুইজন নদী পার হয়ে
সড়কে উঠে ভ্যান-রিক্সা ধরেছে।
হাতে ব্যাগের বোঝা
          নাকে নাকফুল

আমার বোনের মতো দুইজন

তোমারও কি বোন?

পৃথিবীর বোনদের বিবাহ হয়েছে ওই কাঁটাখালি

পণ্ডিতপুর

পঞ্চগড়
আকাশ স্বচ্ছ হলে পড়া যাবে ঈশ্বরের সমাধি-ফলক
দাঁড়াও বাংলাদেশ,ওপারে অন্য গ্রহলোক।

বাতাস তাড়িত ধানক্ষেত
কান পেতে শোন মন্ত্র হ্রিং
উধাও তাকিয়ে আছি দেখা পাবো
সমাধি-চূড়ার থেকে নেমে আসছে হিলারি তেনজিং

প্রিয় পাঠঃ ২
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৮১।ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এই কবি পেশায় শিক্ষক। শৈশব কেটেছে শহর থেকে দূরে।গ্রামে।এক সময় বিভূতিভূষণ একা একা হেঁটে বেড়িয়েছেন এই সব গ্রামে।বনগ্রামে পরে আগমন। তমাল শূন্য দশকের অন্যতম সেরা প্রতিভা।না না,তমাল এ কথা বলতে যাবে কেন, এ কথা বলছি আমরা যাঁরা কবিতাভুক, যাঁরা কবিতার রাজ্যটাকে মোটামুটি চিনি বা জানি। তমাল বরং প্রচার বিমুখ মানুষ।নিজেকে লুকিয়ে রেখে নিজেকে গুটিয়ে ক্রমশ  নির্মাণ করে চলেছেন  কাব্যের রেশম। তাকে কিছু বলতে হয়না। তিনি প্রান্তিক মানুষ। তাঁর জমিতে জো-এসেছে বহু যুগ আগে। আর তিনি লাঙল নিয়ে আজো ফসল ফলিয়ে চলেছেন। কখনও সে জমিতে বারুদের গন্ধ পেয়ে থমকেছেন,ভয় পেয়েছেন, এমনকি শিশুর  মতো কেঁদে ফেলেছেন হাউহাউ  করে।
  ‘সমস্ত সন্ধ্যার শেষে’ তমালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ।২০০৩ -এ কলকাতা বইমেলায় ‘ফসিল’ থেকে বের হয়।দাম পাঁচ টাকা।মাত্র ১২ টি কবিতা ছিল। বইটি এখন দুষ্প্রাপ্য।



সমস্ত সন্ধ্যার শেষে
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রবেশক
ভঙ্গুর বিবাহ ফেলে সে এক হারানো অপরাধ
সতর্ক-প্রবণ দিনে রেখে গেল ইচ্ছে অপবাদ

আর এক অবনত দলছুট হাসি স্মৃতি মেঘে
আদর অগ্রাহ্য করে ধেয়ে এল নক্ষত্রের বেগে

আর এই কেঁপে ওঠা যোগিনীর পান্ডুরাঙা হাত
হাতে হাত চোখে চোখ...অস্ত্রময় বারুদের রাত
লিখেছে ফুলের ঠোঁটে হিজিবিজি অক্ষরের ক্রোধ
ছটফটে পতঙ্গ থেকে কু-সন্ধানী এই মৃত্যুবোধ

চাউনি বাড়িয়ে দেয়.....তৃণ থেকে  বাণ খসে পড়ে
লাঙল গৃহস্থ,তবু পরবাসী চাঁদ অস্ত্রাগারে

যায় সে জ্যোৎস্না ছুঁয়ে ...টুপটুপ লাভা নদী এবং বমন
মোহনা উপেক্ষা করে নীলকন্ঠ অনিচ্ছুক অস্ত্র সমর্পণ



এই নাও আমাদের হৃদয় -স্পন্দন শেষে তুলে রাখা
রঙিন চুড়ির মতো রক্তের চুম্বন আর লাঙলের স্পর্ধা

