অচেনা যাত্রী-৪/বিষয়ঃকেন লিখি ? /নভেম্বর ১৯-৩০,২০১৩/পৃষ্ঠাঃ২

                                      জানিনা কেন লিখি, তবু লিখি
                                                 দেবাশিস সরকার
    খাতা-কলম আমাকে একান্ত আপন করে ডাকলেও, সে ডাক হৃদয়ের কাছে আজকাল অবহেলা পায়, পায় একরাশ অবজ্ঞা । আধুনিক প্রযুক্তিই হোক আর সহজ লভ্যতাই হোক, বর্ণ মুছে যাওয়া কম্পিউটারের কি-বোর্ড-ই দখল করে রাখে আমার সংবেদনশীল হৃদয়ের হাহাকার, তাই বহুদিনের পুরাতন সঙ্গী খাতা-কলমকে ইচ্ছে করেই ভুলে থাকি লেখার কষ্ট থেকে বাঁচতে। আর বিপত্তিটা ঘটে সেখানেই। লিখব মনে করে কখনই বসা হয়না কম্পিউটারে, কিন্তু যখন একান্তে কিছু একটা লিখব বলেই বসলাম তখন সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি সেই দিল আমাকে। উইন্ডোজ বসে গেলো, র‍্যামে ময়লা জমে বিকল হল সে । আর হরতালের কারণে সকল দোকানপাট বন্ধ থাকায় মেরামত করতে না পারায় আমি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইলাম দুটি দিন । নিয়ন্ত্রিত ক্ষোভের নীচে চাপা পড়ে গেল অনেকটা সময় । মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাস হচ্ছে -সময় আর সুযোগ পেলেই নিজেকে জাহির করা চাই, সে সুযোগ আমিই বা হাতছাড়া করি কেমন করে, যখন সুযোগ পেয়েছি নিজেকে জাহির করার । তো যাক সে কথা, আমি কেন যে লিখি তা গুছিয়ে লিখতে গেলে ফিরে যেতে হবে আমার জীবনের অনেকটা সময় আগে । ছোট বেলা থেকেই ডানপিটে আর মারামারি-কোন্দলপ্রিয় হিসাবে পাড়ায় সুখ্যাতি ছিল আমার। বাবা-মা'র অনেক গাল-মন্দ আর পিটুনি ফেরাতে পারেনি সে পথ থেকে। আমার মনে হতো সবাই আমাকে অবহেলা করছে, অবজ্ঞা করছে, দরিদ্র বলে বঞ্চিত করছে সবাই। পরিবারের মধ্যে পড়াশুনার জন্য প্রতিনিয়তই প্রয়োগ করছে চাপ । অতিষ্ট লাগতো চারপাশ, শরীরের শক্তির প্রাচুর্য থাকায় অন্যের সাথে কোন্দল করেই খুঁজে ফিরতাম আনন্দ। এমন অবস্থায় আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমার গৃহশিক্ষক সুধীন চক্রবর্তী আমাকে একদিন বললেন,"তোমার যা খুশি তাই করতে পারো, কেউ তোমাকে বারণ করবে না, কিন্তু একটু পরিকল্পনা করে বুদ্ধি খাটিয়ে যদি তোমার ইচ্ছেগুলোকে মেটাও তবে ভালো হয়। এই যেমন ধরো কেউ তোমাকে অবহেলা করল বা কেউ তোমার সাথে খারাপ আচরণ করল তাকে কী করতে চাও তা আগে খাতায় লিখে পরিকল্পনা কর; কীভাবে করবে তা লেখ এবং সময় নিয়ে কয়েকদিন পরে কাজটি করো -- এতে আরো ভালো হবে তোমার কাজ।" কথাটা মনে ধরল । রাফ খাতা লিখে লিখে ভরে ফেলতে লাগলাম পরিকল্পনায় আর পরিকল্পনায়। কিন্তু অবিশ্বাস্যরকম ভাবে     কমে গেলে আমার ডানপিটে কোন্দলপ্রিয় স্বভাব। সেই থেকেই আমার ইচ্ছে অপূর্ণতা ভালোলাগা মন্দলাগাকে খাতায় লিখে রাখার শুরু। বয়সটা যখন একটু বাড়ল (এই উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময়) পাড়ার এক সহপাঠিনীকে কেমন যেন অন্যরকম লাগতে শুরু করল । দেখলে হাত-পা অবশ হয়ে আসত, বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ শব্দের গতি যেত বেড়ে । অল্প বয়েসের আবেগর বাড়াবাড়ির মুহূর্ত গুলোকে প্রকাশ করতে পারিনি কখনই। তখনও আমার একান্ত আশ্রয় ছিল খাতার পাতায়। একটা সময় নীহার রঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটী, দস্যু বনহুর কিংবা মানুদ রানা সবার প্রতি দুর্বলতা আকুল করেছিলআমায় । ক্লাসের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে পড়তে গিয়েও শেষ পর্যন্ত বয়সে বড় হবার আশায় তুলে রাখতে হয়েছে। মনের দুঃখকে ভুলবার জন্য তখনও আমার মনের কথার আশ্রয় ছিল খাতা-কলম । সময় আর বয়সের বাঁকে বাঁকে অনুভূতির পরিবর্তনে, চাওয়া-পাওয়ার যোগ-বিয়োগের হিসাবের অপূর্ণতার ক্লান্তি আর ছোট ছোট প্রাপ্তির সুখ-আনন্দ-উচ্ছ্বাসকে সবার সমানে প্রকাশ করতে পারিনি কখনই। ছোট বেলা থেকে গড়ে ওঠা খাতা-কলমের সাথে সখ্যতাই আমাকে সব সময় লিখতে প্রেরণা দিয়েছে । অবুঝ হৃদয় পেয়েছে শান্তি আর  নির্মল আনন্দ। প্রতিনিয়তই বয়স বেড়েছে, পুরাতন স্মৃতিমাখা লেখাগুলোকে কয়েক বছর পর-পরই জীবনে বড়ো অপ্রয়োজনীয় আর বেমানান মনে হওয়ায় নিজের লেখায় নিজেই পেয়েছি লজ্জ্বা, মেতেছি সেগুলোর ধ্বংসযজ্ঞ, হারিয়ে ফেলেছি কতশত অবুঝ হৃদয়ের হাহাকার। আজ যখন লিখব বলে লিখতে বসেছি সেই সময়কার