অচেনা যাত্রী ১০/পৃষ্ঠাঃ১৪

বইপত্তর
সুবীর সরকারের সেপ্টেম্বরের পৃথিবী
মাসুদাররহমান

         কাঁটাতারের ওপারে বাংলা ভাষাভাষিদের আর একটি স্বদেশ রয়েছে; ভাষা যাপনের ভেতরেই তাকে অনুভব করেন আমাদের এপার বাংলার (বাংলাদেশের) পাঠক। রাজনৈতিক সীমারেখা ও বাধ্য বাধকতার কারণে হয়তো তাঁদের ভাষাযাপন বা সৃষ্ট  সাহিত্যকর্ম সহজলভ্য নয় অনেক ক্ষেত্রে। তারপরেও অগ্রহ ও প্রাপ্তিচেষ্টার জোয়ার উজানগামী হয়। ফলত ওপার বাংলার অনেক সাহিত্যকর্মই পৌঁছে যায় আগ্রহী পাঠকের পাঠ নাগালে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ওপার বাংলার যে সব কবিদের কবিতা আমার সর্বাধিক পাঠ আওতায় এসেছে তার মধ্যে কবি সুবীর সরকারের নাম নিঃসন্দেহে বলা যায় অন্যতম। বলা যায় সুবীরের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের অদ্য-প্রান্ত আমার পাঠে আছে। আজ বিকেল নাগাদ ওর সর্বশেষ প্রকাশিত দুখানা গ্রন্থ আমার হাতে এল। তাঁর একটি ‘সেপ্টেম্বরের পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থটি। 'এখন বাংলা' কবিতার কাগজ-এর উদ্যগে প্রকাশিত, জলপাইগুড়ি-৭৩১০১ থেকে। বইটির অসামান্য প্রচ্ছদ এঁকেছেন সুবীরের সমসাময়িক আর এক কবি অতনু বন্দোপধ্যায়।  এই কাব্য গ্রন্থটি হাতে পেয়ে পাঠক হিসেবে তাৎক্ষণিক যা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাই জানাচ্ছি।

         কত কম কথা ব্যয় করে পাঠককে কাব্যরস পৌঁছে দেওয়া যায় সুবীর তা জানে। উদহারণ টেনে অনেক বলা যায় । এতো বিশদ ও বিস্তারিততে না গিয়ে ওঁর ‘সেপ্টেম্বরের পৃথিবী’ ১৪ সংখ্যক কবিতার ২/৩টি পংক্তি পাঠে আসি- ‘সব বেশামাল হয়ে পড়ে/ খরাবন্যার দেশে ভাঙা/ ঢোল...’ এখানে ঢোল একটি প্রতীকবাদ্য উৎপাদনকারী, যা দ্বারা আনন্দধ্বনিত হয়। যেখানে কৃষিজীবী মানুষের কৃষিই বেঁচে থাকার অবলম্বণ, সে সমাজে বা রাষ্ট্রে খরাবন্যা অভিশাপের মতো। কৃষকের কখনো তা কাম্য নয়তা কবির ভাষায় ‘সব বেশামাল হয়ে পড়ে’। সুবীরের কবিতায় ঘুরেফিরে নয়; বলবো সর্বতভাবেই এই ভূখণ্ডের প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবীকা তাদের হর্ষ-উৎফুল্লতা বিষাদকেই ধরে তুলেছে। তবে তা কেমন এক ধোঁয়াশা ও কুয়াশা মিশিয়ে। আসলে যা এক শৈল্পিক ভার্সান এবং তা একান্ত সুবীরের। আবারও উদ্ধৃতি-‘সিরিয়াল থেকে মাঠে নামছে চাষিভাই’ ( সেপ্টেম্বরের পৃথিবী,এক সংখ্যক কবিতা)জীবনের চলমানতা বা মুভমেন্টের এক দার্শনিক অভিজ্ঞতা সুবীর ব্যক্ত করেন-‘সাঁতার কাটতে ভালোবাসো, ভালো/ কথা/দু’দণ্ড বিশ্রাম।/বারণ স্বত্বেও অনবদ্য/ স্টাইল’ (কবিতা সংখ্যা-পনেরো)। এই দার্শনিক অভিজ্ঞতা এবং ঋজু কাব্য উচ্চারণ এর চেয়ে আর কি হতে পারে!

