অচেনা যাত্রী-৪/বিষয়ঃকেন লিখি ? /নভেম্বর ১৯-৩০,২০১৩/পৃষ্ঠাঃ৪

     (বানান বিধিঃআকাদেমি বানান অভিধান /২০১১ সংস্করণ/পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি)

ব্যক্তিগত গদ্য
                                    ফেলে আসা সময়
                              দেবাশিস সরকার

                    এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে জ্যোতি ঘূর্ণায়মান জলরাশির দিকে, স্রোতে পাক খেতে খেতে হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত বেগে দৃষ্টির আড়ালে । হঠাৎ হঠাৎ মাছ ধরবার জেলেদের নৌকা ছপ ছপ শব্দে তীরের কাছ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক মনে । দমকা হাওয়ায় সিগারেটের ধোয়াগুলো ঘুরছে ।তারপর আবার শূন্যতা । এইতো ক'বছর আগেও কত কোলাহলে পূর্ণ ছিলো এ ঘাট...যাত্রীবাহি নৌকাগুলো ভিরতো আবার ছেড়ে যেত অন্য গন্তব্যের দিকে।মালবাহী নৌযানগুলি লেগে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা। কুলি-শ্রমিকদের আনাগোনা আর শোরগোলে ব্যস্ত থাকতো সবাই ।  আধুনিকতার ছোঁয়ায় সড়ক পথের প্রভুত উন্নয়নের পাশাপাশি সারা বছর নদীতে জল না থাকায় নৌপথের জৌলুস নেই । সখের নৌকাগুলোও সংস্কারের অভাবে আর কেউ চালায় না...প্রয়োজন ফুরিয়েছে ...। দিনের শেষ আলোটুকু নিভে যাবে এখনই.. জ্যোতি হাঁটতে থাকে ছোটবেলার পরিচিত নদী ধারের সংকীর্ণ পথ ধরে। অব্যবহারের ফলে পুরু ঘাসে ঢেকে যাওয়া রাস্তায় লোকজন খুব একটা আসেনা । বাড়িগুলো সদর পাল্টেছে । একটা সময় ছিলো নদীর দিকেই সদর ছিল সকল বাড়ির । ঘাটে নৌকা বাঁধা ।পরিস্কার ঝকঝকে তকতকে ।আজ সব আবর্জনার স্তুপ। সারি সারি বাড়িগুলো কেমন নি:সঙ্গ আর অচেনা মনে হয়, দু'একটা করে শাঁখ বাজতে থাকে ক্ষীণ স্বরে ।জ্যোতি ভাবে ফাঁকা ঘরগুলো হয়তো কয়েকদিনের জন্য পূর্ণ হবে সামনের এই পুজোয় ।তারপর আবার পড়ে থাকবে আগামী বছর অবধি। প্রধান কর্তা ব্যাক্তি আর গৃহিনী সংসার আগলে পড়ে থাকবে চোদ্দোপুরুষের ভিটেয় বাতি দিতে । জ্যোতি ফিরে যায় ৩৫ বছর আগের ছেলে বেলায় ।তখন প্রতিটি বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় থাকতো শিশুদের কোলাহল ।উচ্চরবে স্কুলের পাঠ মুখস্ত করত সবাই ।পড়াশুনা শেষ হয়েছে ,নতুন কর্মের সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহুরে হয়েছে ,কিন্তু গ্রাম হারিয়েছে তাদের ছেলেদের । জ্যোতির বুক থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসে তখন একটি প্রশ্ন, '' সময় ও জীবন কেন এমন হয় ?'' শ্যওলা পড়া ইট খসে খসে পড়ছে এমন একটি ছাদওয়ালা বাড়ির পাশে এসে দাঁড়ায় জ্যোতি ।কিছু সময় ইতঃস্তত করে পা বাড়ায় ভেতরে ।