অচেনা যাত্রী ১০/পৃষ্ঠাঃ১৯

 প্রবন্ধঃ৪          আবুল বাশারের কথাসাহিত্যঃ মুসলিম নারী জীবনের বেদনার কথামালা        
                                                         অনুপম সরকার

               মুসলিম মেয়েরা যে সমস্ত সমস্যাগুলি নিয়ে এখনও ব্যাপকভাবে বিপন্ন সেগুলি হল,শিক্ষার পথে ধর্মীয় ফতোয়ার বাধা, বিধিনিষেধের বেড়াজালে বিজড়িত পর্দাপ্রথা, বিবাহ সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা ,স্বপত্নী সমস্যা, তালাক প্রথার ব্যাপক উৎপীড়ন এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্ন। এগুলি বিচ্ছিন্ন ভাবে সংবাদপত্রের পাতায় মাঝে মধ্যে উপস্থিত হয় ঠিকই, কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই সবকটি  সমস্যার অভিঘাত  ঠিক কতখানি গভীর তার পরিচয় মেলা ভার। শরিয়তি  বিধানের গোলাপে মুড়িয়ে অন্তঃসারশূন্য, মানবতাবিরোধী ফতোয়া জারি করে মুসলিম নারীদের পথ চলার বিভিন্ন দিককে কণ্টকাকীর্ণ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষিত মুসলমান সমাজই ঐ ফতোয়ার যুক্তিহীন চরিত্রটিকে উদঘাটন করছে। শুধু মুসলিম নারীরাই নয়, বিভিন্ন শিক্ষিত মুসলিম পুরুষেরাও চায় যে মুসলিম নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। আরব সমাজের এক ক্রান্তিকালীন  প্রেক্ষাপটে যে ইসলামি আইন প্রবর্তিত হয়েছিল, উনবিংশ-বিংশ শতকের মুসলিম নারীর কাছে সে আইন কতটা জীবনমুখী সেই  প্রশ্ন  এখন সবার কাছে। মুসলিম  পিতৃতন্ত্র রচিত আইন ইচ্ছেখুশি মতো ব্যবহৃত হচ্ছে স্বার্থ অনুযায়ী, যেটা  নারীস্বার্থ বিরোধী। সমাজজীবনে  ঘটে যাওয়া এইসব সত্যতা ফুটে উঠেছে আবুল বাশারের কথাসাহিত্যে।
            ইসলামি আইনের প্রচলিত প্রয়োগে সভ্য শিক্ষিত মন কতটা রক্তাক্ত হয়, তারই বাস্তব অভিজ্ঞতাপুষ্ট আখ্যান আবুল বাশারের ফুলবউ উপন্যাসটি। উপন্যাসটিতে দেখি  নায়ক মিল্লাতের বাবা সীতাহাটি গ্রামের অবস্থাপন্ন হাজি নিসার হোসেন। তার তিন স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্বেও তিনি চতুর্থবার বিয়ে করেন, কারণ ইসলামি  আইনে চার স্ত্রী রাখার স্বীকৃতি আছে। তিনি চতুর্থবার তাকেই বিয়ে করেন  যাকে তার অন্য স্ত্রী তার সন্তান মিল্লাতের জন্য মনোনীত করে রেখেছিলেন। নিসার হোসেনের এই বিবাহের কদর্যতা  তার পরিবারের মধ্যে ধরা পড়েছে- তার এক পক্ষের কন্যা নবীনা ও অন্য পক্ষের কলেজে পড়া ছেলে মিল্লাতের মধ্যে। মুসলিম আইনকে কীভাবে কাজে লাগায় বিকৃতমনা এই ফতোয়াবাজেরা তারও চিত্র আমরা দেখতে পাই এই উপন্যাসে---
