রম্যরচনা
পুরুষ যখন মা
দীপক মান্না
দীপক মান্না
রাত একটা। হাসপাতালে কেবিনের বেডে আমি একা। পাশে ছোটো একটি টেবিলে রাখা কিছু ওষুধপত্র, কয়েকটা ইঞ্জেকশান, হরলিকসের বোতল, একটা গ্লাস আর চামচ। এদের নিয়েই
চারদিন ধরে সংসার পেতেছি। হাসপাতালের
নার্সদের কেমন যেন গা-ছাড়া ভাব। রুগীদের ঠিকমত পরিচর্যা করে না। বেডে ধবধবে সাদা চাদরটা মেঘলা আকাশের চেহারা নিয়েছে। ওষুধ দিতে তো ভুলেই যায়। মাঝে মাঝে কয়েকজনকে দেখতে পাচ্ছি খিল খিল
করে হাসাহাসি করছে। একা একা
ভীষণ বোর ফিল করছি। মাথার কাছে
জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে একবার উঁকি মারি। গভীর রাতের
শহর দেখার সুযোগ আগে হয়নি। আজ হয়েছে। রাত নাকি ভীষণ একা। তার চেহারা নাকি ভীষণ ভয়ঙ্কর। কী জানি ভূত প্রেতের মতো কিনা। আবার ডিসেম্বর মাস। কয়েকটা কুকুর। আগুন জ্বেলে দু’একটা ভিখিরি হাত সেঁকছে। ওই সরু ঘুপচি গলিটার মধ্যে কারা! মাঝে মাঝে দেশলাই জ্বালাচ্ছে মনে হচ্ছে। নিশ্চয় এরা পাতা-খোরের দল। এরাই দিনের বেলায় হাত সাফাইয়ের কাজটা অতি
যত্নে করে। নাঃ, একটু জল খেতে হবে দেখছি। গলাটা শুকিয়ে
যাচ্ছে । এ এক বিষম
বিপত্তি। হাসপাতালের
যা কিছুই খাই সবেতেই ওষুধের গন্ধ। একটু কাত
হয়ে শুতে হবে। যন্ত্রণাটা
ক্রমশ বাড়ছে। পেটটা বেশ
ভালোই ফুলেছে দেখছি। ছিঃ ছিঃ, কি লজ্জার কথা। আমি একজন
পুরুষ,
আর আমার গর্ভে সন্তান। কাল সকাল
হলেই হয়ত দেখব পাশে শুয়ে আছে তোয়ালে মোড়া এক শিশু। কি আশ্চর্যের ব্যাপার। পুরুষের গর্ভে সন্তান। দেয়ালে ক্যালেন্ডারের বাচ্চাটা কেমন খিল খিল করে হাসছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কি তবে স্বপ্ন দেখছি!
কই না তো!
চিমটি কাটছি, লাগছে। পেটের ভিতর শিশুটা বোধ হয় নড়ে উঠল তিড়িং করে। বেশ পরিষ্কার অনুভব করতে পারছি।
আজ সকালে যখন ট্যাক্সি থেকে নামলাম, মুখে চাদরটা খুব ভালো করে চাপা দিয়েছিলাম। স্ত্রী রমাকে ফিস ফিস করে বলেছিলাম,ভীষণ
লজ্জা লাগছে। সবাই কি
আমার পেটের দিকে তাকিয়ে আছে? রমা বলেছিল, কই নাতো। সবাই ভাবছে এই বয়েসে তুমি বেশ একটা ভুঁড়ি
বাগিয়ে ফেলেছ। ডাক্তারেরা
পরামর্শ করে আমাকে একটা আলাদা স্পেশাল কেবিনে রাখার বন্দোবস্ত করছে অত্যন্ত গোপনীয়তা
বজায় রেখে। তাদের সুপারভিসনেই
এতদিন ছিলাম। আমার অবশ্য
ভালোই হল। কারণ, মহিলা বেডে আমার পক্ষে থাকা একেবারেই সম্ভব নয়। আমি যে একজন পুরুষ। আমার বুকের ওপর নারীর সৌন্দর্যের প্রতীক জোড়া নেই, পাছা, কনুই, হাতের আঙুল সবই দামড়া
