রঙ
সে আর ফেরে নি। যদিও অনেক দিন হল। ছোটু এখন
হাঁটতে পারে। মা মা বলতে পারে । বাতাসে শিমুল-পলাশের
মায়া এল। তবুও.....
তবু
অপেক্ষা। হয়তো গ্রামের পথের ধুলো ওড়াতে ওড়াতে আসবে সে। আবিরে আবিরে ভরে যাবে
গোটা এলাকা। লোকজন ছুটে আসবে ঘরবাড়ি থেকে।
নুনি
দাওয়ায় বসে। রঙ এল। চলে গেল। পান্নার পড়ে থাকা পিচকারি হাতে নিয়ে ছোটু খেলছিল।
সামান্য গোলা রঙ পড়ে আছে তাতে। নিষ্পাপ হাতের চাপে বেরিয়ে আসে। একটু খানি রঙ লেগে
যায় নুনির মুখে। ঠোঁটে। অমনি ছোটুকে জড়িয়ে ধরে। তুমুল ভাবে। মেঘ করে ছিল । এবারে
বৃষ্টি ঝরতে থাকে অঝোরে।
রিজারেকশান
অনির্বাণ
রতনপুর ফিরে এল প্রায় দু-দশক পর। যশোদার
চোখে ছানি । তবু স্নেহের ঘ্রাণে বৃষ্টি নেমে এল দু-চোখে।
বহুদিন পর।
পাশের বাড়িতেও ছানি। পা রাখতেই
নেপথ্যে বাঁশি বেজে ওঠে। ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে
থাকা সুখ-অসুখের অতীত উঠে এল। শ্রাবণ এল। ঝুলন এল।
রাধাকৃষ্ণ সাজা এল। গোপিনীরা এল। যমুনা এল। ঢেউ এল। সব সব উঠে এল এক করে। যেন
করোটীর গভীর গহিনে ইতঃস্তত হামাগুড়ি দেয় এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।
হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ছানিপড়া
বাড়ির আশ্রয়ে অনির্বাণ। শ্রাবণসুরে ভিজে গেল ঝোপঝাড়। দোলনা। রাধাকৃষ্ণ। গোপিনীরা।
যমুনার কিশোরী বুকে নামছে জলের ধারা। অবিরাম।
কমিটমেন্ট
মোবাইলটা টেবিলে রেখেই বাথরুমে
ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিল সুদীপা। ফিরে এল মিনিট দশেক পর। এর মধ্যেই সাত-সাতটা মিসড কল। তিনটে মেসেজ। ‘Happy Anniversary Mrs
Som’ ,‘Coming in the afternoon, darling!’ ও ‘Why late?’। মাঝেরটা সৃজিতের। রাতে পার্টি।
খুব চাপ। কল ব্যাক করল।
-হ্যালো।
অপর প্রান্তে কোনো কথা নেই। মুখে
একটা বিরক্তি ভাব। ‘Coming within an hour.’ সেন্ট হল। তোয়ালে সরিয়ে নাইটিটা
গলিয়ে নেয়। এসময় নীরবে ঘরখানি খোলা
বাতাসের মতো চোখ মেলে দেখে নেয় পলাশের
গহিন গহনে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা পরিযায়ী
পাখিদের মিহি আদরে লেখা এলোমেলো পান্ডুলিপির অবিরাম সন্তরণ।
নিজেকে এলিয়ে দিল সোফায়। হাতে
রিমোট। টিভিতে ঠান্ডা পানীয়র বিজ্ঞাপনে এক নব্য ভারতরত্ন । চেঞ্জ। সিরিয়াল। সিনেমা
। ক্রিকেট। ফিক্সড । সব ফিক্সড। পাতা ওলটানোর মতো এগিয়ে যায়। ডোরবেল বাজে। দরজা
খোলে। একজন ঢোকে। বসে। চা খায়। হাত দুটো এগিয়ে দেয়। পিছিয়ে নেয়। আবার চলেও যায়। সুদীপা আবার ফ্রেশ হতে ছোটে। টেবিলে
ফোনটা কেঁপে ওঠে। দু’বার। একাকী।
আড়ালে যিশুর শব
ভালোলাগেনা কিছুই। এই নদীনালা
গাছপালা ঝাউবন। বাউল মরে গেছে কবে । এখন
কেবল ভূতের চিৎকারে বেসামাল ঘাসবন। তবু
হাততালি। তুমিও এসেছো উত্তরীয় পরাতে। তুমিও ববচুল করেছো। তুমিও ক্লিভেজে শাসাচ্ছ
গোটাদেশ। অথবা রাতদুপুরে উড়ে যাচ্ছো ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো এপাশ থেকে ওপাশ। তুমিও...তুমিও..তুমিও....