আমি পাখির দেহ থেকে প্রতিটি পালক হাতড়ে  হাতড়ে
দেহের  উত্তাপ সহ মৃতফুল,শাসনের একটি কিনারে
রেখে বেরিয়েছি আজ,আমৃত্যু সমুদ্র আর ডিঙির উজান
পিছনে সরিয়ে ফেলে দাঁড়িয়েছি স্নানেরই কারণে

অস্ত্রগৃহে বিষজ্বালা;স্রোতের সুঠাম শিশু খরজন্মে
গাছের প্রতিটি পাতা,ছাল,বাকল,শিকড়ে লিখে যাবে
লিখে যাবে আমাদের বুকের গভীর শুষে,কেড়ে নেওয়া
ফসলের রক্তমাংস,অক্ষিপটে ঐ অবাধ্য দৃশ্যের সম্ভ্রম

সে উলঙ্গ শিশু আজ শত শত মৃতদেহ বয়ে যাবে
স্মৃতির বারুদ গৃহে সসম্ভ্রমে লিখে নেবে আগুন চুম্বন

এই নাও ঐ শিশুটির  স্মৃতির বারুদে আর অস্ফুট অক্ষিপটে
লিখে দাও,লিখে দাও এই অস্ত্রের পালক এবং
দু'হাতের রোমকূপ,হৃদয় হাতড়ে,খুঁড়ে, এঁকে দাও
ওর লাঙলের স্পর্ধা,ফুসফুসে গেঁথে নেয়া ওরই ভাবীকাল
১২//২০০০
পথসীমা মুছে  গেছে,নদীপথে ,মেঘপুঞ্জে জমেছে আগুন
আরোপিত স্নেহ থেকে শুষ্ক ডালে অপেক্ষায় যে পাখির চঞ্চু
ক্রমে লীন হয়ে আসে, ওর নীল পালকের ভাঁজে আজ
গুঁজে দেব মেঘপুঞ্জে রাতজাগা কম্পমান শাসনের ডাক

আমাদেরই সূর্যাস্তে , আজ ধ্বসে যাক  সব বিষের চাবুক
সুগন্ধী বারুদ ফুলে ,সঞ্চিত ঈর্ষার ডাক অচেনা পথের
সীমানা হাতড়ে আর লাঠি বন্দুকের ভারে মিলে যাক
আমরা চাই না এই রক্তময় বারুদের খেলা

এ খেলার শেষ কবে?শেষ কবে বন্দুকের ডানা ছেঁড়া গান?
পথসীমা মুছে নেয়া নদীপথে
আর কবে ডিঙি নৌকার উজান বইবে
আর সুগন্ধী রাতের কানে-কানে লিখে দেবে পাখির গুঞ্জন?

আরোপিত স্নেহ নিয়ে বসে আছি মেঘপুঞ্জ জমছে যেখানে,
পথসীমা মুছে গেছে খেলার আদেশ এবং শাসনে;আজ
সামাজিক ভয়,আর বারুদফুলের লোভ হেলায় সরিয়ে রেখে আমাদের
ফিরিয়ে দিতেই হবে অপেক্ষমান পাখির ফসলের অধিকার....
১৪//২০০০
কতরাত কেটে গেছে মৃত ফসলের খোঁজে

আজ রক্তবৃষ্টি দিন।আমাদের দুই চোখ ভরা
মাটি-মার রাঙাবুক,দেহময় ধমনীর শুদ্ধ-রক্তের
প্রতিটি বিন্দুতে মিশে ডুবে আছে ফসলের ,বেদনার গান
আমাদের করোটির সুগভীরে এই গান,বটের ঝুরির মতো
ডালপালা পত্রেপুষ্পে বিষময় ব্যথিত রয়েছে

অন্ধরাত সন্তর্পণে  জ্যোৎস্নার কোষে কোষে মিশিয়েছে
ঘৃণার বারুদ,আর মা-এর গভীর থেকে জল শুষে,
শিকড়ের শূন্য বুকে জাইলেম ও ফ্লোয়েম কলার দেহে
আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে  বৃষ্টিজল ধুয়েছে পরাগ

