অচেনা যাত্রী-৫//"শীত কাল কবে আসবে সুপর্ণা?" (১-লা ডিসেম্বর,২০১৩)

সূচিপত্র
................
সম্পাদকীয়ঃ~অমিত কুমার বিশ্বাস
 কবিতাঃ~   অমিতাভ দাশ,নিষাদ নয়ন,ওয়াহিদা খন্দকার,সুমন  কুমার সাহু,মীনাক্ষী মুখার্জী,অঙ্কুর কুন্ডু,প্রিয়মুখ রোদ্দুর, অমিত কুমার বিশ্বাস
 প্রবন্ধঃ~
              ১.শিল্পীর স্বাধীনতা  ও আমাদের কর্তব্যঃ~সন্তোষ কুমার হালদার
              ২.বিভূতিভূষণঃজীবনের বাস্তবতায় ও সাহিত্যের কল্পনায়ঃ~ দেবাশিস মন্ডল
 উপন্যাসিকাঃ~
               মাহুত বন্ধু রেঃ~সুবীর সরকার
---------------------------------------------------------------.
 সম্পাদকীয়ঃ~
"শীত কাল কবে আসবে সুপর্ণা?"
.......................................
 হেমন্তের মেঠো পথে   আচমকা তোমাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালাম । ভাবলেশহীন তুমি আজ তোমাতেই  নেই বুঝে উঠতে না উঠতেই মাটির হৃদয় থেকে উড়ে গেল সাদা সাদা বকেদের ঝাঁক ।আমি চেয়ে থাকি কেবল আকাশের দিকে ।কবিতার মতো স্বপ্নে ভেসে যায় আমার প্রশ্বাসের অভিমান । তুমি বোঝনা ।বোঝনা কুয়াশার পালকে লেগে আছে  আমাদের আদরের মিহি শব্দগুচ্ছ আর জোছনার নীল রং ।বোঝনা কাঁচামিঠে রোদ্দুরের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মিঠে সকাল তোমার জন্যই ডুবে গেল বিল-বাঁওড়ের হৃদমাঝারে ।তবু নির্বিকার তুমি ।এখন কেবলই আমার অপেক্ষা ।যদি আসো ।একবার । অন্তত একবার ।এই হেমন্তের অরণ্যে ।এই পোষ্টম্যানের কাছে তোমার গচ্ছিত চিঠিগুলি নিতে ।যদি ।যদি একবার সুপর্ণা !
..........................................................................
 কবিতাঃ~
হেমন্তিকা / অমিতাভ দাশ
================
১.
তখন,
আমাদের গা'এর ওপর ...

ফুল ঝরে, পাতা ঝরে, ঝরে উড়ন্ত পাখীর
গা-ঝরা আলতো রোঁয়া...

রেণু রেণু ভাল লাগার ছোঁয়ায়
আমরা
পলিমাটি হয়ে যাই --

আর দূর দূর দূর থেকে আসা
বৃষ্টি দেখে

কি সুন্দ-অ-র
তোলে মাথা
একটি নদীর অঙ্কুর ...

তিসতা!

২.
আমি পর্বগত বৈচিত্র, লয়, ধ্বনি, তরঙ্গ, সব
হ্রাস করে একটা গাছের মতো স্থির হয়ে যাই...

আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখি পাতার জন্ম,
শাখাপ্রশাখার বৃদ্ধি
কুঁড়ির চোখ মেলা...

এভাবেই আসে অনভ্যস্ত সংশ্লেষণের
দুঃসাহস,
প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে এক আশীর্বাদ

একদিন
ক্লোরোফিল সবুজও করে দেয় আমার অনমনীয় একগুঁয়েমি কে

চরিত্রদের অতিক্রম করে কবিতারা
বুকের পাথরে শেকড় গাড়ে...

আনন্দ উড়তে থাকে একঝাঁক শিমূল তুলোর মতো!

প্রায় দেখা যায়না এমন আপাত-তাৎপর্যহীন
কিন্তু মহীরূহবাহী সত্য
বয়ে বয়ে --

দূর থেকে দূরে...

৩.
রোদের ও আঙুলেরা ছোঁয় হইহই, --
হাওয়ারা জড়ায় দেখি বাহুডোরপাশে...
শীত শীত দুপুরটা নৌকার ছই, --
এমনইতো ডাক ছিল. বিভোর আকাশে!

সোহাগে আরক্তিম আছিল ও গাল।
পৃথিবীটা সলাজে যে কোথায় হারালো!
এমন সঘন কেন নয় চিরকাল?
দুটি চিল উড়ে উড়ে জলছুঁয়ে গেলো!

জলের পাশেতে জল, নিবিড়, অথই!
বিরহ মধুর হয়ে অসীমেতে মেশে,
শীত শীত দুপুরটা নৌকার ছই, --
আকাশ ময়ূর-নীল, -- নদী ভালবেসে!

৪.
তোমাকে টেনে আনি উন্মুক্ত স্বাধীনতায় ...

সে নির্মীয়মান ছন্দে
মৃদু হেসে
যতিচিহ্ন দিয়ে কেমন বললে
'বুঝি কতো প্রয়োজনীয়
বর্ণমালা আর প্রেম!'

তখন আকাশ ও উল্লাসে বলে
'প্রিয়,
আমায়
তাহলে কোর এবার রচনা --
তোমার বর্ণে...গানে...আনন্দে'

তখনও, আমার গ্রামোফোনে পিন আটকে
তুমি শুধুই ঘুরে চলেছো

তাও দারুণ লাগে

আমার বুনোশীষ ও বুনোশিস্
তুমি

৫.
অন্ধকার গাঢ় হলে
বুঝতে পারি তোমার চাওয়া গুলি...

সাঁকো হয়ে গান শুধু গান
আর আবছা অনুভবের আলো

যেন ঋক, সাম, যজু, অথর্ব...
নতুন জন্ম আদি নক্ষত্রের

ঝাউবন দোলে ...
রাতটা আরো কোমল হয় বিস্তারে বিস্তারে

না ঘুমিয়ে গড়ি প্রতিমা তখন...
সমান্তরাল উত্তরণে শিহরণে
সপ্তডিঙা পাল তোলে --
ফোয়ারায় হাজার প্রজাপতি!

ভোর জানলা পর্দা আদরে টেনে বন্ধ করে বলে
''এবার ঘুমোও...এবার ঘুমাই?''

৬.
বললে সে
..........'তুমি আমার হেমন্তের কবি হয়ো!'...

'আমার শব্দটির ওপর
অনেকটা দিয়ে জোর
আর গাঢ় ঠোঁটে চাপ চাপ উত্তাপ ছড়িয়ে...

অগত্যা
বহুবর্ণ প্রমিতি প্রতীতী
প্রতিষঙ্গে বিজড়িত হয়ে
অর্থবাহী উত্তেজনা আনে!

চারিদিকে সমুদ্র সফেন...

সে নারীর শস্যে
রোদ হয়ে বসে থাকি রাতভোর
কবিতায় কবিতায়...

এমতি আপাত-ফাল্গুনে
হেমন্ত এসে উঁকি দিয়ে যায়

দেখে
পান্ডুলিপি জেগে ওঠে রমণে রমণে
...............................................
নিষাদ নয়ন
মিথফুল ও মাইম
ফুটে আছে কাগুজি ফুলের ভিতর ফুল
কোন ঘ্রাণ নেই, দেখতেই শুধু ভালোলাগে
প্রজাপতি-মৌমিতা ভুল করেও চাই না বসতে
ও ফুলের রেণুকায়, কেশরের ভাঁজে লুকানো নেই
কোন বেদনা ; ভুলকে ফুল আর ফুলকে ভুল ভেবে
ভুল করি, সত্যকে মিথ্যা মনে হতে থাকে আর
এভাবেই হয়ে উঠি মুখোশের মুখ- একেকটি মাইম
অথচ মিথ্যা ক্রমশ লোকায়ত সত্য হয়ে ওঠে, যেন
ভুলের প্রতিশব্দ ময়ূরকুমারীর প্রতি মিথ্যা আখ্যান

মনপিপি 
মন শুধু ছুঁতে পারেনি মন, একলা বসে সবুজ মেয়ের
মতো কাঁদে, প্রেমের মড়া ডুবে গ্যাছে মীনকুমারীর ঋতুকালের
সাথে, এখন ফাগুন নয় দেহের ভিতর সমুদ্রের জলসূত্রই কাছে
ডাকে নদী ও নারীকে; জল আর মন প্রায় জগে ওঠে আদিরসে
বাতাসের আবেগি কোমল ছোঁয়ায় কিঙবা কম্পনানুভূতির মায়াকোষে

প্রেম অথবা অপ্রেম
প্রেম শরীর ছাপিয়ে মনের লাবণ্য ছুঁয়ে যায়, হঠাৎ বৃষ্টিতে ধোয়া বাতাসের আঘ্রাণে এত সুন্দর হয়ে ওঠে সবকিছু । তখন শুধু মন নয় তার ক্যারিকেচার প্রেমের সুর ও আকরষণ ধরে রাখে, রেখা-আল্পনার মতো গায়ের পুরনো জামার ভিতর লুকানো থাকে; যে আগুনের অশেষ ভালোবাসা- কী চাও তুমি? পুলক না প্রেম, না কি হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো মনের ভূগোল; উত্তর-দক্ষিণমেরুর বিমুখী মাহূর্তিক মেরুনসুখ

শীত
মাতালের নেশা কেটে যায় তবু সে মনের টানে উড়ে বেড়াতে পারে
চোখ বন্ধ করে কুয়াশার চাদ্র মুড়ি দিয়ে কোথাও কী ভেসে যাওয়া যায়
ব্যাঙের রক্তপানের তিয়াসে কিঙবা শীতের উষ্ণতা খুঁজতে খুঁজতে
ছুটে যায় সাপেরা। একটি ব্যাঙ খেয়ে খুব আয়েসের সাথে শীতের দিনগুলো
তারা কী সুন্দর প্রতিবছর একইরকম নিদ্রালু থেকেই বাইপাস করে দ্যায়।
আবার কেউ কেউ মদপান ও ব্যাঙের মাংস খেয়ে কম্বলের ওমের ঘোরে
কাটাতে থাকে একজীবনের বিগত ও আসন্ন শীতসকালের বেডরুম…
.........................................................................................
ওয়াদিহা খন্দকার
অপেক্ষা
তেজস্ক্রিয় অণু পরমাণুর ঝাঁঝালো দীর্ঘশ্বাস
চেতনায় অন্তক্ষয়ী সংগ্রামের মৌনব্রত
সংকল্পের রসায়ণ লোহিত কণায়
প্রজাপতির রঙের নেশায় মাতাল প্রেত আত্মারা
অস্তিতে মজে যাওয়া পাতকুয়ো
জত্ন জাগায় পদ্ম জন্ম দেবে বলে।