ভেতরে গিয়েই শুনতে পায় কাশির দমকে দমকে কাঁপছে নিতাই দাদু, পাশেই তার নি:সন্তান স্ত্রী , কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় সে । সিঁড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়ায় জ্যোতি । অনেককাল কেউ এটি ব্যবহার করে বলে মনে হয় না, স্তূপীকৃত অকেজো বিভিন্ন আসবাবে পরিপূর্ণ হয়ে আছে । তবে একটু খেয়াল করলে সে দেখতে পেত কেউ একজন যত্ন করে পা ফেলার স্থান টুকু রেখেছে যাতে কোন রকমে ছাদে ওঠা যায় । সে পথ দিয়েই অপেক্ষাকৃত খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে ছাদের যে স্থানে শিউলি ফুলের গাছটির ক'টি ডাল নুয়ে রয়েছে সেখানে এসে দাঁড়ায় । অনেক পরিচিত স্থানে বসবার মতো মনের খেয়ালে বসে পড়ে জ্যোতি, তাকিয়ে থাকে নদীর চলমান জল রাশির দিকে। দমকা হাওয়ায় মাঝে মাঝে শিউলি ফুলের গন্ধ পায় সে, ব্যাঙ আর ঝিঁঝিপোকার ডাক ছাড়া চারিদিকে নিস্তব্ধ ।শুনশান নীরবতা ।মাঝে মাঝে গাছের পাতা চুঁইয়ে জলের ফোটা পড়ার শব্দটিও স্পষ্ট শোনা যায় । কতক্ষণ এভাবে বসে আছে সে বলতে পারবে না । ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিগুলি কোন গল্পের মতো তাঁর সামনে দিয়ে কেউ যেন বলে যাচ্ছে আর তন্ময় হয়ে শুনছে যেন জ্যোতি। তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে, বিরাম নেই পড়াশুনার ।এমন একটি দিনের পড়ন্ত বিকেলে হোষ্টেলের দরজায় কড়া ঝাঁকুনির শব্দ ।ক্ষণকাল পরে নোট নিতে আসা বান্ধবীর মুখের স্ফীত হাসি । বিরক্তিবোধ লুকিয়ে জ্যোতির স্বহাস্য সম্ভাষণ ।কিন্তু চোখ আটকে যায় বান্ধবীর সাথে আসা এইচ এস সি পরীক্ষার্থী অপেক্ষাকৃত বেঁটে কিন্তু সেই মুহূর্তের পৃথিবীর শ্রেষ্ট সুন্দরী রমণীর দিকে তাকিয়ে । চোখ ফেরাতে পারেনা সে ।একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে । হুশ ফিরে আসে মেয়েটির কথায়,''আমাকে চিনতে পারোনি জ্যোতিদা ?''লজ্জ্বা পেয়ে স্মৃতি হাতরে খুঁজতে থাকে মেয়েটির অবয়ব । কিন্তু কই হৃদয়ের কোথাও তো কারো কথা মনে পড়ে না । গভীর ভাবে তাকায় সে মেয়েটির চোখে । না ।সেখানে  নিরবচ্ছিন্ন চঞ্চলতা ছাড়া আর কিছু ধরা পড়েনা জ্যোতির চোখে । ওঁর অচেনা চাহুনি দেখে মেয়েটি বলে ওঠে," জ্যোতিদা আমি শিপ্রা !" বসন্তের পড়ন্ত বিকেলে জানালা দিয়ে একফালি সূর্যের আলো এসে পড়েছে ঘরটাতে । সেই আলোর উজ্জ্বল আলোর আভায় শিপ্রাকে আরো চকচকে দেখায়, অপরদিকে নামটি শোনার পরে জ্যোতি হারিয়ে যায় ছোটবেলায় মামা বাড়ির খেলার সাথীর কথায়। বয়সে কয়েক বছরের ছোট ।নাক দিয়ে সব সময় সর্দি ঝাড়া সেই মেয়েটি আজ.........!! ঈশ্বর তার সমস্ত সৌন্দর্য উপকরণ দিয়ে সাজিয়েছে যেন ওকে । এরপর ওঁরা ফিরে তাকায়নি কখনো জীবনের সামনে অথবা পিছনে । ভালোবাসার এক অনাবিল সমুদ্রে ভেসে ভেসে ওঁরা চলেছে অনেকটা পথ। তখন মাস্টার্সের শেষ পর্বের পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে ।এমনই এক সকালে হঠাৎ শিপ্রার হন্তদন্ত আগমন । মুখটা ফ্যাকাশে । রক্ত শূন্য ।