অচেনা যাত্রী~৮ (বসন্তের অরণ্য) ১ মার্চ,২০১৪

সূচিপত্র
সম্পাদকীয়ঃ
              ঠোঁটকাটা~অমিত কুমার বিশ্বাস
প্রিয় পাঠঃ 
            তীর্থঙ্কর মৈত্র ও অর্ঘ্য মন্ডল
কবিতাঃ
            সুবীর সরকার,ফকির ইলিয়াস,মাসুদ খান,অলক বিশ্বাস,
             বাবলু  রায়,পারু পারভিন, অরূপম  মাইতি,শূদ্রক উপাধ্যায়
ব্যক্তিগত গদ্যঃ
            নরসুন্দর~মাসুদার রহমান
            স্নান~কুমারেশ পাত্র
ছোটগল্পঃ
            ফোড়ন~দেবশ্রী ভট্টাচার্য
উড়োচিঠিঃ
            আলো ও অন্ধকার~ কুমারেশ পাত্র
বইমেলা ২০১৪-এর বইঃ
             ধানবাড়ি গানবাড়িঃস্বপ্নের বাইসাইকেলে আত্মার ওড়াউড়ি~অমিত কুমার বিশ্বাস
তবু লালনমনঃ
            "আর কতদূর পার হলে আমাদের বাড়ি?"~কুমারেশ পাত্র 
......................................................................
প্রচ্ছদঃবাবলু রায়, অলংকরণঃ'ধানবাড়ি গানবাড়ি' ও আন্তর্জাল থেকে( ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত নয়)
সম্পাদকঃঅমিত কুমার বিশ্বাস
----------------------------------------------------------------------------

                                               সম্পাদকীয়ঃঠোঁটকাটা

যুদ্ধ করিনা ।ভাবছো পারিনা । আসলে যুদ্ধের ফলাফলেই যে আতঙ্কিত ।ভীষণ ।তবু যুদ্ধ অনিবার্য ।পাঞ্চজন্য  উঠেছে বেজে । দিকে দিকে ।অনুষঙ্গে 'বিশ্বরূপ' প্রদর্শন ।অগত্যা গান্ডীব দিবানিদ্রা দেবে কীভাবে ?অবশেষে রক্তক্ষরণ । এপার ।ওপার ।সেপার । রাজা থেকে 'আমরা রাজা'র দেশে এক চোখ আর এক চোখকে দেখে চোখ রাঙায় ।লুঠ হয় শরীর । ঘর ।আত্মা ।ভাষায় লেগে থাকে হাতুড়ি মার্কা ফিনাইলের বিকট গন্ধ ।সেই আত্মঘাতী বাঙালি  ।  নিজেরাই কামড়ে খাই নিজেদের । মহানগরের আধপোড়া ফুসফুসে লুটোপুটি  খাচ্ছে বাংলা ভাষা ।তবু আমি বাঙালি ।সেকি গব্ব !!! ২১ -শে ফেব্রুয়ারি । নাচানাচি ।ধিতান নিতান । ফিতে কাটাকাটি ।একদিন । গান্ডুগিরি ।দু'লাইন বাংলা কবিতা আওড়ানো ।"বাংলায় অনেক তো লিখলি,হিল্লে হল ?এবার ইংরেজি জাস্ট ট্রাই কর,ফাতনা ডুবে যাবে !বেস্ট সেলার !হেঃ হেঃ !" অতএব গান্ডুরাও গাণ্ডীবধারী হতে চায় ।আর তার পর সে  কি নেটানো । বোবাকালা বেডপ্যান হেসে ওঠে ।তবু কমেনা চুলকানি । নেটানি । এদিকে  মার খেয়ে পড়ে থাকে আমার মা!সেই মহানগরে ।ভিখারির মতো । তিন ছেলের অবাঞ্ছিত মা ।চক-ডাস্টার নিয়ে খেলা করে বিলেতি-বাদর ।লাফায় ।ঝাপায় ।হিপ-হপ ।দর্শকের বত্রিশ বিকশিত ।বড়োরা ইন্সপায়ার্ড!ছোটোরা ছোটে ।এপ এপ খেলা ।কামড়ে দেয় ভিখারির হাত ।রক্ত ছোটে ।রক্ত রক্ত রক্ত ।"এত রক্ত কেন?" যুদ্ধ কি তবে অনিবার্য ?এবারও ?মা গোঙায় । আবডালে ।রক্তাত হাত নিয়ে ছোটে কবিতার হাসপাতালে ।আর আমরা? আমরা কি প্রস্তুত,অনিবার্য যুদ্ধে?
-------------------------------------------------------------------------
প্রিয় পাঠঃ
 এবারের 'প্রিয় পাঠে' থাকছেন বাংলার দুই শক্তিশালী  তীর্থঙ্কর মৈত্র  ও  অর্ঘ্য মন্ডল ।এঁরা দুই প্রজন্মের ।নিজস্ব ভাষা,ভাবনায়  দুজনেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ।সমালোচকদের মতে তীর্থঙ্কর মৈত্রের কাব্যগ্রন্থ 'রানু এক জ্বর' (১৯৯৭) বাংলা সাহিত্যের এক সম্পদ ।এছাড়া 'হে মেঘের   ভাস্কর্য'(১৯৮৭),'সমুদ্রের বিস্তারের মতো তুমি'(১৯৯৪),'বৃষ্টির ভালো হোক'(১৯৯৯),বসন্তের গিটার(২০০১) ও 'শালিকের ঠোঁটে খড়'(২০০৯) কাব্যগ্রন্থগুলি পাঠকদের  কাছে বরাবর  সমাদৃত ।অপরদিকে অর্ঘ্য বিষন্নতার মাঝে চেয়ে থাকেন কবিতার শরীর নিয়ে ,রাতের অন্ধকারেও তাঁর দু'চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসে এমন সব শব্দবমালা যা বাংলা ভাষায় অননুকরণীয় ।তাইতো তিনি লিখে ফেলেন 'রাত্রি নিজেকে লিখছে'(১৯৯৮), 'হলুদ,তোমাকে'(২০০২)'অগোছাল'(২০০৯) ।অর্ঘ্য প্রচার বিমুখ মানুষ  । লুকিয়ে থাকেন ।  নিজের মধ্যেই । শহরের  কোলাহল তাঁকে বিরক্ত করে ।তাঁর কবিতাগুলি বাংলা সাহিত্যের এক সম্পদ ।বানিজ্যক লাফালাফির বাইরেই যে প্রকৃত কাব্যচর্চা হয়ে আসছে এ সর্বজনবিদিত ।


তীর্থঙ্কর মৈত্র
তবুতো জীবনানন্দ


তবুতো জীবনানন্দ জেগে আছো ভাঙা গলুইয়ের মতো জলার স্রোতে ।
তবুতো তোমার নামের পাশে কাকের ডিমের মতো ধূসর মাখানো কিছু নীল ।

আমার বুকের পাশে এক দুর্নিবার ঝড়ে ভাঙা দ্বীপের খবর ।
গাঙ কুলে চিতায় টানিয়ে দেওয়া গামছার মতো
আমার জীবন ওড়ে সারাক্ষণ লবণ বাতাসে;
আমার দিনের আলোর  সুতা খসে যায়--
তোমার দায়ের চেয়ে আমার জীবন বেশি যুদ্ধে পরিণত !
কি ছিলো,তা আজ বড়ো নয়, দর্শকের দলে তুমিতো রয়েছো;
এখন আমার কাজ স্মৃতি টেনে ঘুরির মতন মাটিতে নামানো !

কাক শালিকের মতো যার পুলকিত দিনের উৎসব;
তার আজ মোচার খোলার মতো জলে ঝ'রে পড়া;জলের জীবন!
নেই ভেসে ফেরা ছাড়া আর ঢেউয়ের কাছে তার কোনো অধিকার;
তুমি তবু চরের পলির কাছে শিকড়ের জীবন পেয়েছো ।
আমার এখন কাজ মোচার খোলার নাও ঘাটেতে ফেরানো!