বর্তমান দর্শন
পথিকের নগ্ন পদস্পর্শের বুকভরা তৃপ্তি
রাজপথের প্রশস্ত হৃদয়ের দীনতা
অথচ অন্তরে মরীচিকার  গোপন বসবাস
ঘোচায় ঠিকানা
আকুতির মর্জি পরীক্ষা
আর দুঃখ যাপনের একরত্তি  বিশ্বাস
তবু বাসে ট্রামে ঠাসবুনটের ভীড়ে
সিক্ত হয় নোনা ভালোবাসা ।

সরে যাচ্ছি কেবলই
সোম-শনির আলপনায়
মগ্ন জলচর পৃথিবী
হাতের রেখায় বিড়ম্বিত
যত্নের নতুন মুখোশ
চেনা রাস্তার ভাঁজে অমলিন সন্ধ্যা
শোবার ঘরের গলিতে
চেনা রেলগাড়ির ঘুম
ল্যাপ্টপের ইতস্ততঃ মুখ
গলে আসছে
অসহ্য বিনোদনের ফাঁকে...
..............................................................

সুমন কুমার সাহু

সুখ দুখ

একদিকে তুমি বৃষ্টি দেখ
একদিকে আমি কান্না
একদিকে তুমি কবিতায় মাত
একদিকে ভাঙা রান্না।

একদিকে তুমি মেঘ বাদলায়
গান শোনো নির্জনে
একদিকে আমি চাল আগলায়
কে কোথায় চিত্কারে।

একদিকে তুমি একদিকে আমি
বৃষ্টির ধারাপাতে
প্রকৃতির মাঝে বাসা বাঁধি
পাশাপাশি সুখ দুখে ।
.............................................

সত্যের ঘোর

মীনাক্ষী মুখার্জী


চোখের কোণে জমাট বাঁধা ঈর্ষার বিষ পিঙ্গল
ফুটপাতের কফির দোকানে ঘোরাঘুরি করছে প্রতিযোগীতা
নাচানাচি করছে ঝিম ধরা আলো বস্তিতে
আঁচড় কাটে স্থাপত্যের গুহায় ফুলদানি ভাঙার আওয়াজ
বাজারের চুপড়িতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে উঠোনের সজনে ফুল
অবগাহন করে খোলা চুলে ভিন্নতার কাব্যচর্চা
অন্যের ভাষায় পাক খায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠা চিন্তা -

...........................................................

 অঙ্কুর কুন্ডু
এখনও  বাকি  আছে

আমার অনেক পথ হাঁটা বাকি
জীবন তোমার সাথে
                    মৃত্যু তোমার সাথে
       জীবন-মৃত্যু তোমার সাথে
কিছুটা এগিয়েছি এপার
কিছুটা পিছিয়েছি ওপার
এখনও বাকি আছে –বাকি পথ হাঁটা

       তোমাদের সাথে যাত্রা শুরু
       তোমাদের মতো কাটানো দিন-রাত
       তোমাদের মতো করে পাল্টাত
       আমিও পাল্টাতাম আমার মতো ১৮০ডিগ্রী-তে
       কখনও একফালি রোদ ,কখনও কবিতা
       এখনও আমি দর্শক তোমাদের শূন্যতার
আমার অনেক পথ হাঁটা বাকি
জীবন তোমার সাথে
                    মৃত্যু তোমার সাথে
       জীবন-মৃত্যু তোমার সাথে

       এখনও করছি অঙ্গভঙ্গি
       এখনও বেঁকে চলেছি কৃমির মতো
       তোমাদের মতো
       তোমাদের পা-এর মাটি খুঁজছি
       কবর খুঁড়ছি
       তোমাদের ,তোমাদের –ঐ তিন টাকার
       তাপ্পি মারা পকেটে তোমাদের খুঁজছি
কিছুটা এগিয়েছি এপার
কিছুটা পিছিয়েছি ওপার
এখনও বাকি আছে –বাকি পথ হাঁটা

সমাধির পা-এর নীচে ফাটল
হাত ঢুকিয়ে শুকনো খট্খট্
ঝড়ের বেগে আছাড় মারবে
বাবুঘাটের পিন্ডি-দানে ,আর
খুলিগুলোর নাম হবে ব্রেন
শুকিয়ে যাওয়া আমসি স্বাদে
যেটুকু জল ছিল –শুষিয়ে নেবে রোদে ;তাই
জীবন তোমার সাথে
                    মৃত্যু তোমার সাথে
       জীবন-মৃত্যু তোমার সাথে
এখনও বাকি আছে –বাকি পথ হাঁটা . . . . .
............................................................
 অমিত কুমার বিশ্বাস
ম্যাকবেথের বিবি-২
ভাসমান ছুরি-সংলাপের চুম্বকত্বে অসহায় হাত দুটো বাড়িয়ে দিলাম.....রাজামশাই আমি আসছি.....ঘুমিয়ে থাকুন...আমি আসছি নিজের ঘুমকেই গলা টিপে মেরে ফেলার একটু আগে আমার মুখটা একবার চেয়ে দেখুন ....দেখুন এখনও  আমি কাঁদতে পারি পাখির মতন রাত-জোছনায় ভাঙা ভাঙা মেঘের নীচে........হৃদয়ের ভিতর বহমান রক্ত নদীর শরীরে ডুব স্নানে হারিয়ে যায় আমার সাধের আংটি আর মানবিক দস্তানা....রাজামশাই আমি আসছি.........শেষ রাতের শেকল ভেঙে হাজার পায়রা-হত্যার আনন্দে যখন  ম্লান হয়ে যাচ্ছে আমার কালো হাত  আমার প্রচ্ছায়ার মুখেও তখন বিদ্রুপের হাসি.........এখন অবিরাম আগুনের উপাখ্যানে কেবলই  আমার অনন্ত সন্তরণ ......আমি আসছি !
.........................................................................
 প্রবন্ধ~১
                                    শিল্পীর স্বাধীনতা   ও আমাদের কর্তব্য//সন্তোষ কুমার হালদার

                  'শিল্পীর স্বাধীনতা','চিন্তার স্বাতন্ত্র','ব্যক্তি স্বাতন্ত্র' ইত্যাদি গালভরা বচনমালিকা শুনতে মন্দ লাগে না । শিল্পীর স্বাধীনতার বিষয়ে বর্তমান ভারতবর্ষে  দ্বিতীয় দফায় জরুরী  অবস্থার কাল । আমার এক শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক বনগাঁর একটা লিটল ম্যাগাজিন 'মেঘনা'য় একটা বিদেশী  কবিতার অনুবাদ করেছিলেন ।নিকোলাস গিলেনের 'হাঙ্গার' ।তার একটা লাইন 'এর নাম ক্ষুধা যাকে আফ্রিকার জঙ্গল থেকে আমদানি করা হয়েছে' । এটির ওপর জরুরী অবস্থার কোপ পড়েছিল ।আর পড়েছিল বর্তমান লেখকের একটা ছোট গল্প 'ছোবল'-এর ওপর ।একটি বিশেষ অংশ যেখানে রেল কলোনীর এক গর্ভবতী শ্রমিক রমণীর পেটে পুলিশ লাথি মেরেছিল,তাঁর কথা লেখা ছিল এই গল্পে ।জরুরী অবস্থার সময়ে সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত,সাহিত্যিক গৌর কিশোর ঘোষ প্রমুখ অনেককেই শ্রীঘরে যেতে হয়েছিল ।পরাধীনতার সময়ে 'পথের দাবী',বিবেকানন্দের রচনার কিয়দংশ নিষিদ্ধ হয়েছিল;নিষিদ্ধ হয়েছিল অনেক পত্রপত্রিকা ।শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ  তথা বাকস্বাধীনতা বা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় নিয়ন্ত্রন অবশ্যই অবিধেয় ।তবে একথা অনস্বীকার্য যে নিরঙ্কুশ ব্যক্তি স্বাধীনতা কোন সমাজই বরদাস্ত করেনা ।দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরপত্তার প্রশ্নে রাষ্ট্র ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে বৈকী ।বাকস্বাধীনতা আছে বলেই বলতে পারিনা "নাপতে চুলদাড়ি কেটে দে" অথবা " মুচি জুতো পালিশ করে দে" । লিখতে পারিনা "কালী একটা সাওতালী মাগী " অথবা " চৈতন্য দারু ব্রক্ষ্মে লীন হন নি;পান্ডাদের ডান্ডা খেয়ে পটল তুলেছিলেন'।ব্যক্তি মানুষের কোন বস্তু বা বিশেষ মানুষ সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনা চিন্তা থাকতেই পারে;তবে তা সদর্পে ঘোষণা করা বা লেখা যায় না ।
                 প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে দেশীয় বেশ কিছু রসরচনা এবং শিল্পীদের এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে ,সমকালীন শিল্পের কোন দায় নেই,শিল্পীর শিল্পচর্চা করার অধিকার নিরঙ্কুশ;সে তার মাধ্যমকে নিয়ে যা-ইচ্ছা তাই করতে পারে ।তাদের কাছে শিল্প সৃষ্টি সমাজ-কল্যাণ নিরেপেক্ষ পুরোপুরি ব্যক্তি ভিত্তিক ব্যাপার ।এ ধরণের মতাবলম্বী শিল্পীরা ব্যক্তি জীবনেও উচ্ছৃঙ্খল ও উন্মার্গগামী ।শিল্পীকে প্রকৃত শিল্পী হতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়;অনেক আমোদ-প্রমোদ থেকে দূরে থাকতে হয় ।ফ্লবেয়ার তাঁর শিষ্য মোপাসাঁকে হাত ধরে এসব কথা বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন ।ত্যাগ তিতিক্ষা ও সবংসহ রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'চিত্রা' কাব্যগ্রন্থের 'সাধনা' কবিতায় বলতে চেয়েছেন শিল্প একটা সাধনা ,একটা ব্রত--
                     "তুমি জান ওগো করি নাই হেলা
                      পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা,
                      শুধু সাধিয়াছি বসি সারা বেলা
                       শতেক বার ।"