খুব অসহায় লাগছে ওকে। কী হয়েছে শিপ্রা ? প্রশ্নটা করে বটে ,উত্তর পায়না। অনেকক্ষণ পর ভাঙা গলায় শিপ্রা বলে, "বাবার চাকরিটা নেই।" অসুস্থ মা..দুই বোন আর দুই ভাইয়ের পড়াশুনা ।বড় বোনটির সদ্য বিয়ে ঠিক হয়েছে ।এমন অবস্থায় ওদের সংসারে নেমে আসে অমোঘ বিপর্যয় । পাগলের মতো হয়ে যায় শিপ্রা ।স্বাভাবিক সদা হাস্যজ্জ্বল বিশ্ববিদ্যালয়ের আমুদে ছাত্রী যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। খবরের কাগজ খুঁটে খুঁটে বিজ্ঞাপন দেখে দেখে চাকুরীর আবেদন করতে থাকে শিপ্রা ।বেমালুম ভুলে যায় জ্যোতির স্বপ্নময় ভালোবাসা কিংবা বাস্তবতার কড়া আঘাতে হৃদায়াবেগের দরজায় মস্ত একটি তালা ঝুলিয়ে দেয় শিপ্রা । দেখা করতে গিয়ে বার বার ফিরে আসেতে হয় জ্যোতিকে ।বন্ধুর এমন দুর্দিনে পাশে না থাকতে পারার যন্ত্রণা কুরে কুরে দগ্ধ করে তাকে ।অপরদিকে পুঞ্জিভূত অভিমান কখন যে রাগে পরিণত হয়েছে তা বুঝতেই পারে না জ্যোতি । চেষ্টা করে ওকে ভুলে থাকতে । ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে জ্যোতির মাস্টার্স পরীক্ষা ।শিপ্রার সাথে শেষ বারের মতো বোঝাপড়া করার ইচ্ছা নিয়ে মহিলা হোস্টেলের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় । খবর পাঠিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ।চলে আসতে যাবে ,এমন সময় শিপ্রার রুমমেট এসে খবর দেয়-ওরতো চাকুরী হয়েছে সরকারি প্রাইমারি ইস্কুলে, লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে হোস্টেল ছেড়ে পাকাপোক্ত ভাবে বাড়ি চলে গেছে শিপ্রা । রাগে দুঃখে অভিমানে আর একটি বারের জন্যও খোঁজ নেয়নি শিপ্রার । কতগুলো বছর কেটে গেছে জীবনের ।একটি কলেজে চাকরী নিয়েছে সে।বছর সাতেক হল বিয়েও করেছে দেখে শুনে ।বিয়ের দুই বছরের মাথায় ঘর আলো করে এসেছে এক ছেলে সন্তান । হঠাৎ ক'দিনের ছুটি পড়ায় স্বস্ত্রীক মামা বাড়িতে বেড়াতে এসেছে জ্যোতি । বিকেলে সময় পেয়ে একাকী বেড়িয়েছিলো নদীর ঘাটের পাড়ে বেড়াবার জন্য। কেমন এক পরিচিত পরিচিত গন্ধ পেয়ে স্মৃতির রাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে আসে জ্যাতি । সিগারেটের আগুনটা কখন নিভে গেছে বুঝতে পারেনি, দেশলাই জ্বালিয়ে আগুন ধরাতেই একটি অবয়ব ধরা পড়ে ওর চোখে, সেই পরিচিত ভঙ্গি..একই রকম মুগ্ধ দৃষ্টি তার, মনের ভেতর প্রচন্ড অবিশ্বাস নিয়ে চমকে উঠে জ্যোতি ...দাঁড়িয়ে যায় মনের অজান্তেই....ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সিঁদুর।হীলাই সিঁথির শিপ্রার দিকে। মুখ ফুঠে বেড়িয়ে আসে একটি প্রশ্ন- "কেমন আছো ?" নিজের কাছেই অচেনা মনে হয় কন্ঠটি..(দীর্ঘশ্বাস আর অপরাধবোধ লুকানোর প্রাণান্ত প্রয়াস) আলো      আঁধারিতে    শিপ্রার স্নিগ্ধ শান্ত অবয়বে অপলক দৃষ্টিতে তখন একটি প্রশ্ন... "কেমন আছো জ্যোতিদা ?'
.............................................................................