তবুতো জীবনানন্দ তুমি জেগে আছো অঘ্রাণের কুয়াশার মতো;
তবুতো তোমার প্রাণে শরতের খন্ড খন্ড রোদ;
আমার এ বোধ আজ কাকের ছায়ার মতো কৃশ কিছু রূপ;
আমার এ চোখে আজ বজ্রাহত বৃক্ষের প্রকাশ্য মরণ ;
আমার এ বুকে আজ নদীর খাড়ির মতো জলের ভাঙন;
তোমার দায়ের চেয়ে আমার জীবন বেশি যুদ্ধে পরিনত !
                                              (১৬/০৪/৯৩)


প্রেম হ'লো উল


ক্রুশ কাঁতায়  তাকে বুনে ফেলা যায় শোনো আজো-
শীতের কুয়াশা থেকে পেড়ে এনে গ্রামের স্মৃতিতে
এখনো বাজানো যায় একখানি হারমোনিয়াম ।

যে সব জিওল পাতা ঝ'রে পড়ে মেঠো পথে রোদে;
তাকেও ফিরানো যায়-শুধুমাত্র তার অনুরোধে!
সাঁকোও পেরনো যায় --শীতে একা রেখে পরিণাম;
বুঝানোও যায় তাকে--'প্রেম হ'লো উল;তাকে বোনে শীতে!'
                                               (০২/০৪/৯৩)

তোমার যৌবন শুধু

কঠিন জীবনের ডাকে তুমি আর বনলতা নও ;
নও বয়ঃসন্ধির অভিমানী নিতু বিশ্বাস !
গ্রামের আকাশ নাম্নী সীমা হালদার
ভিজে দুপুরের ট্রাম ;হকারের ডাকের ভেতর
মিশে গেছো নাগরিক রানুর চোখে--
দুষণের ওপার সিঁড়ি ডেকে নিয়েছে তোমাকে ।

কঠিন জীবনের ডাকে তুমি আর সুরঞ্জনা নও;
নও অরাজনৈতিক বিকেলের লিপি দে।
জ্যাম,জট আর পুলিশের নিকোটিন ঘঁটে;
তোমার যৌবন শুধু কথা বলে যুবকের সাথে--
                                       (২২/০৬/৯২)

নিকোনো উঠোনে ফের

আবার ঘাটের জলে,কিনে আনা নতুন নৌকোটি
ভোরের আলোয় নাচে ,নেচে নেচে মুখখানা রোদের মতন ।
আবার হাঁসের খোঁজে স্বর ভাঙা কিশোরীর গলা !
কিসের আভাস আসে;আহ্লাদিত কিসের খবর!

ঢেঁকির চোখের নিচে কাজলের টান--
সিঁদুরের ফোঁটা জাগে জল ভরা পিতলের ঘটে;
গভীর পেটের তলে,ফ্যানায় ফ্যানায় ভরে মাটির পাতিল;
                                    পায়ে কার প'ড়লো আলতা?

কিসের খবর এলো;নিকোনো উঠোনে ফের কাকের ভেতর?
কার উৎসব রাঙামুখ , খুব ভোরে ফিরে এল বাড়ি ।
কিসের সকাল হ'লো ! হাঁসগুলো দানা পেতে
                                       নরম দাওয়ায় !
                                       (১৯/০৪/৯৩)
 (শালিকের ঠোঁটে খড়// তীর্থঙ্কর মৈত্র//প্রিয়শিল্প প্রকাশন)
---------------------------------------------------------------------------------

অর্ঘ্য মন্ডল
নদী পেরোনোর কবিতা


স্কন্ধ অপারগ হলে বোঝাটি মস্তকে উঠে যায়
বোঝাটি নামে না আর
বোঝাটি নামাতে গেলে
অগত্যা মস্তকই নেমে যায় ।

ব্যাঘ্র-সুমারীর কাছে
এখনই দিও না ধরা, আরও
ডোরাকাটা সংলাপে এই প্রেম
সহিংস থাকুক

ঘুর্ণির কেন্দ্রস্থ হাওয়া
চেনে আমাদের ঘোরাফেরা
এই দলিত স্বদেশ জুড়ে বাদ্য-সহযোগে
ঢিঁ ঢিঁ পড়ে গেছে যেন বিশেষ এক বাঘিনী নিখোঁজ

আকার মিলছে না
রঙও
স্বভাবে প্রকট ডোরাকাটা....
দলিত চঞ্চলরেখা,চুপ এখন,না ধরা দিও না
ডোরাকাটা সংলাপে
প্রেম আরও সহিংস থাকুক


ভেবেছিলাম চেষ্টা করি অন্যদিকে ফেরার
কিন্তু ব্যথা চতুর্দিকে বাজনা দিয়েই ঘেরা
বাজনা বলতে সাপুড়ে -বীণ,ভালুক নাচাবার
ডম্বরু,স্কুল শুরুর ঘন্টা,ষন্ডযুদ্ধ আর
তোমাকে ঘিরে স্বয়ম্বরার অস্ত্র ঝন্ ঝন্

ঘোড়সওয়ারের বুটের  আলোয় ভেবেছিলাম ,মন
দেখতে পাব কিন্তু যা হয় তাই হল এই বারও
ঘরে আসলে মেঘদাত্রী-নিশুতি অন্ধকারও
চতুর্দিকে বাজনা ঘেরা গভীর ব্যথার শেষে
বদলে দিলে মেঘে এবং মেঘতাড়ুয়ার বেশে
পাঠাও আমার এদেশ ওদেশ,এই বাড়ি ওই বাড়ি

দেখি আমার চেয়েও ফাঁকা অনেক ভাতের হাঁড়ি

পাখিদের দেশে তুমি পাখি পুষে পোষ মেনে আছ,পাখিরা প্রহরী হয়ে সন্দিগ্ধ
করুণায় দ্যাখে--তারা খেতে খেতে সব হারিয়ে ফেলার পরে পাখি তাড়ানোয়
মেতে ওঠা লোকজন যা কিছু ফেরত চায় অপরূপ শান্ত বাতাসে আর বারুদাভ
 তোমার ভেতরে তুমি কিছুতেই বোঝাতে পারো না --যে পাখি পুষছে সেও অন্ধ-
পোষ মেনে থাকে পাখিদের দেশে,তুমি কিছুতেই বোঝাতে পারো না ওইসব.........


উদ্ভিদ বেড়াতে এলো আর পূর্ণ হলো অরণ্যবাসনা,ডালে পাখি,শেকড়-
বাকড়ে মাটি,প্রশাখায় গুপ্তবীজি ফল......উদ্ভিদ বেড়াতে এলো বুকের
ভেতরে,এই কালাশৌচের মধ্যেও,তার মুখে কোনও কথা নেই ,শুধু সে আরও
বলতে চায়.....আরও কত অন্ধকার...আরও কত রাতচরা পাখি.....
১০
সিধু পাগলের কাছে কেউ কারও পরিচিত নয়
অসম যাত্রাপথে রোলটি হাস্যের নাকি শীৎকার প্রসূত
গাছের সমাজে গিয়ে সেভাবে জানতে চাইছে না
ঝোলায় লুকোনো ডাইরিতে
দেবতার গোঁফদাড়ি এঁকে
চেষ্টা করছে কামানোর,আর পারছে না বলে
দেবতার কষ্ট দেখে চিৎকার করে কেঁদে ওঠা সে খুব জরুরী মনে করে

সিধু পাগলের কাছে মানুষ আসলে রঙ খেলা,স্নান বিরতির পরে পুনরায় জেগে ওঠে
রঙে আর জড়জগতের অনুভূতি জীবদেহে সঞ্চালিত হলে
বেজে ওঠে তার হাতে তালি

শতচ্ছিন্ন মশারির ডাকনাম কম্যুনিষ্ট রেখে টাঙিয়েছে শনি মন্দিরে
সে বোঝে অন্যের চেয়ে তার এই উচ্চতাটুকু
স্বভাব-বন্যতা ফেলে পোষ মানা নানান কুকুর
সে ধ'রে পেটাতে চায়...থুতু দেয় ছুটে- ছুটে গিয়ে

সে জনসভার দিকে তেড়ে যায় শিশ্ন বাগিয়ে ।
(অগোছাল// অর্ঘ্য মন্ডল//ফসিল)
-----------------------------------------------------------------------------------

