অচেনা যাত্রী ১০/পৃষ্ঠাঃ১৬

     
      প্রবন্ধঃ১  

                                                         ধর্ষণ ও বক্তব্যবাগীশ
                                                              মৃন্ময় প্রামাণিক
                    “লিঙ্গভেদ।/হৃদয় সংলগ্ন বহিরঙ্গে বেঢপ দুটো মাংসপিণ্ড/আর দু’পায়ের ফাঁকে.../ সেই আমার শরীর।/সেটা সুন্দর- অসুন্দর, তার আকার-আয়তন সবটা আমার,/না ভুল।/ওই দু’পায়ের ফাঁকে যাদের চামড়ার দলা  শরীরের বাইরে ঝুলে থাকে/সেই তাদের দখলে- তাদের মনোরঞ্জনের পাত্রী”
                                                                                                 প্রত্যঙ্গ লজ্জা/ দেবলীনা বিশ্বাস

পার্কস্ট্রীট কান্ড থেকে ভোটের প্রচারসভা সমস্ত ক্ষেত্রেই অসাম্মানিত মেয়েরা। এটা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অসভ্যতাকে প্রকট করে, যে অসভ্যতায় অংশ নেয় পুরুষ নারী দুই পক্ষই। এমন অনেক স্ব-ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নারী আছেন যারা পুরুষতান্ত্রিক অসভ্যতাকে দীর্ঘ দিন ধরে দেখতে দেখতে সেটাকে সহজ, স্বাভাবিক ও নিয়ম বলে ধরে নিয়ে তাতে অংশ নিতে শুরু করেছেন। কোনটা কাম্য ও কাম্য নয়, কোনটা উচিৎ বা অনুচিৎ এই ভেদ করার শক্তির অভাবে অনেক নারীরাও হারিয়েছেন ঘটনাকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। সাম্প্রতিক বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনায় বিভিন্ন পুরুষ ও নারীর নানা বক্তব্য এটাই প্রমান করে।
                শব্দের একটা ওজন আছে। অনেক শব্দ আমরা না বুঝেই ব্যাবহার করি, আবার অনেক শব্দ হয়তো ছবি দিয়ে বুঝি কিন্তু তার মানে জানিনা, আবার অনেক শব্দ এমন আছে যেগুলো ঠিকঠাক প্রসঙ্গে ব্যবহার না করলে তা অপরাধ বাক্য হয়ে যায়, এমন শব্দবন্ধ বেশ কিছু শিষ্ট শব্দ দিয়ে তৈরি করা যায় যা 'স্ল্যাং' হয়ে যায়। কীভাবে লোকের সামনে কথা বলবো এর কিছুটা শিক্ষা পরিবার, স্কুল থেকে আসে, কিন্তু আমাদের বয়স বাড়তে বাড়তে আমরা ভুলে যাই। তাই সমস্ত শাখাতেই এমন কিছু শিক্ষিত লোক পাওয়া যাবে যারা হয়তো বেশ বিখ্যাত কিন্তু ভুল বলেন এবং আত্মবিশ্বাসের সাথেই ভুল বলেন। অজ্ঞতা তো মানুষকে সবসময়ই অহংকৃত করে।