ছোটগল্প
                                          রবীন্দ্রনাথ
                           অমিত কুমার বিশ্বাস

                                                এক
                তিনটি রাস্তা তিনদিকে ছুটে চলেছে । ত্রিমাথায় দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ।শুভ্র মর্মর মূর্তি ।সেই সাত দশক ধরে দন্ডায়মান এক বৃদ্ধ ।চতুর্দিকে কত পরিবর্তন ।বৃদ্ধেরও হয়েছে ।তবে যা হয়েছে তা সবই নেতিবাচক ।সাদাচুল,সাদাদাড়ি -এখন সবই হলদেটে ।অনেক কিছুই সয়েছে মূর্তিটি ।প্রবল বন্যা,আয়লা ইত্যাদি ।সেদিনের ঝড়ে মূর্তিটি প্রায় ভেঙেই যাচ্ছিল ।প্রকান্ড ডালটা সামনেই পড়ল ।বৃদ্ধ তবু নির্বিকার ।তাকে যে দাঁড়াতেই হবে মেরুদন্ডী হয়ে।
                     আগামীকাল মূর্তিটি ভাঙা হবে । প্রকান্ড হাতুড়ির আঘাতে টুকরো টুকরো হবে রবীন্দ্রনাথের হৃদয় ।তারপর লাশটাকে রিক্সাভ্যানে তুলে টানতে টানতে নিয়ে যাবে নর্দমার ওপাশে,যেখানে সে বোবাকালা  হয়ে শুয়ে থাকবে সিধুপাগলের পাশে ।
                  সকালেই বড়োবাবু মত দিলেন,"সভ্যতা এগোচ্ছে । রাস্তার মোড়ে এভাবে রবীন্দ্রনাথের ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে আছে ?যতসব নন-ইনটেলেকচুয়াল আউটডেটেড  কনসেপ্ট ।"এদিকে ছোটবাবু বললেন,"বুড়ো হয়েছে,বৃদ্ধাবাসে থাক । তার বদলে ওখানে কচিকাঁচারা খেলাধুলা করুক।" রবীন্দ্রনগরে গত কয়েকদিন ধরে এইসব সাধুবচন হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছিল ।এর মধ্যে কিছু পাগল কবিভক্ত কাঁদল ।রাস্তায় শুয়ে থাকল ।পুলিশ এল ।নিয়ে গেল ।তারপর সেকি প্যাদানী!বাবাগো মাগো চিৎকার ।অতঃপর সব চুপ ।
                সামনেই পরেশের চায়ের  দোকান ।কথায় কথায় সে বলে উঠল,"ইদানিং তো হোর্ডিং এর দৌলতে বুড়োদাদুর মুখই দেখা যায়না ।তার চেয়ে বরং ভেঙে ফেলাই ভালো । ওখানে আরো বড়ো একটা হোর্ডিং লাগান যাবে ।সেই পয়সায় পার্ক হবে ।ইয়াং ছেলেপুলে কাজ পাবে ।হেঃ হেঃ ।এযুগে রবীন্দ্রনাথ সিকির মতোই অচল ।আজকাল ভিখারিকে দিলেও ভিখারি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে ,'বাবু আপনে রাহেন,বিপদি -আপদি কামে আসবে !' বোঝো ঠ্যালা !!"

  "ঠিক বোলিচ পোরে ।"হলুদ হয়ে আসা অবশিষ্ট দন্তগুলি বিকশিত করে চায়ের কাপটা  কাঠের বেঞ্চে বার দুই টোকা মেরে সজোরে বলে উঠল নেপাল খুড়ো,"কি ছিল ওর?ছিলতো এট্টা নোবিল,তাও সেইডারে কিরা গ্যাঁড়া দিছে ।হেঃ হেঃ ।ওর চেয়ে আমাগো মদনা ছেলিটা কী সুন্দর কবিতা নেকে বলোদিন !শোন--
                                    টিপকল
                            চরণ তোমার তলে
                            হাত দু'খানি কলে
                             চাপ দাও হাতলে
                           চরণ ভিজে গেল জলে ।"
বাঃ বাঃ অসাধারণ!" পরেশ চা ছাঁকতে ছাঁকতে বলে ঊঠল,"খুড়ো ,মদনার আর একখানা শোনো-
                                       খেলা