 "নিসার হোসেন প্রথম মাবুদকে দিয়ে বড়গিন্নির কাছে তার চতুর্থ বিবাহের সদিচ্ছা প্রকাশ করলেন। কারণ আরো দুটি বিবাহ তিনি এইভাবেই প্রথমা পত্নীর স্বীকৃতি নিয়েই সম্পন্ন করেছেন। এ ক্ষেত্রে না করার মতো সাহস প্রথমা পত্নীর নেই।  কখনো  কোন পত্নীরই থাকে? নবীর সুন্নতে হস্তক্ষেপ করার ধর্ম বিরুদ্ধ   মনস্কামনা  থাকতে নেই । সেকথা নিসার হোসেন জানতেন। তথাপি যেন  তিনি প্রথম স্ত্রীর কাছে প্রশ্রয়  চাইছেন এমন একটা নিরীহ ভাব করতেন। প্রথমা পত্নী সকলকে ডেকে হাজী সাহেবের  সদিচ্ছার কথা জানালেন। সকলেই শুনল কেউ কোন কথা না বলে চুপচাপ নিঃশব্দে উঠে চলে গেল।"( পৃঃ৩৫)
             অর্থের প্রাচুর্য আর ইসলামি পিতৃতন্ত্রের দাপটে নিসার হোসেনের মন "চারটে বিয়েই চায়। সেই বিয়েতে যে মেয়ের কষ্ট হয় না, নবীর কৃপায় তেমন মেয়ের আকাল হয়নি।"(পৃঃ৩৭)। অর্থের জোর আর ধর্মের সমর্থনে লেখাপড়া জানা দরিদ্র ষোড়শী রাজিয়াকে বৃদ্ধ নিসার হোসেন তার অমতেই তাকে বিয়ে করে ফেললেন। কবুল বলতে সে বাধ্য হয়েছিল বাহ্যিক চাপে । অন্তরের স্বীকৃতি ছিল না। তবুও এটাও ইসলামিক আইনসম্মত চুক্তিবদ্ধ বিবাহ। যে বিবাহের আধুনিকতার মুসলিম ধর্ম ব্যবসায়ীদেরও কোনো কড়া নজর চোখে পড়ে না। তাদের ফতোয়া জারির পিছনেও আর্থিক প্রেক্ষাপট কাজ করে । তাই নিসার হোসেনরা অনৈতিক কাজ করলেও ধর্মীও বিধান তাদের পক্ষেই রায় দেয়। অসম্মতির বিয়ে যা মিল্লাতের কাছে আদৌ বিয়ে নয়, এমন বিয়ের পর রাজিয়া যৌন সম্পর্ক গড়তে না দেওয়ায় স্বামী নিসার হোসেন তার কনুই পুড়িয়ে দেয়। আর স্বমীকে যৌন অতৃপ্ত রাখার কারণে ধর্মীয় বিধানে রাজিয়া হয়ে যায় পাপী। ফুলবউ উপন্যাসে রাজিয়া নামাজ পড়ে শুনে মুসলিম  ধর্মের  সংস্কারবাদী রিয়াজ মিল্লাতকে বলে,"আমার মনে হয়, মুসলমান পুরুষের তুলনায় মুসলমান মেয়েরা বেশি নামাজ পড়ে। কেন পড়ে বলতে পারবে মিল্লাত? ভাববার মতন কথা। অথচ মেয়েরাই বেশি দিজখ জাবে। হাদীসের কথা। পুরুষের  তুলনায় নারীরাই অধিক  দোজখী।"(পৃঃ৮৩) রাজিয়া নামাজ পড়লেও  সে চরম পাপী। সে স্বামীর ইচ্ছা পূরণ করেনি। স্বামীর কাছে সে খালাস পায় নি। এই উপন্যাসে আর একটি চরিত্র  নবীনাও এই অত্যাচারের স্বীকার। মুসলিম আইনকে কীভাবে কাজে লাগায় ক্ষমতাবাদী পুরুষতন্ত্র।
   নিসার হোসেনের মতো লোকেরা নবীর সমাজের সমর্থনে ইসলামি আইনের জোরে  একালে বসেও চার স্ত্রী রাখতে পারে । আর ধর্মের চাবুকে তার সমর্থনও আদায় করে নেয় অন্য স্ত্রীদের কাছে। কিন্তু ইসলামি আইনের এমন কদর্যর প্রয়োগের সঙ্গে আপস করতে পারে না সভ্য সচেতন মনগুলি। তাই সারা উপন্যাস জুড়ে লড়াই চলে ধর্মের মুখোশধারী  স্বার্থসিদ্ধিকারীদের সঙ্গে যুক্তিবাদীদের।