মৃত-ফসলের খোঁজে অস্ত্রসহ চেনা-মুখসব স্মৃতি বিষ্ফোরণে
ধুয়ে গেছে অকাতরে....আমাদের কালো এই কাপড়ের
প্রতিটি বুননে লেখা,লেখা আছে ফসলের নাম,
মৃত মা'র ধমনীর শুদ্ধরক্ত ভিজে যাওয়া বীজজন্ম এই..........
১৮//২০০০

আদিম সূর্যোদয়ের লোভে আমরা বসেছি এখানে,
হৃদয়ের সব ধ্বনি, হাতের সমস্থ চুড়ি স্তব্ধ করে বসে আছি
অস্ত্রাগার প্রহরায়। সমুদ্রময় তুফান আর উজান হাতড়ে
আমরাই সামলেছি স্নানের আমৃত্যু ডাক--

আজ পিছু ডাকবো না,যদিও বুকের মধ্যে বেজে যাক
নীড় ভাঙা চঞ্চুহীন ত্রস্ত পাখির ক্ষুধিত আক্ষেপ...

জানি আজ ব্যর্থ রাত,শরীরের সব ক্ষুধা  হেলায় সরিয়ে
শাসনের সব বাঁধা, রক্তচক্ষু বনান্তরে বামপাশে ঠেলে
হারানো লাঙল কিংবা ফসলের প্রার্থনায় ভারি হবে,
পাখির কুজনে,গানে,প্রতি পালকের স্পর্শে মুছে দেবে ঘুম......
যে ঘুম করোটি ,নাভি,আর স্মৃতির বারুদে নেশাখোর
উন্মাদের মতো আঁকে,গেঁথে দেয় পরাজয়,গ্লানির চুম্বন.....

সাজিয়েছি জয়টিকা, পিছু থেকে ডাকবো না আজ,

সযত্নে লালিত এই শিউলিরা ঝরে যেতে পারে ঝড়ের আঘাতে

আমাদের চাই শুধু আমৃত্যু  শান্তির ঘুম,ফসলের তপ্ত মাঠ,কেননা
এতদিন সামলেছি ঋতুময়-স্নানের আদিম লোভ...............
২০//২০০০
বারুদ বেধেছি আজ,তরবারী বুকের ভেতরে,
আগুনের ক্ষিপ্রজিভ, আচমকা তিরস্কৃত সকাল ডেকেছে....
আমাদের ক্ষুদ্ধ পথ, ছত্রাকের নীচজন্ম, বুকভরতি অভিমানে
পাঠ্যবই বহির্ভূত শিক্ষার অনন্যোপায় পৃষ্ঠায়
লেগেছে কাজল, আর,পেশী  ঈর্ষার উচ্ছ্বল সুর

শূন্যগ্রামে ক্লান্তিহীন মৃত্যুর পরাগ শুষে ক্ষুধিত চোখের
অন্ধকার কোণে বেজে চলে দিগ্বিজয়ী অস্ত্রের
অবিরাম ঝনঝন,দর্পিত অশ্বের ক্রুদ্ধ হাঁটা-চলা...

অন্ধগ্রামে ,দশদিকে, সন্ধ্যার প্রতিটি কোষে ,সূর্যের অযুত কোটি
অনু-রশ্মির নির্বাক, একত্রিত ফিরে চাওয়া বিম্বিত হয়,
পেশীর গভীর থেকে যত লোভ শুষে নিয়ে প্রতি ডালে অন্ধ-ত্যেজ
ঢেলে দেয় বিষজালা, অস্ত্রাগারে পক্ষির প্রহরা-

বারুদ জমেছে বুকে,আরোপিত সব ঈর্ষা অক্ষিপটে
হলকর্ষণে তুলেছে যুদ্ধের দামামা,আর অতর্কিতে একদিন
আমাদের স্তব্ধ পথে অস্ত্রের ঝংকার তুলে অস্ত্রাগারে পুড়িয়েছে
পাঠ্যবই অন্তর্গত অনন্যোপায় শিক্ষার দিনরাত
/১০/২০০০