পুরুষের মতোই। গোঁফ, দাড়ি হ্যাঁ, তাও আছে।তবে কোথা থেকে যে একখানা গর্ভ শরীরে এসে জুটল কে জানে। ওভারি, না পুরুষের তো নেই। যতদূর জানি ওভারিই মাতৃত্বের প্রধান কারণ। আমার শরীরে ওভারি নেই অথচ সন্তান জন্ম নিয়েছে। বেশ বুঝতে পারছি। দেবতারা আমায় নিয়ে বেশ ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে। তবে ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। দেবতারা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য আমার শরীরটাই
বেছে নিল। কোনো অলৌকিক
ঘটনা ঘটাবে আমায় দিয়ে।
আমি দেয়ালে ক্যালেন্ডারের শিশুটার
দিকে তাকিয়ে থাকি। আপন মনে
মায়ের দুধ পান করছে শিশুটা। আর তার মা
পরম যত্নে শিশুটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বড়ো মায়া
জাগছে শিশুটার প্রতি। এ কী হল? ক্যালেন্ডারে শিশুটার মা হঠাৎ উধাও হয়ে গেল মনে হচ্ছে। আর তার মায়ের জায়গায় আমি হাত বোলাচ্ছি শিশুটার
মাথায়। শিশুটি ঘুমের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছে
আমার স্তন-যুগল। আমার শরীরে
কি এক মায়াবী মায়া জাগছে শিশুটার প্রতি!
আমি কি তবে ধীরে ধীরে একজন মা হয়ে পড়ছি!
আমি তো একজন পুরুষ। তবে আমার
মনে শিশুটার জন্য এমন স্নেহ, মায়া, মমতা জন্মাচ্ছে
কেন? যা কেবল একজন মা-ই দিতে পারে তার সন্তানকে। আমি কি তবে পেটের মধ্যে অপেক্ষারত শিশুটার
কাছে মা হয়ে উঠছি! না হবার তো কিছু নেই। শারীরিক গড়নে, হাঁটা চলায় একজন পুরুষ মা না হতে পারে কিন্তু বাবারা মায়েদের থেকে কম যায় কিসে?
সকাল সাতটা এগারোর ট্রেন ধরার জন্য কোনোরকমে দু’মুঠো ভাত নাকে মুখে গুঁজে
অফিস ছুটি। ছেলের স্কুলের
মাইনে,
প্রাইভেট টিউশন, সংসার খরচ, পোশাকআশাক এগুলো কি মায়া মমতার বাইরে? কম্পিউটারের ভাষায়
সংসার হল এক ধরনের ইনপুট-আউটপুট সিস্টেম। বাবারা ডাটা হিসাবে ক্যাশ যোগান দেয় আর প্রসেসর
মা তাকে ভালো করে প্রসেসিং করে আউটপুট দেয়। যার ফল স্বরূপ
দুমুঠো খেতে পাই, ছেলে মেয়ের পড়াশোনা হয়, অসুখবিসুখ হলে সেবাযত্ন পাই। তাছাড়া বাবা
মায়ের সাথে ফারাক খুব একটা চোখে পড়ে না। আমার ক্ষেত্রে
ব্যাপারটা যদিও একটু উলটো হয়ে গেছে। এই ক’মাস
রমাই আমাকে জুগিয়ে যাচ্ছে। অফিস থেকে
ফিরে আমার সেবা যত্ন করছে। কখন কী ওষুধ
খেতে হবে,
ঠিক সময়ে হরলিকসের গ্লাস হাতের কাছে এগিয়ে দেওয়া, নিয়ম করে খাবার পর একটা ফল অবশ্যই, নইলে ধমকানি খেতে
হয়েছে। আমরা পুরুষরা
বোধ হয় স্ত্রীর জন্য এতটা করি না।
মাঝে মাঝে রমাকে দেখলে মনে হয় ওই
বোধ হয় বাবা। সংসারের
কর্তা। কঠোর নিয়ম কানুন। আর আমি গর্ভধারণ করে বিছানায় শুয়ে আছি নব
জাতকের আশায়। মাঝে মাঝে
ভীষণ টক খেতে ইচ্ছা করত, তাই রমা বাজার থেকে অফিস ফিরতি পথে কখনও কদবেল,
কাঁচা তেঁতুল কিনে আনত। দুপুরে ভাতের পর খেতে খুব ইচ্ছে হয় এই সময়।