কবিতাঃ
পুনর্জন্মের কবিতা
সুবীর সরকার

 ১।
মৃত্যু ব্যথিত করে
হিজলগাছের ছায়ায় ঘুম
             ভাঙে
সুতো জড়িয়ে যায়
মাছের কাটার দিকে পায়ে
             পায়ে
২।
দীর্ঘ বাক্যকে উস্কে দিয়ে
পা পিছলে পড়ে
          গেলাম
একনাগাড়ে প্রশ্ন করলেই
বেশ গুছিয়ে নিই নিজেকে
 ৩।
তুমি কি খোঁপায় ফুল গুঁজবে!
আবার পাশ কাটিয়ে
           যাওয়া
দোলাচলে থাকি।
টক আর তেতো মিশিয়ে
              খাই
৪।
আবার আশ্চর্য খটকা
দু’পাশে পুনর্জন্মের পথ
আবার ঘাবড়ে যাওয়া

গুড় বা চাল দিয়ে বানানো
            খাবার

৫।
বৃষ্টির মধ্যে লাফ
গুঁড়ি কিংবা সুঁড়িপথের
          রেফারেন্স
ভোররাতের ঘুম কাজে
আসছে।

৬।
তর্কে না গিয়ে শান্ত থাকি
খিচুড়ির মধ্যে আলু
অভিজ্ঞতার কথা বলি
পুকুরে বড়োসড়ো
          হাঁস
এবং আঙুর ।বিচিত্র
           আহার্য।
-----------------------------------------------------------------------------


অনেক কিছুই থেকে যাবে অপ্রকাশিত
ফকির ইলিয়াস

আমি দূরে দাঁড়িয়ে ওদের ঝগড়া দেখি। পাখি ও প্রত্যুষের ঝগড়া। বন ও বাদামের
ঝগড়া। ঘর ও গন্তব্যের ঝগড়া। কিছু পাপড়ি ভেসে যাচ্ছে নদীতে। গঙ্গাস্নানে এসেছে
যেসব রমণী, তারা স্পর্শ করছে চাইছে সেই পাপড়ির রঙ। জন্মদাগ বুকে নিয়ে এই
দেশ ত্যাগ করে কিছু মেঘ উড়ে যাচ্ছে অন্য দেশে। ওরাও ঝগড়া করছে আকাশের
সাথে। বলছে- যাবার আগে আমরাও পদছাপ রেখে যেতে চাই।আমি পুনরায় সংরক্ষিত ছাপবিজ্ঞান থেকে এই ছাপরহস্যটুকু তালাশ করি। কেন সব কিছুই প্রকাশিত হবে, কিংবা কেন সকল প্রশ্নই খুঁজে পাবে উত্তর- এমন ভাবনাবীজে আমি অংকুরিত হই। অনেক কিছুই থেকে যাবে অপ্রকাশিত, বলে যে প্রাক্তন প্রেমিকা আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছিল, তার কথা মনে পড়ে। জমাট বরফে শাবল চালাতে চালাতে পেছন ফিরে দেখি ভাঙনের চিহ্নগুলো তৈরি করেছে বেশ কিছু
জাগৃতির ম্যুরাল ।

-------------------------------------------------------------------------------


ছক
মাসুদ খান

দশটি পথ এসে যেখানটায় কাটাকাটি হয়ে চলে গেছে দশ দিগন্তের দিকে, সেইখানটায় গিয়ে বসে থাকেন আমার মা। পথের ধারে বসে মা আমার মানুষ দ্যাখেন, মানুষের আসা-যাওয়া দ্যাখেন। কোনো পথ দিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা। কোনো পথ দিয়ে আসে গ্রহণ-লাগা, ক্ষয়ে-যাওয়া, নিভু-নিভু সব বনি-আদমের দল। আবার মেঘ ও মিথুন রাশির ছায়ায় তুমুলভাবে বাঁচতে থাকা মানব-মানবীদের যাতায়াত কোনো কোনো পথে।

একদিন আসা-যাওয়ার পথের ধারে মা কুড়িয়ে পেলেন আমার ভাইকে (আমি তখনো আসিনি আমার এই মায়ের কাছে)। কিন্তু কিছুকাল পর আমার সেই ভাই হঠাৎ গেল হারিয়ে। তারপর থেকে মা আমার ওই পথমোহনায় বসে তীব্র পুত্রশোকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন।

একবার, গোধূলিরঙের লম্বা-লম্বা চুলদাড়িঅলা এক বুড়ো পথিক ক্ষণিকের জন্যে থামালেন তার পথচলা। মা-র কাছে সব শুনে বললেন, ‘কোথাও তো কিছু হারায় না মা এই মহাবিশ্বে! যাও খুঁজে দ্যাখো।’ তারপর থেকে মা আমার উড়ে উড়ে বিশ্বসংসার তোলপাড় করে খুঁজে ফিরেছেন তার সন্তানকে। শেষে সপ্ত-আকাশের পরপারে আমাকে কুড়িয়ে পেয়ে, এবং তার সন্তানকেই পেয়েছেন মনে করে, উড়িয়ে নিয়ে এলেন এই মর্ত্যরে ধুলায়। আমি তখন সাত আসমানের ওপারে অনন্ত নক্ষত্রকুঞ্জের ঝাড়জঙ্গলের ধারে সোনালি খড়ের গাদায় বসে অনাথ শিশুর মতো কাঁদছিলাম একা একা, মাকে হারিয়ে।
দিন যাবে, মাস যাবে, ঘুরে আসবে বছর...
একদিন হয়তো আবার হারিয়ে যাব আমি এই নতুন পাওয়া মায়ের কাছ থেকে আর আমাকে খুঁজে পাবেন অন্য এক মা। তারও হারিয়েছে সন্তান। আমাকে পেয়ে ভাববেন, খুঁজে পেয়েছেন তারই হারানো ছেলেকে।

এইসব অনন্ত বিভ্রম আর বন্ধন
এই যে নিখিল ভুলবোঝাবুঝি
লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদা আর হারানো-পাওয়া খেলা
এইসব নিরন্তর মায়া ও ম্যাজিক...
সবকিছু অমীমাংসিত রেখে দিয়ে,

কাটাকুটি ময়লা ডুপ্লিকেট নকশা একখানা জগৎসংসারের,
তা-ই মেলে ধরে অবাক উদাস হয়ে বসে আছেন জরিপকর্তা।

নকশাটাতে একপাশে লেখা-- স্বাক্ষর/- অস্পষ্ট
নিচে তার চেয়েও অস্পষ্ট একটা সিল... 

-------------------------------------------------------------------------

 গোলাপদিন
অলক বিশ্বাস


পাপড়ি খুলে গেলে লেখা হলো গীতগোবিন্দ
 দু’চার পংক্তিতে শ্লোক, ভেঙে যাচ্ছে নদী অন্য নদী
 নামে
আহ্লাদে ছুঁয়ে গেলে কপালের টিপ
মৃত্যহীন সে গোলাপের ঋণ

রোদ্দুরে উড়ছো টুসু
 মেঘ ভেঙে নদী করে দাও প্রেম
 রুমাল কথায় স্বপ্নময় তুমি
শ্লোকে শ্লোকে কবিতা গোলাপদিন।

একটি পালক উড়ে এলে ফাল্গুন হয়ে যাই
 একটি ঠোঁট এঁকেছি এতদিনে
বোরোধানে এইবার নেচে ওঠো নদী
 দু’পায়ে পলাশ পরাই।

ভোরের দুপুর খেয়ে গেলো কাঁঠবিড়ালি
দোয়েল ঠোঁটের পাশে ছায়াকীর্ণ রাত বাজুতে একটি
 গোলাপ

লালপরী, নীলপরী এই চুমু রাখলাম পাখির প্রপাত


শস্যফুল
অলক বিশ্বাস


যে মেয়ে ভালবেসে বলেছিলো
চুঁইয়ে যাওয়া প্রেম, জলঘাসে ছায়া হয়ে থাকি।
 তাকে বলি নদী হয়ে থাক।

যে নদী শান্ত জলে কেবলই ভেজায়
আনমনে ঝুঁকে পড়ে ঈশারা আলো
সে তো আমারই ফাগুন!