সমস্ত সন্ধ্যার শেষে কক্ষ্যচুত গ্রহদের মতো
স্রোতহীন নদীপ্রান্তে ভেসে আসছে নক্ষত্রের আলো
সহসা চলার আগে যে ভাবে ক্ষয়িষ্ণু পথ কার যেন
আদিম চোখের কোণে লেগে থাকা আগুনের স্তূপ দেখে বার বার
স্তব্ধ হতে থাকে,আজ মৃত্যু-মুখর গানের সঞ্চারী-সুর
স্মৃতির উন্মাদ কোণে সেই বেগে এঁকে দিচ্ছে আরোগ্যের ক্ষত

আমাকে পালাতে দেখে রঙিন আলোর কাছে হাতে হাত
সহসা দাঁড়াল যারা,ওরাই তো আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে
কুমারী মায়ের বুকে এঁকে ছিল বিষভরা দাঁতের কোলাজ
আমার মায়ের বুকে সেই ক্ষত আজও কেন শুকায়নি
নক্ষত্র আলোয় এসে,আমি সব পরিষ্কার বুঝি

ওদের কঠিন হাতে রক্তের দুর্গন্ধভরা ফসলের জমি-
ধারালো অস্ত্রের বাঁকে ক্রমচলমান নদী
সমস্ত স্রোত হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে আসে; এবং কক্ষচ্যুত
গ্রহের হাজার খন্ড আমাদের প্রহরার পাশে এসে পড়ে...
আর অস্ত্রাগার থেকে ওদের দর্পিত ছুটে আসা......
রঙিন আলোর পাশে হাতে হাত সশস্ত্র দাঁড়ানো
পঁচিশ বছর আগে  মায়ের গর্ভ থেকে আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই
২৫//২০০১
এই তো আঁধার হল,নিভে এল সব বিষ-ক্ষুধা....
করোটির বিষপাত্রে,অবাধ্য শরীর-কোষে বীজের জন্ম শেষে
কার যেন অতর্কিত আক্রান্ত স্পন্দন দেখে জমা হল
ঈর্ষার উন্মাদ ডাক-আমরা সহসা কোনও প্ররোচনা হেতু
পালক সম্বল হাতে ফসলের সোঁদা-গন্ধ মুছে
খেলার শাসন ভুলে দাঁড়ালাম অস্ত্রাগারে,
সুগন্ধী রাতের বুকে লিখলাম অবিশ্বাস্য বারুদের ক্ষুধা

একদা লাঙল কাঁধে পথ চলা কৃষকের পায়ে কোনও এক
রঙিন স্বপ্নের ঘোর প্রতিরাত্রে বাসা বাঁধে আজ--
লাঙল সরিয়ে রেখে স্মৃতি বিষ্ফোরণ হেতু রক্তাক্ত পথে
বারবার ফিরে আসে লাঠি-বন্দুকের ডাক এবং প্রত্যেক পাখি
নীড় হারাবার ভয়ে প্রখর নদীর স্রোতে ঝাঁপ দেয়
আর যত অন্ধরাত, নষ্ট ফসলের ডাকে ক্ষতময় পথ ধরে....
সব অস্পৃশ্যতা যেন অস্ত্রের অবাধ্য ডাকে ভুলে যায় নবান্নের ঘ্রাণ
২৭//২০০১
নিশুতি রাতের ঠোঁটে অবিশ্বাস্য বেজে উঠছে বারুদের গান
আমরা স্নানের শেষে প্রলম্বিত বেণী পার্শ্বে কড়ি ও কোমলের
সব তাপ ভুলে নেমেছি বিরুদ্ধ সংগ্রামে

পুতুল খেলার শেষে ইচ্ছার বিরুদ্ধ পাখি কার যেন
নিরুপায় রক্তচক্ষু মুছে রেখে সব নীল রাত্রি থেকে
ফুলের রেণুর মতো শুষে নেয় সসম্ভ্রম মাতাল প্রলাপ আর
যুদ্ধ প্রস্তুতির পথে অতর্কিত  স্নেহ-ভেজা ডাকে,
রক্তময় নীলকণ্ঠে ফিরে আসে ঘৃণা ভেজা উত্তপ্ত  পঞ্চম