কথা বার বার মনে আসছে, নষ্টালজিয়ায় ভেসে যাচ্ছে হৃদয়-মন। যৌবনের পরতে পরতে আবেগের চাওয়া-পাওয়া অনেক রমণীর প্রতি ভালোলাগা আর ভালোবাসার যে অনুভূতিগুলো সযত্নে সাজিয়েছিলাম ডায়রির পাতায় পাতায়, বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার কারাগারে প্রবেশের প্রাক- মুহূর্তে সেগুলোকে দিয়েছি আত্মাহুতি। তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে লেখাবিহীন-অনুভূতিহীন কর্তব্যের মায়াজালে। জীবনর আনন্দ-হাসি-সুখ আশ্রয় নিয়েছিল অর্থে-ধনে-পণ্যে, সমৃদ্ধির নেশার রঙিন মায়াজালে। কিন্তু সুখ পাখি আমার কাছে আসেনি, ধরা দেয়নি ভালোবেসে । আনন্দ চলে গিয়েছিল লক্ষ-যোজন দূরে। অবাস্তব হৃদয়ের বিলাস বলে যাকে একদিন ঠেলে দিয়েছিলাম দূরে, আজ সেখানেই আবার ফিরে এসেছি। আত্মযন্ত্রণাগুলোকে লিখে ফেলতে পেরেই পাই অসম্ভব সুখ। আজ সকল অপূর্ণতা, সকল ব্যার্থতা, না করতে পারার অব্যক্ত বেদনা, শোষণের সাথে সাথে মিশে যাওয়া প্রতিবাদ সব কিছু নির্দ্বিধায় লিখে লিখে প্রকাশ করে ফেলি সুখের আশায়। সহজ পথে চলতে না পারার কথা, সুন্দর করে বাঁচতে না পারার ব্যথা, পেট ভরে খেতে না পাওয়ার মানে, অসাম্যের পথে কাঁটার পাহাড় বাধাহীন করারা মুহূর্ত, আজও সামাজিক ভেদাভেদের তুমুল লড়াইয়ে নিজেকে যখন খুব অসহায় মনে হয়, সামর্থহীনতায় যখন হারাই প্রতিবাদের ভাষা, তখন নিজেকে বাঁচাতে কলম আর কাগজকেই বড়ো আপন বলে মনে হয় । যৌনতার পরিসমাপ্তিতে সংসারিক গন্ডিকে আজ কেন জানি মেকি সাজানো মনে হয়, খাওয়া-পড়া-জন্মদান, অন্যের অমর হওয়ার অমুলক ইচ্ছা সব কিছুকে মনে রাখতে আর মেনে নিতেই কম্পিউটারের কি-বোর্ড ঠক্ ঠক্ করে চলি অবিরত। একফোঁটা শান্তি খুঁজতে পড়ে থাকি অনেক রাত অবধি ফেসবুকের পাতায় । কিন্তু কেন লিখি, কী জন্য লিখি-- সব কিছু আজও গুছিয়ে লিখতে পারি না, হয়তো পারবোও না কোন দিন। আমি জানি না, সত্যিই আমি জানি না কেন লিখি,তবু লিখি ।
------------------------------------------------------------------------
                                                             আমি কেন লিখি
                                                              শান্তনু হালদার
    মনের কল্পনাকেন্দ্রে তৈরি হওয়া ভাব আবেগের- নির্যাস ফল্গুধারার মতো বয়ে চলে সমস্ত মানব হৃদয়ে।সেই সব  নীরব    অনুভূতি কেউ কেউ প্রকাশ করতে পারে ভাষার সঙ্গীতময় শব্দের বাঁধনে, আর কারো কারো কাছে এই একান্ত নিজস্ব অনুভূতি,ভাব,আবেগ, বা আবেশ--মনের সেই সব ফুটন্ত লাভা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে নির্গত হতে পারে না- থেকে যায় মূক-বধির হয়ে কিংবা সুপ্ত অবস্থায়।প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি প্রতিক্রিয়া আছে আমারা জানি ।মন একটি সদা ক্রিয়াশীল বস্তু। আমাদের জীবনে কত কি ঘটে-কত সুখ-দুঃখ,হাসি-কান্না,ব্যথা-বেদনা,কত সাদা-কালো সবুজ-নীল অনুভূতি।মনের আকাশে কত রামধনু রঙের আনাগোনা ।কত করাল অন্ধকারময় রাতের অবসান হয়ে নতুন ভোরের আলোতে উদ্ভাসিত হয় এই হৃদয়ের আকুল পারাবার। এক নিমেষেই ঘটে যায় কত ইতিহাস।আমাদের চিন্তনশক্তি ঈশ্বর প্রদত্ত এবং এটা এতটাই সদাপরিবর্তনশীল যে,প্রতি মুহূর্তে এটি পালটে দেয় ভূগোলের ইতিহাস কিংবা ইতিহাসের ভূগোল।তাই একথা বলতে কোন দ্বিধা নেই যে মন সদা ক্রিয়াশীল।আর ক্রিয়া যখন আছে তাঁর প্রতিক্রিয়া তো থাকতেই হবে। মহাভারতের অর্জুনের মতো আমি তীর চালাতে পারি না - যে নিজের চিন্তাশক্তি গভীর ভাবে লক্ষ্য বস্তুতে নিয়জিত করে তীরের তীক্ষ্ণ ফলাতে লক্ষ্যভেদ করে নিজের মনের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন করবো ।সচিনের মতো ব্যাট চালাতেও পারিনা - যে অগনিত দর্শকের মাঝে ব্যাটের শক্ত আঘাতে বল ক্রমাগত ক্রিকেট মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দু-দণ্ড শান্তি পাবো।একিলিস্ এর মতো তরবারি চালাতেও পারিনা বা রামায়াণে বর্ণিত হনুমানের মত আমি অত শক্তিশালীও নই।কিন্তু এটাতো সত্যি ,আমার একটি মন আছে। আর মন আছে বলেই মনের ক্রিয়া আছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া? তরবারি, ঢাল অস্ত্রসস্ত্র কিছুই নেই আমার।