                        কবিতা ও কাব্য সৃষ্টি এবং জীবন রচনা একই রচনার দুই পিঠ ।সাধনা ,সংযম ও নিরলস চেষ্টা এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য ।সে কারণেই বাল্মীকি বসেছিলেন 'ধ্যানাসনে তমসার তীরে' ।আজকের দিনে তথাকথিত কবি-সাহিত্যিকদের সে সংযম সে সাধনা তিলমাত্র নেই বললেই চলে--কি ব্যক্তি জীবনে কি শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে ।মার্কিন কবি গীনসবার্গকে এক  ভক্ত  শ্রোতা তাঁর একটা কবিতার অর্থ জিজ্ঞাসা করেছিলেন ।কবি সকলের সামনে তাঁর সমস্ত পোশাক খুলে ফেলে সম্পূর্ণ  দিগম্বর  হয়ে জানালেন যে তাঁর কবিতার অর্থ  হচ্ছে এই ।এই সব কবি সম্পর্কে রুচিসম্পন্ন সাহিত্য রসিকের কী ধারণা হতে পারে তা সহজেই অনুমেও  ।অসংযত শিল্পীর জিবনে নেমে আসে  'Punishment by natural consequence '। মোপাসাঁ তাঁর চরম দৃষ্টান্ত,যিনি মহান শিল্পী হয়েও দুরারোগ্য সিফিলিসে ভুগে মারা যান ।বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক তথা বিদ্রোহী কবি মাইকেল মধুসূধন বিজাতীয় প্রলোভনে ভুলে এবং উৎকেন্দ্রিকতার পথে নিজের জীবনে ও পরিবারের সকলের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছিলেন ।সমাজ কল্যাণের কথা না ভেবে  একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে যারা লেখেন তাদের অনেক বিড়ম্বনা সইতে হয় ।'শয়তানের পদাবলী'(Satanic Verses) -র লেখক তা  মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছেন । ভারত সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে  ঠিকই করেছিলেন ।অথচ উদ্ধত লেখক  তৎকালীন প্রধান মন্ত্রীকে  তিরস্কার করেছিলেন । 'শয়তানের পদাবলী'(Satanic Verses) হাজার হাজার কপি বিক্রীত হচ্ছিল বটে ;কিন্তু এই রচনার জন্য অনেক দেশের শান্তি  ভঙ্গ হয়েছিল ।ভারতের মতো দেশে ঐ বই ছাপা হলে কী ভয়ংকর কান্ডটা না ঘটত তা অনুমেয় ।
                  আমার মনে হয় যারা এধরনের গল্প,কবিতা বা উপন্যাস লেখেন প্রথমত cult figure হওয়ার জন্য ।ঘড়া ঘড়া কারণবারি সেবন করে রিরংসার  উদ্রেককারী সাহিত্যকর্মে লিপ্ত হন ।অনেকে আবার কায়েমী স্বার্থবাদী  সম্প্রদায় এবং প্রকাশকের দ্বারা ক্রীত হন । এসব ছাড়া আছে  অর্থের প্রলোভন। টলস্টয় তাঁর 'What is Art?'  গ্রন্থে দৃষ্টান্ত সহযোগে দেখিয়েছেন যে,পরশ্রমজীবী অলস ধনিক ও অভিজাত শ্রেণি  নরনারীদের ভোগের স্পৃহাকে  পুষ্ট করে তোলবার জন্যই শিল্প সাহিত্যে রিরংসা পরিবেশনের এত বিচিত্র ভঙ্গি । এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে সাহিত্য বা শিল্পদূষণ বন্ধ করা যায় ।একক ভাবে  কোন মানুষের দ্বারা এই মহতী কর্ম  করা সম্ভব নয় ;কেউ সেটা করে সফল হতে পারেন না ।অনেক সময় এই সমস্ত প্রতিবাদী মানুষকে আক্রান্ত হতে হয় । বর্তমান প্রবন্ধকার 'সীমান্ত বাংলা'য় 'রবীন্দ্রদূষণ' নামক প্রবন্ধ লিখে বনগাঁর অনেকের  বিরাগভাজন  হয়েছিলেন এবং তাকে পথে ঘাটে এমনকি বাড়িতে শাসানি ও গালমন্দ  শুনতে হয়েছিল ।সুলেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ 'শয়তানের পদাবলী'(Satanic Verses)-র  নিন্দা করেছিলেন বলেই প্রকাশ্যভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন । বিখ্যাত পরিচালক হৃষীকেশ মুখার্জি কলকাতায় এসে বলেছিলেন যে তাঁরা সেন্সর বোর্ডে বসে চলচ্চিত্রের অনেক দৃশ্যই বাদ দিয়ে দেন,অথচ তাদের  অবাক করে দিয়ে  সেই সব দৃশ্য ছাড়পত্র পেয়ে যায় ।সবদেশে সবকালে অনেক মানুষ আছেন যারা  অর্থকে পরমার্থ মনে করে এসব করে থাকেন ।কায়েমী স্বার্থবাদীরা সমাজ সংসার দেশ জাতির কথা ,তাদের কল্যাণের কথা না ভেবে শিল্প ও সাহিত্য থেকে সত্য-শিব-সুন্দরকে নির্বাসিত করবার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে।
                 মহামতি লেলিন এবং টলস্টয় এই মত পোষণ করেন যে, গণচেতনার জাগরণ এবং গণসংগ্রামের মধ্য দিয়েই এই জাতীয় অপকর্ম ও অপসংস্কৃতি রোধ করা সম্ভব ।মানুষের মনে সুস্থ  সংস্কৃতির পিপাসা অবশ্যই আছে এবং এই পিপাসাকে সংগঠিত  রূপ দিয়ে পরিচালিত  করতে হবে  গণসংগ্রামের পথে ।অবশেষে বলি ,সাহিত্য হল হিতের সাথে বর্তমান--বহুজনহিতার সাহিত্যিক বা কবি হলেন দ্রষ্টা এবং শ্রষ্টা দুই-ই ।আপনি যখন লিখবেন ,গাইবেন,ছবি আঁকবেন তখন আপনি জাগ্রত এবং বহুজনের মধ্যে অবস্থিত ।তাই বঙ্কিমের সাথে সুর মিলিয়ে বলি যে,লিখে যদি  মানুষের মঙ্গল করতে  পারেন ,তবে লিখবেন ,নতুবা নয় ।বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক লিও টলস্টয় তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন যে তাঁর প্রথম দিককার উপন্যাসগুলি ভোগী সমাজের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে রচিত;সুতরাং ত্যাজ্য ।সমাজ ও জনগণের প্রতি অসীম দরদ ছিল বলেই তিনি তাঁর নিজ সৃষ্টি সম্পর্কে এই ধারণা পোষণ করেছিলেন । কবিরা হচ্ছেন 'Unacknowledged legislators of the world ."
.................................................................................
 প্রবন্ধ~২
                             বিভূতিভূষণঃজীবনের বাস্তবতায় ও সাহিত্যের কল্পনায়//দেবাশিস মন্ডল