              ধর্ষণ বাজারকে উত্তপ্ত করেছে। আর এই উত্তাপে সায় দিতে গিয়ে যার যার কথা বলার ক্ষমতা আছে তারা সবাই কথা বলতে হবে এই ভেবে বা সব লোকেই তো বলছে তবে আমি কেন নয় এই চিন্তায় কথা বলে চলেছে এবং তা না ভেবে অথবা ভুল ভেবে। স্বাভাবিক, উত্তেজিত মানুষ আর ভাববে কি করে! শরীর যেমন স্পর্শকাতর, শরীর বিষয়ে মন্তব্যও। ইদানিং কালে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনায় প্রায় প্রতিদিনের নিয়মমাফিক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে ধর্ষণ। নিজেরা কে কতটা সংবেদনশীল বা কে কতটা ঘৃণা করি ধর্ষণকে এইটা বোঝানোর উত্তেজনায় সময় দিতে পারছিনা নিজের বোধ, বুদ্ধিকে ফলত ধর্ষিতা মেয়ে বেশ্যা ছিল কিনা জানতে চাই আমরা, তার কাস্টমার ধর্ষণ করেছে নাকি অন্য কেও- আমরা জানতে চাই, তার পোষাক কেমন ছিল জানতে চাই। কেউ কেউ তো বিধান দিয়েছেন মেয়েরা জিন্স পরবেন না, হাঁটুর ওপরে পোশাক পরবেন না, কেউ কেউ প্রবাদ বচন জানিয়েছেন কিছু কিছু বৈশিষ্ট থাকলে নাকি মেয়েরা ধর্ষিতা হবেই। এর মধ্যে অনেক মেয়েরা আছেন যারা নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমান করতে ধর্ষিতা মেয়ের অধিকার, চেহারার ভূগোল ও চরিত্রের ইতিহাস নিয়ে মন্তব্য করে থাকেন, কোনো কোনো নারী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ত্ব আছেন যিনি বিরোধী পক্ষের চক্রান্ত খোঁজেন ও ধর্ষিতা নারীর সম্মানের মূল্য ঠিক করে দেন। কোন কোন পুরুষ রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ত্ব আছেন যারা আবার সেই নারীর দাম কত হবে ধর্ষিতা হলে ফিচকেমি করে জিগ্যেস করেন, কেউ কেউ মেয়েদের প্রতি এত সংবেদনশীল সেটা বোঝাতে গিয়ে কোনো বিশেষ নারী রাজনৈতিককে বলে ফেলেন তিনি ধর্ষিতা হলে কী হবে, ইত্যাদি জাতীয় কথাবার্তা। ‘শব্দ ব্রহ্ম’ কিন্তু আমরা আজও শিখিনি শব্দের ওজন আছে, তার মানে আছে, শব্দ ব্যবহার একটা শিক্ষা।
             