হেনির 'ডিগিং' কবিতা পড়ে তাই মন ভরে ওঠে। আসলে আমার কাছে মনের প্রতিক্রিয়া দেখানোর যে অস্ত্র আছে তা হল 'কলম'- যা দিয়ে আমি তীব্র তীক্ষ্ণ ধারালো ফলার মত লেখনী প্রসব করতে পারি। মনের অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা, হাসি-কান্না আবেগের,অনুভূতির,ভাব- আবেশের প্রতিফলন জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে আমার কলমের নিব্-এ । আমার কলমের কালির গন্ধ আনতে পারে নতুন প্রভাত। আমাকে নিয়ে যেতে পারে এক নান্দনিক আনন্দের দেশে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো কল্পনার রঙিন ডানায় আমি খুঁজে পাই আমার 'আমি'-কে । আর এভাবেই মনের রঙ-বেরঙের অনুভূতির প্রকাশ করে এক অচেনা অনন্দের জোয়ারে ভেসে চলি । এ এক অনন্য অনুভূতি। রোমহর্ষক। তাই তো আমি লিখি।
------------------------------------------------------------------------
                                                       লেখার জন্যই লেখি
                                                       মোস্তাফিজুর রহমান
কেন লেখি? এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া বেশ শক্তপোক্ত এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে প্রশ্নটা শোনার পর থেকে উত্তর হিসাবে যে কথাটা মাথার ভেতর ঘুরপার খাচ্ছে, তা হল, ‘লেখার জন্যই লেখা’। লেখার প্রতি ভালোবাসা থেকে লেখা। নিজের মনের কথা, উপলব্ধি, অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্যই লেখা। চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনায়, কথাটা কাব্যিক সুরে বললে, ‘চলমান সময় শ্রোতের বালুকা বেলায় ক্লান্ত, বিদ্ধস্ত, ফুলে ওঠা ফেনার আত্মকথা, অভিব্যক্তি প্রকাশ অথবা প্রতিনিধিত্ব করতেই লেখা ।’ আমি দেখছি নির্বিচারে মানুষকে ধর্মের নামে, গণতন্ত্রের নামে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে; কোমলমতি ছেলেগুলো বখে যাচ্ছে; মানুষ ভুল অথবা প্রথাবিরোধী সম্পের্কে জড়াচ্ছে, তা নিয়ে টানাপোড়েন সৃষ্টি হচ্ছে! এ অবস্থায় আমার কিছু বলা উচিত, কিছু করা উচিত। আর এ জন্যেই লেখা। আমি জানি, হয়তো আমার কথায় কোনই পরিবর্তন হবে না । কিন্তু এ গ্রহের বাসিন্দা হিসাবে আমার একটা দায়বদ্ধতা থাকা উচিত । অন্য কারো জন্য নয়, স্রেফ নিজের চেতনার দায়বদ্ধতা থেকেই লেখা । অন্ধকারেও যেন বলতে পারি, আমি চুপ থাকিনি, অন্তত নিজেকে ধোকা দেয়নি । মানুষের দুটো রূপ থাকে, একটা প্রকাশ্য অন্যটা গোপন । এই দুটো রূপ একে অন্যের পরিপুরক। যারা ঈশ্বরতত্ত্ব বিশ্বাস করেন, তাদের সিংহভাগের ঈশ্বর সম্পর্কে বিশ্বাটও অনেকটা এরকম । ঈশ্বর বা প্রকৃতির একটা রূপ প্রকাশ্য আর একটা রূপ গোপন ।এর কোনটা বাদ দিয়ে প্রকৃতি হয় না । মানুষের এই দুটো রূপই রং, ঢং, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, চাওয়া-পাওয়ার আহ্লাদে পরিপূর্ণ । অথচ গোপন রূপটা নিয়ে অনেকেই বিব্রত থাকেন, কেননা তা প্রকাশ্যের সাথে সংঘাতপূর্ণ । রাষ্ট্রীয় আইন, সামাজিকতা, ধর্ম, প্রথা ইত্যাদিএই দুই রূপের মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়ায় । কিছু অদৃষ্টের বিশ্বাস এবং আমাদেরই তৈরি ব্যবস্থাকে সর্বজনীন রূপ দিতে যুগে যুগে অজস্র রক্তপাত হয়েছে । অসংখ্য প্রাণ অকালে ঝরে গেছে । এমন-কি ভূগোল পর্য্ন্ত পাল্টে গেছে বহুবার । অথচ ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ    স্নায়ুবিক, রক্তপাতহীন, বিচ্ছেদহীন করে তুলতে পারে একমাত্র লেখনী । মানুষের এই দুই জগতের মধ্যে চমৎকার সংযোগ সৃষ্টি করে পৃথিবীর স্বাভাবিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে পারে একমাত্র লেখনী । এই বোধ ভেতরে আছে বলেই লেখি । মানুষের মন সঠিকভাবে শাসন এবং নিয়ন্ত্রন করতে লাগে তার উচ্চ ক্ষমতা, দক্ষতা । আর সেই ক্ষমতা, দক্ষতার উৎকর্ষতা ঘটিয়ে মানুষকে আরও মানুষ করে তোলে লেখনী । নিজেকে অন্তত মানুষ করে তুলতে চাই বলে লিখি । লেখার চেষ্টা করি বলেই রোজকার পরিচিত মুদি দোকানিকে প্রতিদিন নতুন করে আবিষ্কার করি । আমার সামনেই বেড়ে ওঠা শিশুটির অশান্ত হয়ে ওঠা দেখতে পারি ঈশ্বর অথবা প্রকৃতির চোখ দিয়ে । প্রতিদিন নিজের মস্তিষ্কের মধ্যে নতুন একটা রুদ্ধ কক্ষের কপাট খুলে চমৎকৃত হই । নিজের ভাবনা আর কাজের জগতে সদম্ভে বহুদূর দাপিয়ে বেড়াতেই লিখি । সমাজ, রাষ্ট্র এবং ক্রমান্বয়ে গোটা পৃথিবীকে ইতিবাচক পরিবর্তন এবং সমৃদ্ধির পথে আনতে, এর