কাল ভোর হতে না হতেই খবরের কাগজ, টিভির লোকজন হাসপাতালের বাইরে ভিড় করবে। তার সাথে রিপোর্টারদের অজস্র প্রশ্নবাণ আর ক্যামেরার ঝলকানি
রুখতে হবে। কাগজে বড়ো
বড়ো হেডলাইন বের হবে – ‘পুরুষের গর্ভে শিশুর জন্ম’ অথবা ‘পুরুষের গর্ভ সঞ্চারের ফলে শিশুর জন্ম’। তারপর চলবে ইন্টার্ভিউ পর্ব – আপনি পৃথিবীর প্রথম পুরুষ যে কিনা একটি শিশুর জন্ম দিল- এই মুহূর্তে আপনি কি নিজেকে একজন মা হিসাবে মনে করছেন? আপনি কি মনে করেন একটি শিশুর জন্ম দেওয়া একজন মায়ের কাছে সব থেকে যন্ত্রণাদায়ক?
কিছু নাম ঠিক করেছেন আপনার সন্তানের জন্য? তার
কেরিয়ার সম্পর্কে কিছু ভেবেছেন?’ – এইসব
বেয়াড়া ঝড়ের মতো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। কি আশ্চর্যের ব্যাপার! মায়েরা কি সন্তানের জন্মের
সাথে সাথেই তার কেরিয়ার নিয়ে চিন্তা করে? হতেও পারে। কিন্তু আমার তো ওসব হচ্ছে না। আমি কি মনে মনে একজন পুরুষ বলে? তা ছাড়া সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবারই বা কি আছে? সকলের
ভবিষ্যৎ ওপরঅলা আগে থেকেই ঠিক করে থাকে। বড়ো হলে একটু ঘষেমেজে নিতে হবে। এই যে আমার কথাই চিন্তা করুন না, হতে চেয়েছিলাম সন্তানের পিতা, হয়ে গেলাম মাতা। আমার চোদ্দ পুরুষ কখনও ভেবেছিল যে আমার গর্ভে
সন্তান জন্ম নেবে। সুতরাং ওসব
ভেবে লাভ নেই। ওপরঅলা যখন
ওকে পাঠাচ্ছে তখন দায়িত্ব তিনিই নেবেন। তাছাড়া এ
সন্তান যখন পৃথিবীর অন্যান্য আশ্চর্য ঘটনার মতোই একটি, তখন ওকে নিয়ে ভাববার মতো লোকের
অভাব হবে না। খুব জোর
বেঁচে গেছি। ছেলে বড়ো
হয়ে ডাক্তার হবে না ডাকাত হবে ওসব নিয়ে আমায় ভাবতে হবে না। তাছাড়া ওসবের পিছনে সময় দেওয়া মানে নিজের জীবনের সমস্ত সুখ
আহ্লাদ নষ্ট করা। তৈরি করলাম
ডাক্তার,
হল খুনে ডাক্তার। এইতো সেদিন
কাগজে দেখলাম, পনের-বিশটা হনুমানের কিডনি বের করে
মানুষের শরীরে লাগিয়ে দিয়েছে। এসব তো খুনে
ডাক্তারদেরই কাজ। আবার অনেক
নষ্ট ছেলেরাও কষ্ট করে ভালো হতে পারে তার উদাহরণ তো আছেই। যেমন, দস্যু রত্নাকর হয়ে গেলেন মহাকবি বাল্মিকি।
না আর চিন্তাশক্তি কাজ করছে না। যন্ত্রণা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে চলেছে। শিশুটা মনে হচ্ছে পেটের ভিতর হাত পা ছোঁড়া
শুরু করে দিয়েছে। কাউকে চোখের
সামনে দেখতেও পাচ্ছি না। না ডাক্তার, না নার্স, না কোনও আয়া। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। কামারশালের হাপরের মতো বুকটা উঠছে নামছে। পেটের বাঁ দিকটা কী একটা উঁচু হল যেন। এই ধরেছি। মনে হচ্ছে হাঁটু, আবার নামিয়ে নিল। এখন থেকেই বদমাইশি? দাঁড়া, বের হ তারপর দেখাচ্ছি মজা। যে কোনো মুহূর্তে বুকের হাপরটা বন্ধ হয়ে যেতে