তখন দীঘির কাছে নিখোঁজ যুবক দেহ আর দেহ টানাটানি খেলা
সীমাহীন বক্তৃতার অসহ্য আদেশে আর মতামত ভারে জেগে থাকে
তঞ্চিত রক্তের দাগ হলুদ বসন্ত ভুলে পুনর্বার যেন জেগে ওঠে-
হারানো অস্ত্রের কোনও স্বরহীন স্বরলিপি,
অন্য এক ভূমিষ্ঠ শিশুর নিরুদ্বেগ অক্ষিকোণে বলে দেয়
যুদ্ধের প্রস্তুতি রাত.....নিশুতি ফুলের ঠোঁটে ফুটে ওঠা  বারুদ প্রলাপ
৩০//২০০১
বনপ্রান্তে উচ্চারিত  বিবর্ণ নৌকার ক্রম  অবিমিশ্র  ঘুম আর
উন্মাদ প্রকাশ লোভ সযত্নে সরিয়ে রেখে
এই তো দাঁড়িয়ে আছি অস্ত্রের আবেগে

বিষময় রাত্রিশেষে ভোরাই আলোর ডাকে যেভাবে  বৃন্তহীন
গোলাপের দেহে আর রক্তাপ্লুত পতঙ্গের ঠোঁটে পুনর্বার বেজে ওঠে
সৃষ্টির আদিম সুর; হলকর্ষণের পর উপ্ত বীজের সহস্র-ক্ষত
অপার্থিব আলোকের নিরুচ্চার আবেগের মাঝে রেখে আজ
আমরাও উঠলাম দৃপ্ত এক হাসির স্পন্দনে

সে হাসি সহজলভ্য। সে দর্পের রামধনু রঙ
উজান হারানো নদী ...সীমাহীন পথ ভুলে সামাজিক
সমস্থ ঈর্ষার শেষে  বারংবার ফিরে এল অচিন অপ্সরা গ্রামে।আর
ছটফটে শিশুদের লুকোচুরি খেলা অবসন্ন উপত্যকা ধরে
মিশে গেল মাংসাশী-পশুদের মুখে--

সে মুখ ভোলার আগে অন্ধকারে আরো এক রক্তচক্ষু,
দর্পিত ক্রুদ্ধ শাসন সম্মোহিত করে আর পালক-অধিক বেগে আগুনের
ক্ষিপ্র জিভে আচমকা নেমে আসে ফসলের গোপন সন্ত্রাস
আর সে ভোরাই সুর......সাতরঙা রামধনু হাসি গ্রাস করে উপত্যকা গ্রাম,
আমাদের ক্ষুদ্ধ পথে,অস্ত্রাগারে,অক্ষিপটে লিখে দেয়
প্রকাশের লুকোচুরিবিবরণ নৌকার এক তৃপ্তিমান ঘুম
//২০০১
১০
অপেক্ষা রসিক এক দামাল প্লাবন তার রক্তচোখে
সীমান্ত সাধিত পথে প্রত্যেক আলোর কাছে বসিয়েছে তড়িৎ প্রহরা
আমরা  ঘুমের কাছে, নীড়-ভাঙা তৃষাতুর পাখির পালকে,
নদীপথে এঁকে রাখছি  ক্রুদ্ধ এক হায়নার বিষাক্ত ক্ষত

শতেক জন্মের আগে বিস্মৃত সমস্ত স্বর আজ
অথর্ব লাঙল মুখে তীর্থ-ভ্রমণের শেষে গেয়ে ওঠা পরাজয় গীতি হয়ে
জল-ওষ্ঠ মধ্যবর্তী দর্পণের রতিবিম্বে ফুটে ওঠে ...
পথের জটিল বাঁকে ভুলে যাওয়া প্রিয়জন,হারানো বোনের ঠোঁটে
জেগে ওঠা বিষ-নখ....সুঠাম উলঙ্গ শিশু...রঙিন আলোর পাশে
জ্বালাময়ী ভাষণের আর রাত্রি-পাগল সেই
ট্রাক্টরের চুপচাপ অভিনব হত্যা গোপন.....
হৃদয় প্রকোষ্ঠ থেকে ডেকে দেয় প্লাবনের দীর্ঘ উপচ্ছায়া