বাসিন্দাদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে, একে টিকিয়ে রাখতে প্রধান ভূমিকা লেখকদের । অথচ কোন কোন ক্ষেত্রে এটাকে কোন পেশা হিসাবে মানা হয় না! গুটি কতক বাদে বেশিরভাগ লেখক প্রাপ্যসম্মানী থেকে বঞ্চিত থাকে । তবুও লেখকরা লেখে । টাকার জন্য নয়, কেবল দায়বদ্ধতা থেকে । এই লেখার জন্য অনুরোধ করে অমিতদা রীতিমতো আমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন । অমিতদার সাথে দীর্ঘ্ক্ষণ আলাপ হল । আমি আমিতদা’কে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমার মতো নতুন লেখকের জন্য এটা খানিকটা আধিখ্যেতা । উনি আমাকে বোঝালেন যে ,এটা  মোটেও আধিখ্যেতা নয়, বরং অনেকেই তোমার লেখা থেকে উৎসাহিত হবেন । জানিনা, আমার এই লেখা থেকে কেউ উৎসাহ পাবেন কি না ! তবে এই লেখাটিও কেবল লেখার জন্য লেখা।
--------------------------------------------------------------------------
                                          ভাব ও অভাবের তাড়নায় আমি লিখি
                                                    সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কেন লিখি? এমন প্রশ্ন করলে বলা যায়, ভালো লাগে তাই । এছাড়া আমি চাপা স্বভাবের মানুষ । সব কথা বলতে পারিনা, তাই লিখে প্রকাশ করি। ভালো লাগা থেকে শুরু হলেও এখন তা ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে। আর ভালোবাসার প্রতি একটা দায়িত্ববোধ এসে যায়। মূলত আমি আশাবাদী ও স্বপ্নবিলাসী । তবে আমার কোন উচ্চাশা নে ই। আমার আশাবাদ ও স্বপ্নবিলাসই আমাকে লেখক হতে উৎসাহ যুগিয়েছে । লেখকের মাঠে আমি কচ্ছপগতিসম্পন্ন একজন প্রতিযোগী । অনেকের চেয়ে অনেক পেছনে । তাই বলে আমি থেমে নেই । লিখছি এবং লিখব । এটাই আমার দৃঢ় প্রত্যয় । সেই তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন একটা গল্প লিখেছিলাম । লিখে লুকিয়ে রাখলাম । তবুও তা পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের হাতে পৌঁছে গেল । স্কুল থেকে ফিরে দেখি সবাই আমাকে দেখে মুচকি হাসে । পরে মা বললেন আসল ঘটনা । আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম । আমার লেখালেখির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার মরহুম নানাজান মাওলানা আফসার উদ্দিনের । ছোটবেলা থেকে নানার কাছেই থাকতাম । দেখতাম, নানা রাত জেগে কীসব বই পড়েন । আমিও সুযোগ পেলে পড়তে শুরু করি । ভালো লাগে । কবি-লেখকদের জীবনী আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে । নিজেও লিখতে চেষ্টা করি । সে সময়ের লেখাগুলো এখন আমার কাছে নেই । থাকলে হয়তো নিজেই লজ্জা পেতাম। এখনো খুব ভালো লিখি কি না জানিনা । তবে প্রতি সপ্তাহে দু’একটা লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয় । অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন পাঠ্য বইয়ের একটা কবিতাকে নকল করে একটা কবিতা লিখেছিলাম । আমার মামা মাওলানা মেজবাহ উদ্দিন সেটা দেখে বললেন,‘অন্যেরটা নকল করে কেন? নিজে লেখার চেষ্টা করো।’ তবে একটা বিষয় লক্ষণীয় , আমার নানা-মামা দু’জনেই ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী হলেও সাহিত্যকে সমাদর করতেন । নিজেরাও প্রচুর পড়তেন । দ্বিতীয়বার উৎসাহটা মামার কাছে পাই । তৃতীয়ত এক বালিকার প্রেমে পড়ে ডজনখানেক প্রেমের কবিতা লিখলাম । বন্ধুরা কবিতা ধার নিতে আসতো । কাউকে আবার প্রেমের চিঠি লিখে দিতে হয় । নিজেও একটা প্রেমপত্র লিখে বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলাম । ‘প্রিয় নদী, নদ যেমন নদীর কাছে ছুটে যায় । আমিও তেমন তোমার কাছে ছুটে যাই ।’ এটা নিয়ে বকুনি খেতে হয়েছে । যদিও পত্রটা পাত্রীর কাছে পৌঁছানোর আগেই বড়ভাই মোসলেহ উদ্দিনের হাতে পড়ে যায় । মূলত কবি বলেই ভেতরে একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাব চলে আসে । এই ভাব থেকেই লেখক হওয়ার বাসনা আরো তীব্র হয় । অন্যদিকে অভাব একটা মূল কারণ । দাদার মৃত্যু ও নদী ভাঙন আমাদের অভাবের মুখে ফেলে দেয় । টেনেটুনে সংসার চলছে ঠিক । কিন্তু কোন আবদারই বাবা পূরণ করতে পারেন নি । অভাবের কারণেই নানা বাড়ি থাকতে হয়েছে আমাকে । এককথায় বলা যায়, ভাব আর অভাবের সংমিশ্রণে কবিসত্ত্বা জেগে উঠেছে । এখন ভাব আছে অভাব নেই । তবুও মাঝে মাঝে নিজেকে শূন্য মনে হয় । এর কারণ, কখনোই মানুষের জীবনে পূর্ণতা আসে না । কিছু না কিছুর অভাব থেকে যায় ; বা লেখক-কবির অন্তরে অভাব থাকতে হয় । সেটা হতে পারে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম অভাব । এসএসসি পরীক্ষার প্রাক- মুহূর্তে লেখার ভাবটা তীব্র হয়ে ওঠে । আমার মেজভাই নুরুদ্দিন আহমেদ বিষয়টি ভালোভাবে নেননি । রাতে ঘুমোতে গেলে তিনি বকতে থাকেন । ‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুল হবা । লেখা-পড়া নাই । সারাদিন কবিতা ’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন । আমি চুপ । কথার জবাব দিলেন বড়ভাই । 'লিখুক না । সমস্যা কি লিখলে ? রবীন্দ্রনাথ-নজরুলতো একদিনেই বিখ্যাত হননি ।' আমি মনে মনে আন্দোলিত হই । উৎসাহ পাই । যা হোক অন্তত একজন আমার পাশে আছে । পরীক্ষার রাতেও কবিতা লিখেছি । অনেক টেনশন হলে কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয় । এইচএসসি পড়ার সময় একটা টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে যাই । সবাই ধরে নিয়েছিল আমার দ্বারা লেখা-পড়া হবে না । অবস্থাটাও তেমন । ভর্তি হয়ে ক্লাসে যাইনা। ঢাকা থেকে চলে আসি গ্রামের বাড়ি । উপন্যাস লিখতে শুরু করি । দু’তিনটে লিখেও ফেলি । কিভাবে ছাপানো যায় ? একটা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় । উপায় খুঁজে পাইনা । বাংলাবাজারের অনেক প্রকাশনীর সাথে যোগাযোগ করি । তাতে টাকার প্রয়োজন । ফিরে আসি । তবুও থেমে নেই । লিখে যাই প্রতিনিয়ত । আমার কবিতার খাতার কিছু পাঠক তৈরি হয় । তাঁরা পড়ে উৎসাহ দেন । ভালো লাগে । পোশাক-আশাক, চলা-ফেরায় পরিবর্তন আসে । চটের ব্যাগ কিনি । পাঞ্জাবী-পাজামা পড়ি । সবাই ‘কবি’ বলে ডাকে । শুনতে ভালো লাগে । কিন্তু মনের মধ্যে একটা অপূর্ণতা থেকেই যায় । একটা লেখাও প্রকাশ হলনা । লেখা প্রথম প্রকাশ হয় খালাতো ভাই লুৎফর রহমানের সাহায্যে । ২০০৩ সালে জেলা শহর থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় । ছাপার হরফে আমার কবিতা দেখে সেদিন যে আনন্দ পেয়েছিলাম  তা আজ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় ! সম্মান শ্রেণিতে পড়তে এসে লেখালেখির তাড়নায় যুক্ত হয়ে যাই মফস্বল সাংবাদিকতার সাথে ।  সাংবাদিকতার  পাশাপাশি লেখালেখির একটা প্লাটফর্ম পেয়ে গেলাম । কলেজের নোটিশ বোর্ডে গল্পলেখা প্রতিযোগিতার আহ্বানে সাড়া দিলাম । প্রথম গল্পেই বিশেষ পুরস্কার পেয়ে গেলাম । পুরস্কারের সুবাদে জেলা শহর থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক-সাপ্তাহিকে লেখার জন্য অনুমতি পেলাম । ২০০৮ সালে দৈনিক দেশবাংলার সাহিত্য পাতায় কবিতা ছাপা হল । এরপর থেমে থাকতে হয়নি । জেলার গন্ডি পেরিয়ে জাতীয় দৈনিকসহ সাহিত্যের ছোটকাগজে লেখালেখি শুরু হয় । দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লেখা আহ্বান করে । খুলনা, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, নীলফামারি, জামালপুর, হাতিয়া, আগৈলঝাড়াসহ বিভিন্ন শহর থেকে আমার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে । সর্বোপরি দেশের বাইরে বলতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে লেখা প্রকাশ হওয়ার আনন্দে এখনো চোখের কোণে চিকচিক করছে জল । আর এ লেখাটা মূলত ‘অচেনা যাত্রী’র সম্পাদকের নির্দেশে । নির্দেশ বলবো একারণেই যে, আমার কাছে লেখা চেয়ে অনুরোধ করার মতো ক্ষুদ্র মানুষ তিনি নন ।  আমার মতো ক্ষুদ্র লেখককে লেখার জন্য বরং নির্দেশ করা যায় । কেন লিখি ? এমন প্রশ্নের জবাবে এতক্ষণ নিজের ঢোল নিজে পেটালাম । আমার ঢোল আমি পেটালে অন্যরা পিটাবে কী? আমি শুধু বলবো- মনের তাগিদেই লিখছি । লেখাটা একটা নেশায় পরিণত হয়েছে । মাঝে মাঝে মন থেকে যখন ভাব ও অভাব দূর হয়ে যায়, তখন কিছুই লিখতে পারিনা । চেষ্টা করেও পারি না । সে সময় অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগি । মনে হয় আমি আমার লেখক সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলেছি । নিজেকে অসহায় মনে হয় । ভাবের জন্য বিরহের দরকার । অভাবের জন্য ঔদাসীন্য দরকার । তখন দুটোকেই অর্জনের চেষ্টা করি । ‘প্রেমের পরশে প্রত্যেকেই কবি হয়ে ওঠে’ কিংবা কবিতার জন্য কবিকে প্রেমে