                 
                      প্রতিদিনই ইন্টারনেটের নানা সাইটে হাজারো ভাষায় হাজারো গল্প তৈরি হচ্ছে যৌন সুরসুরি নিয়ে। এককালে যে যুবসমাজ বা সদ্য বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেরা (মূলত) বাংলা চটি পড়ে যৌন শিক্ষা নিচ্ছিল, তার সাথে সাথে অবশ্যই উত্তেজনাময় সুরসুরি , তারা আজ ইন্টারনেটের দৌলতে সেই রিস্ক জোন থেকে বেড়িয়ে ক্যাফেতেই মিডিয়া বিজ্ঞানের নানা রকম এফেক্টে আরও বেশি সুখ উপভোগ করছে। আর নিজের কাছে ল্যাপটপ, ডেক্সটপ সহ ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে তো কথাই নেই। ‘মোবাইলে ঝিঙ্কু ছবি/ আড়াল হলেই গিন্নি।' ব্লু ফিল্মের হলে তাই অফিস ফেরত ভদ্রলোকের আনাগোনা বেশ কমেছে, কমেছে যুব সমাজের আনাগোনাও। এগুলোর কোনোটাতেই সমস্যা নেই। বেশ স্বাস্থ্যকর অভ্যেস এগুলো। কিন্তু সমস্যা যেখানে তা হল এই ব্লু ফিল্ম গুলোর মধ্যে বা বাংলা চটির সাইট গুলোতে বা পুরনো সেই বাংলা চটি বই গুলোতে ধর্ষণ একটি মজাদার টপিক। পুরুষকে পুরুষ তৃপ্তি দিতে ধর্ষণ-কে বেশ উত্তেজনাপূর্ণ ও মজাদার বিষয় হিসেবেই দেখেছে, দেখিয়েছে। সেই গল্প পড়তে পড়তে বা দেখতে দেখতে অনেকে মন্তব্যও করতে থাকে, ‘শালা, বাধা না থাকলে আর মজা কি’। দিনরাত এই মজার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বড়ো হয়ে ওঠা আমাদের। তাই অনধিকারকে অভ্যাস ভেবে ফেলেটা একটা সামাজিক   ব্যাধি হয়ে দাড়িয়েছে। পর্ণোগ্রাফির জনপ্রিয় ন্যারেটিভে ধর্ষিতা নারী কখনও জোরে চিৎকার করে বাঁচতে চায়না, একটু জোরাজুরি করলে তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও সে আর তেমন বাধা দেয়না। কিংবা কখনও নীরবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে পুরুষের অনুগত হয়ে মিটিয়ে যায় অনাহূত যৌন চাহিদা।
                   এসব দেখে তো কোনো খোকাবাবুর মনে হতেই পারে ধর্ষণ উত্তেজক, রোমাঞ্চকর ও উপোভোগ্য।তাই তার মুখ থেকে অকপটেই বেড়িয়ে আসতে পারে এমন কিছু মন্তব্য। ইনোসেন্স খুব ভালো খুকুর জন্য কিন্তু বুড়ো খোকাদের জন্য নয়। তাই কেউ যখন ধর্ষণকে উপভোগ্য বলে ঘোষণা করার পর ট্যুইটারে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন অভিষেকের কথাকে (ধরা যাক সে লোকসভা ভোটে সাংসদ পদপ্রার্থী) কারণ বলে দর্শান তখন তার অপরাধ আরও বাড়ে, তার কথা দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যেন অন্য পেশায় এসব বলাই যায়। এই প্রসঙ্গের পাশাপাশি এটাও প্রতিফলিত হয় যে, একজন সাংসদ পদপ্রার্থী লোকসভা নির্বাচনের মত গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়কে ঠিক কীভাবে দেখে। এটা তো প্রকাশ্যে একটি সামাজিক অপরাধ। কেউ কেউ হয়তো বলবেন নোংরামিও তো নান্দনিক ভায়া।
                     সমাজে নানা স্তরের পুরুষের জন্য রয়েছে নানা রকম মাধ্যমের এই সব চটি। কিন্তু যে নিরক্ষর বা যার কাছে এইসব রগরগে জ্ঞানের কোন সুযোগই নেই তাদের অজ্ঞানতা আছে, আর আছে সবার মতই শরীরের টান। আর সব পুরুষকে তো ছোটোবেলা থেকেই নানাভাবে এই সমাজ শিখিয়ে দিয়েছে যে মেয়েরা দুর্বল। গায়ে জোর নেই। তাই সবল যতরকম ভাবে পারে দুর্বলের ওপর অত্যাচার করবে। তাই পুরুষ ছোটোবেলা থেকে মেয়েকে খেলতে নেবেনা, তার পুতুল ঘর ভাঙবে, বিয়ের পরও তার ওপর অত্যাচার, গায়ের জোরে তার ইস্কুলের বসার জায়গা ছিনিয়ে নেওয়া, মেলার ভিড়ে পিছনে চিমটি কাটা থেকে শুরু করে জমির আলের বেড়া টুক করে বাড়িয়ে নেওয়া, একটা দেশের সীমান্তে আক্রমণ করা বা খবরদারী চালানো। নিজের অহং-কে আর নিজের আগ্রাসনকে দুর্বল পেলেই পুরুষ চাপিয়ে দেয়। ‘বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা’, কথাটা ঐতিহাসিক ভাবে সত্যি হতে পারে, কিন্তু সব্বনাশ হল যেখানে পুরুষ বুঝতে শিখল সে বীর এবং সে তার সাধ্যমত সব কিছুই ভোগ করবে। তার মানে পুরুষ অন্যের অধিকারের থেকে বেশি সম্মান দেবে তার অনধিকারকে, অন্যের অবস্থান অনিশ্চিত হবে তার আগ্রাসনে। এই অলিখিত নিয়মের ধন্দে পড়ে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে অনেকের কাছেই ধর্ষণ হয়ে উঠল ধর্ষিতারও অপরাধ, কিছু কিছু মন্তব্য বুঝিয়ে দিল ধর্ষিতাই অপরাধী।
                 