                       যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন 'বাংলাদেশের সাহিত্যের উপাদান বাংলার নরনারী,তাদের দুঃখদারিদ্রময় জীবন,তাদের আশা-নিরাশা হাসি-কান্না-পুলক',তিনি তো কেবল কল্পনার বল্গাহীন পাখায় ভর করে উড়ে বেড়াতে পারেন না রূপকথার জগতে;তাকে নেমে আসতে হয় বাস্তবের মাটিতে, যেখানে শুধু মানুষ ও প্রকৃতি সবই এই সৃষ্টির মাঝখানে দুঃখে -সুখে একাত্ম ।তাইতো তিনি চান 'বাঁশবনের,আমবাগানের নিভৃত ছায়ায় ঝরা সজনে ফুল বিছানো পথের ধারে যে সব জীবন  অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে ' তাদের কথা বলতে,তাদের সে গোপন সুখ-দুঃখকে রূপ দিতে ।
              কাঁচড়াপাড়ার মুরাতিপুরে ১৮৯৪ সালে বিভূতিভূষণের জন্ম;বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়,মা মৃণালিনী দেবী ।মহানন্দ ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি,করতেন কথকতা। তাঁর যৌবনের টুকরোকাহিনী ধরা পড়েছে অপুর বাবা হরিহরের মধ্যে ।'পথের পাঁচালী'তে হরিহর যখন তাঁর স্মৃতি  রোমন্থন করে,তখন মহানন্দের জীবনকথার অনিবার্য ছায়া পড়ে ।আবার 'তৃণাঙ্কুর'-এ বিভূতিভূষণ লিখেছেন--
"..............রাখালী পিসিমা ছিলেন চন্দ্র চাটুজ্যের মেয়ে............শ্বশুরবাড়ি ছিল চৌবেড়ে । নিবারণ রাখালী পিসিমার ভাই,ভারী সুন্দর দেখতে ছিল-কলেরাতে মারা যায় আঠারো বছর বয়সে ।"
আর 'বল্লালী বালাই'-এ স্মৃতি  রোমন্থনে ইন্দির ঠাকুরুণ বলেছেন-
      "নিবারণের কথা মনে হয়--নিবারণ !নিবারণ !..........ষোল বৎসরের বালক,..... ওই ঘরে সে কঠিন জ্বররোগে শয্যাগত হইয়া যায় যায় হইয়াও দুই-তিনদিন রহিল।"
এখানে নিশ্চিতভাবে বলা যায়  জ্ঞাতিবোন মেনকা মহানন্দের সংসারে থাকতেন; তাকে নিয়েই গড়ে উঠেছে ইন্দির ঠাকুরুণ ,যিনি ঝগরাটা জোরালো হলেই গৃহত্যাগিনী হবেন, আবার প্রতীক্ষা করেও থাকবেন  দুর্গার ডাকের অপেক্ষায়।
              মা-পিসিমাকে কাঁদিয়ে আড়াই তিন-বছরের বিভূতি নিরুদ্দেশ হয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন বনের প্রান্তে,কিন্তু নিজে কাঁদেনি একফোঁটা ,আর 'অপরাজিত'য় স্মৃতিচারণে-- "অপুর বয়স যখন তিন বৎসর,তখন সে একবার হারাইয়া যায়............পারার কাহারও বাড়িতে নাই,...........সর্বজয়া  কাঁদিয়া আকুল হইল ।"
  আর পাঠশালায় পড়ার ক্ষেত্রে অপু ও বিভূতিভূষণ দু'জনেই প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের ছাত্র;একজন নিশ্চিন্দিপুরের ,অন্যজন হুগলীর কেওটায় । নয় -দশ বছরের বিভূতিভূষণ-"বহুদূরের কোন নির্জন স্থানে ,কখনো বা নির্জন নদীর ধারে হাতে নিতেন একখানা বাঁশের  কঞ্চি ।সেই কঞ্চি হাতে একা দাঁড়িয়ে তিনি শূন্যে চিৎকার করে গল্প বলতে শুরু করতেন (পরিমল গোস্বামীর স্মৃতিচারণ)।
অপুও বাঁশবনের পথে,বাড়ির পিছনে গাছের ডালকে অস্ত্র করে কল্পনা করে,"তারপর  দ্রোণ তো একেবারে দশ বাণ ছুঁড়লেন,অর্জুন করলেন কি,একেবারে দুশোটা বাণ দিলেন মেরে ।তারপর- ওঃ সে কি যুদ্ধ !"
               বারাকপুরের বিভূতি বনগ্রাম হাইস্কুলে পড়বার সময় যেমন পায়ে হেঁটে যেতেন,পথে তন্ময় হয়ে দেখতেন গাছপালা,তেমনি 'অপরাজিত'-র অপুও মনসাপোতা থেকে আঁড়বোয়ালের  ইস্কুলে হেঁটে যেত আর তন্ময় হয়ে দেখত "ঝোপঝাপ মাঠ,মাঝে মাঝে অনেকখানি ফাঁকা আকাশ ।"
            ১৯১৬ সালে তিনি রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ )  ভর্তি হন।এখানে তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণিতে ছাত্র  বিভূতিভূষণ বিতর্ক সভায় "নূতনের আহ্বান " শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন,যেমনটি পাঠ করেছিলেন 'অপরাজিত'-র নায়ক অপূর্বকুমার ।আর্থিক  অস্বচ্ছলতা মাথায় নিয়ে বিভূতিভূষণ থাকতেন মির্জাপুরের মেসে,আর 'অপরাজিত'রনায়ক অপু থাকত অখিলবাবুদের মেসে ।পরবর্তীতে বিভূতিভূষণ উক্ত মেসটি ছেড়ে চলে আসেন একটি ছাত্রদের মেসে,যেখানে ছাত্রদের জলপানি আর ছাত্র পড়ানোর টাকায় মেসটি চলত;এমনটিই চলত অপুদের সুরেশ্বরদের মেসবাড়ি ।
                  চাঁপা ফুলের প্রতি বিভূতিভূষণের আসীম  ভালোবাসা ও মমত্ববোধ ছিল,যা তিনি প্রথমা স্ত্রী গৌরীর স্মৃতিতে বারেবারে  কিনতেন ।চাঁপা তাঁর প্রিয় বলে স্ত্রী কল্যাণী ঘাটশিলা এবং বারাকপুরের বাড়িতে চাঁপাগাছ লাগিয়েছিলেন ।যেমনটি চাঁপাগাছ পুঁতেছিল অপর্ণা -মনসাপোতায়;অপুর পছন্দের  কথা স্মরণ করে ।
                     ৪১, মির্জাপুরে  স্ট্রিটে থাকার সময় বিভূতিভূষণ কর্মহীন,তাই মরিয়া বিভূতি চাকরি নিলেন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী কেশোরাম পোদ্দারের গোরক্ষণী সভার প্রচারকের ।ঠিক একই রকম  আর্থিক টানাপোড়েনে চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছে 'অভিযাত্রিক' এর নায়ক ।সাহিত্যের বাস্তবতায় এখানেই  তাঁর স্বল্পদৃষ্টি,তাইতো গোপালনগর স্টেশনে জ্বরে কাবু বিভূতিভূষণ দেখেছিলেন পদস্ত কর্মচারী খেতে বসেছেন ছুরি-কাঁটা হাতে "আস্ত মুরগীর রোষ্ট,মুলোসিদ্ধ,কাঁচা পেঁয়াজ,কাঁচা কপির পাতা-এমন সব আহার্য ।" আর 'অনুবর্তন ' উপন্যাসে  আমরা দেখি ট্যাংরা মাছের ঝাল অথবা মাছের মাথা দিয়ে রাঁধা কচু শাকের ভক্ত অ্যাংলো সাহেব হেনরী ক্লিফোর্ড ক্লারিজকে ।সাহিত্যে  বর্ণিত এই আহারের বিন্যাস  শৈশবে দেখা বাস্তবের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে ।
               অতি ভোজনের এই চিত্রের পাশাপাশি আমরা পাই অনাহার -অর্ধাহারের বর্ণনা যা বিভূতিভূষণের জীবনে অতি বাস্তব । মহানন্দের বড় ছেলে তখন অষ্টম  শ্রেণির ছাত্র ,অনটন আর ছন্নছাড়া জীবনযাপন তখন তার প্রাত্যহিকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জড়িয়ে ছিল । বাল্য-কৈশোর-যৌবন জোড়া আকালের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখেন 'সই' গল্পটি ।'দৃষ্টি প্রদীপ' উপন্যাসে  এই অভিজ্ঞতা আরো বাস্তব ও মর্মান্তিক । এই উপন্যাসে বিভূতিভূষণ জিতুর দাদা ও বৌদির সংসারের আদল নিয়েছেন তাঁর ভগ্নীপতি ও বোন জাহ্নবী দেবীর সংসার থেকে ।
                    'আহ্বান ' গল্পটি বারাকপুর গ্রামের এক বৃদ্ধা মুসলমানের  কাহিনী অবলম্বনে রচিত;যে স্বামী ও পুত্রকে হারিয়েছে অকালে ।বিভূতিভূষণকে বৃদ্ধা  ছেলেবেলা থেকেই খুব ভালোবাসতেন ।এই দীনহীন,অনাত্মীয় মুসলমান বৃদ্ধাকেও বিভূতিভূষণ বড় ভালোবেসে ছিলেন ।তাঁর  মৃত্যুর পর  বৃদ্ধার কবরে  একমুঠো মাটি দিয়েছিলেন ।'আহ্বান' গল্পের নায়ক বৃদ্ধার কফনের কাপড় কিনে দিয়েছিলেন এবং "দিলাম এক কোদাল মাটি ।সঙ্গে সঙ্গে মনে হল ,ও বেঁচে থাকলে বলে উঠত-'অ মোর গোপাল" ।
                ১৯২৬ সালে বিভূতিভূষণ হাঁটা পথে ভাগলপুর থেকে  দেওঘর গিয়েছিলেন,আবার পায়ে হেঁটেই ভাগলপুর ফিরেছিলেন ।তাঁর এ সময়ের অভিজ্ঞতা  ,বিশেষত পথে বটেশ্বর নাথের মেলা দেখার অভিজ্ঞতা   "স্মৃতির রেখা"য় ধরা আছে ,যা প্রায় হুবহু উঠে এসেছে 'আরণ্যক ' উপন্যাসে ।ভাগলপুর  জঙ্গলমহলের অভিজ্ঞতা আর সিংভূম ভ্রমণের সঞ্চয় থেকে সৃষ্টি হয় 'আরণ্যক' ।বিক্রমখোল শিলালিপি পরিদর্শনের সময় তিনি গ্রিন্ডোল গ্রামে নাচ দেখেছিলেন ।নিশ্চিত করে বলা যায় যে 'আরন্যক'-এর নাটুয়া বালক ধাতুরিয়ার মুহূর্তে ওই গ্রিন্ডোল গ্রামই বিভূতিভূষণের কাছে ধরা দিয়েছিল ।
                ১৯৪১ সালে ডিসেম্বর জাপানী বোমার ভয়ে  কলকাতা থেকে ঘাটশিলা যাবার পরিকল্পনা করেন বিভূতি দম্পতি।কিন্তু বোমার ভয়ে পলায়নরত জনতার ভিড়ে ইন্টার ক্লাসে জায়গা পাওয়া দায়;বোধ হয় সেকেন্ড ক্লাসেই টিকিট কাটতে হবে ! ঠিক একই চিত্র দেখি 'অনুবর্তন' উপন্যাসে ।১৯৪৩ সালে বিভূতিভূষণ আরো একবার কলকাতা থেকে ঘাটশিলা যাচ্ছিলেন ।ট্রেনে একজনের সন্তান হারানোর কান্না তাঁর অন্তরে বেদনা জাগিয়ে   তাকেও সমব্যথী করে তুলল--আর কলমে সহমর্মিতায় ভেসে উঠল একটি কাহিনী 'ভিড়' ।
             "স্নিগ্ধ ইছামতীর দু'পাড় ভরে ঝোপে ঝোপে কত বনকুসুম............স্নিগ্ধ পাটা শেওলার গন্ধ বার হয়,জেলেরা জাল ফেলে,ধারে ধারে কত গৃহস্তের বাড়ি ।কত হাসি কান্নার মেলা ।আজ পাঁচশত বছর ধরে কত  গৃহস্ত এল,কত হাসিমুখ শিশু প্রথমে মায়ের সঙ্গে নাইতে এল-কত বৎসর পরে বৃদ্ধাবস্তায় তার শ্মশান  শয্যা  হল........... কত তরুণ-তরুণী সময়ের পাষাণবর্ম বেয়ে এসেছে ।গিয়েছে মহাকালের  বীথিপথ বেয়ে...........এদের গল্প লিখব ,নাম দেব 'ইছামতী'
।"    (স্মৃতির রেখা ,বি.র.-১ম খন্ড)
                     কিন্তু 'ইছামতী' শিল্পের আয়ত্তে আসে তখনই যখন ভবানীচরণ ,তিলুর মতো গৃহস্থলী,টুনুর মতো পুত্রের সঙ্গ খুঁজে পায় ।বিভূতিভূষণকেও তাই চারের দশক পর্যন্ত  অপেক্ষা করতে হয় কল্যাণীর প্রাণঢালা  সংসার আর বাবলুর অর্থহীন হাসিকান্নার অনাবিল আনন্দধারার জন্য। তখনই বিভূতিভূষণের জীবন আর সাহিত্য সেতু বেঁধে পৌঁছাতে পারে 'ইছামতী'তে ।
..............................................................