পড়তে হয় । আমি প্রেমে পড়ি । কিন্তু আগলে রাখতে পারিনা । সঙ্গত কারণেই বিরহ অবধারিত । তখনই প্রত্যেকটি কথা হয়ে ওঠে একটি কবিতা বা গল্প । সাম্প্রতিক সমস্যাগুলো যখন নাড়া দিয়ে ওঠে,তখন হয়ে যাই বিদ্রোহী । আত্মার প্রশান্তির জন্য রচনা করি নাটক , এবং তাতে নিজেই অভিনয় করি । লেখালেখি করি ঠিক কিন্তু সমস্যা পিছু ছাড়েনা । মফস্বল শহরে থাকি বলে লেখার জন্য কোন পারিশ্রমিক জোটেনা । ফলে বাধ্য হয়ে অন্য কাজও করতে হয় । কিন্তু কোন কাজই আমার জন্য স্থায়ী হয়না । কবিতার কারখানায় যেমন শ্রমিক, জীবিকার তাগিদেও শ্রমিক হতে হয় । এখনো পরিবারের গঞ্জনা রয়েছে । রয়েছে প্রিয়তমার তিরস্কার । ‘কিছু একটা করো ।’ সবার একই তাগাদা । আমিতো কিছু একটা করছি । কিন্তু তাতে অর্থ নেই । আর সবাইতো অর্থই চায় । তবে আমি বিশ্বাস করি, অর্থ ও খ্যাতি একসাথে আসেনা । লেখালেখির ক্ষেত্রে অর্থ আশা করাটাও অরণ্যে রোদন মাত্র । দেশে হূমায়ুন আহমেদ আর ক’জন ? এবার মূল কথায় আসি । বাংলা সাহিত্যে প্রেম রোমান্স এক অবিচ্ছেদ্য অংশ । কবিতা লিখতে গিয়ে কবিকে প্রেমে পড়তে হয় । অথবা প্রেমে পড়ে তাকে কবিতা লিখতে হয়েছে । দুটোই চিরন্তন সত্য । কবির মনে প্রেম জাগ্রত না হলে কবিতা হয় না। কাব্যচর্চার জন্য প্রেম অনিবার্য । আর সে চর্চাকে অব্যাহত রাখতে হলে বেছে নিতে হয় বিরহকে। কারণ মিলনের চেয়ে বিরহই কবিকে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করে । নব সৃষ্টির উন্মাদনা জাগ্রত করে । কবি বলেছেন-‘প্রেমের পরশে প্রত্যেকেই কবি হয়ে উঠেন ।’ কবিতার সাথে যেন প্রেমের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। লোকে বলে- কবি মানেই প্রেমিক । আর প্রেমিক মানেই কবি। পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর যিনি জীবনে অন্তত এক লাইন প্রেমের কবিতা বা ছন্দ রচনা করেন নি । সবার জীবনে একবার প্রেম আসে- কথাটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি জীবনে অন্তত একবার কাব্য রচনা বা সাধনা করেন নি একথাও অস্বীকার করার জো নেই। কেউ যদি মনে-প্রাণে,ধ্যানে-জ্ঞানে কবি হন তবেতো কথাই নেই । বাংলা সাহিত্যে প্রেমের কবিতা বা কবিতায় প্রেম বিষয়ে পরিসংখ্যান করা খুবই দুঃসাধ্য । দ্রোহ-সংঘাত বা অস্থিরতার মধ্যেও বাঙলা কবিতায় প্রেমের অনুষঙ্গ অগণিত । মধ্যযুগের পদাবলি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অধিকাংশ কবিতায় প্রেমের অনুষঙ্গ এসেছে অসংখ্য বার । বর্তমানে যারা খ্যাতনামা কবি বা যারা প্রতিষ্ঠার জন্য কাব্যচর্চা করছেন প্রত্যেকেই হয়তো প্রথম জীবনে কোন বালিকার উদ্দ্যেশ্যে প্রেমকাব্য রচনার মাধ্যমে আবির্ভূত হয়েছেন । পড়নে পাঞ্জাবী-পায়জামা আর পায়ে চটি জুতো পড়ে কাঁধে একটা চটের ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে প্রথম দর্শনেই সবাই তাকে কবি বা লেখক ভাববেন । ভাবাটাই স্বাভাবিক। বেশ-ভূষায় কবি বা লেখক হলেই কী প্রকৃত লেখক হওয়া যায় ? যায় না । লেখকের প্রাণশক্তি তাঁর লেখনী । লেখনীর মাধ্যমেই সে পাঠক মহলে কবিখ্যাতি বা লেখক হিসাবে পরিচিতি লাভ করবেন । আসলে লেখক হওয়ার উপায় কী? শুধু কি কালি-কলম-মন দিয়েই লেখা যায়? নাকি আরও কিছু দরকার হয়? আপনারা যারা লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর, তাঁরা নিশ্চয় এই প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজছেন । লেখালিখিটা প্রধানত সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এক ক্ষমতা । ইচ্ছে করলেই লেখক হওয়া যায় না । তার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য ও অধ্যাবসায় । ত্যাগের মানসিকতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা । সর্বোপরি লিখতে হলে পড়তে হবে । বিশিষ্ট কবি-লেখকরা অবশ্য একথার সাথে সবাই একমত যে, 'এক লাইন লিখতে হলে দশ লাইন পড়তে হবে ' । পড়ার বা জানার কোন বিকল্প নেই । তথ্য বা শব্দ ভান্ডার হতে হবে সমৃদ্ধ । প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাক বা না থাক তাতে কিছু যায় আসে না । সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় শিক্ষা একান্ত আবশ্যক । এছাড়া লিখতে গেলে অগ্রজ কাউকে না কাউকে অনুসরণ করতে হয় । অনেকেই অনেক কবি-লেখক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন । এক্ষেত্রে লেখকের কল্পনা শক্তি হতে হবে প্রখর । লেখকের ‘তৃতীয় নয়ন’ বলে একটা বিষয় আছে, যা আর দশজন সাধারণ মানুষের নেই । কবি ও অকবিদের মধ্যে মূল পার্থক্য এখানেই । সাধারণ মানুষ যে জিনিসটি সাধারণ ভাবে দেখে, একজন অসাধারাণ মানুষ সেটাকে অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে । একজন লেখকের দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের অন্যান্য মানুষের চেয়ে আলাদা হতে হয় । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করতেন, যদি আজকের দিনই হয় আমার জীবনের শেষ দিন, তাহলে আমার কোন কাজটি সবার আগে করা উচিত? একজন লেখকও এ রকমভাবে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেন শব্দে শব্দে কী লিখতে চান তিনি, কীভাবে লিখতে চান, কী কথাই বা বলতে চান? অমর একুশে বইমেলার বই-গন্ধ গায়ে মেখে তোমরা যারা লেখক হওয়ার পথ খুঁজছ, যারা স্বপ্ন দেখছ ভবিষ্যতের লেখক হওয়ার, তারা তো জানোই শব্দে শব্দে মিল- অমিল দিয়ে লেখক হওয়া এত সহজ কর্ম নয়। এর জন্যও লাগে দীর্ঘ প্রস্তুতি, পড়াশোনা । তোমাদের জন্য দেশের তিন খ্যাতিমান লেখক এবার জানাচ্ছেন কেন লেখক হলেন তাঁরা, কীভাবে লেখক হলেন । অভিজ্ঞতার আদ্যপান্ত । লেখক হওয়ার উপায় সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন- লিখতে হলে পড়তে হবে । তরুণ লেখকদের প্রতি প্রথমত এটিই আমার বলার কথা । মনে রাখতে হবে, লেখকের পথ বড়ই বিপদসঙ্কুল । এটা সম্পূর্ণ একার পথ । কঠিন এক সাধনা । কোনো লেখকের পক্ষে কি বলা সম্ভব, তিনি কেন লেখক হয়েছেন? মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, লেখক না হয়ে উপায় ছিল না বলেই শেষ পর্যন্ত লেখক হয়েছি । খুব ছোটবেলা থেকে কেন যে কবিতা, গল্প এসব লিখতাম, আজ সেটা স্মৃতি খুঁড়ে বের করা কঠিন । বলা যায়, যে পৃথিবীতে বেঁচে আছি সেই পৃথিবীর একটা অর্থ ও ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারি লেখার মাধ্যমে । এটি হয়তো প্রত্যেক লেখকই পারেন । তবে এ ক্ষেত্রে একজন লেখকের সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট একটা ধারণা থাকা জরুরি। লেখক হতে চাইলে তুমি যা কিছু করতে চাও, তার সবই তোমাকে লেখার ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত করতে হবে । ব্যক্তিভেদে এক-একজন লেখকের লেখার কৌশল এক-এক রকম । আমি যেমন সাধারণত একটি লেখা একবারেই লিখে ফেলি । কিন্তু লেখাটি লেখার আগে তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা থাকে বিস্তর । কীভাবে আগের লেখা থেকে নতুন লেখাকে আলাদা করা যায় -- এই ভাবনাও থাকে । আমি মনে করি, প্রত্যেক লেখকই তাঁর নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেন একান্ত তাঁর মতো করে । কবি মহাদেব সাহা বলেছেন, আমি কি কবি হতে পেরেছি? জানি না। মনে পড়ে, ১৯৯৬ সালে প্রেসক্লাব-সংলগ্ন ফুটপাতের ওপর বসে একটানে লিখেছিলাম ‘চিঠি দিও’ কবিতাটি । পরে সেটি প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয় । শৈশবে আমার মা বিরাজমোহিনির মুখে রামায়ণ ও মহাভারত শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তখন মনে হতো বাল্মীকি বা ব্যাসদেবের মতো যদি কবি হতে পারতাম! তিনি আরো বলেছেন, একটি শব্দের জন্য বসে থেকেছি সারা রাত । জীবনানন্দ দাশ কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা পড়েছি উন্মাদের মতো । পড়েছি জন কিটস, রাইনার মারিয়া রিলকে, ডব্লিউ বি ইয়েটস। পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে হয়তো কবি হয়ে উঠেছি আমি । আমার মনে হয়, পৃথিবীতে কবি হচ্ছে একমাত্র অবিনাশী সত্ত্বা, রাজা, সম্রাট তাঁর কাছে কিছু নয় । তাই কবি বা লেখক হতে গেলে যেমন পড়াশোনা জরুরি, তেমনি দরকার লেখকের স্বাধীন সত্ত্বা । কারও পরামর্শ নিয়ে কেউ কোনো দিন কবি হতে পারে না । অদিতি ফাল্গুনীর বক্তব্য এরকম, যদি মেয়ে না হতাম, তাহলে আমি হয়তো কখনোই লেখক হতাম না । কথাটি খোলাসা করি, মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী সঙ্কুচিত হয়েছে । সেই শৈশব উত্তীর্ণকালে আমার বয়সী বন্ধুগোত্রীয় ছেলেরা যেভাবে পৃথিবীকে দেখেছে, আমার দেখা ছিল তাঁদের থেকে ভিন্ন । শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী যে ছোট হয়ে এল, এই