কী যে তার নাম, কী আঁচলে রেখেছে বেঁধে
অবান্তর নয় আর
আমারই ভাষায় লিখি কলমিলতা।

সে আমার গল্পদুপুর নদীজলে নির্জন
 বিরহে মহুয়া ফুল মনের মাদল
 মাঠময় দুলে ওঠা শস্যফুল!
------------------------------------------------------------------------
 মুকুটের ঘৃণা
পারু পারভিন
অনল আর আক্রমন সয়ে
কিভাবে ধরে রাখি
নীল চাদোয়া গান !
শুনবে ডাহুক মন বাদলের ডাক?
 করাত কেটে যায় ভেতর টা
অথচ বাইরে কি তুলকালাম !
চোখের জোয়ার নামলেও
 দুহাতে বুনে যাই বনিকের সুখ।
তোমাদের আলো দেয় চাঁদ,
 ভুলে গিয়ে জোয়ার ভাটা
মান অভিমান।
মুকুটের ঘৃণা ভাসিয়ে দেই
 আমিও নিশ্চুপ !
আয়নার মত ঝকঝকে চিবুক দিয়ে
কিনেছি শিয়র আর শিকল যন্ত্রনা।
 অল্প জলে অতিকায় দুঃখ,
উৎসব উৎসব পশু বন্দনা !
..............................................................................................................



রাত্রিপোকা
অরূপম মাইতি 


ভোরের নরম রুমাল দিয়ে
চোখের পাতা মুছে
 কোদাল হাতে, ধানের মাঠে পা।

 স্বপ্নের ভারে ক্লান্ত মন
 সেচের জলে ছবি দেখে
 ধানের মাথা ভারী
পুরুষ্ট শিষ আরে বৌয়ের পেট
 দুটো এক সময়ে পাকবে।

 বাঁকের পরে বাঁক, আলের পাকদন্ডী
সবুজের চাদরে দিগন্তের ধু-ধু মুখছোঁয়া
 দিনের কাজের শেষে
রাত্রিপোকা কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে
একদিন এখান থেকে পাড়ি দিবি, তুই
 মেঘবলাকার দেশে।
নীল গালিচার বুকে
 তোর হাতের যাদুতে
 বুনে দিবি হাজার স্বপনের বীজ।
----------------------------------------------------------------------


উঠে এসো
বাবলু রায়

উঠে এসো এই ছায়ায়
হাত ধরো রৌদ্রাহত পালক

আজ পাতালের অন্ধকার
ঢেকে দিল
শব্দ মুকুলের ঘ্রাণ
ছিন্ন হাওয়ায়
শূন্যের খেয়া নেমে আসে
রক্ত ধূলায়।
--------------------------------------------------------------------------

ভালোবাসা
শূদ্রক উপাধ্যায়

যে গাছ নিমজ্জিত হয়নি ভালোবাসার গাঢ় কুয়াশায়
শুধুই তাকিয়ে থাকে স্বচ্ছ জলের দিকে ! সেও
 একদিন সূক্ষ্ম হৃদয় টেনে হিঁচড়ে বেড়িয়ে আসবে
তোমার ডাকঘরে...

শীতের শেষ মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে চিৎ হয়ে শুয়ে
 থাকে শিশু ; অনাদরে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে
 সবুজ ঘাসের হৃদয়ে...
----------------------------------------------------------------------------------



ব্যক্তিগত গদ্য-১
                                        নরসুন্দর
                                    মাসুদার রহমান


   হাট ফেরৎ হাবিল নরসুন্দরের পাশে হাঁটি। পরনের লুঙ্গি খাটো করে পরা; হাঁটুর কাছাকাছি। ওর পায়ে হাটপথের ধুলো। কাঁথে ব্যাগ, হাতেও। একটিতে কিছু সওদাপাতি, আনাজ চাল ডাল। অন্য ব্যাগটি ওর কাঁধে, তার মধ্যে খৌর-কর্মের খুর কাঁচি আয়না ব্রাশ ক্রিম সাবান এবং কাঠের তৈরি একটি আসন পিঁড়ি। হাটমধ্যে বিশাল বিস্তারময় বটতলায় যে পিঁড়িতে নরগণকে বসিয়ে সুচি সুন্দর করে তোলার কাজটি করে। ওর শরীর আর পরণের ঢলঢলে পোশাকআশাক ক্রিমসাবান আর ঘামেগন্ধ মেশানো এক অনন্য সুবাস পথের হাওয়ায় ছড়িয়ে যায়। কত রকম কথা চালাচালি হয় হাবিলের সঙ্গে। ওর ছেলেবেলা; বাবা হারানোর পর গৃহস্থবাড়িতে রাখাল জীবন। তারপর মহিম নরসুন্দরের শিষ্যত্ব নিয়ে আজ এই কাঁধের ঝোলায় খুরকাঁচি। হাবিল জানায় ওর বৌ মেয়ের কথা। সামান্য ঝুপরিঘরের সামনে এক চিলতে উঠোনের আমগাছ দুটির কথা, একটি গাছের আম খুব মিষ্টি আর সুস্বাদু, অন্যটি একটু টক স্বভাবের তবে তা দীর্ঘস্থায়ী; মৌসুমের শেষ পর্যন্ত সে ফল দেয় হাবিলকে। কথায় কথায় সন্তুষ্টিতে হবিলের চোখ আলো হয়ে ওঠে। ‘আজ হাটে রোজগার কত?’ জানতে চাই হাবিলের কাছে, সন্তুষ্টি মুখে হাবিল যা জানায় তাতে আজকের বাজারে বয জোর ৩কিলো চালের পয়সা সে রোজগার করেছে। এই রোজগারে শুধু চাল কেন ওকে ওর চাহিদার তরিতরকারি তেলনুন সংসারের সব ক্রয়ই নিতে হয়েছে। হাবিল খুশি। হাবিলকে জানাই আরও বেশি কিছু রোজগার করা উচিত ওর। কথা শুনে ও কেবল হাসে এবং বলে, ‘চলে যায় ভাই ; খুব একটা আসুবিধা হয় না’। আমি বলি পাশের বাজারে খড়বিচালির বেড়া বাঁশ দিয়ে একটা সেলুনঘর তুললে হয় না? তাতে রোজগার নিশ্চিত বেশি হবে কয়েক গুণ । হাবিলের উত্তর, অনেক খরচ তাতে, তাছাড়া এই রোজগারে তার চলে যায় তেমন আসুবিধে নেই। ওর কাছে বুজবুদ্ধি পরাস্ত হব আমার। সুখি নরসুন্দরের কাছে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের অসুখিতা পরাস্ত হোক, ওম শান্তি!
-------------------------------------------------------------------------------

 

ব্যক্তিগত গদ্য-২
                                               স্নান
                                         কুমারেশ পাত্র