তথ্যসূত্রঃ ১।বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায়
২।   বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-রুশতী সেন
৩।পথের কবি- কিশলয় ঠাকুর
৪।বিভূতিভূষণ রচনাবলী-গ্রন্থপরিচয়-১ম,৪র্থ  ,৫ম,৬ম,৮ম,১২ তম  খন্ড ।
............................................................................
ঙ.উপন্যাসিকাঃ~
                                                              মা হু ত ব ন্ধু  রে
                                                             সু বী র স র কা র

                                                                 ।। ১ ।।
              উঁচু টিলার ওপর রাজবাড়ি। লাল টিয়া। টিয়া উড়ে যায় তামারহাটের দিকে। আসারীকান্দির দিকে। রাজবাড়ির পিছনে বিস্তৃত জলরাশি। বাওবাতাস। কাঁপে তিরতির জলরাশি। লাওখোয়ার বিল। কোষা নৌকো। নদীয়া হোলা।সারারাতের গানবাজনা সেরে ফিরে যাচ্ছে বসন্ত মালী সুধীর রায় সীতানন্দ বুড়া। ঢোল দোতরা সারিন্দা সহ। গানের পর গান। মদিরাঘন পরিস্থিতি পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়েও কেন যেন আর বেরিয়ে আসা হয় না। টিলা থেকে নেমে বসন্ত ঈষৎ দিগভ্রান্ত হল। সে কোথাও যাবে। বড় রাজকুমারীর বাড়ি! না কি গোলোকগঞ্জের হাট! সংসার তো সেভাবে আর আটকে রাখতে পারলো না। জন্ম জন্ম ধরে গানের পৃথিবীতে সে যেন গরুর রাখোয়াল। কত কত বছর পূর্বেকার তামারহাটের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বুঁনো দাঁতালের গৌরীপুর শহরে ছুটে আসবার দৃশ্যখন্ডটি তাকে হাতছানি দেয়। সেই বুঁনোকে শেষতক বাগে এনেছিল লালজি রাজা। রঘুনাথ মাহুত। তারপর মাহুত ফান্দীদের সঙ্গে তাকে যেতে হয়েছিল বগরীবাড়ির টিলাপাহাড়ঘেরা বনাঞ্চলে লালজি রাজার হাতিক্যাম্পে। সেখানে ধুনি জ্বালিয়ে রাতভর চলতো কত কিসিমের গান। আগুন জ্বলত। লালজি রাজার হাসির শব্দ বনভূমিতে চঞ্চলতা জাগাতো। ফান্দি দফাদার মাহুতেরা গানের পর গানে মাতোয়ারা হত। বসন্ত মালী তখন দোতরা বাজাতো। ঢোল বাজাতো। কাঠি ঢোল। গোয়ালপাড়ার কাঠি ঢোল। গানের তাড়সে সুরের নেশায় ফান্দিমাহুতদের শরীরে একেকসময় নাচ এসে যেত। নৃত্যছন্দ এসে যেত।দু’এক পাক নেচেও উঠতো তারা। ঢোল দোতরা বাঁশির আওয়াজে তীব্রতা আসতো আরো_
   নাল শাড়ি পিন্ধিবে ময়না
   নাল শাড়ি নে
   ভূটান মহালের মাহুত রে তুই
   গৌরীপুরিয়া ফান্দি
   মোটরগাড়ি চড়বে ময়না
   নাল শাড়ি নে...

    এতোকিছুর ধারাবাহিকতায় কেবল স্থির হয়ে থাকতেন লালজি রাজা। হাস্যময় বলিরেখাশোভিত প্রসণ্ণ মুখমণ্ডল। মাথায় শোলার টুপি। রাজবাড়ি থেকে নেমে এসে এমত দৃশ্যমায়ার স্মৃতিলহর কেন যেন বারবার গ্রাস করেই ফেলে বসন্ত মালীকে। আর তামারহাটের দিকেই উড়ে যেতে থাকে কেবলি লাল টিয়া।

                                                                ।।২ ।।
                ভ্রম ও বিভ্রমের বাইরে এসে দাঁড়ালেই বসন্ত মালীর সঙ্গে সুধীর রায়ের সামান্য দৃষ্টি বিনিময় হয়। এই পর্বে আমরা দেখি গানের নিবিড়ত্বে গান পৃথিবীর স্থিরতর হয়ে থাকাটাকে গতিজাড্যতা এনে দেবার তীব্র প্রয়াসে গদাধর নদীর কোন এক মানুষডোবা চরে দলবদ্ধ হয়ে মেয়েদের নাচ গান
তরঙ্গায়িত হয়ে বিমূর্ত থেকে মূর্ত হতে থাকে। নদীর হাওয়ায় ধুলোর ঘূর্ণী হয়। চরময় ছড়িয়ে পড়ে ধুলোর কুয়াশা। খিলখিল হাসির শব্দে গান ও নাচ সহ এক নতুনরকম নাচগানের পৃথিবীই বুঝি কেবল চিরায়ত দৃশ্যের মতো জেগে থাকে_
        যৌবন রঙ্গের খেলা রে
        নয়া নদীর জল যেমন হে
        ঔ না যৌবন বান্ধিয়া রাখিনুং
        রঙ্গিলা আঞ্চল দিয়া রে

           এত এত গানের এত এত নাচের খুব গভীরে প্রবেশ করবার পর সুধীর রায় ও সীতানন্দ বুড়া একধরনের নৈকট্য টের পায়। তাদের হাতের দোতরা সারিন্দা দিয়ে তারা দৃশ্যটুকরোগুলিকে আত্মস্থ ও আত্মগত করে তুলতে থাকে। তাদের মনে পড়ে রাজাবাহাদুরের বড় বেটীর, মানে নীহার রাজকুমারীর সেই বাঘ শিকারের গাঁথাগল্পটির কথা। রাজাবাহাদুরের প্রিয় হাতি জংবাহাদুরের হাওদায় বসে রাজকুমারীর বিশাল বাঘটিকে উদ্যত থাবাদাঁতনখের বিপদজনকতা নিয়ে ছুটে আসা ডোরাকাটা হলুদের অপার্থিব সৌন্দর্য নিয়ে ছুটে আসা বাঘটির দিকে ছুটে যাওয়া গুলির শব্দ আজো যেন রূপসীর জঙ্গলবাড়ি থেকে ভেসে আসা বিরহী গানের সুরের মত ক্রন্দন করতে থাকে। আর সেই ক্রন্দনআর্তি হাহাকার আজও ঘুর ঘুর ঘুর উড়ানী কইতরের গানের মত দশ কুড়ি গ্রামবিলঝিল ঝাড়টুকরো অতিক্রম করে গুমরে মরতে থাকে গৌরীপুরের আকাশ বাতাসের শূণ্যতায়। সুধীর সীতানন্দ তাদের বাদ্যবাজনায় একে একে এনে ফেলতে থাকে হাতির মাহুত,নবনী গাড়িয়াল ও মইষাল বন্ধুর জন্য গাইতে থাকা অনবদ্য সব গানগুলিকেই। এত এত ঘটনাক্রমের সাথে তাল মেলাতে না পারলেও শীতকুয়াশার পৃথিবীতে কার্তিক পেরোনো প্রান্তরে প্রান্তরে গতজন্মের দিনকালগুলির কথা মনে পড়ে। স্মৃতিকাতরতা দিয়ে তো আর পুরোন স্মৃতি থেকে বেরিয়ে নতুনে ঢুকে পড়া যায় না! রাজবাড়ি থাকে। রাজার বেটীর গান থাকে। ঢোলদোতরার আশ্চর্য সঙ্গতটুকুনও থাকে। কেবল স্মৃতি থেকে গজাতে থাকে আরো আরো স্মৃতি ধারাক্রমধারা বজায় রেখেই।
  
                                                                ।। ৩।।

   কালা ছাড়িয়া না যাইস রে
   বুকে স্যালো দিয়া
   হাঁটিয়া যাইতে ক’মর ঢোলে
   আহারে কাঙ্খিনী গছের গুয়া...