বেদনাবোধই আমাকে লেখক করে তুলেছে । মাঝেমধ্যে মনে হয়, প্রতিকূলতা অনেক সময় আমাদের ভেতরের আগুনকে উসকে দেয় । আমাদের বাড়িতে বড় একটি পাঠাগার ছিল । সেখানে ছিল রুশ সাহিত্যসহ নানা ধরনের বই । এ ছাড়া কলেজের গ্রন্থাগারে পড়েছি গ্রিক নাটক । এই পাঠ আমাকে পুষ্টি দিয়েছে । একসময় পাহাড়ে ওঠার খুব শখ ছিল, পারিনি। শেষমেষ দেখি, গল্প-কবিতা লিখতে লিখতে লেখকই হয়ে উঠেছি ! লেখালেখির জন্য প্রথমত ভাষাগত প্রস্তুতি থাকা খুব দরকার বলে আমার মনে হয় । আর ভাষাগত প্রস্তুতি গড়ে ওঠে মহৎ সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে । বাংলা ভাষায় লিখতে হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়া যেমন আবশ্যক তেমনি অন্য ভাষার মহৎ সাহিত্যিকদের লেখাও পাঠ করতে হবে । আমার ব্যক্তিগত জীবনে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে আমার নানার অনুপ্রেরণায় । তিনি রাত জেগে পড়তেন । দেশি-বিদেশি সবধরণের সংগ্রহ ছিল তাঁর । মাঝে মাঝে লিখতেন । ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন । তার সংস্পর্শে আমিও পড়া ও লেখার অভ্যাস গড়ে তুলি । নানা বলতেন, লিখতে লিখতে লেখক হওয়া যায় । গ্রামীণ প্রবাদের মতো- ‘হাটতে হাটতে নলা/ গাইতে গাইতে গলা ।’ সর্বোপরি কথা হচ্ছে- নিরলস চেষ্টা, চর্চা ও সাধনাই একজনকে লেখক হিসাবে গড়ে তুলতে পারে । তাই বলছি, 'আমি কেন লিখি?' -- এমন প্রশ্ন না করে বরং ভাবুন-আপনি কেন লিখবেন না? তবে অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে আপনাকে লিখতে হবে । লেখক হতে গেলে সীমাহীন ধৈর্যের প্রয়োজন । প্রয়োজন অধ্যাবসায় । হতাশা নয় আশাবাদী হোন । আমি নিশ্চিত আপনি একদিন সফল হবেন।
সম্পাদকের কথাঃসালাহ উদ্দিন মাহমুদ বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিমান  তরুণ কবি ।বিনয়ী ।সম্পাদক অতি সাধারণ মানুষ ।এরকম কবির কাছে সম্পাদক বার বার লেখা চাইবার অনুরোধ করবে । নির্দেশ দেবার ক্ষমতা-অক্ষমতা-যোগ্যতা-প্রতিষ্ঠা কিছুই নেই সম্পাদকের ।আছে কেবল একটা মন ।ভাষার প্রতি প্রেম ।বাংলার প্রতি প্রেম ।সাহিত্যের প্রতি প্রেম ।
.........................................................................
                                                            কেন লিখি
                                                             পার্থ কর
 প্রতিদিনের যাপনের ধুলো ঝেড়ে, যা যা বলতে পারিনি স্থান- ও সময়মতো ,বয়স ও বেলা মেপে—সময় পেরিয়ে গেছে ভেবে চার দেওয়ালে ঘিরে বসে গোপনে সাদাকালোয় ধরে রাখি এ আশায় যে,তা একদিন বস্তুতীর্ণ,কালোত্তীর্ণ হয়ে আমার পুরোনো অক্ষমতাগুলোকে ঢেকে দেবে । আফসোসের বারান্দায় বিকেল রোদ্দুর পায়চারী করতে এসে আলাপী হয়ে সমস্ত বিলাপের খোঁজ নিয়ে ঠিক ছড়িয়ে দেবে রাতের তারায়... আর, ঠিকই একদিন তোমার চোখে পড়ে যাবে আমার তারা — এই আশায় লিখি !
----------------------------------------------------------
                                       লেখা নয়,কেবলই রক্তক্ষরণের দিনলিপি
                                                      অমিত কুমার বিশ্বাস
জীবন তো নয়,এ এক রক্তক্ষরণ !সামনেও শ্ত্রু,পিছনেও।এ এক চক্রব্যুহ ।পরম মিত্র-আত্মিয়ের মাঝে একা ।তবু অভিমন্যুর অভিমান আর সাহস নিয়ে  ক্রমশ অগ্রসর  হওয়া । এভাবেই চলছে চলবে ।চলতেই থাকবে ,সে আমি না থাকলেও ।আর এরই মাঝে চলবে উদ্ধত অসি-খেলা ।সবাই যে আজ ভীষণ উন্মত্ত !নিজ কাজে যতটা,তার থেকে ঢের বেশি  অন্যকে কী চমৎকার শৈলীতে খামচে দেওয়া যায়  ।সেই রক্তের ছাপ লেগে যায় সাদা পাতায় ।তাকে লেখা বলা যায় কিনা এনিয়ে বিদ্বজ্জনেরা বিলেতি বিড়ি ফুঁকে নস্যাৎ করার ঢের আগেই বলে উঠি- এ লেখা নয়,কেবলই রক্তক্ষরণের দিনলিপি মাত্র ।এ আমার রক্তকণিকার অভিমান ।
...................................................................................................................
পরের পাতায় যাবার  জন্য  ক্লীক করুন পুরাতন পাতাসমূহে

মন্তব্যসমূহ

achena yatree nishondehe akti milefalok.sahitter akashe ujjol nakkhatro hoye udito hoyeche.jar alo kakhonoi mlan habena.upon aloy udvasito korbe charidik.....ashesh suvokamona tar jonno.....salah uddin mahmud