পারে। তাহলেই সব শেষ। কেউ জানতেও পারবে না একটা ইতিহাস সৃষ্টি হওয়ার
মুখেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। হাসপাতালের
কী দশা। গর্ভবতী পুরুষ বিছানায় ছটকাচ্ছে, চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছে অথচ কারোর সাড়া নেই, দেখা নেই। পরদিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলবে – বাচ্চা বড়ো হয়নি, উলটে ছিল, মাথা
ঘোরেনি, ব্রিদিং সিস্টেম কাজ করছিল না। যতসব অজুহাত। ডাক্তারের উক্তি – অ্যাবনরমাল কেস। এক্ষেত্রে পিতা পুত্র কেউ বাঁচে না। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু শেষরক্ষা
হল না। অথচ কেউ জানতেই পারবে না যে কেন পৃথিবীর
আশ্চর্যতম সন্তান জন্ম নিতে পারল না। আসল রহস্যটা
কোথায়।
ঠক ঠক। ওই বুঝি নার্স এসে কড়া নাড়া দিল। এভাবে কোন নার্স ওয়ার্ডে ঢোকার আগে দরজায় টোকা দেয় না। অথচ আমার কেবিনে তা হল। লজ্জায় তাকাতে পারছে না। দরজার আড়াল থেকেই বলল – ওষুধগুলো খেয়েছেন? এখন কি অসুবিধা হচ্ছে? বললাম যন্ত্রণাটা বেড়েছে। নার্সটা
বলল
–একটু পরেই ডাক্তার আসবেন আপনার চেক আপ করতে। এই বলেই চলে গেল। বেশ বুঝতে পারছি বাইরে নার্সগুলো আমাকে নিয়ে বেশ হাসাহাসি করছে। মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হচ্ছে শিশুটার প্রতি। পেটের ওপর থেকেই একটা চাঁটি মারার চেষ্টা
করলাম। লাগল নিজেরই। হতচ্ছাড়া আমার পেটে এসেই জুটল। আবার পেট চিরেই বের হবে। কেন মেয়েরা তো মা হওয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়। মা না হতে পারার জন্য কত সংসার ভেঙে যায়, কতজনকে শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা শুনতে হয়। এমনকি সুইসাইড পর্যন্ত করতে হয়। তাদের পেটে গিয়ে জুটতে পারলি না। আমার পেটের ভিতরটা দেখার এতই সখ। বেশ স্পষ্ট মনে আছে, বিয়ের প্রথম রাতে রমার কানে
ফিস ফিস করে বলেছিলাম –তুমি মা হবে, তোমার
কোলে ফুলের মত একটা শিশু হাসবে। রমা প্রথমটা
ভীষণ লজ্জা পেয়েছিল। তারপর আমার
নাকটা ধরে নাড়িয়ে বলেছিল – তোমাদের আর কি! মা হওয়া
অত সোজা নয় চাঁদু! মা হওয়ার যা যন্ত্রণা যারা মা হয় তারাই জানে। সেদিন তাকে অনেক জ্ঞান দিয়েছিলাম। দ্যাখো, পৃথিবীতে সমস্ত মেয়েরাই
চায় মা হতে। আর এটাই
তাদের জীবনে প্রধান কাম্য। পৃথিবীতে
মায়ের স্থান এভারেস্টের থেকেও উঁচুতে ।তার জাতি দুটো। মানুষ এবং মা। শিশুকে বুকে
জড়িয়ে ধরে যখন আদর করবে, দেখবে সব দুঃখ, জ্বালা,
যন্ত্রণা নিমেষে কর্পূর হয়ে উবে যাবে। রমা সেদিন ভীষণ আদর করেছিল আমায়।