               আবুল বাশারের অন্য আরেকটি উপন্যাস "ধর্মের  গ্রহণ"-এও দেখি মুসলিম আইনকে ব্যবহৃত হতে। উপন্যাসে দেখি নাস্তিক বেলালের সাথে কোরাণ পাঠের মধ্য দিয়ে পবিত্র নাজনিনের বিয়ে হয়। এই বিয়ের পর  সব জটিলতা বাড়ে। নাজনিন তাকে ছুঁতে দেয় না। কারণ তার কাছে বেলাল অপবিত্র। বেলাল নাস্তিক হলেও এক সময় এই আইনকে ব্যবহৃত করেছে  নিজের স্বার্থে। দুজন  স্ত্রী-পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্ক কীভাবে  ধর্মের  গ্রহণে কলুষুত হয়ে যায়  তারই প্রমাণ এই উপন্যাসটিতে।
                 আবুল বাশার তার ছোটোগল্পেও মুসলিম নারীদের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেছেন। তার 'সীমার' গল্পটিতে দেখি আবুল   বাশার  সুখবাসের দাম্পত্যজীবনকে অবলম্বন করে মুসলিম সমাজের অন্তঃপুরে  ঢুকে গেছেন। পুরুষের স্বার্থন্ধতা আর কুসংস্কারাচ্ছন্নতার বলি জাহেদা ও মদিনা। আজন্মলালিত শিক্ষার সহনশীলতায় জাহেদা মৃত্যুর কাছে মাথা  নোয়ায়, আইনের বিকৃতিতে মদিনা  ঘর হারায়। রাগের মুহূর্তে গালাগালির মতো তালাক শব্দ ব্যবহার করে সুখবাস বিপদে পড়ে। জাহেদা, মদিনা, সুখবাস, ঈসা, গিয়াস, মৌলবি ও অন্যান্য চরিত্ররা মুসলিম গ্রামজীবনের চলমান ছবি। এরা লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার ছাঁকনিতে ধরা পড়ে 'সীমার' গল্পে আশ্রয় নিয়েছে। 'নাস্তিক' গল্পেও  আমরা দেখি এই আইনকে কীভাবে পুরুষেরা নারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। যে মানুষ ধর্মকে বিশ্বাস করে না সে যখন স্বার্থ ও সুযোগ পেল তখন সেও হয়ে উঠল  মুসলমান। মুসলিম আইনকে ব্যবহার করে কীভাবে ফতোয়াধারীরা নারীকে ও তার নারীত্বকে করে অপমান। এই গল্পে আমরা তাও দেখতে পাই। আবুল বাশার 'এক টুকরো চিঠি' গল্পেও মুসলিম সমাজের তালাকের জটিলতায় নারী হননের কাহিনী শুনিয়েছেন লেখক। এই গল্পের চরিত্ররা সঙ্কীর্ণতার গণ্ডি কেটে স্বচ্ছ আলোয় পথ খুঁজতে চেয়েছে তারা,  কিন্তু সমাজের অবস্থান তারা বদলাতেই  পারেনি। গল্পেও গণ্ডি কেটে আমরা তারই সুর শুনতে পাই---"আমার হাতের মুঠোয় সেই মারাত্মক  চিঠি নিঃশব্দে পড়ে রইল প্রতিবাদহীন। (পৃঃ১৪২)
             লেখক আবুল বাশার আমাদের দেশে মুসলিম সমাজের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকেই উপস্থিত করেছেন তার  কথাসাহিত্যে। চাবুক চালিয়েছেন মুসলিম পিতৃতন্ত্রের একচেটিয়া ক্ষমতা অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে। নতুন দিগন্ত খুলে দেওয়ার সরবটায় তিনি উচ্চকিত হয়েছেন।

মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
দারুণ... দারুণ... " লেখক আবুল বাশার আমাদের দেশে মুসলিম সমাজের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকেই উপস্থিত করেছেন তার কথাসাহিত্যে। চাবুক চালিয়েছেন মুসলিম পিতৃতন্ত্রের একচেটিয়া ক্ষমতা অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে। "