অচেনা যাত্রী ১০/পৃষ্ঠাঃ১৫

মুক্তগদ্য
জোতজমিটাড়িবাড়ি
সুবীর সরকার

ধনীরাম হেঁটে আসছে এক অন্তহীনতা নিয়ে হাওড়হাওয়ার দিকে। নিশারাত্তিরের ছমছমে অনুভূতি জড়িয়ে মায়াময় হয়ে উঠতে চাওয়া পৃথিবীর অতিঘোর বিস্তারের বহতায় আকাশজোড়া মেঘের চলনবিচলন ও একাকীত্বের অসহাতায় তার কেমনতর হয়ে ওঠা জীবনের রহস্যকে মাঠের মধ্যে বাজিকরদের তাঁবুতে যৌথ কোলাহল সংগীতধ্বনিতে বিমনা হতে হতেও কীভাবে যেন টাল খাওয়া স্বপ্নগুলি বারবার জেগে উঠতে থাকে স্মৃতিকন্দরে। দূরের গাঁ-গঞ্জে তখন হিমস্তব্ধতা। কুকুরের ডাক। মিটমিট লম্ফআলো। বাঁশবাগানের ভিতর সাপখোপ ফিসফিস সংকেতভাষ্য। ধনীরাম দ্বিধাগ্রস্থতা থেকে সামান্য সরে এসে দ্রুতগামী হয়। মাথার তন্ত্রীতে জেগে থাকে ব্যাপারীপাইকার পেঁয়াজ হলুদ পুঁইপাতা টাড়িবাড়ির ধুলোমাখা মানুষজন। সব মিলিয়ে গমগম করে ওঠে যেন আস্ত একটা নাথুয়ার হাট। জঙ্গলঘেরা। চা-বাগান ঘেরা। ভূটান পাহাড়ের কোলঘেঁষা। হাট থেকে দু’কদম দূরে আঞ্চলিক নদী,বামনীঝোরা আর পিয়ারুদ্দিনের মহিষবাথান। পিয়ারু তার ইতিহাস ও আখ্যান মেখে জেগে উঠতে চায় স্পষ্টতর দিবালোকের মতো। বাথানের ভিতর মহিষের গলার ঘান্টি এবং আকালু বর্মণের গান যুগপৎ ভেসে ওঠে-‘ওরে বাথান বাথান/করেন মইশাল ও/ও মইশাল/বাথান কইচ্চেন বাড়ি/যুবা নারী ঘরত থুইয়া/কায় করে চাকিরি/মইশাল ও...'

গানের সুর আবহ শিল্পোর্ত্তীর্ণ হয়ে ওঠে কারণ ঘন্টির বাইজন যেন বাদ্যবাইজের ঢেউ ছড়িয়ে দেয়। রাত ঘন হয় ।ধনীরাম ঘাড়ের গামছায় মুখ মুছে বাড়ির সদরে উঠে আসে।



২।

জন্মজন্ম ধরে জন্মান্তর পেরিয়ে এভাবেই তো ধনীরামদের বাঁচা;বেঁচেবর্তে থাকা। ধনীরাম,ধনীরামের মতন করে এই আকাশবাতাসপরিধীর ভিতর অতিজীবিত করে ফেলতে থাকে যাপনটুকুন। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে কম্পনরেখাসূত্র ধরে কিংবদন্তি থেকে খুঁজে আনতে থাকে লোককথার দর্শনদর্পণ কাজলটানা এক সময়পরব। যেখানে স্বাদু জলের আঞ্চলিক মাছেরা ঘাই মারে। জালুয়ার জাল ফেটে বেরিয়ে যেতে চায় মহাশোল। পূজাবাড়ির উৎসবমুখরতায় স্তব্ধতা এনে দেয় জঙ্গলের প্রসারতা থেকে ছলকে আসা একুশ হাতির দঙ্গল।

          বিলপুখুরির শিথানে দেহতত্বের আখড়া বসায় অধিকারি। জোড়শিমুলের ডালে ডালে স্পন্দন তোলে গানের সেই বিষাদসুরটুকু_'একবার হরি বলো মন রসনা/মানব দেহাটার/ গৈরব কৈর না... '

           জীবনের সহজ প্রশ্নসমুহ কি ধনীরামকে বিচলিত করে? না কি জায়মানতা থাকে না কোথাও, তবু জায়মান মাঠপ্রান্তরের ভিতর হালবলদগরু নিয়ে নেমে গিয়ে হলকর্ষণে মেতে ওঠা। ৪০/৫০ শরত হেমন্তের আগেকার দিনগুলির মায়ামেদুরতায় আচ্ছন্ন হতে হতে ধনীরামের স্মৃতিঝিল্লিতে ভেসে ওঠে পিরডাঙ্গার সাজুবিল-এ ‘বাহপরব’, মাছ ধরার উৎসব। জোতদারের খোলানে ধান লুঠের মেলামিছিল। নুরুদ্দিন জোতদারের খুটার বন্দুকের সে কি বিক্রম! বিগত সব দিনগুলি আগিলা মানষিলা সব কেমন হাওয়া! উধাও।ধনীরাম বিষাদগ্রস্থতা থেকে বেরিয়ে আসতে না চাইলেও জীবন তাকে বাধ্যতই এই চিরসত্য দার্শনিকতায় একপ্রকার পৌঁছেই যেন দেয়।