        একজন তরুণ যখন লিখতে আসেন তাঁর চারপাশে অগ্রজ ও সতীর্থরা তাকে শেখাতে থাকেন কবিতা কি! তাতে করে ‘কবিতা কি’ এই ধারণার উপরে অন্যের প্রভাব জন্মাতেই পারে, আবার নাও পারে। কবি হিসেবে সুবীরেরও  ‘সেপ্টেম্বরের পৃথিবী’ পর্যন্ত এতটা পথ হেঁটে এসে স্পষ্ট একটি কাব্য ভাবনা তৈরি হয়েছে, আমরা ভাবতেই পারি। ওর কবিতা পড়ে বলা যায় ওর কাব্য ভাবনা অনেকটাই স্বাতন্ত্র্য এবং নিজস্বতায় স্বকীয়। ‘সেপ্টেম্বরের পৃথিবী’ এই কাব্যগ্রন্থ থেকেও আমরা খুঁজে পাই এমনতর ভাবনার নানা ডাইমেনশন। লক্ষ্যনীয় সতের সংখ্যক কবিতা- ‘আবেগের কোন ব্যাখ্যা হয়/ না/ ঝুঁকে পড়েছে গ্যালারি/ হাততালিহীন বেশ আছি’কিংবা উনিশ সংখ্যক কবিতাটি- ‘চুপিসারে শুরু হওয়া বৃষ্টি/ ভিজে চুলোয় কাঠ-গুঁগজতে গুঁজতে/ গান/ দ্রুত হাঁটছে বাক্যবন্ধ।...শৈলি ও প্রকরণ নিয়ে দোলাচলে/ আছি’সুবীরের কবিতার আরও একটি বিষয় ব্ল্যাকনেস্, আদিম ও অন্ধকারময় জগৎ বা সেই জগৎ-এর আভাস। যার প্রতীক হিসেবে আদিমগুহা, মশাল, বল্লম হাতে মানুষ,তীরধনুক, পশুপালনচাষবাস এনেছে সুবীরওর সেপ্টেম্বরের পৃথিবী পাঠেও এমন অভিজ্ঞতা লাভ করবেন পাঠক। পাঠক হিসেবে সুবীরের কবিতায় উপকথার প্রদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও পাই। ‘তিন বুড়ি গোল হয়ে নাচে’। কিংবা ‘শুনছি ডাইনির গল্প/ কিন্তু মিউজি-এর/ পোকা’ এই উদ্ধৃতিগুলো ‘সেপ্টেম্বরের পৃথিবী’ থেকেই।

              সেপ্টেম্বরের প্রকৃতির মতো শান্ত সিগ্ধ উজ্জ্বল ও রহস্যপ্রবণ কিছু পংক্তি ‘সেপ্টেম্বরের পৃথিবী’ থেকেই তুলে দেওয়া যায়।

‘কেউ কোথাও নেই। বিস্তর হাসির পর / শান্ত/ পৃথিবী’-( পঁচিশ সংখ্যক কবিতা)

‘পুরনো বাড়িতে পালক পড়ে আছে/ গোধুলি মায়ায়/ ডুমুর গাছ’- (সাতাশ সংখ্যক কবিতা)
‘সিঁড়িতে বিকেল ঘুমায়। ঘাট/ উদাসীন’ (চৌত্রিশ সংখ্যক কবিতা)

‘আপাতত নিরাপদ হাড়িয়া ম্যাঘের/নিচে/ভুবনমায়ার আলো/অপলক জলাশয়/সেপ্টেম্বরের পৃথিবীতে উজান দ্যাশের/পাখি’ (দশ সংখ্যক কবিতা)

‘অনেক দূরে চলে যাব, আর ফিরবো না/ পুরনো দিনের চশমায় বেশ দেখাবে/.../লক্ষ করেছো অদ্ভূত মিল!/.../ আওয়াজ ভরা সেপ্টেম্বর। বাইরে খেতে/যাই।‘ (তিন সংখ্যক কবিতা) 

       সেপ্টেম্বর এক আশ্চার্যতম প্রকৃতি ও মায়া বিছিয়ে আসে এই অখণ্ড বঙ্গভূমির উত্তরখণ্ডে  (যেখানে কবি সুবীর সরকারের আজীবন বসবাস)।   তখন প্রচণ্ড দাবাদাহ ও বর্ষা শেষ। ক্ষয়ে ধরা মেঘমালা আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া। উজ্জ্বল বর্ণের রোদ অতচ তার ঝাঁঝালো ভাবটি কমে এসে সিন্ধ রূপ নেয় এবং  রহস্য ও মায়াময় এই ‘সেপ্টেম্বরের পৃথিবী’কবি সুবীর সরকারের কবিতার পৃথিবী।