আসলে এভাবে ভাবিনি। ভেবেছি
যুদ্ধের শেষে আমাদের একটা জমি হবে। ঘর হবে। স্লোগান ছেড়ে শুতে যাবো মাঝরাতে একসাথে। আমাদের ছেলেটা হামা দিতে দিতে শুয়ে পড়বে
মাঝখানে। তবু জেগে থাকবো। ঢের কথা এখনও যে বাকি। সূর্য উঠলেই একটা দিনের শব পড়ে থাকে
অবহেলায়। তার আগে। তার ঢের আগে আর
একটুখানি বেশি বাঁচা। একটুখানি ছুটে যাওয়া পাখিদের দেশে। নদী মরে ভূত। ঝাউবন মরে
ভূত। আমাদের ছোটোগ্রাম একেঁবেকে চলা ছোটোগ্রাম সব সব ! চারিদিকে কেবল মানুষ। ঝান্ডা হাতে ডান্ডা হাতে কিলবিল করা
মানুষ। তারাও মরে। তবুও মানুষ হয় না ভূত কখনও। ভয় পাই। কাঁপতে থাকি। নিজ হৃদয় উপড়ে
নিয়ে বেনেরা বসে আছে রাজপথে। আত্মাও। নিজ কঙ্কাল ঝুলিয়ে রেখে শিখছে
যোগবিয়োগ ধারাপাত। কখনও কবন্ধ জীবনে বাসা বাঁধে স্বপ্নের পাখি। লাফাই।ঝাপাই।
পাখিরাও ভয় পায়। উড়ে যার মহাকাশের বাইরে। জীবন , এক অদ্ভুত
জাগলার তবু! হাততালির নেশায়
আবারও নেমে পড়ে ঘাসবনে। ছানিপড়া চোখের মতো উঁইয়ের ঢিবি মাথায় নিয়ে একা একা
এগোতে থাকে। এদিকে কেবলই অনন্ত বসে থাকা। বসে থাকি। আমি। আমরা। কেউ উঠে আসবে শেষ
মহাভোজের আসরে । কেউ । কেউ ভীষণ একজন। আর
কফিন থেকে সহসা সটান লাফিয়ে উঠবো
আমি থেকে আমরা।
খোককস
একটা চুম্বন। একটা ঝোড়ো চুম্বন।
সবচেয়ে উঁচু গম্বুজের উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া একটা চুম্বন। শুধু তোমার জন্য। শুধু...শুধু...।তোমারই জন্য দেখ এতদূর হেঁটে
আসা। একটা বন একটা কাঁটাবন একটা রাত একটা
ঝড়ের রাত হেঁটে আসা। শুধু...
সহসা হাত থেকে পড়ে গেল! একটা কবিতা? একটা আত্মা? একটা চুম্বন? একটা ঝোড়ো চুম্বন? একটা...একটা...? কী ? কী?
তোমায় দেখি। নৃত্যরত। ময়ূরের সাথে। নববর্ষায়। আর তোমার বিশাল চুম্বন ক্রমশ ঢুকে
যাচ্ছে বৃষ্টির পেটে।
ডুব
চাঁদ ডুবে গেল। তবু চাঁদ জেগে । ব্যালকনিতে। একা। বড্ড একা।
২
রোহিতের নম্বরটা ডিলিট করে দেয়। কী হবে রেখে? তার আগে একটা মেসেজ। ভালো থেকো।
চলি।ইত্যাদি।
৩
আবার একা। এবারে সেও ডুব দেয়। ডু-উ-উ-উ-উ-উ-উ-উ-উ-উ--উ-ব!
কবি ও কবিতা
ফড়িংটা উড়তে উড়তে হারিয়ে গেল বাতাসের শরীরে। কচিঘাসের
মতো চেয়ে ছিল শুভ।সেদিকেই। হারিয়ে যাওয়া পথটা খুঁজে বেরায়।খুঁজতে খুঁজতে সেও
নিরুদ্দেশ।বসন্তের অরণ্যে। সেথা ফড়িং-যাপন
অন্য ফড়িংদের সাথে। ওড়ে। উড়তে উড়তে কবিতা হয়ে যায় শুভ।একটা সুদীর্ঘ কবিতা। পাকা
আমের মতো টস টস তার শরীর। টপ টপ করে রস
পড়ে। খেজুর রস।এখন ফড়িং শুভো আর কবিতা
সেন্ট্রাল পার্কে।চুমু খাচ্ছে।
মার্চ ইন দ্য হেল
তোমার মুখে থুঃ ! প্রেমিকা বলল।
তোর মুখে থুঃ ! মা বলল।
তোদের মুখে থুঃ! দেশবাসী বলল।
২
আসামী এগিয়ে এল ফাঁসিমঞ্চে। কালোকাপড়
মুখে। হাত বাঁধা। ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। মনে পড়ে সব। শিশুটিকে ছিনিয়ে নিচ্ছে লাল
কুকুরগুলো। মায়ের দো-ফসলি স্তনে এখনও তাঁর মুখ। ঝাঁপিরে পড়ল। ভাদরের চড়া রোদে পুড়ে গেল মোসানি। মাড়িহীন চোয়ালে লেগে থাকা দুধের সাথে মিশে
যাওয়া কান্না ও লালার মতো চিৎকার ওজোনস্ফিয়ার ভেদ করে ছুঁয়ে গেল চাঁদের বক্ষদেশ।
তবু.....।
এমন সময় অ্যালবার্ট গর্জে ওঠে। অমনি
লুটিয়ে পড়ে কুকুরগুলো। তাঁর উর্দিতে কেবলই রক্ত। দুগ্ধদাত্রী ততসময়ে শেষ। আর
শিশুটি লালায় লালায় ভয়ে গেছে। বুকে তুলে নেয়। জড়িয়ে ধরে। শিশুর মতো শিশুকেই। চুমু
খায়।
রুমাল নড়ে। শেষমেশ নিজেকেই নিজে
জড়িয়ে ধরে সাঁতারকাটে মহাশূন্যে। শান্ত ধ্যানস্থ মুনির মতো।
৩
কিছুদিন আগে আগুন্ডার ফাঁসি হয়। এক নৃশংস ধর্ষক। মোসানির
পথে পথে জ্বলে উঠেছিল মোমবাতি। 'খুনি
রাষ্ট্র নিপাত যাও।' বুদ্ধিজীবী শ্রমজীবী সব । আজ পথ সুনসান।
সবার মুখে ‘থুঃ’ !