৩।

এইভাবে একপর্বে গানমাস্টার কিংবদন্তির মতো হয়ে ওঠে। হারাতে হয় নিজনাম। তার গান, গায়নভঙ্গি কণ্ঠের জাদু তাকে লোকপ্রিয় করে তলে। উত্তীর্ণ হয় গানমাস্টারে। গৌরিপুরের রাজার বেটি নিহারবালার ডাকে সে ঘুরে বেড়ায় গৌরিপুর আভয়াপুরি গদাধরের ভূগোলে ভূগোলে । কত গান কত বাদক গিদাল লোক মানুষের উত্তাপ তাকে অঙ্গে মাখতে হয়। সে সব বড়ো যুদ্ধের সময়কালের। ঐ যেবার বোমা পড়ল। হিটলারের নাম প্রথম যেবার শুনল গানমাস্টার। আর গরুর গাড়ির নিচে শীত রাতের লণ্ঠন দোলে ভয় ও ত্রাসে। ‘মানসীর বাড়িত মানসী নাই সুকান দিঘিত পানিনাই’ ।



৪।

এইভাবে একটানা আমাকে শুনে ফেলতে হয় আখোড়টি। গানমাস্টারের গল্পটি।  ১৯৪৫ এর পৃথিবী ২০১৩ তে এসে থমকে দাড়ায়। তখন টাড়িবাড়ি বাতাস আকাশ রাজাজোতদার শিকারটিকার দোতরাসারিন্দার দীর্ঘ পরিভ্রমণ সাঙ্গ হতে না চাইলেও ইতিহাসপুরাণকে নুতনভাবে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস সচেতনভাবেই জারি থাকে। দূরের মাঠ নদী থেকে হাওয়া আসে। হাওয়ায় জাগে শত শেয়ালের ডাক। মাঘনিশিথের কোকিল। জিনপরিময় সময়ক্রম। সব কিছু না সরিয়েও বুঝে নিতে পারি কোথাও বিনির্মিত হচ্ছে নিম্নবর্গীওদের ইতিহাস,যার ভিতর বাদ্য বাজাতে বাজাতে হেঁটে আসছেন আমোদিত এক গানমাস্টার।


৫।

গান গান করিয়া সর্বনাশ/ তবু না মেটে গানের হাউস খুব বেশি শীত। খীব জাড় বাহে। হাড়ের ভিতর সেঁধিয়ে যায় আলতাফ করাতী। কুয়াশা দলা দলা। অগুণতি পাখিরা কুয়াশাবাড়ির দিকে। শূন্য সব মাঠে মাঠে শিশিরশব্দ। কোথাও কি যাওয়ার থাকে মানুষের? পাখির ডানার নিচে হেঁটে যেতে যেতে স্মৃতিতাড়িত এক যাপনই সামনে এসে পড়ে বুঝি। শীতের রহস্যময় রাতগুলি যেন না ফুরোতে চাওয়া কীসসাগাথা। অনেকানেক প্রান্তরের জেগে থাকা গানবাড়িগুলি তাকে প্ররোচিত করলেই আমোদিত হবার বহুবর্ণ উপাদান সমেত সম্পন্নতায় আশ্চর্য মিশে যায় কুয়াশাঘেরা চাঁদের আলোর খদলে। এত এতর ফাঁকে কখন দোতরাবাহিত ঢোল বাঁশি,সারিন্দাবাহিত জীবনযাপন নিয়েই কখন ধনীবাড়ির খোলানে এসে দাঁড়ায় গানমাস্টার ছায়াময় মায়াময় সব দোহার বাদকবৃন্দ সমেতঃ ‘মাছমারেমাছুয়াদোলাবারিতহালুয়া।'