অন্ধকার থেকে উঠে দাঁড়ানো আমার আত্মা অকস্মাৎ তোমার স্পর্শে  শরীর পেয়ে শিখেছিল বন্ধুর পথে কৌশলী বালকের মতো কীভাবে এগোতে হয় ।চামড়া আর চর্বির তলে সবারই থাকে হৃদয় ।রন্ধ্রের সাথে মিশে থাকে প্রক্ষোভ মাধুর্য ।এসব নিয়ে এসে দাঁড়াই তোমার সামনে ।তোমার শরীর  তখন নির্মল অন্ধকারে করে স্নান ।
         এরকম সুগন্ধী অন্ধকারে ভিজে যায় শরীর ।মন।পাখিদের ডাকে ।পাতার শব্দে । জলের কলতানে ।এই স্নান মুখরা করে আমাদের অবুঝ মনকে ।তখন মন মনকে চায় ।আর একটু হেঁটে তেমনই শরীরকে শরীর চেয়ে ফেলে । অগত্যা । স্নান তার নিজ ধর্মেই  নিরবচ্ছিন্ন  ভাবে  এগোয় ।এগোয়,আর গাঢ়  হয় পৃথিবীর পালকের নীচে লুকিয়ে থাকা নরম মাংস-চর্বি-লোমের অন্ধকার ।প্রেম-ভালোবাসার উষ্ণতায় মহাশূন্যে ডুবে যায় আমাদের পৃথিবীর ডানা ।
                                                ২
 এসময় ক্লান্ত শরীর  উঠে আসে ।বালিশে মাথা রাখে ।ঘুম খোঁজে ।ঘুম আসে । তবু স্বপ্ন লেগে থাকে অবচেতনে ।স্নান চলে ।অক্লান্ত স্নান । অন্ধকারে ।
             ঘুমের মতো ছায়া খোঁজে শরীর ।দানা খোঁজে পাখিদের মতো ।হে  প্রিয় দেশ,আজও  দানাঘরের দুয়ার আগলে আছে বেকারত্ব । খাদ্যান্বেষণে আসা পাখি নীড়ে ফিরে যাবার আগেই খাঁচায়  চালান হয় ।লেভেল ক্রসিং - এর  উলটোদিক ভোরবেলা সেজে ওঠে খাঁচায় । লোক জমা হয় ।একটা  শীর্ণাকায় লোক খাঁচাটি আঙুলে ঝুলিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে   ডুবে যায় কুয়াশার  গভীরে ।অন্ধকারে ।সামাজিক নিয়মে নেমে আসে স্নান । কালো স্নান !মাংস থেকে ধোঁয়া উঠে আসে নির্লিপ্ত ঠোঁটে ।
                                                 ৩
আমার শরীরের পালকবন্ধনী ক্রমশ শিথিল হয়ে আসে ।মাংস ক্ষয়ে যায়।হাড়মাস সব ।আত্মা হাওয়ার উলটোদিকে পড়ে থাকে ।এইখানে ।যেখানে শরীর পেয়েছিল স্বপ্নের উষ্ণতা ।তারপর অবাধ্য বালকের মতো ছুটে বেড়ায় এদিক সেদিক ।একদিন সশস্ত্র প্রহরী ভেদ করে উঠে আসা মংসের ধোঁয়ার সাথে সে আসে ।অশরীরী হয়ে ।কালো স্নানসুখে চোখ বসে গেছে ।কালি সেথা ।কুঁড়ে ঘরের চেতনায় আজ গভীর প্রহরা ।কিন্তু অবচেতনে কে?স্নান নেমে আসে প্রকৃতির নিয়মে । পৃথিবীর থেকে বৃহৎ প্রোক্ষভ মাধুর্যালয়ে  থাকে আমাদের আত্মারা ......সনাতনি সময়  শুধু খেলা করে.....তবু শরীরহীনতায় স্নানে লেগে থাকে বিষণ্ণতার প্রলেপ ।শীর্ণাকায় লোভী হাতদুটো এগিয়ে আসে,রেললাইনের পাশে,আর  পোশাকের মতো পরে নেয় তোমার  ফেলে আসা শরীর ।
-------------------------------------------------------------------------------

ছোটগল্পঃ
                                           ফোড়ন
                                      দেবশ্রী  ভট্টাচার্য