                 
কলেজ জীবনে একটা গল্প শুনেছিলাম, এ রাজ্যেরই একটি বড়ো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের একটি ছাত্র তার প্রতিষ্ঠানের বাইরে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করলে সেই প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর বলেন নাকি, আমাদের ছাত্রদের পড়াশুনোর চাপ অনেক তাই একটু ফুর্তি তারা করতেই পারে। সদ্য উত্তর ভারতের একজন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ত্বের নির্বাচনী সভার বক্তব্যে এই গল্পটি মনে পড়ে গেল। ফাঁসি বা জীবন দন্ড কোন অপরাধের জন্যই আধুনিক রাষ্ট্রের থেকে প্রত্যাশিত নয়। অপরাধীর নিজেকে সংশোধনের সুযোগ যেমন সেখানে থাকে না, তেমনই নিরপরাধী অথচ নানা চক্রে ফেঁসে যাওয়া ব্যাক্তির ওপরেও সর্বোচ্চ মাত্রায় অন্যায় হয়, সম্ভাবনা থাকে এই আইনকে নানা দুষ্টচক্রে কাজে লাগানোর। তাই এই আইনের পরিবর্তন বিষয়ে আলোচনা চলতে পারে। কিন্তু এরকম প্রস্তাব উঠে আসার প্রেক্ষিত হিসেবে যদি আমাদের এমন মানসিকতা থাকে যে, পুরুষ নিতান্ত বালকোচিত এবং সে এই নাবালকত্যের কারণে একটু ভুল বসতো ধর্ষণ করে ফেলে তাহলে বক্তার শাস্তি হওয়া উচিৎ সভ্যতার স্বার্থে।
                    পুরুষ দম বন্ধ করে, হাত মুঠো করে, চোখ বুঝে যৌন ভোজের আহ্বান চাপতে শিখুক। মানুষও বড়ো অসহায়, তাই সে আইন তৈরি করে আর মানুষের মধ্যে মানবিকতা জাগাতে চায়। এছাড়া মানুষের কিছু করার আছে কি? বরং যা করার আছে তা ধর্ষকদেরই। আমাদের প্রত্যেকের মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা একটু একটু ধর্ষকরা এগিয়ে আসুক আর হাত ধরুক এই অসহায় মনুষ্যত্বের। আর একটা কথা মনে রাখি না একটু কষ্ট করে, সবাইকে যে এ বিষয়ে মত প্রকাশ করতেই হবে এমন নয়। এই অপরাধের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে যখন লড়তে পারবো না, যখন মানুষের সম্মান বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে পারবো না ,তখন মন্তব্য করে আলোচনার আগুনে ঘৃতাহুতি না দিয়ে মুখ বুঝে অন্য কাজে মন দিই না। একের পর এক ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনা হয়তো আমাদেরও অন্যান্য ভাবনার পথগুলো রুদ্ধ করে দিচ্ছে। নাহলে কেনই বা আমরা দাবী করছি না ধর্ষণ নিয়ে এরকম মন্তব্য যারা করবে, যে মন্তব্যে ধর্ষিত বা ধর্ষিতার অপমান হয়, নারী পুরুষের অপমান হয়, মানুষের অপমান হয়, ধর্ষককে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, ধর্ষণকে সুযোগ হিসাবে দেখা হয়, সেই সমস্ত ব্যাক্তিদেরও শাস্তি হোক। আইন তৈরি হোক তার জন্য।

মন্তব্যসমূহ