সে প্লাবন  নির্বিকার। নীড়-ভাঙা পাখিদের ঠোঁটে ডেকে দেয় বান....আর
অস্ত্রাগারে,মধ্যরাতে ট্রাক্টরের ক্রুদ্ধ ঠোঁটে মুছে দেয় সব হত্যার দাগ
২৬//২০০১
১১
স্বজন হারানো এক দাহ্য অনুভব আজও স্বপ্নের ঘোর-
নবান্ন ঘ্রাণের লোভে মেতে ওঠে করোটির বিষ গ্রন্থি থেকে
দশদিকে ইতস্তত লাঙল-বিহীন চাষী আর ভয়ানক শীত
মন্থর তরঙ্গ ছুঁয়ে নেমে আসছে উপত্যকা-গ্রামে

রঙিন পাখির ডাকে উড়তে,ভাসতে থাকা হলুদাভ পাতা
যে এক সনাক্তকারী যুবকের দেহ থেকে
সমস্ত রক্তের কণা গ্রাস করে নেয়...আর লৌকিক তদন্ত শেষে
সন্তান হারানো মা'র দুগ্ধহীন শুষ্ক বুকে এঁকে দেয়
লাঙলের ভুল চাষ; সে শুধু বসন্ত শেষে
পরিধি-কেন্দ্র ছিঁড়ে ভেসে আসা সুপ্ত অপবাদ

অপেক্ষা-প্রবণ এক দাহ্য অনুভব আর ফেলে আসা
ভুল জাতক-কথন....দর্পিত পদাঙ্ক থেকে আজ প্রতিটি
সবুজাভ  গাছে গাছে লেপে দিচ্ছে বিকালের আলো।আর
শীতল শিশির ছুঁয়ে অনাগত নবান্নের বাঁকে,
জমে থাকা নীল ঠোঁটে, উপত্যকা গ্রামে
বেজে উঠছে মৃদু শিস...রক্ত-চুম্বনের ঢেউ....
স্বজন হারানো এক দাহ্য অপবাদ
//২০০১

১২
স্বজন হারানো পাখি সহসা ভুলেছে তার চঞ্চুভরা ক্ষত
দশদিকে  ইতস্তত গোধূলি-অনীহা বশে সৈনিকের অস্ত্র সমর্পণ
উড়িয়েছে পারাবত--মঞ্জির গোপনে বেঁধে
মার্জনা, রটনা মতে ভুলিয়েছে স্রোত-বক্ষে সুঠাম শিশুর সব দূর-ব্যবধান

পক্ষি-প্রহরার পর আমাকে   নর্তকী ভেবে উত্থিত গরল হত্যা
গন্ডুসে পানের পর সে কোন শতাব্দীহারা নীলকন্ঠ, আজ জন্তুর
হৈ হৈ রব শুনে সব পাতার আড়ালে যেন লিখে গেল বিভাব-বারুদ

এই তো অপেক্ষা শেষে বিশল্যকরণী হাতে দাঁড়িয়েছি স্নানের কারণে
করটির সুপ্ত কোণে লাঙলের সব মৃদু মন্ত্রোচ্চার
ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সমস্ত বাতাসে আজ ছেয়ে আছে
রক্তচোষা কোনো এক বারুদের অবৈধ উল্লাস

থেমে যাক বারুদের...অস্ত্রের  এ সব সৌরভ, আমরা
হারানো ফসল লোভে লাঙল সরিয়ে  হাতে তুলে নেওয়া
অস্ত্রের  রক্তাক্ত ক্ষত বিশল্যকরণী মেখে ধুয়ে নেব ঠিক...
ভুলে যাব ফসলের....রাত্রির লাঙলহীন সব অজুহাত আর আত্মসমর্পণ
তুলে দেব সুপ্ত কোণে স্বপ্নের সব ছিটকিনি

  স্মৃতির বারুদ গৃহে যে স্বপ্ন লিখে দেবে সব
অভিনব হত্যা-গোপন...ছিন্ন বসন ত্যাগের পর নিদারুণ ক্ষোভে
জ্বলে ওঠা ভলক্যানো এলোমেলো উড়ে যাবে ...আর অস্ত্রাগারে
বারবার লিখে দেবে  রৌদ্র-বারুদের শেষে নিরুপায় আত্মহত্যা লোভ
১৭//২০০১




মন্তব্যসমূহ