                      কড়াটা গ্যাসে চাপিয়ে, মিতালি ভাবল আজ ডালে কী ফোড়ন দেওয়া যায়। মুসুর ডাল হবে , ডালটা আগেই শেদ্ধ হয়ে গেছে। কী ফোড়ন দেওয়া যায় আজ! ফোড়ন আলাদা হলেই ডালের স্বাদ আলাদা হয়ে যায়। মুসুর ডালে জিরে ফোড়ন দিলে একরকম স্বাদ, মেথি ফোড়ন দিলে একরকম স্বাদ ।আবার রাঁধুনি ফোড়ন দিলে আরেক রকম স্বাদ।
                      কড়াটা বেশ গরম হয়ে গেছে। মিতালি তেল ঢেলেই মুচকি হাসল। এক্ষুনি ফোড়ন দিলেই সবাই হাঁচতে শুরু করবে। এ বাড়িতে ফোড়নের গন্ধ কেউ সহ্য করতে পারে না। তা বললে কী চলে! ফোড়ন না দিলে কী চলে! ফোড়ন না দিলে আর ডাল খাওয়া কেন? কড়া ফোড়ন হবে লোকে হেঁচে-কেশে অস্থির হবে তবেই না মজা,নইলে ডাল একেবারে পানসে হয়ে যাবে না!
                      সামনের টেবিলে সকালের চায়ের আসর বসেছে। অবনীমোহনের চা-টা অবশ্য মিতালি ঘরেই দিয়ে এসছে।শীতকালের সকাল, ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেও নড়াচড়া করতে বিশেষ চায় না অবনী্মোহন!যৌবনকালে যা ছিল, রিটায়ার করার পর থেকে তেমন ধারাই চলছে । ডাক্তার কত করে বলেছে মর্নিং ওয়াকের কথা – কে কার কথা শোনে!তা-ও শাশুড়ি যতদিন ছিলেন ততদিন তাঁর ধমকে একটু নড়াচড়া করতেন, কিন্তু এখন মিতালির আদরে সব বন্ধ । বেলা দশটার আগে পা-ই পড়বে না মাটিতে।
                      টেবিলে আসর বসিয়েছে অবনীমোহনের সন্তান-সন্ততিরা ।তবে সকালবেলা তো আর আজ রবিবারও নয়, তাই এই আসরটা ভীষণ সংক্ষিপ্ত। আসর বসবে রাত্রে ডিনারের সময়। এখন সকলের মুখের সামনে একটা খবরের কাগজ। কারো সামনে রাজনীতি, কারো সামনে খেলার পাতা কারোর আবার সিনেমার গসিপ।
                     এ বাড়িতে কাগজ আসে চারটে। দুটো বাংলা, দুটো ইংলিশ । একটা বাংলা কাগজ অবনীমোহনের ঘরে আগেই চলে গেছে। বাদ বাকি তিনটে কাগজ আর সবাই ভাগাভাগি করে পড়ছে।
 -খবরটা দেখেছিস! চেন্নাইয়ে কী সাংঘাতিক ব্লাস্ট হয়েছে!
চায়ে চুমুক দিয়ে বলল শশাঙ্ক ।অফিসে ফিটফাট কেতা দুরস্ত হলে কী হবে,বাড়িতে বিশেষত সকালের চা-টা শশাঙ্ক প্লেটে ঢেলে খায়।শুধু তাই নয় ,প্লেটে চুমুক দিয়ে খাওয়ার সময় সুরুত করে একটা শব্দ হয়। এই শব্দ শুনলেই মিতালির গা হাত-পা জ্বলে যায়।
   -হ্যাঁ, কালকে এক ঝলক দেখেছিলাম, নিউজে... ডিটেলসে দেখিনি।আর ছাড়ত , এসব তো রোজকার ব্যাপার।
স্পোর্টস পেজের পাতা উলটোতে উলটোতে মৈনাক বলল।
 -আরে কী সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে! .........দ্যাখ, একটা গাড়ীর ভেতরে বোমাটা রাখা ছিল......। দ্যাখ, কত লোক মারা গেছে!                     
-আরে! ছাড়ো না দাদা সকাল সকাল কী সব আজেবাজে খবর পড়ছ!
  এবার টুসকি বলল কথাটা- অবনীমোহনের সবচেয়ে ছোটো মেয়ে।
  ঠিক এইসময়ই মিতালি কড়াইয়ে ফোড়নটা দিল।
 -ব্যাস্‌...বৌদি এবার আমাদের উঠিয়ে ছাড়বে। হাসতে হাসতে মৈনাক বলল।
-তা যা বলেছিস সোজা কথায় বলবে না, এমন কাণ্ড করবে যে আর না উঠে উপায় নেই ।
প্লেটে ঢালা চা-টা শেষ করেই একটা বোম্বাই হ্যাঁচ্চ দিল শশাঙ্ক।
-উফ্‌ কী জ্বালা রে বাবা!
 মিতালি বুঝল, এবার সভা ভঙ্গ হবে।কড়াইতে ডালটা নাড়তে নাড়তেই বলল – তা আমি কী করব! আমাকে তো কাজটা শেষ করতে হবে নাকি!
 ওদিকে অবনীমোহনের ঘর থেকেও দু একবার হাঁচির আওয়াজ কানে এল।
  -দেখেছ কাণ্ড সারা বাড়ির লোককে হাঁচিয়ে কাশিয়ে কী যে রান্না হচ্ছে ভগবান জানে!
 শশাঙ্ক পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে নাকের কাছে চেপে ধরল।মিতালি গ্যাসটা অফ করে দিল।
 -এইত  হয়ে   গেছে,কতক্ষণের আর ব্যাপার...... এমন কর না তোমরা !
 হাতটা তোয়ালেতে মুছতে মুছতে এগিয়ে এল মিতালি
-তা আজ কী নিয়ে আসর বসেছিল?
-আরে ছাড়ত এসব...ও তুমি বুঝবে না!
   শশাঙ্ক গা ঝাড়া দিয়ে চলে গেল ওর অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে!
 -বৌদি প্লিজ্‌,আজকে আমার নতুন টপটা একটু প্রেস করে দিও না গো।টুসকি আবদারের সুরে বলল।
 - কেন রে ,আজ কি কোথাও বেরোবি?
-হ্যাঁ, আজ কলেজে একটা চ্যাট শো আছে।
  -চ্যাট শো!সেটা আবার কী !
 -ও তুমি বুঝবে না। প্লিজ একটু টপটা প্রেস করে রেখো।
            না মিতালি কিছুই বুঝবে না । চ্যাট শো কি বুঝবে না।কাগজে কী লেখা হয়েছে বুঝবে না।লাস্ট ওভারের আগে অ্যাডের সময় চ্যানেল ঘুরিয়ে সিরিয়ালের ইম্পরট্যান্ট সিনটা দেখলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয় ,মিতালি কিছুই বুঝবে না।
                  যাগ্‌গে বাবা অত কিছু বোঝার সময়ও নেই, এদিককার সব মিটে গেলে আজকে একবার স্টোররুমটা নিয়ে পড়তে হবে।অনেকদিন ওটা ঝাড়পোছ করা হয়নি।
                                                                    ২
আজকের মিটিংটা খুব সাকসেসফুল হয়েছে।এতটা ভালো যে হবে শশাঙ্ক নিজেও বোধহয় ভাবতে পারেনি।মিটিংটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেতেই আর কথা নেই, সোজা KFC-র একটা গ্রিল চিকেন খেয়েই গাড়িতে উঠে পড়েছে ।আজ আর কোন কাজ নয়।সোজা বাড়ি ফিরে রেস্ট ।
                 কিন্তু গাড়িটা মোড় নিতেই চক্ষুচড়কগাছ! এ কী অবস্থা! বাড়ির সামনে এত লোক কেন? বুকটা একবার ধড়াস্‌ করে উঠল।তবে কি বাবাড় কিছু হয়েছে?না না, তাহলে সব বাড়ির বাইরে কেন!মিতালি, মৈনাক, টুসকি- সব এমন উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে আছে কেন! কোনমতে গাড়ি থেকে নেমেই সোজা মিতালির সামনে......।উত্তেজনায় পুরো কথাটা বোধহয় পরিষ্কার করে বলতেও পারছে না।
 - আরে কী হয়েছেটা কী !এত পুলিশ কেন?
  মিতালি কিছু বলার আগেই মৈনাক বলল
- দাদা কী কাণ্ড! বাড়ির সামনে একটা ব্যাগ পড়ে ছিল।ব্যাগটা বেশ ফুলো ফুলো। আমরা কেউ দেখিনি,কখন কে ওটা ফেলে গেছে জানিনা, বৌদি না সোজা পুলিশে খবর দিয়ে দিয়েছে । বলছে ওটায় নাকি বম্ব আছে!
               শশাঙ্ক এ ব্যাপারটা  কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি।বাড়ির সামনে পুলিশ দেখে অনেক কিছু চিন্তা করেছে, কিন্তু ব্যাগের ভেতর বম্ব!বম্ব কথাটা শুনেই সকালের নিউজ পেপারটা মনে পড়ে গেল।ফ্রন্ট পেজের ছবিটা ! উঃ কী ভয়ঙ্কর ছবি! রক্ত মাখা হাত-পা কাটা ছিন্ন-ভিন্ন সব দেহগুলো পড়ে আছে। কিন্তু তাই বলে এখানে এই গলির মধ্যে! কে জানে হতেও তো পারে! শশাঙ্ক ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারল না । মিতালির বুদ্ধির তারিফ করবে নাকি ওর পাগলামিতে হাসবে! শশাঙ্ক ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল।
- বম্ব মানে!
 কথাটা তিনবার ঢোঁক গিলে এমন ভাবে বলল পাশের লোক তো দূরের কথা নিজেও বোধহয় ঠিক করে শুনতে পারল না।এদিকে ওই ব্যাগটা নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। চারজন পুলিশ ওটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। বম্ব স্কোয়াড আসেনি বটে, তবে দুজন হাতে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে বুলিয়ে চলেছে।দু-তিনবার বুলিয়েও কোন আওয়াজ হল না।
   -ধুর, বম্ব-টম কিছু নেই।
  বম্ব যে নেই সবাই জানে। তবু যতক্ষণ বম্ব কথাটা ঘোরাফেরা করছিল , ততক্ষণ সবার মুখে যেন ভয়ের কালো ছায়া জড়ান ছিল।লোকগুলো মানুষ না স্ট্যাচু সেটাই বোঝা যাচ্ছিল না। পুলিশ দু'জন বার বার মেটাল ডিটেক্টর লাগিয়ে যখন ঘোষণা করল  এটায় বম্ব নেই ,তখন সবাই হাঁফ ছাড়ল। একসাথে সবার হাঁফ ছাড়ার শব্দ শোনা গেল। এবার যেন সব মুখগুলোয় কথা ফুটল ।পরম বিজ্ঞের মতো সবাই বলতে শুরু করলো – জানতাম তো বম্ব নেই, এখানে আবার কেউ বম্ব রাখে নাকি !যতসব ...মিতালি না......!
  সবার কথা এক ধমকে থামিয়ে পুলিশ ইন্সপেকটর বললেন –না না ! মিসেস সেন একদম ঠিক কাজ করেছেন। বলা তো যায় না ,বম্ব তো থাকতেই পারতো।এরকম ভাবে সব নাগরিক যদি সাবধান হয়ে যায় তবে আমরা অনেক কিছুই আটকাতে পারি। আপনি একদম ঠিক কাজ করেছেন।
পুলিশের ধমকেই হোক আর যে কারণেই হোক সবাই এবার উলটো সুর গাইতে শুরু করল।
-না না , ঠিক ঠিক! মিতালি একদম ঠিক কাজ করেছে।
                                                                      ৩
              ব্যাগটায় সেরকম কিছুই পাওয়া যায় নি। কিছু ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো আর পুরনো কিছু কাগজ দলা পাকানো। আস্তে আস্তে সব ভিড় চলে গেল, কিন্তু আলোচনা আর থামতেই চায় না। কেউ কেউ আবার উৎসাহ চাপতে না পেরে সোজা চলেই এল মিতালির বাড়িতে।শুধু পাড়ার লোক নয়,আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কোথা থেকে সব খবর পেয়ে ফোনে , কেউ একেবারে স্বশরীরে হাজির। পুরো বাড়িটা একেবারে গম্‌ গম্‌ করছে। সবার মুখে শুধু একটা কথ--বাপরে মিতালির কী সাহস! কারো সাথে একটা কথা বলা নেই , পরামর্শ নেই ,সোজা পুলিশে ফোন! না না, ঠিকই তো করেছে। সত্যিই তো যদি বম্ব থাকতো, তাহলে লোকজনের সাথে পরামর্শ করতে গেলে দেরি হয়ে যেত না!
   আজকের সভা যেন আর থামতেই চাইছে না।গত দশ – বারো বছর যেখানে যেখানে বম্ব ব্লাস্ট হয়েছে তার গল্প, তার কারণ ,সেই প্রসঙ্গে আজকের ঘটনা আর  মিতালির দূরদর্শিতা ......। মিতালি তো অবাক! লোকজন যেন সব আস্ত একেকটা উইকিপিডিয়া। সব ঘটনা সাল তারিখ সমেত মুখস্থ ।এই আলোচনা আজ আর থামার নয়।রাত্রে শুয়েও সেই এক কথা। শশাঙ্ক যেন এখনো বিষ্ময়ের ঘোর কাটাতে পারছে না
– তুমি সোজা পুলিশে ফোন করে দিলে!
     মিতালি চুপ , এত হৈ চৈ চলছে সেই বিকেল থেকে ,অথচ ওর মুখে কোন কথা নেই ।
              রাত্রি তখন বেশ অনেক, কে জানে কটা বাজে, সবাই ঘুমোচ্ছে, এ সময়  প্রায়ই মিতালি  জানলার কাছে আসে। ওর জানলা থেকে আকাশের চাঁদটাকে বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। ওই চাঁদটার সঙ্গে অনেকক্ষণ চুপি চুপি কথা বলে মিতালি।
              আজও বলল ।কেউ দেখল না ।মিতালির চোখে মুখে দুষ্টুমির হাসি ।ব্যাগটাকে কেউ চিনতে পারেনি। ওটা টুসকির অনেক পুরনো  ইস্কুল ব্যাগ।আজ স্টোররুম পরিষ্কার করতে গিয়ে পেয়েছে। দলাপাকানো কাগজগুলো লক্ষ্য করলে দেখতে পেত ওর মধ্যে মৈনাকের জমানো অনেক পেপার কাটিং আছে, এমনকি দু'চারটে পুরনো টেলিফোন বিলও আছে।জীবনেও তো একটু ফোড়ন লাগে , না হলে জীবনটাও যে পানসে হয়ে যায়।
------------------------------------------------------------------------------------