৬।

চার পাঁচ কুড়ির মাঝামাঝি বয়সের গানমাস্টার ভুলে গেছে তার নিজনাম। ৮/৯ বয়স থেকেই বাপের বাপ চন্দ্রকান্ত অধিকারীর সঙ্গে সঙ্গেই গানের দলে কেবল ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কখন যৌবন এসে গিয়েছিল, তারপর বাপ ধনকান্তর দলের মূল গিদাল হল সে। বাপের বাপ চন্দ্রকান্ত খুব ভালবাসতেন এই নাতিটিকে। চন্দ্রকান্তই তার দীক্ষাগুরু শিক্ষাগুরু। চন্দ্রকান্ত তাকে জীবন শিখিয়েছেন। চিনিয়েছেন। গানের তত্ত্বতালা মনোশিখন শিখিয়েছেন;বুঝতে শিখিয়েছেন--লোকগান হল সাধনা,জীবনবন্দনা। সেই থেকে দিনকাল পেরিয়ে দেশাচার লোকাচার গঞ্জ মানুষ নদীদিঘি মেলামহোতসব ছুঁয়ে ছুঁয়ে চন্দ্রকান্তর বড়োবেটার বড়োবেটা রতিকান্ত নাম হারিয়ে মাইল মাইল জঙ্গলজনপদ হাওড় হাওয়ার এক পৃথিবীর গানমাস্টার। যার গানে যার বাদ্য বাজনায় অতিপ্রাকৃত পাখিরা, মানুষেরা চিরকালীন হয়ে যেতে থাকে। রসিয়া বসাইছে ফান্দ বানিয়া বসাইছে ফান্দ ৩৮। সে কবেকার কথা। ব্রিটিশ আমল। চারদিকে কত কত জোতদার। পুবে জয়নাব মুন্সি খামারু জোতদার সরকারবাবু ফণিমোহন তো উত্তরে ঢোল দেওয়ানি খগেন বসুনিয়া হাতি জোতদার। নিজ চোখে কতবার দেখা হাতির পিঠেতে চড়ি জোতদারের গমনাগমন। ভবতারণ ধনীর বাড়িতে রাসযাত্রা হত। পালোয়ানি কুস্তির লড়াই কুশান যাত্রা দোতারা পালার আসর,সে এক ধুন্ধুমার ব্যাপার। একবার রানিরহাটের এক গানবাড়িতে সে দেখেছিল কোচবিহারের এক রানিকে।পাতলাখাওয়ার জঙ্গল থেকে চিতা বাঘ বেরিয়ে আসতো মাঝে মাঝে। ও ছিল কোচবিহার রাজার রিজার্ভ ফরেস্ট।।গানমাস্টার একবার রাজাদিঘির খেলার মাঠে পালা গাইতে গিয়েছিল। রাতভর পালা শেষ করে ফিরে আসার পথে দেখেছিল হাতির জুলুস আসছে। বাজনা বাজছে। পথের দু'পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মানুষেরা। জানাগেল মহারাজা আসছেন শিকারক্যাম্পে । একঝলক দেখেওছিল বুঝি রাজাবাহাদুরকে!




৭।

দিনদুনিয়ায় দেশকালের ওপর কখন যেন আন্ধার নেমে আসে। লম্ফ জ্বলে ওঠে কচুঝোপে জোনাকআলোর জোনাই। ধল্লা নদীর চরে কাশিয়াবাড়িতে শেয়ালেরা ডেকে ওঠে। পাকশালে আন্ধনঘরত রেহেনা খালার তৎপরতা শুরু হয়। দাওয়ায় বসে তামাক টানে ইদ্রিশ মোল্লা। তামাকের রসে পুরুষ্টু হতে থাকে শরীরমন। অর্ধচেতনায় তখন জোতজমি কাকিন্যার বড়োবিল নীলসাগর রসুনভাজার গন্ধ। নিকাহের খোয়াব ভাসতে থাকে। একসময় খোয়াব ভাঙেও রেহেনা খালার গুনগুন বিয়ের গীতের টানা সুরের লহরীতে। জোতজমির মতো জোতজমি পড়ে থাকে আর চারপাশে কেবল আহাজারি। রুহের জন্য মাগ ফেরাত।



৮।
‘হাড়িত নাই ভাত
মাথাত দিনু হাত’

বনাঞ্চল চরাঞ্চল-এর ভিতর হাওড় বিল কুড়া দহের ভিতর উদ্দেশ্যহীন অনিবার্যতায় নৌকো ও মাঝির সম্পর্কের মতন দোতরা ও গীদালের সখ্যতার মতন জীবন সংকোচনপ্রসারনের ধন্ধধোঁয়ায় ফাঁকা ফসলহীন শীতমাঠে নেমে এসেও নির্জনতা খুঁজতে গিয়ে চিরকালীন বিষাদ নিয়ে জেগে উঠতে থাকে শোক ও শ্লোকবাহিত। ধান কাটার মরসুমে কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলার অপরূপ দৃশ্যসুখ স্মৃতিতে বহন করতে থাকা রূপকান্ত অধিকারী তখন ঘুমের ভিতর পাশ ফেরে আর বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকে বাওকুমটা বাতাসের যত গান। গল্পের পাকে পাকে জড়িয়ে যাবার মতন।


মন্তব্যসমূহ