                   হারমোনিয়াম সারারাত ডেকেছে নাক,
                   রামের বোতলে মহাভারত আর একতা কাপুর
                   খেলছে হা-ডু-ডু।
                   এদিকে চুরি গেছে সানি লিওনের অন্তর্বাস
                   যমুনা তীরে কাঁদছে সে হাপুস নয়নে ।
                  এদিকে বড়োবাবুর কপালে ভাজ,
                   হারমোনিয়াম সারারাত ডেকেছে নাক ।

                   অক্টোপাস আসপ্রিয়াও পর্নোগ্রাফিতে নামার আগে
                  সেরে নিম গঙ্গাস্নান ওপাড়ার রুমকী বৌদির সঙ্গে ।
                  মেয়েকে বেঁচে আইফোনের নীল ছবিতে রেখেছে চোখ
                  এক সুখি দম্পতি। ভগবানের পিছনে বাঁশ
                  দিয়ে পুজোর ক'দিন কেলাচ্ছে দাত কুমোরটুলির
                  দুই কারিগড় ।এর মধ্যে ফেসবুকের দেওয়ালে
                  হিসি করে দিয়ে গেল্ বেপাড়ার ছেলেগুলো !
                  এ দেখে বড়োবাবুর কপালে ভাজ
                 হারমোনিয়াম সারারাত ডেকেছে নাক ।

সাব্বাস!! এইডা হইলো গিয়া কবিতা ।আর ওই রবি যে কীসব বস্তাপচা নিকে সাহেবগো কাছ থিকা নোবিলডা গ্যাঁড়াইয়া নিল,সেইডারে ঠাহোর কোরতি পারিনে বাপু । বাপের জোমিদারি থাকলি ওরম নিকা যায় ।বোজ্জো! আর মোনি রাখবা, গ্যাঁড়ার মাল গ্যাঁড়ায়-ই যায়।"
                                           দুই