 উড়োচিঠিঃ  আলো ও অন্ধকার
                    কুমারেশ পাত্র



প্রিয়..............
আলো আর এলনা ।অন্ধকারের ছায়াতে এখন চাদর মুড়ি দিয়ে দিনযাপন ।একা একা ।'ঠোঁট দিচ্ছে এখন অন্য ঠোঁটে আলো '।অগত্যা শুকনো মুড়ির সাথে বাবল গামের ককটেলে তিতিবিরক্ত হবার পরিবর্তে তুমি নাচন -কোদন করছো দিবারাত্র ।এঘর । ওঘর । সেঘর  ।রাস্তায় রাস্তায় কুচেবাচ্চারা ভ্যালেন্টাইন-ভ্যালেনটাইন খেলছে । তুমি ওদের ফানুস দাও।  ওদের ফানুসগুলো ফুলেফেঁপে উঠুক ।অন্তত একদিনের  জন্য হলেও । মানুষ  । ফানুস ।আর তুমি । তুমিও না হয় ঢুকে গেলে ফানুসগহ্বরে ।বাবল গামে তখন আর স্বাদ নেই ।তবু  হ্যাংলা মেগা সিরিয়ালের মতো অকারণে চিবোচ্ছ  তখন থেকে ।আর আমি অন্ধকারে একা ।খুব একা ।কেরোসিন ডিলার খেয়ে ফেলেছে লম্বা লম্বা দড়ি ।তার পাকস্থলীতে সাঁতার কাটছে সাপের খোলস ।অগত্যা এ আধাঁর চলছে চলবে ।ভালো থেকো ।
                                                                                                              ইতি
                                                                                                             তোমার ইয়ে


------------------------------------------------------------------------------------------

বইমেলার বইঃ২০১৪
       ধানবাড়ি গানবাড়িঃ স্বপ্নের বাইসাইকেলে  আত্মার ওড়াউড়ি
                               অমিত কুমার বিশ্বাস

বই মেলায় হাজার হাজার,কম বললাম,লাখ লাখ বই প্রকাশিত হয় । ক'দিন ধরে চলে বিজ্ঞাপন ।পত্রপত্রিকায় । সাহিত্যেরর চাইতে বইয়ের বিজ্ঞাপনের ভারে প্রায়  পত্রিকাগুলো ন্যুজ্ব । সোসালসাইটে ফাটছে বোমা ।প্রকাশক-কবি/লেখকের মধ্যে চলছে তুমুল খেলা ।গোপন চুক্তি ।সবাই জানে ৯৯% বই লেখকের গাটের কাঠ খসিয়েই হয় ।তবু চলে মিথ্যি মিথ্যি খেলা ।পুসিং সেল।নিজেই নিজের বই কিনে পুড়িয়ে দেওয়া আর ঠ্যাং তুলে লাফানো,উহু আমি ইস দ্য বেস্টু !! আর ইউ? ইয়েস ইয়েস ,আই আর! চক্ষু চড়কগাছ !!
        ঘাবড়াবেন না ।আমি আলোচনায়ই নেমেছি ,গরুরচোনা চারাপোনা  নকলসোনায় নয় ,আবার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে নয়,ব্রিগেড চলোয় নয়,তার পূর্বে বা পরের ব্যাপারেও নয় ।কান টানলে মাথা আসে।তাই মাথার পুরোটা না এলেও কিছুটা এসে আবার চলে যাচ্ছে ।মাথা তো যাবেই ।না হলে ঐ মাথা খাবে কে?এমনিতে বাঙালি মাথা খাওয়ায় সেরা ।আর সে জন্যই যত বুদ্ধি !!
          কবি  সুবীর সরকার এসবে নেই ।এক প্রান্তিক মানুষ তিনি । প্রান্তিক হয়েই থাকতে চান তিনি ।প্রকৃতির কোলেই তাঁর জন্ম । প্রকৃতিই তাঁর সব ।তাই প্রান্তিক মানুষ, প্রান্তিক জীবন,প্রান্তিকতা বার বার  ঘুরে ফিরে আসে তাঁর লেখায়।
      লাখো বইয়ের ভিড়ে এবারের কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হল তাঁর গদ্যের বই 'ধানবাড়ি গানবাড়ি' ।আত্মজীবনীমূলক বই এটি । গদ্য।কিন্তু তাতো পুরোটাই বিশুদ্ধ পদ্যময় ।কবিতার মতো মিঠা তাঁর প্রতিটি শব্দের চাউনি ।
"আর সন্ধ্যেবেলা ঝুঁকে পড়ে চাঁদ।আমি এলোমেলো চলতে থাকি ।হালকাভাবে হাঁটতে থাকি।পাশে ঝলমলে শহর ।খোলা দোকান থেকে গানবাজনার তীব্র আওয়াজ আসে ।আমাকে টোপকে যায় দ্রুতগামী রিকসা।সুন্দরীদের আঙুল দেখতে পাই।মসৃন নখ দেখতে পাই।সরে আসি নির্জনতার দিকে ।কুয়াশা জড়িয়ে মৃদু আলো নিয়ে আগুন ও বাতাস নিয়ে আমার জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সাদা হাসপাতাল।তুমুল ঔদাসীন্য আর নিঃসঙ্গতা নিয়ে আমি ঢুকে পড়ি হাসপাতালের পাকস্থলীর ভিতর।।....."(গুহালিপি/ধানবাড়ি গানবাড়ি/পৃঃ১১)
আঃ......!! প্রথম বলেই ছক্কা ।প্রথম পাতা পড়ি আর হামাগুড়ি খাই ।ঘুরে ফিরে আসি একই যায়গায় । বার বার ।এগোতে ইচ্ছে করেনা ।আলস্যসুখ রাসেলও বলে গেছেন ।তাহলে?কী হবে বইয়ের?সবাই যদি অলস সুখে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকেড?অগত্যা এগোতে হয় ।বলা বাহুল্য একটু জিরিয়ে নেবার পর পাঠককে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় শব্দগুলি। সুবীর সরকারের শব্দ তো আর নেহাত শব্দ থাকেনা ,হয়ে যায় শব্দের প্রতীমা।অতএব কাব্য ।অনুভবের মহাকাব্য ।সে মহাকাব্যে বিচরণ করতে সহসা চড়ে বসি স্বপ্নের বাইসাইকেলে ,আর ক্রিং ক্রিং করতে করতে পৌঁছে যাই অলৌকিক সোপানে ।
"রিমঝিম বৃষ্টির মধ্যে,টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে শূন্যতা নিয়ে থই থই ভেসে গেছি আমি ।আমার কোনও বন্ধু নেই।স্বজন নেই ।ঈশ্বর নেই। পৃষ্টপোষক নেই ।রাজনীতি নেই ।আমি ঠিক স্বাভাবিক মানুষ নই ।সতেজ যুবক নই ।গুছিয়ে কথা বলতে পারি না ।গলা ছেড়ে গান গাইতে পারি না ।মস্তানের মতো দুরন্ত গতিতে সব কিছু দু'পকেটে  ভরে নেবার রণকৌশল আমার আয়ত্তে নেই ।অন্ধকারে  নিসর্গ দৃশ্যের কিনারা ধরে হাঁটি ।নির্জনতা ভেঙে দূরে জেগে থাকে ভাটিখানা।আমি মাতালের কাঁধে হাত রাখি।আর লম্পটের চোখের জলে ভেসে যায় আমার করতল।।.."
                           (এলিজি/ধানবাড়ি গানবাড়ি /পৃঃ১৩)
সাইকেল রেখে উপলব্ধি করি এই ভেসে যাওয়া।এই 'নেই' যুক্ত মানুষটার খেদ ।যন্ত্রণা।আবিষ্কার।একান্ত বিচরণ ।স্লোগান থেকে বেশ দূরে থাকার স্বর্গীয় সুখ ।
     এর পর আবার থামা ।থামাতো নয়,যেন  থমকানো ।তেল-আতেল থেকে দূরে থাকা জীবনের পাশে ।
 "আমার কবিতাজীবন শুরু হল।আমার অভিশাপের জীবন শুরু হল ।"(হাতিমার্কা কেরোসিন/ধানবাড়ি গানবাড়ি/পৃঃ১৪)
অ্যাঁ !!সে কি !! তা অভিশাপ কেন? খামোকা কেন অভিশাপ হতে যাবে কবিতাজীবন?মাথা ঘোরে ।বনবন ।কিছু বুঝে উঠতে পারিনা ।অগত্যা সাইকেল তুলে নিয়ে প্যাডেল করি ।এগোই ।এসে পড়ি 'ললিত কুসানী'র দেশে ।সাইটোল সম্রাজ্ঞীর দেশে ।মাটিয়াবাগ টিলার রাজবাড়ি।মাহুত-রাজবংশীদের দেশে ।আসি ।আর ভাবি,সত্যিই কি অভিশাপ!বুঝি এ এক স্বর্গীয় অভিশাপ ।নিজেকে দুঃখি করে আনন্দলাভ।প্রকৃতির মাঝে নিজেকে  রিক্ত করে আনন্দলাভ ।এই আনন্দলাভেই সাইকেল তুলে নি ।এবারে জোরে চালাই।এবারে ঢুকে পড়ি ফেলে আসা আত্মপ্রতিকৃতির মাঝে ।জল আর ঝাউবনে তৈরি ।আর একটার পর একটা পার হই।'রঙিলা দালানের মাটি'।'আবহমান'।'গাথাশোলকের অন্ধকার '।'শোলকগাথা'।'বউয়ার বাপ'।'কাঠপুল'।'এলুয়া কাশিয়ার ফুল '।বাঘের ডাক'।'ভোন্দা বিলাই'।'ঝাড়ের বাঁশ'।' হাড়িয়া ম্যাঘ' ।'লাল টিয়া' ।'এপিটাফ'।'সোলক গাথার বর্ধিত অংশ '।অবশেষে এসে পড়ি 'ধানবাড়ি গানবাড়ি '।যা আমাদের গন্তব্য ।আমার আপনার ।হারিয়ে যাবার গন্তব্য । ইট কাঠ পাথরের ছ্যাঁকা দেওয়া জীবন থেকে ঢের দূরে থাকা এক জীবন ।অন্য জীবন ।"হেথা নয় হেথা নয় ,অন্যকোথা"।অন্য রকমের জীবন ।যে জীবনের আভাস পূর্বেই পেয়েছিলাম বইটির অপূর্ব প্রচ্ছদে ।প্রসঙ্গ ও প্রচ্ছদ--এ দুয়ের মেলবন্ধন ঘটানো যে কত কঠিন তা কেবল যাঁরা বই নিয়ে একটু বেশি নাড়াচাড়া করেন তাঁরাই জানেন ।আর এখানে সেঁজুতি দাশগুপ্তের প্রয়াস সার্থক ।এ জীবন বিমুখ হয়ে কেবলই আমরা শহুরে উকুন মেয়ে চলেছি নিজের অজান্তে ।উদ্ভ্রান্ত উদ্ভট উন্মাদের মতো ।আর তাকে নিয়েই আছি বেশ ।'চুমু আর বিদেশ '। গভীর রাতে  টর্চ হাতে জীবনের সন্ধানে কে  নেমে আসতে চায়,এমনকি স্বপ্নের বাইসাইকেলে?জীবন?ভুল বললাম ।অন্য জীবন।অন্য রকমের জীবন।মাছরাঙা সদৃশ জীবন ।কবিতা জীবন।অভিশাপের জীবন।স্বপ্নের বাইসাইকেল থেকে নেমে স্বপ্নের গভীরে ঘুমিয়ে পড়ার এক জীবন ।
==================================
ধানবাড়ি গানবাড়ি//সুবীর সরকার //ধানসিড়ি প্রকাশন,কলকাতা //ISBN 978-81-926422-6-0//মূল্যঃ ৮০ টাকা মাত্র(৫ $)
--------------------------------------------------