বইপত্তর// উৎসবমুখর রায়চৌধুরী

ঘুমন্ত পৃথিবীর রেপ্লিকা
সৈকত ঘোষ
অভিযান পাবলিশার্স
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণঃ সুব্রত সাহা
ISBN- 978-81-80197-30-5
মূল্য- ৭৫/-

বইটির  প্রায় সব কটি কবিতাই খুব সুন্দর। কবি লিখছেন, “ আঁশটে মাছেদের পাখনার ভেতরে / তিন কোনা পৃথিবী থাকে...” অথবা ,  “মুখটা ঝাপসা হলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় / ঘুমন্ত পৃথিবীর রেপ্লিকা...”  কিংবা, “ যৌগিকস্বর আসলে মেটামরফসিস...” চুড়ান্ত অনুভূতির থেকে উঠে এসেছে কবিতাগুলি । বইটি সুপাঠ্য। আশা জাগায়। আবার ধরেও রাখে।



২৬ অক্টোবর
সঞ্জয় ঋষি
সুতরাং প্রকাশনী
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণঃসঞ্জয় ঋষি
মূল্য- ২৫/-
কবি বইটি চমকপ্রদ ভাবে উৎসর্গ করেছেন ছোট্ট একটি কবিতা দিয়ে,“যতগুলো প্রশ্ন আছে কবিতায়/ সেই উত্তরের মতো ভালো থাকুক/ কাব্যদেবী”। বইয়ের  পাতায় পাতায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে।“এই রাত জেগে তুমি কী করো? / গান শুনি।/মোরগফুলের রঙ নিয়ে আঁকিবুকি/এই সব ২৬ অক্টোবর...” ।কবি তাঁর বইয়ের কভার পেজ-এর পেছনে লিখছেন,“ মা বলেন, মেয়েরা ভালবাসতে বাসতে /মা হয়ে যায়।” বাঃ!





বিশল্যকরণী
নীহার চক্রবর্তী
সুতরাং প্রকাশনী
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণঃ সঞ্জয় ঋষি
মুল্য- ৫০/-
জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে সমস্ত কবিতাগুলি।“ মিথ্যাগুলো কি সুন্দর নেচে যায়...”। আবার কখনো কবি বলছেন, “রাতের সব কথা বুঝি/আমি দুখিনীর অবাক সন্তান”। এক জায়গায় কবি তাঁর চরম উপলব্ধি থেকে লিখছেন, “ প্রকৃত বন্ধুত্ব বটবৃক্ষের মতো/ যেখনে ক্লান্ত ভগবানও বিশ্রাম নেন।”


শরীর শরীর আলো
অমিতাভ দাস
সুতরাং প্রকাশনী
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণঃ অমিতাভ দাস
মূল্য- ৩৫/-
কবি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন উৎসর্গে । বইটি দু'পর্যায়ে ভাগ করেছেন। একটি 'হেমন্তের কবিতা', অপরটি 'নতুন কবিতা'। কবি ভালোবাসাকে “মরুধুলোর মতো” আখ্যায়িত করেছেন,  কোথাও 'পর্ণমোচী'-র সাথে আবার কখনথ'চন্দনকাঠ'-এর সাথে তুলনা করেছেন। আবার কোথাও নিজেকেই নতুন করে আবিষ্কারের কথা বলেছেন। চরম অনুভূতি থেকে কবি লিখছেন, “ এই হিমশীতল মৃত্যু বলো / আজ কার বুকে লিখি... হায় ঈশ্বর,/তোমার লুডোর চালে আমি /সামান্য পুট হয়ে আছি...”। বেশ লাগে কবিতাগুলো।




বুক ভর্তি তোফা  
শবরী শর্মারায়
সুতরাং প্রকাশনী
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণঃসঞ্জয় ঋষি
মুল্য- ৬০/-

 মোট ৭৪ টি কবিতা রয়েছে বইটিতে । টাটকা অনুভব থেকে উঠে এসেছে সমস্ত কবিতাগুলি।বেশ ভালো পঙক্তিতে ঠাসা বইটি,“ চুরি হয়ে গেছি/ চুরি হতেই আমার জন্ম/ সাদা,কালো,বাদামি রঙের চুড়ি...” বা ,“ দু’টি মেঘ/ আত্মীয় হচ্ছে/ মন্ত্র পড়ছে শূন্য...” । ভালো প্রোডাকশন।



মন্তব্যসমূহ