                  মধ্যরাত । ল্যম্পপোস্টের ছানিপড়া আলোর কুয়াশা  ভেদ করে কারা ছুটে আসছে এদিকেই ?একটা শিশু ।মুখে আর্তনাদ ।বাঁচাও।বাঁচাও।পিছনে খানবিশেক লিকলিকে নেড়ি কুকুর ।ক্ষুধায় উন্মাদ । শিশুটির এক হাতে খাবার জাতীয় কিছু ।অন্যহাতে রক্তের প্রলেপ ।নরখাদকগুলোর আক্রমণে ।ছুটতে ছুটতে শিশুটি রবীন্দ্রনাথের কাছে এল ।পিশাচগুলোও।সেগুলো ছোবল মারতে না মারতেই শিশুটি মূর্তিটির ওপর চেপে বসল ।একেবারে কাঁধে । চড়েই জাপ্টে ধরল রবীন্দ্রনাথকে ।জংলী শ্বাপদ্গুলো নীচে ঘোরাফেরা করছিল,আর মাঝে মধ্যে স্থির হয়ে তাকাচ্ছিল কিছুক্ষণ ,ঠিক যেভাবে  ধর্ষকামী নেশাখোরেরা ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্বমুহূর্তে অদ্ভুত এক পৈশাচিক ভঙ্গিমায় মৌন হয়ে যায় আর তাদের চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসে  আগুনের হলকা,জিভ্ দিয়ে লালাঝরে অবিরত ।হঠাৎ রাক্ষসগুলো সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে,আর সেই বিকট শব্দে যেন চৌচির হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের হৃদয় ।কালো হাতের দেশ থেকে অপদেবতারা এসেছে ছোট্ট রাজপুত্রকে লুঠ করতে ।রবীন্দ্রনাথ কি পারবেনা রক্ষা করতে  তাঁর কোমল হাত দুটিকে?পারবেনা এভাবেই তাকে কাঁধে ধরে রাখতে?
                 পরনে একটা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট ।ছেঁড়াই ছিল । পিশাচগুলো আরো ছিঁড়ে দিয়েছে ।পা থেকে খুবলে নিয়েছে মাংস ।হাত থেকেও ।খালি গা ।সেখানেও কামড়ের দাগ স্পষ্ট ।টপ্ টপ্ করে রক্ত পড়ছে ।ভয়ে মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছেনা।দেহ কালিমালিপ্ত।অস্তিচর্মসার ।চুল উষ্কখুষ্ক ।মুখটা শুকিয়ে একসা । চোখদুটো নীল।কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ।ঠক্ ঠক্  করে কাঁপছে  সমস্ত শরীর ।কয়েক মুহূর্তে মূর্তিটি লাল ! রক্ত গড়িয়ে নীচে পড়ছে,আর পিশাচগুলি চটপট চেটেপুটে খাচ্ছে ।সে কী ভয়ঙ্কর আহারযুদ্ধ !শিশুটি আরোও  ভয় পায় ।কাঁপে ।শীতের থেকেও বেশি ।মৃত্যুকে মুখোমুখি দেখতে পেয়ে গলা শুকিয়ে যায় ।মূর্তিটিকে  বড় বেশি আপন মনে করে আরোও জড়িয়ে ধরে,সন্তান যেভাবে ধরে তাঁর মমতাময়ী  মাকে।
                   না ,তাঁর মা নেই ।বাবাও।পথেই জন্মেছিল একদিন । হয়তো পথেই হারিয়েযাবে একদিন ।একদিন জ্ঞান হবার পর নিজেকে আবিস্কার করল হরিপদ-র চায়ের দোকানে ।একদিন হাত থেকে গ্লাস পড়ে যায় ।মুহূর্তেই চৌচির ।তৎক্ষণাৎ হরিপদ হাতের গরম চা ছুঁড়ে মারে মুখে ।
              সবেমাত্র চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল ।ভাবতেই চোখ খুলে যায় ,দেখে,সেখানেই আছে ।নীচে পিশাচগুলি শুয়ে ।একটা টুক করে একচোখ খুলে দেখে নেয় হাল-হকিকৎ ।তারপর বন্ধ ।পাকা অভিনেতা ।খেলা জমে ওঠে ।শিশুটিরও চোখ বন্ধ হয়ে আসে পুনরায় ।আর সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে ওঠে হরিপদ-র চায়ের দোকান থেকে পালানোর দৃশ্য । পালাতে পালাতে একদিন কাগজ-কুড়ানিদের দলে ।তারপর ভাড়াটে ভিখারির ছদ্মবেশ ।তারপর ইটভাঁটায় । বিহারিলালের ধাবায় ।ট্রেনে ট্রেনে জুতোপালিশ,টয়লেট সাফ করা ।তারপর ?তারপর?তারপর?কাজ আসে কাজ যায়।সে নিজেই ভুলে যায় নিজের নাম । ঠিকানা।পরিচয় ।এক কক্ষচ্যূত গ্রহাণুপুঞ্জের মতো মহাশূন্যে ভেসে বেড়ায় অবিরত ।সুখ নাই ।সুখ নাই ।সুখ নাই কোথাও।
                                                    তিন
               ভোর হল ।রবির রক্তিম আলোয় ভরে উঠল এ ক্রন্দসী ।ভরে উঠল কূজনে ।একদল ভীষণ কালোমাখা লোক সহসা ঘিরে ধরল রবীন্দ্রনাথকে,যেভাবে সুপারী কিলারেরা ঘিরে ধরে তাদের  নিরীহ শিকারকে ।একে একে সকলে অস্ত্র তুলে ধরে ।এইবার.. এইবার...এইবার শেষ.... একেবারে.....
এমন সময়  একজন কালোমাখা লোক বলে উঠল,"এত রক্ত কেন?"

..........................................................................
'অচেনা যাত্রী-৪' এখানেই সমাপ্ত।পুরোনো সংখ্যাগুলো পেতে ডানদিকের নীচের লিঙ্কে ক্লীক করুন ।ধন্যবাদ ।

মন্তব্যসমূহ