     তবু লালনমনঃ                        
          
      "আর কতদূর পার হলে আমাদের বাড়ি?"
                            কুমারেশ পাত্র

           মায়ের কান্না এখন মধ্যরাতের নিদ্রা থেকে একাকী নেমে গেছে একটা      পূর্ণাঙ্গ  নদীর অহংকার নিয়ে ।বাবা  তার কিছুই টের পাইনি ।তাঁর ক্ষত শুকিয়ে গেছে আপোসী মলমে ।আজ সে তাই  ঘুমায়।তাঁর ঘুমের ব্যাকুল ভাষা পৃথিবীতে আরো ঘুম আনতে চায়--ঘুম পাড়াতে চায় গাছপালাদের ।বাবা টের পাইনি অনুপমা কখন নদীতীরে আসে ।ডুব দেয় জলের শরীরে ।একসময় নদীটা সাপের মতো গোঙাতে থাকে ।মাথা না ল্যাজ তুলে দেয় আকাশে ।ফোঁস ফোঁস করে দেয় এক ছুট --ছুটে চলে যায় মহাকাশে ।তারপর একটা পূর্ণাঙ্গ  আঁধার গম্ভীর আকাশ জুরে ।সাপের কালো পেট থেকে অনুপমা বেরিয়ে আসে।হেঁটে  যায় ।তাঁর ছোটো ছোটো পায়ের ছাপ আলপনার মতো লেগে থাকে সারারাত ।বাবা কি এখনও কিছু টের পান ?অনুপমাকে?সভ্যতার  চোখরাঙানী যাকে নিয়ে গেছে দূরে ।যাকে আমি অস্ফূটে দিদি বলে ডেকেছিলাম ।শেষবার ।সবাই ছুটে এসেছিল আমার দিকে ,সভ্যতার মারণপান্ডুলিপি নিয়ে শ্বাসরোধের উল্লাসে মেতেছিল .......তখন ! একবার !তারপর আমিও চোখের পাতা বন্ধ করেছি ।ঘুমিয়েছি প্রাণপন ।কান্না,হাসি,দম---বন্ধ করে । অনেকক্ষণ।এমনকী পিঠে বসা মশাকেও বেমালুম ভুলে গেছি ।তবু বাবা আশ্চর্য ঘুমের নিবিড়তায় ।আর আমার মায়ের নিঃশ্ব হৃদয়ে সঞ্চিত পরিণত ঘৃণায়ভরা উপাখ্যানের পর জন্মনেয় একটা স্বপ্নের সংসার ।যার ঘরগুলি খুব গোছানো । রান্নাঘরের তাকে বাসনগুলি সাজানো । খাবার আছে। বিছানা আছে।মায়ের খুস্ খুস্ কাশির জন্য ওষুধ আছে।কিন্তু ঘটি-বাটির নিত্য টুংটাং নেই ,ভাতের কাড়াকাড়ি নেই,মুখরা তর্জনি নেই ,খবরদারী নেই ,যেখানে পান্ডুলিপিতে শুধু আমাদের দিনযাপনের বিশুদ্ধ প্রনালী,যেখানে একটা পিস্তল বোবাকালা হয়ে যায় অমায়িক ভাবে ,যেখানে একটা মরচে পড়া সাবেকী কামান চুপিসাড়ে সরে যায় সলজ্জ চক্ষু নিয়ে ।এখানে অনুপমা হেসে  ওঠে ,এখানে মা হেসে ওঠে ,এখানে বাবা হেসে ওঠে ,এখানে গাছপালা ,নিদ্রিত পাখি হেসে ওঠে মলয়বাতাসে ।
----------------------------------------------------------------------------
    অষ্টম সংখ্যা এখানেই শেষ ।পুরোনো সংখ্যাগুলো নীচে পাবেন।পড়ুন ও পড়ান।ভালো থাকুন।'অচেনা যাত্রী'র সঙ্গে থাকুন।বিদায় ।

মন্তব্যসমূহ

দেবশ্রী ভট্টাচার্য্যের ফোড়ণ গল্পটা বেশ ভাল লাগল।
Unknown বলেছেন…
ফোড়ন গল্পতা দারুন