           গদাধরের পারে পারে রোজকারের জীবনযাপনের ভিতর বাধ্যতই অভ্যেস এসে পড়লে বেঁচে থাকবার ভিতর এসে পড়া কৌতুকটিকে পুনস্থাপন করতে করতে রাজার বেটী একসময় রাজবাড়ি ও উঁচু টিলাকে নিজের অতীতের কালখণ্ডের খুব কাছাকাছি পৌঁছে দিতে চাইলেও রাজকুমারী কিছুতেই নিজেকে স্মৃতিকাতর করে তুলতে চান না। তার শুধু গান চাই। অতীতের সব আলোঝলমলতায় কেমন ভেসে ওঠে ব্রহ্মপুত্রের সব চরগুলিতে রাতের পর রাত শীতকুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রান্তিক সব মানুষের ভিতর আস্ত এক গানবাড়ি নিয়েই কেমন ঢুকে পড়া। কোন খেই থাকে না জীবনে। নিয়ন্ত্রণহীন জীবনে কেবল গানের পর গান ঢেউ-এর ভাসমান মোচার খোলের মতো। সেই সব সিজিলমিছিলের পাশে রাজাবাহাদুরের শিকারজুলুস। বাদ্যবাজনার স্ফুরণ। প্রতাপ সিং-এর জোড়া দাঁতের হাওদায় বিশ্রামরত চিতিসাপ। ঝমঝম বৃষ্টির ভিতর কেমন বাল্যকাল! বৃষ্টির শব্দের ঘোরাচ্ছন্নতার ভিতর নিশীথপোকার গুঞ্জনের ভিতর কেমন দোতরা বাজিয়ে যেতেন করিতুল্লা বয়াতি। বয়ান শেখ।শরীরময় নাচ নিয়ে জীবনের জীবন হয়ে ওঠার সমগ্রতা নিয়ে তাকে নাচ শেখাতো শরৎসুন্দরী বড়ুয়ানী। এ কোন প্রথাগত শিক্ষা নয়। পরিপার্শ্ব বাজনার মতো ছন্দের বহতা নিয়েই কেমন ঢুকে যেত রক্তের ভিতর যাপনচিত্র হয়ে।

                                                              ।।৪।।

                   নিন্দের আলিসে তাকে কিঞ্চিত স্মৃতিময় হতেই হয়। সে তার আভিজাত্য দিয়ে সারল্য নিয়ে একগুঁয়েমি দিয়ে হাহাকার নিয়ে প্রেমময় আর্তি নিয়ে নতুন ধানের গন্ধ নিয়ে গৌরীপুরের মাহুতবন্ধুদের নিয়ে গদাধরের পারে পারে হেঁটে বেড়াতে থাকা জ্যেঠবাবাকেই যেন আবডাল থেকে দেখে ফেলে। আবার তার ভ্রম ভাঙতেও সময় লাগে না। জ্যেঠবাবা নেই। লালজি রাজা নেই। রাজপাট কামলাকিষাণ হাতি ফান্দী কিছুই নেই আজ। তবুও অভ্যেসের চিরকালীন মত্ততায় সে নিজের জীবনকে জীবনের হাতেই ছেড়ে দিয়ে কেমন উদাসীন হয়ে পড়ে। রাজবাড়ির আভিজাত্য ভেঙে গোটা রাজপরিবারই তো বরাবর নেমে এসেছিল মিশে থেকেছিল সাদাসাপটা ধুলোমাখা হাটমাঠের জনমানুষের ঘামঘ্রাণের ভিতর। মিশে থাকতে থাকতে কখন কীভাবে যেন কিংবদন্তীর গাঁথাগল্পের জন্ম হয়েছিল। গানগুলি নাচগুলি সে ছড়িয়ে দিয়েছিল সঞ্চরণশীল মেঘের মতো চারপাশের মানুষদের সমগ্রতায়। তার দুই মেয়েও তো লোকগান নিয়ে নাচ নিয়ে তারই উত্তরাধীকার বহন করতে করতে একসময় শিয়ালডাকা গ্রামদেশের অন্দরে কন্দরে রাজবাড়ির গাননাচকেই চূড়ান্তের দিকে নিয়ে যাবার প্রয়াসটুকুনই অনুমোদনের অপেক্ষায় না থেকে চিরদূরত্বের এক রঙিলা দালানকোঠার দৃশ্যচিত্র হয়ে জলঘুঙ্গুরার বাজনের মত মুখরিত হয়ে উঠেছিল। এতকিছু নিয়ে সাজানো জীবন মানুষের। অথচ কেউ কি কখনো ভাবে_
     দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে
    রঙিলা দালানের মাটি
    ও গোঁসাই জি,কোন রঙ্গে

                                                                ।।.৫..।।

বইল মাছে
খেইল খেলায়...

           রাজবাড়ির সামনে হাওয়াখানার সামনে উঁচু টিলার ওপর অ্যানথ্রাক্স রোগে মরে যাওয়া লালজি রাজার সেই হাতিটি;প্রতাপ সিং যার নাম,তার সমাধির ওপর ফুল ছড়াতে ছড়াতে রাজকুমারীর মনে পড়ে যায় বাল্যের সব দৃশ্যগুলি। প্রতাপ সিং-এর সামনে নেচে নেচে সে গান ধরতো_
     হাতি রে তুই দমিয়া দমিয়া নাচেক রে
     মধুমালার হাতি রে
     লালজি রাজার হাতি রে...

        শুঁড় দুলিয়ে আহ্লাদিত হত প্রতাপ সিং। খুদে খুদে চোখে অপার খুশির ঝিলিক। রঘুনাথ মাহুতের কাছে, রঘুনাথের বাবার কাছে প্রতাপ-এর নানান আশ্চর্য গল্পগাছা শুনতে শুনতে সে তার নাচ তার গান তার ঘুরে বেড়ানোর জীবনেই কেবল ভেসে বেড়াতো। তখন জ্যেঠোবাবার হাতি বড়বাবার হাতি লালজি রাজার হাতি পার্বতী বাই’দর হাতি সব যেন সার সার হেঁটে যেত গদাধরের পারে পারে;চরে চরে। লাউখাওয়ার বিলের পাশে নৃত্যবাদ্যগীতের শোভাযাত্রায় নাচতে নাচতে জীবনের পর জীবন চলে যাওয়া আগমনী চাপড় অভয়াপুরী তামারহাট বা ধুবড়ির দিকে। গোলকগঞ্জ রতিয়াদহ অতিক্রম করতে করতে আলাউদ্দিন ভাইজানের গানের সুরকে প্রলম্বিত করবার জন্য চারপাশে ভরা রোদের ভরভরন্তের ভিতর কেমন বাঁশি বেজে উঠতো। তরলাবাঁশের বাঁশি। প্রেমানন্দ ঠোঁট ছোঁয়ালেই সংক্রামিত হয়ে ওঠা সেই বাঁশি আবেগথরথর এক বাঁশিয়ালের বৃত্তান্ত রচনা করতে করতে অনেক অনেক রূপকথায় যেন সাঁতার কাটতে থাকা মাছেদের গোপন ঘাই হয়ে ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি নিয়েই বৃত্তাকারে হতে থাকতো। রাজকুমারী বল, রাজার বেটি বল সবাই তখন পরিপুর্ণতা নিয়ে যেন বিনির্মিত ভরা যুবতীর পায়রাজোড়া। পাটগাভরু। প্রতাপ সিং-এর কথা বারবার ঘুরে ঘুরে আসে তার স্মৃতিতে আর সে অনন্ত অতীত থেকে বর্তমানে ফিরতে চাইলেও সদাঅতীতময় এক তাড়না বোধ করতে থাকে। সমগ্রতার সঙ্গ অনুসঙ্গে বহন করতেই থাকে গৌরীপুর আর গৌরীপুর। অন্যমনস্কতায় তার কন্ঠে গুণগুণ সুর চলে এলে সে সুরের ধরতাইএ অবধারিত সমর্পণ করেই ফেলে নিজেকে। কবেকার ভরসন্ধের শীতে, শীতার্ত হতে হতে গড়িয়ে নামে গান। ঢোলবাঁশিসারিন্দার মিশ্রণে বেগবতী সেই গান যেন গড়িয়ে গড়িয়ে টিলা থেকে নামতে থাকে গদাধরের দিকেই_
     ঝিকো ঝিকো কড়ি রে
     আঞ্চলে বান্ধিয়া রে
     যায় নীলীমণ গৌরীপুরের
     হাট রে
     নীলীমণ নীলায় ও না...

                                                                ।।৬।।

 আমতলি নদীতে
 ঝাম্পলি খেলাইতে
 খসিয়া বা পড়িল
 বালির শিষের সেন্দুর রে...

              গল্পের একটা সূত্র থাকে। গল্প থেকে গল্পে যাবার একটা ঘটনাপরম্পরাক্রম থাকে। সাঁকো বা ব্রিজের মতো। গল্পকে সাজিয়ে বসলেই তো আর হয় না। গল্পকে পটভূমি দিতে হয়। পরিসরের অবকাশটুকুন দিতে হয়। গল্পকথকের চোখেমুখে শীতদুপুরের রোদ মাখা থাকলেও গল্প স্রোতময় নদীতে ভাসতে থাকা সাম্পান হয়ে যেন অনেক অনেক দূরে চলে যাবার ঘনঘটায় একধরনের রণমত্ততায় বর্ণিল হয়ে ওঠে আর গল্প থেকে গল্পে যেতে যেতে জ্বলে ওঠে ক্যাম্পফায়ারের আগুন। রতিকান্ত দেওয়ানীর অব্যবহৃত বন্দুকনামার মরপৃথিবীতে নেমে আসা। রতিয়াদহ বাজারে একা একা গান জমিয়ে দেয়া আব্দুল জব্বারের গানের হিজিবিজির ভিতর স্বপ্নের নানারকম দিকবিদিকের রসায়নে যেন হাড়িতে ভাত ফোটবার টগবগ শব্দের মায়া লেগে যাওয়া। রতিয়াদহ থেকে বেরিয়ে আসা গল্প তখন গঙ্গাধরের দিকে ছোটে। বাইচ খেলার গানতরজায় নানাকিসিমের আরো গল্প অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই তখন মিশ্রিত হয়ে যায়। পটভূমির ভিতর উপুড় হয়ে বসে থাকা গল্প তখন ক্লান্তি বিষণ্ণতা নিয়ে বাওবাতাসের আশ্রয় চায়। বাওবাতাসে মিশে গিয়ে বাওবাতাসেরই গল্প বয়ন করতে করতে সকল গল্প বুঝি রাজবাড়ির দেশেই ফিরতে থাকে। সেতু পেরিয়ে তো কোথাও যাওয়া হয় না। কত কত শীতরাতের স্মৃতিপুরাণে গানের পর গান দিয়ে নাচের পর নাচ দিয়ে রাজপুরুষদের দাম্ভিক হাসি দিয়ে দোতরার কান মোচড়ানোর শব্দ দিয়ে বুকের ভিতরের অদ্ভূত এক কষ্টের মতোন কিছু যেন জাপটে ধরে। পুরাতন থেকে বর্তমানে আসাযাওয়ায় দেহতত্ব মনোশীক্ষা কুষাণযাত্রার মরমীয়া বুনটে বারবার চোরা ঢেকুর তুলতে থাকে সেই সব ছোটবড় হাতির দল। মাহুতফান্দির দল। বসন্ত মালীর বেটা বিমল মালী বল কিংবা সুধীর রায়ের বেটা অনিলই বল সবাই যেন তখন প্রাণপনে দৃশ্যখন্ডকে আটকে রাখতে চায়। তামারহাটের শিকারবাড়িতে ঢাকঢোল বাজতে থাকে। তামারহাটের দিকে উড়ে যাওয়া রাজবাড়ির টিয়ার ঝাঁক অতিক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে সব ও সমস্ত ঝাড়টাড়ভূট্টাবন। রাজার বেটীর ছোট কইন্যা তখন গান ধরে_
  নাল টিয়া কি টিয়া রে তোর
  ভাসা নলের আগালে
  বিনা বাতাসে ভাসা ঢোলে রে