আজ সব উলটো হয়ে গেল দেখছি। রমার বদলে যন্ত্রণাটা আমার শরীরে ঢুকেছে। বড়ো ভয় করছে। সমস্ত যন্ত্রণাটা আমায় সহ্য করতে হবে। যন্ত্রণাটা যে বেশ কঠিন হয় তা এবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। টিভিতে কয়েকটা সিরিয়ালে দেখেছি, নায়িকার বাচ্চা প্রসবের সময় সে কি চিৎকার। এই বুঝি গেল গেল। ক্লাস নাইনে
যখন পড়তাম, ক্লাসের অন্য ছেলেদের কথা একবার কানে এসেছিল। ওরা বলেছিল, ম্যাডোনার ঘরের দরজায় নাকি এরকমই এক প্রসবকালীন ছবি লাগানো ছিল। প্রসব যন্ত্রণা যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যন্ত্রণা
এ ছবি নাকি সেই তাৎপর্যই বহন করে। গাঁজাখোরি
গল্প কিনা জানিনা। তবে যন্ত্রণাটা
যে মারাত্মক তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ভয়ে হাড়
হিম হয়ে আসছে।
রাত দুটো
বাজে। কয়েকজনের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমার ঘরের দিকেই আসছে। মনে হয় ডাক্তার। ওমা, এ যে দেখছি পাঁচ-ছ জন ডাক্তার একসাথে ঢুকছে। তা তো হবেই। পুরুষের পেটে সন্তান কিনা।
--কেমন
আছেন?
--যন্ত্রণাটা
আগের থেকে অনেক বেড়েছে।
--রাতে
কিছু খাননি তো?
--না,
জল পর্যন্ত দেয়নি। তেষ্টায়
গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
--এখনি
আপনার সিজার হবে।
একজন আয়ার কাছে জানতে পারলাম রমা সন্তানের
পিতার মতো ওয়েটিং রুমে পায়চারী করছে। আমি দেয়ালে
ক্যালেন্ডারের সেই শিশুটার দিকে তাকিয়ে আছি। সে চুপটি
করে আপন মনে দুধ খাচ্ছে। আমার শরীরে
শিশুটার প্রতি মায়া-মমতা, স্নেহ পদ্মফুলের
মত ফুটে উঠছে। নইলে পেটের
ওপর হাত বুলিয়ে শিশুটিকে আদর করছি কেন? আমি কি শিশুটাকে আদরযত্ন,
মায়া মমতায় ভরিয়ে রাখতে পারবো? মায়ের মমতা আমার
শরীর ক্রমশ গ্রাস করছে। নার্স এসে
বেশ কয়েকটা ইঞ্জেকশান দিয়ে গেল। বোধহয় এখনি
আমায় লেবাররুমে নিয়ে যাওয়া হবে। আমার চোখ
বুজে আসছে। আর কিছুক্ষণ
পরেই জন্ম নেবে প্রিয় সন্তান। এবার বোধহয়
সত্যিই মা হয়ে পড়ছি। আমার শরীরের
সমস্ত অঙ্গ-পতঙ্গ বদলে যাচ্ছে। বুকে পদ্মের মত ফুটে উঠেছে দুটি স্তন। মোলায়েম ত্বক। গোঁফ নেই, চোখের ভ্রূটা নদীর মত। আমারতো এখন
লজ্জা পাচ্ছে না। মুখের ঘোমটাটা
সরাই তো একবার। আয়নার সামনে
একবার দাঁড়াই। একি আমার
পুরো শরীরটা একেবারেই বদলে গেছে। লজ্জার ভাব
ফুটে উঠেছে সারা শরীরে। প্রচণ্ড
গর্ব অনুভব হচ্ছে। কাল সকাল
হলেই আমি মা হয়ে যাবো। আমার পাশে
তোয়ালে জড়ানো থাকবে এক শিশু। বিড়াল ছানার
মতো কান্না জুড়ে দেবে। টুংটাং ছুরি
কাঁচির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। চোখের ওপর
জ্বলে উঠল অপারেশন থিয়েটারের গোল ধাঁধানো লাইট। মনে হচ্ছে ভোরের নতুন সূর্য।
মন্তব্যসমূহ