৪
মর্গে এগারো বছর পড়ে থাকে। অবশেষে কিছু
কালো কুকুর একদিন অকস্মাৎ ঢুকে পড়ে। টেনে নিয়ে যায় একটা একটা করে। চিবিয়ে খায়।
৫
অবশেষে পাসপোর্ট পেয়ে অ্যালবার্ট চলে আসে। দ্যাখে লাল কুকুর তিনটে সোফায় বসে আছে। ল্যাজ নাড়ছে।
পাশে স্বয়ং ঈশ্বর ।
--আরে আসুন আসুন অ্যালবার্ট সাহেব।
আপনাকে আমরা সম্বর্ধনা দেবো, আসুন!
অ্যালবার্ট ডানে তাকায়। বায়ে তাকায়।
সবশেষে বলে, ‘থুঃ’ !
দাড়াঁশ
শরৎ এসে গেল। অথচ চড়া রোদ ভুলুকে
কিছুতেই ছুঁতে পারেনা। সারাদিন বেচারা কুঁই কুঁই করে কেঁদে মরে। এ কৃতিত্ব
নির্মলের। প্রকৃতপক্ষে বোস বাড়ির নির্মল পরিবেশের জন্য তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তবু এক গোপন হাহাকার ভেসে বেড়ায়
অন্দরমহলে। শ্রীলেখা আজ সাফ জানিয়ে দিল,ডাক্তার
দেখাও নয় আমাকে মুক্তি দাও,সুমিকে নিয়ে আমি কোথাও চলে যাই।
এভাবে আর কত দিন! অতএব চেম্বারে। ডাক্তার অনেক চেক-আপের পর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ইরেকশান
ডিসফাংশান! কিউরেবল। বাট টেক টাইম। এ ওঁর মুখ চায়। ফিরিয়ে
নেয়। শেষে পরাজিত খেলোয়াড়ের মতো ঘরে ফেরা।
২
গভীর রাত। চাঁদ আজ বড়ো বেশি একা।
ভুলু শুয়ে একপাশে। শুয়ে শুয়েই কুঁই কুঁই। ভুলুর কান্নাটা সমস্থ হৃদয়কে তছনছ করে
দেয়। নির্মল নেমে আসে। ধীরে ধীরে। ভুলুকে জড়িয়ে ধরে। অবশেষে বাধ ভাঙে। জলের তোড়ে
ভেসে যায় সব।
কফিনের ’পরে নীল মোম
যেন দু-জনমের মাঝে আটকে থাকা এসকেলেটরে দাঁড়িয়ে বিলকিস। মুখের রোদ সরে সরে যাচ্ছে। ক্রমশ। এই অবেলায়। বিকল বাতাসে
নৌকার পালের মতো নিষ্পলক তার দৃষ্টি। শরীর নুইয়ে পড়ছে বটের শাখার মতো। স্মার্টফোনে
আঙুল বুলিয়ে দেখে নিল অবস্থান। কী আশ্চর্য। ভুল।ভুল ভুল। সে ভুলের উপর দাঁড়িয়ে।
এতক্ষণ! অথচ সমীরণই বলেছিল 'Mark Hotel'–এর সামনেই। তার মানে সে ‘Unmarked’ ! রোদ চশমাটা
খুলতেই এক ঝাঁক ঝাঁঝালো তেতো রোদ এসে লাগে। সহসা রোদের বুক চিরে রহস্যময় মানুষের
মতো কেউ একজন এগিয়ে আসে। বলে,
--আপনিই বিলকিস?
--হ্যাঁ! কেন?
--সমীরণ পাঠালেন। নিন্।
লোকটা উধাহ। আর সে দাঁড়িয়ে বিলম্বিত বিষ্ময়ে। পা’দুটো ডুবে যায় চোরাবালির
ক্ষুধার্ত পেটে। কেবলই চেয়ে থাকে। ফ্যাল ফ্যাল করে। এক ফোঁটা তরল মুক্তোর
শরীর এসে ছুঁইয়ে যায়। আর গলে পড়ে বসন্তের ঘরবাড়ি।
মন্তব্যসমূহ