   জন্মজন্মান্তরের এইসব গল্পগুলি জন্মজন্মান্তরের এক আবহমানতাই এনে দিতে থাকে।
                                                              ।।৭।।

                  যেমন হাতিধরার ভিতর জীবন কাটিয়ে যাওয়া লালজি রাজা,যেমন উত্তাপউষ্ণতা মাখতে মাখতে সন্নাসী ও সৈনিকের জীবন কাটিয়ে গেলেন জ্যেঠোবাবা; ঠিক জীবনসম্পৃক্ত জীবনেই বেঁচে থাকবার এক মানুষঘেরা গানঘেরা নদীঘেরা মদ্য ও মাদকঘেরা জীবন নিয়ে জীবনকেই জীবন্ত করে তুলতে তুলতে চুরমার করে দিয়ে নিজেকে নতুনতর জীবনের সংজ্ঞায়নে উন্নীত করেই গেলেন রাজকুমারী।তার গান, লোকমানুষের এক পৃথিবী, ভালবাসার এক ঘোর, অজস্র হাতিমাহুতের উত্তাপ তাকে তখন কিভাবে যেন হস্তীকন্যায় রূপান্তরিত করে দিল। হস্তীকন্যার উদাসীনতায় আভিজাত্যে সে কিন্তু হাতিমাহুতের গানের ভুবনে বারবার দেশজতা টেনে এনেছিল। মরুচমতী কন্যার মরিচগাছে হেলানি দিয়ে নেচে ওঠবার পাশাপাশি বিরহবেদনার বারমাসীয়া গানগুলি দিয়ে সে কি একধরনের মুক্তিই প্রত্যাশা করেছিল! সে কি গদাধরের পারে পারে শূণ্যতা নিয়ে মাহুতবন্ধুকে হেঁটে যেতে দেখেছিল! এত এত সংশয়ের পাঁকে তার যাপনপর্ব অসমাপ্ত পালাগানের খোসার মত ক্রমে তার দিকে বিদ্রুপময় এগিয়ে এসে তাকে অনেকানেক গানবাড়ির মুক্তাঞ্চলে, লোককথার হারানো কিসসাগুলির সঙ্গে মিশে যেতে সামান্য প্ররোচনাও দিয়েছিল বুঝি! চটুল গানের দিকে যেতে যেতে সে ডেকে নেয় গৌরীপুরের চ্যাংড়া বন্ধুকে। চ্যাংড়া বন্ধুর নাচের তাললয়ে তার শরীরময় অনন্য বাজনার আবাহনে সে কিন্তু চটুলতাকে গানের স্রোতে তালডিঙার ভেসে যাওয়াকে লিপ্ত করে দেয়। গান থাকে। নাচ থাকে। শিকারক্যাম্প থেকে জংলি হাতির বৃংহণ ভেসে আসে। সবই সাবলীল দৃশ্যের সহজিয়া অবতারনা যেন। আদতে কি বোধগম্য কোন ব্যাখ্যা মেলে জীবনের? যেমন চ্যাংড়া বন্ধুর চ্যাংড়া বন্ধু হয়ে ওঠা! যেমন রসিয়া বন্ধুর রসিয়া বন্ধুই হতে চাওয়া কেবল! হস্তিকন্যার হস্তিকন্যা হয়ে ওঠার কথাকাহিনীর সামান্য মোচড়ের জন্যই হয়তো ডুবজলে ডুবে থাকা গানকলি ভুস করে ভেসে ওঠে_
    রসিয়া বসাইছে ফান
    বানিয়া বসাইছে ফান
    নিধুয়া পাথারে ও কালা
    যাইও না...

ভেসে ওঠা গানখন্ড পলকহীন যাপনসর্বস্বতা নিয়েই হাজার মানুষের ছুটন্ত পদশব্দে চমকে উঠতে গিয়ে সন্ত্রস্ত হয় আর যাবতীয় নাচগান কোমড়ের ভাঁজে দুরন্ত দুলুনি নিয়ে চ্যাংড়া বন্ধুর দ্বিধাহীনভাবে চ্যাংড়া বন্ধুই হয়ে উঠতে চাওয়া যেন বা!

                                                              ।।৮।।

                         অনেক রোদের বিস্তারিতের ভিতর আদ্যন্ত ডুবে থাকতে থাকতে নদীপ্রান্তরের পাথারবাড়ির নকশিবিষাদটুকু সারাজীবন ধরতে গিয়েও শেষাবধি অধরাই থেকে যায়। ইশারাসংকেত দিয়ে তার রাজার বেটী হয়ে ওঠার ঘটনাক্রম একসময় থিতু হয়ে যায়। তার যাপনটাই বুঝি মিথ হয়ে ওঠে। আগুনের গোলকের মধ্যে সর্বশরীর ডুবিয়ে গানে গানে মেতে ওঠা জীবন নিয়ে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয় জনপদ আর জনপদে। সে দেখে নিতে থাকে কিভাবে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘ। জলহীন শুকানদিঘীতে হরিণেরা জল খেতে আসে। জন্ম জন্ম ধরে দিনকাল জুড়ে এ এক অচরিতার্থ যাপনবৃওান্ত। কবেকার মানকাচরের গানবাড়িতে গিয়াসুদ্দিন, ভুলুলালদের নেচে ওঠবার যৌথতার স্মৃতি তার গানের ভুবনে বেগ এনে দিলে সে গানের কিসসার, ছিলকার গাওবুড়োর হুঁকোর তালে তালে নতুন এক জীবনই যেন খুঁজে পায়। ধরাবাঁধার বাইরেই আজীবন তাকে থেকে যেতে হল। বিষণ্ণ হয়ে ওঠবার অবকাশই সে পায় না। সে অধিকন্তু কেবল বিষণ্ণতা নিয়েই গানের ভুবনে বিস্তারিত হতে থাকে। পুরনো গানগুলি থেকে মহিষের গাড়ি ও মৈষাল গাড়িয়ালের গানগুলি দিয়ে সে অতীতবর্তমানবাহিত হয়ে মহামহিম জীবনেই প্রানান্তকর ফিরতে থাকে। তখন বসন্ত মালী বল সুধীর রায় বল সীতানন্দ বুড়া বল সবাই যেন ঢোলবাঁশিগান নিয়ে রাজবাড়ির দিকে ভাঙা প্রাসাদের দিকে প্রতাপ সিং-এর সমাধির দিকে গৌরীপুরের হাটের দিকে ধুবড়ি শহরের দিকে গদাধরের নামহীন চরের দিকে আগমনী বিষখোওয়া গঙ্গাধরের দোলং-এর দিকে প্রজাবিদ্রোহের দিকে লালজি রাজার হাতিধুরার দিকে হা হা হাসির দিকে চিরবিরহের সব গান নিয়ে কেবলই ফিরতে থাকে।তাদের কন্ঠের সমবেতে গান বাজে_
  গান কইরচে হায় প্রাণ ঢালেয়া
  গোয়ালপাড়িয়া গীতি...

             রাজবাড়ির স্তব্ধতা ভেঙে ফিরে আসতে থাকে গমগম গমনাগমন। বটবৃক্ষের ছায়ার মতন একটা আশ্রয়ের ভরসা জাগে যেন। লন্ঠণ জ্বালিয়ে পদুমোহন আসে। ফরাস বিছিয়ে দেয় ফুলমতী মাই। হাতির দাঁতের চিরুণী দিয়ে রাজার বেটী সেরে নেয় কেশবিন্যাসপ্রসাধন। গানে গানে জেগে উঠবে আজ বাইচ খেলা। মেলাবাড়ির দিকে গড়িয়ে নামবে বাইচের গান। আসরবন্দনার টানা স্রোতে নিবিষ্ট হতে হতে দোয়ারিরা গলা মেলাবে। নাচনীরা খোসা নাচ দিয়ে ভরিয়ে দেবে পাথারবাড়ি_
   শ্যাম কালা ও রে শ্যাম কালা
   ছাড়িয়া দে মোর শাড়ির আঞ্চল
   যায় বেলা...
আর হামলে পড়বে শীতের পাল।

                                                                        ।।৯।।

  ও মোর দান্তাল হাতির মাহুত রে
  যেদিন মাহুত জঙ্গল যায়
  নারীর মন মোর ঝুরিয়া রয় রে...

         হাতিমাহুতের জন্য দান্তাল হাতির জন্য তার প্রান কান্দে। তার মাহুত ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলে জঙ্গলে। হাতির পিঠিত চড়িয়া তার মাহুত যেন কিসের বাঁটুল মারে। আবার গোয়ালপাড়ায় গিয়ে খেয়ে আসে গামছাবান্ধা দই। চিলমারীয়া চিকন চিড়া। তামাকবাড়িতে সন্ধ্যে নামলে মাহুত আর কেবল মাহুত থাকে না। হাতির পিঠ থেকে নেমে এসে অতিমানুষ হয়ে ওঠে। মাহুতের জন্য কি প্রেম জমে মনে!  যেমন গৌরীপুরীয়া গাভরুর জন্য ভুপেনদার মনে জন্মেছিল। তার মরম লাগে। সমস্ত যৌবনকাল জুড়ে সে তো মাহুতের জন্য, দান্তাল হাতির মাহুতের জন্য বারবার গেয়েই ওঠে গান_
     ও মোর হায় হস্তির কন্যা রে
     খানিক দয়া নাই
     খানিক মায়া নাই
     মাহুতক লাগিয়া রে...

      মাহুতের গামছাজড়ানো মাথার ওপর শীতের আকাশ। মাহুত যখন জঙ্গলবাড়ির দিকে তখন তো বাদ্যনৃত্যের সমবেতে সে তার মাহুতকেই খুঁজতে থাকে; খুঁজেই গেছে অন্তহীন। মাহুতের প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে সে তো জীবনভর হাতিমাহুতের পৃথিবীর
চালচিত্রে, খুঁড়ে খুঁড়ে এনেছে পুরাকল্পবাহিত যতসব গান,
  ও মোর মাকনা হাতির মাহুত রে
  হাতির পিঠিত চড়িয়া রে মাহুত
  তোমরা কিসের বাঁটুল মারো...

     তার গান জুড়ে তো  কেবল হাহাকারই থাকে না! হাতিমাহুতবন্দনাই থাকে না! তার গান বহন করে আনে লোকজনতার ইতিহাস। কথাকিংবদন্তী থেকে হস্তিতত্ব নিয়ে এসে ইতিহাসকে নিম্নবর্গীয়তার ভুবনেই প্রবিষ্ট করা হয়। পরম্পরা পারম্পর্য ভেঙে এভাবেই তার মাহুত, তার হাতি, তার হাতিশিকার, হাতিপ্রশিক্ষণ সবকিছু দিয়ে সে অত্যাশ্চর্য এক হাতিসংস্কৃতিই তুলে ধরতে চেয়েছে। এখানেই তো স্বতন্ত্রতা। এভাবেই তো তার মিথ হয়ে ওঠা। মিথ হয়ে যেতে  যেতে মিথের ওঠানামায় শীতের খুব জাড়ের ভিতর সে আদুল শরীরের মাহুতকে গানে গানে কথায় কথায় বাদ্যে বাদ্যে উষ্ণ থেকে উষ্ণতরতার দিকেই ঠেলে দেয়। জীবনের ভিতর আর কিছু না থাক, আর কিছু না পাওয়া যাক; সে ভীষণরকম মাহুতবন্ধুর গানের টানে টানেই পরিপুর্ণ হতে থাকবে।
                                                                  ।।১০।।

  কলসির পানি মাঝিয়ায় ঢালিয়া
  কলসি হইল মোর খালি
  হায়রে কলসিতে নাই মোর পানি রে...

                গদাধর নদীর পারে দলবদ্ধ মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে নাচে। গান গায়। গাননাচেরই পৃথিবী তাদের। তার সব চিরকালের নাচুনি। বিহুতলিতে নাচে। পাথারবাড়িত নাচে। বিয়াওবাড়িত নাচে। কীর্তনবাড়িত নাচে। নাচে, কেবল নাচে। নাচতে নাচতে তার গানপালার আঁখরগুলিই তুলে আনে। তাদের গানের,নাচের ভিতর আশ্চর্য ধারাবর্ণনা। দৈনন্দিন মানবজীবন উঠে আসে। শরৎসুন্দরী, মৌরীবালা, নান্দুনি বুড়ি, খইমালার চিরপুরাতনকে চিরনুতন করে দিয়ে মরিচখেত বাইগনবাড়ির ভিতর,ভুস করে জেগে ওঠা নদীচরের কাশিয়ার ঝোপে ঝোপে নাচগান নিয়েই চলাচল করে। তাদের এই উচ্ছাসময়তা দিয়ে বেন্ধে রাখা জীবনযাপন কখন কিভাবে ভূগোলইতিহাস দেশাচারলগ্ন হয়ে পড়ে তার কোন ঠায়ঠিকানা থাকে না আর; কেবল আকাশময় মেঘের আলোয় তাদেরকে হুদুমপুজার মাঠে গিয়ে দাঁড়াতেই হয়, কখন আন্ধাররাতি আসবে সেই উদগ্র আশাআকাংখা নিয়েই। কোথাও কেউ থাকে না। কেবল হুমহুম এক হাহাকার। নদীর কাছাড় ভাঙার হিড়িক হিড়িক শব্দ বুকের গহীনে। বলরামের ঢোল বাজে। কাঁঠল খুঁটার দোতরা কথা বলে। গদাধর নদীর শিয়রে লোকঠাকুরের থানে মাটির পিদিম জ্বালিয়ে নদীতেই নেমে যায় কেউ। দূরেকাছের ঘরবাড়ির ভিতর রাত্রিকাল নেমে আসে। আন্ধাররাতি। কৃষ্ণকালো কেশ খুলে দিয়ে ধেয়ে আসে খ্যাপা, হাড়িয়া মেঘদল।নাচুনিরা থামে না;তাদের তো থামতে নেই। দূরাগত বাতাসে ভেসে আসে তাদের গান_
    আয়রে হাড়িয়া ম্যাঘ
    আয় পর্বত ধায়া
    তোক ম্যাঘক বান্ধি থুইম
    ক্যাশের আগাল দিয়া

          নাচগানের দিনদুনিয়ায় নাচগানকে প্রাধান্য তো দিতেই হয়। বসন্ত মালী না থাক,সুধীর বা সীতানন্দ না থাক; নাচগান থাকেই। বৃহওরতার ঐকতানে, বোধে জারিত হতে হতে হাস্যচপল নাচুনিরা নাচে। নদীজলে নেমে পড়ে। জল ছড়াতে থাকে। গান ছড়াতে থাকে,
      ছিড়িয়া বাইগনের বোঁটা
      মাইরো না...
                                                                  ।।১১।।

                রাজবাড়ির গল্পে রাজকুমারীর গল্পে রাজার বেটির গল্পে লালজি রাজার গল্পে কোন আদিঅন্ত থাকে না। রাজার বেটীর গানভুবনের মেয়াদ কি চিরদিনের হতে পারে! থেমে যাওয়াটা আবশ্যিক। থেমে যাবার বিন্দু থেকে নতুনভাবে উঠে আসবেই সব আবার। এ এক ধারাবাহিকতাই যেন। পদ্মশ্রী পাবার পর তেমন পুলক তো জাগে নি তার! সে তো নিস্পৃহই ছিল। পান্ডের সঙ্গে কেমন এক দূরত্বই থেকে গেল সারাজীবন! জীবন তো তেমন কোন গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারলো না! অবশ্য গন্তব্য বলে কিছু হয়? নিশ্চিতই কিছু থাকে! মানুষ তো গন্তব্যহীন গন্তব্য নিয়েই দুরাগত হাওয়ায় কেবল কেঁপে কেঁপে ওঠে। সারাজীবন কেবল ‘নিন্দের আলিসে হাত পড়ে বালিশে’। গৌরীপুর সেজে উঠেছিল তাকে বিদায় জানাবার জন্য। সারারাতের অপেক্ষা শেষে তাকে তো আসতেই হয়েছিল। ডিসেম্বরের শীতে। কুয়াশাময় শ্লোকের ভিতরে। শোকসংগীতের বদলে একযোগে বেজে উঠেছিল একশো দোতরা। জীবনযাপনের ভিতর সমস্ত না পাওয়াগুলি নিয়ে সে বেঁচে ছিল দীর্ঘ কিছু দিন, নিজের মতোন। তার চোখের তারায় কৌতুক। যা দিয়ে চিরদিনই সে প্রান্তিকতার দিকে, প্রান্তবাসীর কাছে,ভুমিলগ্ন জীবনই সাজাতে চেয়েছিল। তার জীবন ছিল গ্রন্থের খোলা পাতার মতো। হেঁটো কবির পাঁচালীর মতো। ফকিরকবিরাজের ঝোলার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা জীবন নিয়ে সে কি আদ্যন্ত এক হস্তিকন্যা হয়ে  নিজেকে সংজ্ঞায়িত করবার প্রাণান্তকর এক ব্যাস্ততার কুয়াশায় উড়ে গিয়েছিল! যেভাবে,যত গানই সে গাক;সমস্ত জীবনজুড়ে একটিমাত্র গানই কুহকে ডুবে গিয়ে তাকে গেয়েই যেতে হয়েছিল,
      তোমরা গেইলে কি আসিবেন
      ও মোর মাহুত বন্ধু রে...

                                                                  ।।১২।।

বাইজ আইনছেন ঢ্যারেৎ  ঢ্যারেৎ
ও শ্যাম কালিয়া রে...

উঁচু টিলার ওপর রাজবাড়ি। লাল টিয়া। টিয়া উড়ে যায় ঝাঁকে ঝাঁকে। তামারহাটের দিকে। আগমনীর দিকে। গদাধরের পারে পারে। রাজার বেটীর স্বপ্নময়তার ফাঁকে রাজবাড়ির ভয়াবহ শূণ্যতার ফোকড়ে আবারো বাদ্য বাজে। নৃত্যময় ভঙ্গি সাজিয়ে বর্তমানের নাচুনিরা জড়ো হয়। বিমল মালী আসে। অনিল আসে। পরমেশ্বর ও গিরেনও এসে যায়। আসে প্রিয়ম।ঢোলদোতরাবাঁশিসারিন্দা ও নতুনসব গীতভান্ডার নিয়েই। রাজবাড়িতে গান বাজে।শীতশিশিরের ফোঁটায় ফোঁটায় মিশে যেতে থাকে টুকরো টাকরা সব গানগুলি। যেন ঢেউ জাগে। লাউখোওয়ার বিল  থেকে ফিসফিস কথাবার্তায় বাতাসেরা ঘিরে ধরে সময়। মহাকাল। আমরা দেখতে পাই,নয়াবাড়ির নয়া সাগাইসোদরের মতোন গান গাইছেন পুনম বরুয়া। নতুনকালের সময়াতীত অতিক্রম করে আসা এক নুতন হস্তিকন্যার মত। যাকে গাইতে হয়,গাইতেই হবে হাতিমাহুতের সব অনন্তকালের গানগুলি। গৌরীপুরীয়া মাহুতবন্ধুকে আবহমানতায় ফিরিয়ে আনবার জন্যই হয়তো বা!
                                      =============সমাপ্ত==================


মন্তব্যসমূহ